নয়
ক্লাবঘরের গেটের বাইরে একটা বক্স অফিসের মতো ঘর। ওরা ঢোকার জন্য তৈরি হয়ে সেখানে দাঁড়াতেই একটা উর্দিপরা লোক জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনারা আমাদের মেম্বার? কার্ড এনেছেন?’
‘না, আমরা মেম্বার না। বিদেশ থেকে এসেছি।’
‘সরি, আমাদের অনুষ্ঠান শুধু মেম্বারদের জন্য।’
ওরা পাশে সরে দাঁড়ালো। আরো কয়েকজন ওদের পেছনে লাইন করে দাঁড়িয়ে গেছে।
একজন টাক মাথাওয়ালা বয়স্ক লোক সুফীর কাঁধে টোকা দিয়ে বললো, ‘এক্সকিউজ মি, আপনারা বিদেশ থেকে এসেছেন বললেন। আর আমাদের ক্লাবের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চান? কোত্থেকে এসেছেন আপনারা?’
টাকওয়ালা ভদ্রলোকের বয়স ভালোই হয়েছে মনে হলো, প্রায় সত্তরের মতো। কিন্তু বেশ ঋজু কাঠামো শরীরের। মুখে আভিজাত্যের ছাপ। হাতে একটা ছোট ছড়ি। তাঁর সঙ্গে ভদ্রমহিলাও বেশ বয়স্ক। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, স্লিম চেহারা। লাল শাড়ি পরা ভদ্রমহিলার হাবভাবে একটা নানি-দাদির ছাপ স্পষ্ট।
সুফী বললো, ‘আমি এসেছি ঢাকা থেকে। আর আমার বন্ধু নেপালের। আমরা বোম্বেতে এসেছি সায়েন্স কংগ্রেসে যোগ দিতে। আজকেই আমাদের প্রথম দিন এ-শহরে।’
‘বেশ ভালোই হলো তাহলে। আপনারা দুজনেই বিদেশি। আপনারা যদি চান আপনাদের আমি এই ক্লাবের গেস্ট হিসেবে নিতে পারবো। শুনলেনই তো এ-ক্লাবের অনুষ্ঠানে অ-সভ্যরা ঢুকতে পারবেন না। আপনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন সায়েন্স কংগ্রেসে যোগ দিতে। অতএব আপনাদের নিমন্ত্রণ জানানো আমার কর্তব্য।’ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন তিনি।
ভদ্রলোকের এতো আন্তরিক ব্যবহার দেখে ওরা দুজন বেশ খুশি হলো। আর একটু সংকোচও লাগলো ওদের মনে। ওদের দুজনকে তিনি নিয়ে এলেন সেই অফিসের সামনে। বললেন, ‘মেহতা, আমি দুজন বিদেশি গেস্ট নিয়ে এসেছি। একজন ঢাকা থেকে আরেকজন কাঠমান্ডু থেকে। এঁদের কি গেস্ট বইতে সই করতে হবে?’
‘ওয়েলকাম ব্রিগেডিয়ার সাহেব। গুড ইভনিং। ওনারা যখন আপনার গেস্ট আর আজকের অনুষ্ঠানও যেহেতু আপনাদের তাই ওঁদের আর সই করতে হবে না। আপনাদের জন্য আমি হাই টেবিলে জায়গা করে দিচ্ছি।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘চলুন আমার সঙ্গে। আমরা আরাম করে বসি। তারপর আলাপ হবে।’
একটা আলাদা বড় টেবিলে তাঁরা বসলেন। সংঘমিত্রা ভদ্রমহিলার পাশে আর সুফী ব্রিগেডিয়ারের পাশে।
‘আমার নাম রমেশ মেহতা আর আমার স্ত্রী অরুণা। আমরা দুজনেই গুজরাটের মানুষ। আমি আর্মি থেকে কয়েক বছর আগে রিটায়ার করেছি। এখন আমি জেন্টলম্যান অ্যাট লেজার।’
অরুণা বললেন, ‘আমি হাউসওয়াইফ। তাই কোনোদিন রিটায়ার করবো না।’
ওরা দুজনে নিজেদের নাম আর কী তাদের কাজ তাও বললো Ñ ‘কলকাতা থেকে আমরা ট্রেনে রওনা দিয়েছি। আর ট্রেনেই আমাদের দেখা। মাত্র চারদিন আগেও আমাদের অস্তিত্ব দুজনের কাছে একেবারেই অজানা ছিলো।’
ব্রিগেডিয়ার সাহেব আর অরুণা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। ব্রিগেডিয়ার বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার তো! জানো, আজ আমাদের পঁয়ত্রিশতম ম্যারেজ অ্যানিভারসারি। আমার সঙ্গে অরুণার দেখা হয়েছিলো পঁয়ত্রিশ বছর আগে ট্রেনে। আমি যাচ্ছিলাম ঢাকা থেকে শিলং। সিলেট পর্যন্ত ট্রেনে। তারপর গাড়িতে যেতে হবে ডাউকি হয়ে। আর অরুণা যাচ্ছিল কলকাতা থেকে শিলং ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে। এই ঢাকাতেই ট্রেনে ওকে প্রথম দেখলাম। ওর বাবা-মায়ের সঙ্গেও আলাপ হলো।’
সুফী বললো, ‘আপনি চারদিনের বিবরণ প্রায় চারটি বাক্যেই শেষ করলেন। বুঝতেই পারছি এগুলো আপনার নিজস্ব ব্যাপার। তবে আপনাকে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতে পারি আপনি ঢাকায় কী করে গেলেন। কী সূত্রে, অতো বছর আগে?’
‘আমি স্যান্ডহার্স্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন পেলাম ১৯২৬ সালে। তারপর ১৯২৭ সালে আমার পোস্টিং হলো ঢাকায় লেফটেন্যান্ট হিসেবে। আমি তখন তরুণ আর্মি অফিসার। বিয়ে করিনি। আমাকে থাকতে দেওয়া হলো ঢাকা ক্লাবে। তখন সেখানকার মেম্বার সবাই ব্রিটিশ বা অন্য ইউরোপিয়ান। আমার মতো কালো কেউ ছিলো না। একটা গুর্খা রেজিমেন্টের সঙ্গে আমি যুক্ত। আর একজন মেজর, ব্রিটিশ অবশ্যই। আমরা দুজন অফিসার।’
‘এতো বছর আগে ঢাকা কেমন ছিলো আমার ধারণাতেই নেই। শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।’
‘হ্যাঁ, ধীরে-সুস্থে বলছি। তার আগে বলো তোমরা কী পানীয় খাবে?’
অরুণা বললেন, ‘আমি নিজে এখানকার লিম্বু পানি সবসময় শখ করে খাই। জলজিরা দিয়ে লিম্বু পানিটা খুব ভালো বানায় এখানে। যদিও এটা গরমের পানীয়, তবু আমি সারাবছর ধরেই খাই।’
মিত্রা বললো, ‘আমিও তাই খাবো। যদিও আমরা একটু আগেই চা খেয়ে এসেছি। আর সুফীকে কোনো চয়েস দেব না। ওকেও লিম্বু পানি খেতে হবে।’
সুফী হাসলো শুধু। বললো, ‘তাই সই।’
অরুণা আবার বললেন, ‘অবশ্য রমেশ ওর বাঁধা ড্রিংক এখন খাবেন Ñ বরফ দিয়ে হুইস্কি। তাই না?’
রমেশ বললেন, ‘যাক, পানীয়র ব্যাপার তো ঠিক হলো। একটু পরে যখন খিদেটা পাবে তখন আমাদের আরেকটা ডিসিশন নিতে হবে Ñ ডিনারে কী খাবে? সে পরের কথা দেখা যাবে পরে।’
সুফীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি জিজ্ঞেস করছিলে তখনকার ঢাকা কেমন ছিলো? আমি ছিলাম ঢাকা ক্লাবে। একাই তো ছিলাম, ভালোই লাগতো। আমি তখন স্যান্ডহার্স্ট থেকে পাশ করা নতুন কমিশন নিয়ে এসেছি। নিজেকে একটা কেউকেটা বলেই মনে হতো। মনে করো স্যান্ডহার্স্টে থাকার সময় আমার বয়স তখন কুড়ি বাইশের মতো। আমাদের মাথায় সে-সময় ঢুকিয়ে দেওয়া হতো যে, আমরা শুধু ভারতের নয়, গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন সেরা মানুষ। আমাদের দায়িত্ব অনেক। সারাজীবন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে অনেক দায় আমাদের কাঁধে নিয়ে বেড়াতে হবে। আমাদের নিচে যারা আছে তারা অনেক আশা নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের নিরাশ করলে চলবে না। এসব বড়-বড় কথা বারবার এমনভাবে বলা হতো যে, এগুলো আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে যেতো। এসব বিশ্বাস না করে উপায় ছিলো না। আমাদের চলাফেরায়, কথাবার্তায় আর খাকি উর্দিপরা চেহারায় এই এলিটিস্ট ভাবটা আপনাতেই ফুটে ্উঠতো। আগেই বলেছি, আমার প্রথম পোস্টিং হলো ঢাকায়। গুর্খা রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে। বেশ আরামেই দিন কাটছিলো। তখন ঢাকা ক্লাবে একটা সুইমিংপুল ছিলো। যখন ব্যস্ততা কমে আসতো গরমের দিনে অনেকটা সময় তখন সুইমিংপুলের ধারেই কাটতো। ক্লাব আর রেজিমেন্টের বাইরে বিশেষ কাউকে চিনতাম না। দু-একজন সাদা চামড়ার লোক মাঝে মাঝে পুলে আসতো। কিন্তু বেশি আসতো ওদের ফ্যামিলির মেয়েরা Ñ নানান বয়সের। ওদের মধ্যে একজন সাদা চামড়ার মেয়ে, কুড়ি বাইশ বছর হবে। তার সঙ্গে আমার ভালোই ভাব হয়ে গেল। এটা ওদের দৃষ্টি এড়ালো না। কানাঘুষা চলছিলো। তখন ক্লাব কর্তৃপক্ষ একটা নোটিশ টাঙালেন। কালো চামড়ার লোকেরা, সে যে-ই হোক না কেন, সুইমিংপুল ব্যবহার করতে পারবে না। আমি বুঝলাম ব্যাপারটা। কিন্তু আমি একেবারে আমল দিলাম না সেই নোটিশটার। আমি আগের মতোই সুইমিংপুলে যেতে থাকলাম। হাজার হোক আমি হিজ ম্যাজেস্টিজ আর্মির একজন অফিসার। কিন্তু সেই মেয়েটি আর এলো না সুইমিংপুলে। এটাই আমার ঢাকা ক্লাবে থাকার একটা দুঃখজনক ঘটনা কিন্তু একদিক থেকে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনাও বটে।’
লিম্বু পানি, হুইস্কি এলো। ওরা গ্লাস ঠোকাঠুকি করে হ্যাপি অ্যানিভারসারি বললো রমেশ আর অরুণাকে।
অরুণা বললেন, ‘তোমাদের আমি তুমি করে বলছি। কিছু মনে করো না। তোমাদের দুজনের বয়স যোগ করলে আমার বয়সের চাইতেও কম হবে নিশ্চয়ই।’
রমেশ বললেন, ‘আমি সেনাবাহিনী থেকে দুবছর আগে রিটায়ার করেছি। আর বোম্বেতেই থাকি এখন। আমরা নানা-নানি হয়েছি। আমার মেয়ে আর জামাই কয়েকদিনের জন্য পুনা গেছে। আমার জামাই ওখানকার ফিল্ম অ্যাকাডেমিতে কাজ করে। ওদের দশ বছরের মেয়েকে আমাদের কাছে রেখে গেছে। ওকে ঘুম পাড়িয়ে তবে আমরা অল্প সময়ের জন্য এখানে এসেছি। তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগলো। বাইরে যখন তোমরা বললে ঢাকা আর নেপালের কথা, তখনই আমার কেমন জানি মনে হলো আমার প্রথম পোস্টিংয়ের কথা ঢাকাতে। আর নেপালে আমি বহুবার গিয়েছি। প্রথমদিকে গুর্খা সৈন্যদের রিক্রুটিংয়ের কাজে এবং পরে আমাদের পুরনো রেজিমেন্টের সঙ্গে যারা কাজ করেছে তাদের গ্রামের স্কুল আর হাসপাতালের জন্য। আমরা টাকা-পয়সা আর সময় দিয়ে অনেক কাজ করে চলেছি এখনো।’
মিত্রা এতক্ষণ বেশি কথা বলেনি। চুপচাপ শুনেই যাচ্ছিল। এবার হঠাৎ সে বললো, ‘আচ্ছা। আপনারা বলছিলেন আপনাদের প্রথম দেখা ট্রেনে। ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছিলেন নাকি তখন। আপনাদের সেই প্রথম দেখার গল্প আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।’
সুফী মিত্রার দিকে তাকিয়ে একটু ধমকের সুরে বললো, ‘এই তুমি কী বলছো? ওঁদের সঙ্গে ঘণ্টাখানেকের কম দেখা আমাদের। এরই মধ্যে তুমি এসব প্রাইভেট কথা শুনতে চাইলে ওঁরা কী মনে করবেন?’
মিত্রা বললো, ‘হ্যাঁ, একঘণ্টার কমই বটে আমাদের দেখা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে আমার খুব আপন মনে হচ্ছে ওঁদের।’
অরুণা হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে। মিত্রাকে বকো না। ও ঠিকই বলেছে। তোমাদেরও আমার খুব আপন মনে হচ্ছে।... অবশ্য ভালো বলতে পারবে রমেশ। ও গল্প বলতে ওস্তাদ। এতো রং চড়িয়ে সব বলবে যে, আমিও অবাক হয়ে শুনি মাঝে মাঝে। আমার সম্বন্ধেই বলছে কিন্তু আমি নিজেই ভাবছি যেন আরেকজনের ব্যাপারে কথাটা শুনছি।’
এমন সময় একজন কর্তাগোছের ভদ্রলোক এসে রমেশকে বললেন, ‘আচ্ছা তোমরা এখানে বসে আছো দেখছি। আমরা তোমাদের হন্যে হয়ে খুঁজছি। আজকের প্রোগ্রামটা কেমন করে সাজাবো বুঝতে পারছি না। তোমাদের খুব দরকার। আসতে হবে আমাদের সঙ্গে।’
ব্রিগেডিয়ার সাহেব ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সরি, তোমাদের একটু একলা রেখে যেতে হচ্ছে। তবে এক্ষুনি ফিরে আসছি।’
দুজন একা বসে থাকলো। তারপর সুফী বললো, ‘আচ্ছা, কাল সকালের প্রোগ্রামটা কখন কী হবে আমাকে বুঝিয়ে বলো তো। আমার প্রেস ইনফরমেশন চিঠিতে অনেক কিছু লেখা আছে। তাতে কোনটা বেশি দরকারি আর কোনটা ফালতু তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।’
মিত্রা হেসে বললো, ‘তুমি কি সবগুলো সেশনে যেতে চাও? তোমার কাগজের জন্য কী কী দরকার তা আমি ঠিক বলতে পারবো না। তবে আমি যে যে জায়গায় যেতে চাই তা তোমাকে বলতে পারি। উদ্বোধন হবে সকাল ৯টায়। এটা আমার জন্য এমন কিছু ইন্টারেস্টিং নয়। কিন্তু তবু মিস করতে পারবো না।’
‘আমাকে তো যেতেই হবে। খবরের কাগজের জন্য খুবই দরকার।’
‘কালকের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন হোমিভাভা।’
‘তিনি আবার কে?’
‘আরে তিনিই তো এই টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল স্টাডিজের ডিরেক্টর। ভদ্রলোক ইন্ডিয়ার এক নম্বর ফিজিসিস্ট। এই কংগ্রেসের বড় উদ্যোক্তা। আর চিফ গেস্ট হবেন পল ডিরাক।’
‘তাঁর কোনো বিশেষ পরিচয় আছে? আমাকে বলো না?’
‘তুমি কী রকম জার্নালিস্ট? পল ডিরাকের নাম শোনোনি? তোমাকে এখানে পাঠালো কেন তোমার খবরের কাগজ?’
সুফী একটু অসহায়ের মতো তাকালো মিত্রার দিকে। বললো, ‘এই প্রোগ্রামটার আমন্ত্রণপত্র এতো দেরি করে ঢাকায় পাঠালো যে কোনো খোঁজখবর নেওয়ার সময় পাইনি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। কাল সকালে উদ্বোধনীতে আমার পাশে বসো। তখন আমি তোমাকে কিছু কিছু বলতে পারবো।’
‘আমি তোমার সঙ্গে বসতে পারবো কিনা জানি না। আমার প্রেস কার্ড আছে। আমাদের জন্য আলাদা বসার জায়গা থাকবে বোধহয়।’
‘ও তুমি বিশেষ জায়গায় বসতে চাও! আমার সঙ্গে বসলে তোমার মানহানি হবে। বেশ তুমি তাহলে নিজেই সব খবর জোগাড় করো। পল ডিরাককেও জিজ্ঞেস করতে পারো। বলবে, আপনার নাম আমি আমাদের খবরের কাগজে ছাপাবো। তখন আপনার নাম সবাই জেনে যাবে। আমি আপনাকে প্রসিদ্ধ করে দেবো।’ তারপর একটু থেমে বললো, ‘তিনি মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন ফিজিক্সে। তাঁর আগে এতো অল্প বয়সে কেউ নোবেল প্রাইজ পাননি। এটুকুই এখন তোমাকে বললাম। উদ্বোধন হবে ৯টায়। অনেক বক্তৃতা হবে। একেবারে বোরিং। চলবে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। তারপর কফি ব্রেক। ১১টা থেকে প্রথম সায়েন্টিফিক সেশন শুরু হবে। পল ডিরাক প্রিজাইড করবেন। প্রথম পেপারটাই আমাদের। ড. গুপ্ত পড়বেন। আমি কো-অথর। যদিও যে-কাজটা নিয়ে পেপার তার বেশির ভাগ আমিই করেছি।’
‘সেটা তো বেশ সম্মানের ব্যাপার। তোমাদের পেপারের একটা কপি আমাকে দেবে তো? যদিও কতোটা বুঝবো জানি না।’
‘দুপুর ১টায় লাঞ্চ। বেলা দুটো থেকে আবার আরেকটা সেশন। আমি ইন্টারেস্টেড না। আমি ফাঁকি দিতে চাই। কিন্তু পাঁচটা থেকে হবে গার্ডেন পার্টি। সেটা হবে বোম্বে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে। গার্ডেন পার্টিটা বাদ দিতে চাই না। তোমাকেও আসতে হবে। এখানে ক্যামেরা নিয়ে আসতে ভুলো না কিন্তু। অনেক ছবি তোলার চান্স পাবে। অনেক সুন্দরী মহিলাও থাকবে। তোমার কাগজও পছন্দ করবে ছবিগুলো।
‘পল ডিরাকও আসবেন নিশ্চয়ই।’
‘যদি আসেন তাহলে যে করেই হোক তাঁর সঙ্গে আমার একটা ছবি তুলে দিও। আমি কলকাতা ফিরে গিয়ে সবাইকে দেখাতে পারবো। তখন সবাই হিংসা করবে আমাকে।
‘আচ্ছা তিনি নোবেল প্রাইজটা পেলেন কী কাজের জন্য?’
‘উঁহু, বলবো না এখন। তোমাকে নিজেই সব কিছু খুঁজে বের করতে হবে। আমার সঙ্গে সকালে তুমি বসবে না বলছো। নিজের প্রেস এনক্লোজারে বসবে। ঠিক আছে। তবে আমার সঙ্গে বসলে বলতাম তখন।’
‘বারে! আমি কি ইচ্ছে করে বসতে চাইছি না। তুমি তো বসবে ড. গুপ্তের সঙ্গে, যারা পেপার পড়বে তাঁদের জায়গায়। আমাকে সেখানে যেতে দেবে কেন? যদি দেয় তাহলে নিশ্চয়ই মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার প্রেস কার্ডটা লুকিয়ে তোমার সঙ্গে বসতে রাজি আছি।’
এবার মিত্রা একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, দেখা যাবে তখন কী হয়।’
ব্রিগেডিয়ার মেহতারা ফিরে এলেন একটু পরে। আরাম করে চেয়ারে বসে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘যাক এখনকার মতো কাজ হলো। ভালোই হলো। নিশ্চিন্তে বলতে পারবো সব এখন তোমাদের।’
হুইস্কির গ্লাসে হাত বুলোতে বুলোতে ব্রিগেডিয়ার মেহতা বলতে লাগলেন, ‘আগস্ট মাসে ভীষণ গরম পড়লো ঢাকায়। আমি ভাবলাম, এখানে কাজ তো খুব বেশি নেই এখন। কিছুদিন একটু শিলং বেড়িয়ে আসলে কেমন হয়? ছুটির জন্য আমার রেজিমেন্টাল কমান্ডারের কাছে ধরনা দিলাম। প্ল্যান ছিলো ঢাকা থেকে ট্রেনে যাবো সিলেট, তারপর সেখান থেকে গাড়ি করে ডাউকি হয়ে শিলং। পূর্ববাংলা আর আসাম তখন একই আর্মি কমান্ডে। বলা হলো দুসপ্তাহের জন্য আমি রেজিমেন্টের কাজেই শিলং যেতে পারি। তার জন্যে সবই আমার রেজিমেন্ট ব্যবস্থা করবে।
ঢাকায় ট্রেনে উঠেছি। তখনই অরুণা আর তার বাবা-মা উঠলেন আমারই কামরায়। ওই একটা ফার্স্ট ক্লাস কামরা ছিলো ট্রেনে। ঢাকা থেকে ইবিআর ট্রেন। তারপর আখাউড়ায় বদল করে এবিআর যাবে সিলেট।
আলাপ হলো ট্রেনে। অরুণারা থাকতো কলকাতায়। অরুণার বাবা পাটের মিলের ম্যানেজার সেখানে। নারায়ণগঞ্জে আসতে হতো মাঝে মাঝে পাটের ব্যবসার কাজে। এবার মেয়ে আর তার মা সবাই কাজের শেষে, আমার মতো গরমের অত্যাচারে একবার শিলং বেড়াবার ইচ্ছে।’
ব্রিগেডিয়ার সাহেব এই পর্যন্ত বলে একবার হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিলেন। অরুণা মিটিমিটি হাসছেন।
ব্রিগেডিয়ার সাহেব আবার শুরু করলেন, ‘অরুণা যে তখন কী রকম সুন্দর ছিলো তা তোমরা ধারণা করতে পারবে না। আমি ভাবছি কী করে যে কথা বলি ওর সঙ্গে। কিন্তু আমি বসে আছি এ-পাশের বেঞ্চে। অরুণার বাবার সঙ্গে গল্প করছি। আর অরুণা উলটো দিকের বেঞ্চে বসেছে ওর মায়ের সঙ্গে। কলকাতায় ওরা থাকতেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে। আর অরুণার বাবার জুটমিল ছিলো হুগলী নদীর ওপারে হাওড়ার কাছে। নদী পার হতে হতো একটা পন্টুন ব্রিজের ওপর। সেটাও আবার খোলা হতো রোজ। নৌকারা যাতে নদীতে যাতায়াত করতে পারে। দু-এক ঘণ্টার জন্য মাত্র। তোমাদের এসব কথা বলছি কারণ এখন তো তোমরা বড় হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে চট করে নদী পেরিয়ে যাও। তখন ও-রকম ছিলো না। অরুণা পড়ে বেথুন কলেজে Ñ কলকাতায়। জুটমিলের ম্যানেজারের জন্য আলাদা বিলাসবহুল বাড়ি ছিলো। কিন্তু মেয়ের কলেজের জন্য তাঁদের কলকাতায় থাকতে হচ্ছে।’
আবার তিনি থামলেন। এক চুমুক দিলেন গ্লাসে। এমন সময় দুজন ভদ্রমহিলা এসে ওদের কংগ্র্যাচুলেশন জানালেন। দুজনই অরুণার বয়সী। বললেন, ‘ব্রিগেডিয়ার সাহেব, আমরা অরুণাকে কিছুক্ষণ ধার নিচ্ছি। ওকে খুব দরকার। দু-একটা গানের রিহার্সাল দিতে হবে। কিছু মনে করবেন না। একটু পরেই ফিরিয়ে দেবো ওকে।’
অরুণা চলে গেলেন ওদের সঙ্গে। যাওয়ার সময় আস্তে করে বললেন, ‘তোমার গল্পে কিন্তু বেশি বেশি রং চড়িও না। আমি ফিরে এসে ওদের জিজ্ঞেস করবো তুমি সব ঠিক-ঠিক বলেছো কিনা।’
ব্রিগেডিয়ার সাহেব আবার শুরু করলেন, ‘আঃ আসল সময়েই নিয়ে গেল ওরা অরুণাকে!... আজকে অরুণা আমাকে বলেছিলো, আমার ইউনিফর্মটা পরতে আবার। আসলে রিটায়ার করেছি তো। এখন আর ইউনিফর্ম পরা হয় না। স্পেশাল পারমিশন নিতে হয় পুরোনো ইউনিফর্ম পরার জন্য। অরুণা বলতো সেসব দিনে যখন আমি একজন তরুণ আর্মি অফিসার, তখন ইউনিফর্ম পরলে আমাকে কতো স্মার্ট লাগতো।’
সুফী বললো, ‘আপনাকে এখনো খুবই অ্যাট্রাকটিভ লাগে। ইউনিফর্ম না পরলেও এই স্যুটে আপনাকে বেশ মানিয়েছে।’
তিনি নিজের পেটে একটু হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘দেখ এখনো কোনো ভুঁড়ি হয়নি। রোজ ব্যায়াম করি তো। একেবারে ফ্ল্যাট টামি। আচ্ছা, যা বলছিলাম। ট্রেনে অনেক কথা হচ্ছিল। যখন দেখলাম আমরা সবাই গুজরাটি তখন আমরা ইংরেজি ছেড়ে একেবারে গুজরাটি ভাষায় কেম ছো, সারু ছাই, ভুখ লাগিস Ñ এসব বলতে লাগলাম।’
ক্ষিধের কথা উঠতেই অরুণার মা তাঁর টিফিন ক্যারিয়ারভর্তি রান্না করা খাবার বের করলেন। আমি ডাকলাম আমার ব্যাটম্যানকে পরের স্টেশনে। ওর কাছে আমার খাবার ছিলো। অরুণার মা ওকে প্রায় ধমক দিয়ে বিদায় করে দিলেন।
খাবার পর ওরা দুজন বেঞ্চে ঘুমিয়ে পড়লেন। শুধু অরুণা আর আমি এখন একটা ছোট কামরায়। কতোক্ষণ আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা যায়। আমি মাঝে মাঝে অরুণার দিকে তাকাই। ওর বাবা-মা ঘুমে অচেতন। দেখি অরুণাও আমার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু এরপরই সে আবার চোখ সরিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে মনে হলো ওর চোখে একটা দুষ্টু হাসি। কি মুশকিলে যে পড়লাম! ওই এক সেকেন্ডের চাউনির আঘাতেই আমি তখন ছটফট করছি। বুঝে দেখো আমি স্যান্ডহার্স্টের পাশ করা মিলিটারি অফিসার। শত্র“কে ঘায়েল করার জন্য কী-কী অস্ত্র কেমন করে ব্যবহার করতে হয় সে-বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা আমার রয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষা করার দায়িত্ব স্বয়ং সম্রাট পঞ্চম জর্জ আমার ঘাড়ে দিয়েছেন। তবু এই একটা অল্পবয়সী কলেজেপড়া মেয়ে আমাকে নিয়ে যে কী খেলা শুরু করে দিলো...?’
তাঁর কথা বলার ধরনে ওরা দুজনেই হেসে দিলো। ‘তোমরা হাসছো? কিন্তু আমার যে তখন কী অবস্থা একবার যদি বুঝতে? আমি বুঝতে পারছি অরুণা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু যেই আমি ওর দিকে দেখি, ও সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।’
সুফী একটু সুর করে গাইলো, ‘প্রাণ চায়, চক্ষু না চায়, মরি একি দুস্তর তোর লজ্জা।’
‘ওটা কী গান বলো তো। বেশ সুন্দর তো!’
মিত্রা বললো, ‘ওটা রবীন্দ্রনাথের একটা গান। আচ্ছা আমি ওটার হিন্দি ভার্সনটা শোনাচ্ছি আপনার জন্য। পংকজ মল্লিক গেয়েছেন। আমার তো অতো ভালো হবে না। তবে মানেটা বুঝতে পারবেন। শুরুটা হচ্ছে এই রকম Ñ প্রাণ চাহে নায়ান না চাহে/ আরে তু কিউ ইঁউ শারমায়ে।’
‘তোমাদের রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই আমার মতো অবস্থায় পড়েছিলেন। কী যে যন্ত্রণা... আবার ভালোও লাগে। আচ্ছা, তোমরা দুজনে পরে মাইকে এ-গানটা সকলের সামনে গাইবে?’
‘না না। আমরা তো লোকের সামনে কখনো গান করিনি।’ ওরা বললো।
‘বুঝতে পারছি তোমরা সংকোচ করছো। ঠিক আছে পরে দেখা যাবে। অরুণা ফিরে আসুক।’
‘যাকগে, সিলেটে পৌঁছে একটু কথা বলার সুযোগ পেলাম। ওর বাবা-মা মালপত্র দেখতে ব্যস্ত। ওদের গাড়িতে সব ওঠানো হচ্ছে। আর আমার মিলিটারি গাড়িতে আমি একলা যাবো। ওর বাবা বলেছিলেন, শিলংয়ে তারা পাইনউড হোটেলে থাকবেন। আমি থাকবো আমার মিলিটারি ব্যারাকের রেস্টহাউসে। শিলং আমি আগেও এসেছিলাম একবার। সেখানে লাবানে আমার থাকার ব্যবস্থা। গাড়িতে ওঠার আগে অরুণাকে একটু খানিকের জন্য একলা পেলাম।
মরিয়া হয়ে ওকে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলাম না আগে। তবে এটুকুই এখন বলবো। পাইনউড হোটেলের কাছেই আছে ওয়ার্ড লেক। সেখানে আছে সুন্দর একটা কাঠের ব্রিজ। আগামীকাল বিকাল ৫টার দিকে যদি আপনি ওখানে থাকেন তাহলে আপনাকে একটা দরকারি কথা বলতে চাই। আপনি একলাই আসবেন কিন্তু।’
মাথাটা নাড়িয়ে কোনো কথা না বলে অরুণা চলে গেল ওর বাবা-মায়ের কাছে। কোনো ভাবান্তর দেখলাম না মেয়েটার চোখেমুখে। কোনো মেয়ে যদি আমাকে এ রকম একটা কথা বলতো আমি তো ভড়কে যেতাম।
অরুণা পরদিন ঠিকই ওয়ার্ড লেকের কাঠের ব্রিজের ওপর অপেক্ষা করছিলো ঠিক সময়ে। আমাকে দূর থেকে দেখে হাত নাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘আমি কিন্তু আধঘণ্টা আগে এসে গেছি। ওয়ার্ড লেক যে এত কাছে তা তো জানতাম না। ভেবেছিলাম ট্যাক্সি নিতে হবে।... আমার বাবা-মা ৫টার সময় আসবেন। যা বলার তার আগেই বলে ফেলেন। ওঁরা এলে আর আপনার সঙ্গে থাকা যাবে না।’ বাব্বা, কী সাহস মেয়েটার! বাবা-মায়ের কাছে কী রকম লক্ষ্মী মেয়ের মতো থাকে, আর এখন কী রকম বেপরোয়া! ওর নীল রঙের শাড়ির প্রশংসা করবো, নাকি ওর সংকোচবিহীন ব্যবহারের। খোঁপায় আবার একটা বেলিফুলের মালা পরে এসেছে। আমি তো কুপোকাত হয়েই আছি। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দেওয়ার দরকার কী? বেশি কিছু না বলে... বুঝতে পারছো ওয়ার্ড লেকের ওই কাঠের ব্রিজের ওপরেই আমি ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম।’
ও জবাব দিলো, ‘এসব কথা আমার বাবা-মাকে বলবেন।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি রাজি আছো?’ তার জবাবে সে কী বললো জানো? বললো, ‘আমি কি আপনার শত্র“? আপনার সঙ্গে কি যুদ্ধ করছি যে আমাকে সারেন্ডার করতে হবে?’ বিয়ের প্রস্তাবে কোনো মেয়ে এ-রকম জবাব দিয়েছে বলে আমি জানি না। এ-কথাটির যে কী মানে পঁয়ত্রিশ বছরেও আমি তা বুঝতে পারিনি। ওই যে তুমি গান করলে, ‘প্রাণ চাহে নায়ান না চাহে, আরে তু কিউ ইঁউ শারমায়ে’র গানের কথায় একই ভাব; কিন্তু অরুণার ভাষাটা অন্যরকম। যা হোক, ওর বাবা-মা সেনসিবল মানুষ। তাই বিয়ে হয়ে গেল। এখন থেকে এই পঁয়ত্রিশ বছর আগে। কিন্তু অরুণাকে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। মিষ্টি একটা হেঁয়ালি ভাব রয়েই গেল। কিন্তু অরুণা এখানে নেই বলে তোমাদের বলতে কোনো বাধা নেই। আমি একদিনের জন্যও অসুখী হইনি।’
এমন সময় অরুণা হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন। বললেন, ‘দেখো, আমাকে গেটে ডেকে পাঠিয়েছিলো একটু আগে। বাড়ি থেকে টেলিফোন এসেছিলো। ফ্ল্যাট থেকে আমাদের ডা. মিস্ত্রি ফোন করেছিলেন আমাদের জন্য। আমাদের আয়া তাঁকে ফোন করে ডেকে এনেছে। রানীর বেশ জ্বর হয়েছে। খুব মাথাব্যথা করছে, বমি হয়েছে। ডা. মিস্ত্রি বললেন, রানী বেশ অসুস্থ। পারলে আমাদের এক্ষুনি বাড়ি ফিরে আসা উচিত। ডা. মিস্ত্রিকে খুব চিন্তিত মনে হলো।’
ব্রিগেডিয়ার সাহেব প্রথমে কথাই বলতে পারছিলেন না। অরুণাই বললো ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে, ‘দশ বছরের আমাদের নাতনিকে আমাদের কাছে রেখে মেয়ে আর জামাই গেছে পুনাতে কদিনের জন্য। সব দায়িত্ব এখন আমাদের। আপনাদের মনে হচ্ছে আমরা একটু অসুবিধায় ফেললাম। কারণ তোমাদের এক্ষুনি নাতনির কাছে যেতে হবে।... ডা. মিস্ত্রি বলছিলেন, যদি মেনিনজাইটিস হয় তাহলে যতো তাড়াতাড়ি পারা যায় ওকে হাসপাতালে নেওয়া উচিত। তিনি তাই সন্দেহ করছেন। আমরা কাফ প্যারেডে থাকি। বেশিদূর না এখান থেকে। আর জে. জে. হাসপাতাল আমাদের বাড়ি থেকে কাছেই।’
মিত্রা তার স্বভাবসুলভ দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, ‘আমি কি আপনাদের জন্য কিছু করতে পারি? আমার মামা জে. জে. হাসপাতালেই কাজ করেন। পেডিয়াট্রিক্স ডিপার্টমেন্টের রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার। হাসপাতালে যদি নিতেই হয় তাহলে আমি আমার মামার সঙ্গে কথা বলতে পারি এক্ষুনি। আপনাদের গেটের অফিস থেকে টেলিফোন করতে পারি। হয়তো সব ব্যবস্থা একটু এগিয়ে নেওয়া যায়।’
মিত্রার কথা শুনে ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন, ‘তুমি কথাটা ভালোই বলেছ।’
তাঁরা উঠে গেলেন বাইরের দিকে। অফিসে গিয়ে মেহতাকে বললেন, ‘আমরা দুঃখিত, আমাদের এ-রকমভাবে ফিরে যেতে হচ্ছে। ইমার্জেন্সি। তুমি অতিথিদের কাছে মাফ চেয়ে নিও আমাদের হয়ে। ...আচ্ছা মিত্রা কথা বলুক ওর মামার সঙ্গে।’
মিত্রা টেলিফোন ধরলো। সব কথার পর ও অরুণাকে বললো, ‘আমার মামাও বলছেন মেনিনজাইটিস হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। যতো তাড়াতাড়ি পারা যায় হাসপাতালে নেওয়া উচিত। মামা বলছেন, তিনি আপনাদের ঠিকানায় অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিতে পারবেন। এই নিন, টেলিফোনে আপনাদের ঠিকানাটা বলে দিন।’
সুফী বললো, ‘কিছু যদি মনে না করেন, আমরা আপনাদের একলা ছেড়ে দিতে চাই না। আপনাদের এই বিপদে আমরাও আপনাদের পাশে থাকতে চাই। যদি কোনো কাজে লাগতে পারি।’
একটু আশ্বস্ত গলায় ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন, ‘তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। তোমরা থাকলে ভালোই হয়। আমরা প্রাণে একটু সাহস পাবো। দু-ঘণ্টাও হয়নি তোমাদের সঙ্গে পরিচয়। এরই মধ্যে তোমাদের অনেক কাছের মনে হচ্ছে। আমার মেয়ে আর জামাই যখন এখানে নেই, তখন তোমরা হবে তাদের মতোই।’
ব্রিগেডিয়ার সাহেবের গাড়িতে করে ওরা বের হলো। দশ মিনিটের মধ্যেই কাফ প্যারেডের তাঁদের বাড়িতে পৌঁছলো। অ্যাম্বুলেন্স বাইরে অপেক্ষা করছিলো। স্ট্রেচারসহ অ্যাম্বুলেন্সের লোকদের নিয়ে তাঁরা লিফটে উঠে গেলেন। ওরা দুজন নিচেই থাকলো। দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই ছোট্ট নাতনিকে নিয়ে তাঁরা ফিরে এলেন। মেয়েটা প্রায় অজ্ঞানের মতো ঝিম মেরে আছে।
মিত্রা বললো, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে হাসপাতালে যাবো। আমি তো ওখানেই থাকি।’
অরুণা বললো, ‘ঠিক আছে। তবে সুফীকে আমাদের গাড়ি ওর হোটেলে পৌঁছে দেবে। তারপর আমাদের জন্য হাসপাতালে চলে আসবে।... আমি আমার মেয়েকে সব বলেছি। ওরাও আগামীকাল এসে যাচ্ছে। ইস, তোমরা যদি না থাকতে আমরা একলা যে কী করতাম?’
অ্যাম্বুলেন্স রওনা হওয়ার আগে মিত্রা হাত নাড়িয়ে বললো, ‘কাল সকালে দেখা হবে সায়েন্স কংগ্রেসের উদ্বোধনীতে। দেরি করো না।’
দশ
সকালে যখন সুফী পৌঁছলো সায়েন্স কংগ্রেসের মিটিংয়ে তখন অনেক লোক এসে গেছে সেখানে। ভাগ্যিস ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিলো। খোলা জায়গায় প্যান্ডেল বানিয়ে উদ্বোধনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভেবেছিলো অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু না, হয়নি। যা হয় আমাদের দেশে। ভাগ্যিস সময়ের ব্যাপারে আমরা এখনো অতো পাংচুয়াল হতে পারিনি।
সামনের দিকেই দেখা হয়ে গেল ড. গুপ্তের সঙ্গে। তাঁকে একটু কাহিল লাগছিলো দেখতে। সুফীকে দেখেই তিনি বললেন, ‘তুমি তো এসে পড়েছো কিন্তু সংঘমিত্রা কোথায়?’ তাঁর গলাটা একটু ধরা।
‘আমারও তো সেই একই প্রশ্ন।’
‘আচ্ছা, তুমি ভালো আছো? আমার অবস্থা কিন্তু অতোটা ভালো নয়। সেই যে অজন্তায় আমার একটু খারাপ লাগছিলো গতকাল থেকে সেটা আরো জাঁকিয়ে বসেছে। রাত্রে ভালোই জ্বর হয়েছিলো। গলায় ব্যথা, ঢোক গিলতে কষ্ট। আর স্বর শুনে বুঝতেই পারছো আমার গলায় ইনফেকশন হয়েছে। এখানে আসতে মোটেও ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু উপায় নেই। এই অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আমাদের পেপার পড়তে হবে। স্বয়ং পল ডিরাক সভাপতি। আমার গলার যা অবস্থা তাতে আমার পক্ষে পেপার পড়া অসম্ভব।’
সুফী বললো, ‘আপনার সঙ্গে সংঘমিত্রা তো কো-অথর তাই না? তাহলে ও তো পড়তে পারে।’
‘হ্যাঁ, ওকেই পড়তে হবে শেষ পর্যন্ত। তবে ও এখনো জানে না। কিন্তু ও কেন আসছে না এখনো?’
সুফী তাঁকে বললো অল্প কথায় কেমন করে গতরাতে ব্রিগেডিয়ারের নাতনিকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিলো। সেজন্যে হয়তো সংঘমিত্রার দেরি হতে পারে। তবে এসে যাবে।
হঠাৎ সুফীর মনে একটা বুদ্ধি এলো। গতকাল মিত্রা ওকে পল ডিরাকের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলেনি দুষ্টুমি করে। তাই সে ড. গুপ্তকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি আমাকে পল ডিরাকের সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবেন। আমি বিশেষ কিছু জানি না কিন্তু আমার কাগজের জন্য কিছু একটা লিখতে হবে।’
‘পল ডিরাকের সম্বন্ধে অনেক কিছু বলার আছে। আমার গলার যে অবস্থা তাতে আমার পক্ষে কিছু বলতে চেষ্টা করা সম্ভব নয়। তবে আমার সঙ্গে একটা ছোট বই আছে। পল ডিরাকের জীবনী। পড়ে দেখো। কতোটা বুঝতে পারবে জানি না। তবে সবই ইন্টারেস্টিং। ডিরাক ইকোয়েশন, ফেরমি ডিরাক স্ট্যাটিসটিকস, অ্যান্টি ম্যাটার Ñ এসব খুব সহজে লেখা আছে।’
তিনি তাঁর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা বই বের করলেন। বলেছিলেন ছোট কিন্তু বইটি দেখে ছোট বলে মনে হলো না। বইটি একটু উলটেপালটে দেখে ওর মনটা খুশি হয়ে গেল। সুযোগ বুঝে মিত্রাকে তাক লাগিয়ে দেবে আজ ডিরাকের সম্বন্ধে কথা বলে।
সুফী অধৈর্যের মতো তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক কিন্তু মিত্রাকে দেখতে পাচ্ছে না। এদিকে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে নিজের নিজের জায়গায় বসার অনুরোধ করা হচ্ছে। সুফী নিজের জায়গার দিকে চললো। প্রেস রিপোর্টারদের জায়গা আলাদা।
ড. গুপ্ত বসলেন সামনের সারিতে আমন্ত্রিত অতিথিদের জায়গায়। তাঁর পাশে মিত্রার জন্য চেয়ার খালি রেখেছেন তিনি। এমন সময় দূরে গেটের কাছে দেখতে পেলো মিত্রাকে। হন্তদন্ত হয়ে সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে। ড. গুপ্তও দেখেছিলেন মিত্রাকে। সে সামনে এসে তাঁর পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। সুফী অনেক চেষ্টা করলো ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার কিন্তু ভিড়ের মধ্যে ও যতোই হাত নাড়–ক, মিত্রার নজরে তা পড়লো না।
সুফী মনে মনে ছটফট করছে মিত্রার খবর জানার জন্য। মিটিংয়ের প্রেসিডেন্ট ড. হোমি ভাভা সবাইকে অভ্যর্থনা করে বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু সুফীর কানে বিশেষ কিছু ঢুকলো না। আরো অনেক বক্তৃতা হলো। সুফী দেখলো ওকে যে ফোল্ডার দেওয়া হয়েছিলো কংগ্রেসের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে, তাতে বক্তৃতাগুলোর কপি রয়েছে। অতএব বিশেষ কোনো নোট নেওয়ার দরকার নেই। হঠাৎ তার মনে হলো, তার হাতে একটা ক্যামেরা আছে। আর অন্য ক্যামেরাম্যানরা ছবি নেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে স্টেজের কাছে আর অতিথিদের কাছে আসা-যাওয়া করছে। সেও যখন প্রেসের কার্ডধারী একটু এদিক-ওদিক গিয়ে ছবি তুললে কেউ তাকে বাধা দেবে বলে মনে হয় না।
একটু সুযোগ পেয়ে সে মিত্রা আর ড. গুপ্তের কাছে গিয়ে ওদের একটা ছবি তুললো। মিত্রা ওকে দেখে হাসিমুখে বললো, ‘এই অভ্যর্থনা কমিটির বক্তৃতার পরই কফি ব্রেক। বাইরে এসো। কথা আছে।’ মাথা নাড়িয়ে সুফী নিজের সিটে ফিরে এলো।
এক কাপ কফি আর একটা পাকোড়া নিয়ে মিত্রা এগিয়ে এলো। বললো, ‘তুমি শুরু করো, আমি আসছি স্যারের সঙ্গে কথা বলে।’
ড. গুপ্ত তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। মিত্রা তাঁর হাত থেকে একটা কাগজ আর ছোট বাক্স নিলো। তারপর ফিরে এলো সুফীর কাছে।
‘কাল রাত্রে কী কাণ্ড হলো তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর এখনো বলা হয়নি।’
‘তোমার হাতে এগুলো কী? হাতে ধরে থাকলে কফি খাবে কী করে? আমাকে দাও না হয়।’
‘না, এগুলো অন্য কারোর হাতে দেওয়া যাবে না।’ বলে সে তার নিজের ব্যাগে যতœ করে রাখলো। বললো, ‘দেখো না স্যার কী ঝামেলা বাধালেন। তাঁর গলায় ইনফেকশন হয়েছে। স্বর ভেঙে গেছে। আমাদের পেপারটা তাঁর পড়ার কথা। তিনিই তো সিনিয়র অথর। কিন্তু পারবেন না পড়তে। তাই সেটা আমাকেই পড়তে হবে। দেখো দেখি, হ্যাঁ প্র্যাকটিক্যাল কাজগুলো আমিই তাঁর উপদেশমতো করেছিলাম। কিন্তু এই রকম একটা বিরাট আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে আমি কোনোদিন কোনো পেপার পড়িনি। তাও আবার আমাদের সেশনের চেয়ারম্যান হবেন পল ডিরাক। আমার তো সেটা ভাবলেই হাত-পা পেটে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। আমার বুক এখন থেকেই ঢিপঢিপ করছে।’
‘তুমি নিশ্চয়ই পারবে। প্রথম প্রথম একটু নার্ভাস লাগবে বটে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রেখো, এই মিটিংয়ে এতো লোকের ভেতরে তুমিই হয়তো সবচেয়ে বেশি জানো এ-ব্যাপারে। কী যেন তোমাদের পেপারের নাম Ñ ‘ফ্রম সাইক্লোট্রন টু সিনক্রোট্রন’। তো আমি আমার কাগজের জন্য খুব ভালো একটা রিপোর্ট পাঠাবো তোমার প্রেজেন্টেশন নিয়ে। চিন্তা করো না।’
‘থ্য�