চল্লিশের দশকের শেষদিকে কথাসাহিত্যিক হিসেবে যখন শামসুদ্দীন আবুল কালামের আত্মপ্রকাশ ঘটে তখনও তো বাংলার নগরগুলো সেই অর্থে বিকশিত হয়নি। অনিবার্য কারণেই গল্প-উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে অন্য অনেকের মতো তাঁকেও বেছে নিতে হয়েছে গ্রামকে। তাঁর গল্প-উপন্যাসে বাংলার গ্রামকে একেবারে ভেতর থেকে দেখানোর একটা প্রয়াস আমার খেয়াল করি। বাংলার গ্রাম এবং গ্রামীণ সংস্কৃতিকে তিনি তুলে আনার প্রয়াস চালিয়েছেন নিজস্ব শিল্পকুশলতায়। ‘কাশবনের কন্যা’ থেকে শুরু করে ‘কাঞ্চনগ্রাম’, প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে তাঁর এই প্রয়াস আমরা দেখি। একইভাবে তার গল্পেও গ্রামকে তিনি উপস্থাপন করতে চেয়েছেন বহুমাত্রিকতায়। ফলে তার গল্প-উপন্যাস পড়তে গেলে মনে হয় সত্যিকারার্থেই যেন একজন বাঙালির লেখা পড়ছি, যিনি বাংলাকে জানেন, বাংলাকে বোঝেন, বাংলার মানুষের চোখের ভাষা, মুখের ভাষা পড়তে পারেন। হ্যাঁ, শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্প-উপন্যাস পড়তে গেলে এমনটাই মনে হয়; যদিও এই মনে হওয়ার মধ্যে রকমফের আছে। আমি সেই রকমফেরের কথা বলব না। আমি বলব না পল্লী-বাংলার জনমানস চিত্রণের ক্ষেতে তাঁর মধ্যবিত্তসুলভ ভাবালুতার কথা। আমি শুধু তার প্রচেষ্টার কথা বলতে চাই। মনে রাখা দরকার, ‘প্রচেষ্টা’ এবং ‘সফলতা’ দুটো আলাদা বিষয়। শব্দ দিয়ে প্রান্ত বাংলাকে আঁকার যে প্রচেষ্টা তাঁর, আমি সেই প্রচেষ্টার দিকেই আলোটা ফেলতে চাই।
শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা একেবারে কম নয়। আমার জানা তথ্য অনুযায়ী তিনি দশটি উপন্যাস ও পাঁচটি গল্পগ্রন্থ লিখেছেন। কে জানে, আমার জানার বাইরে আরো থাকতে পারে। বলছি না তাঁর সব গল্প-উপন্যাসই বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীর কোনো লেখকের পক্ষেই তার প্রত্যেকটি লেখাকে মাস্টারপীস বা অনন্য বা অসাধারণ করে তোলা সম্ভব নয়। কিছু কিছু লেখা অনন্য হয়ে ওঠে, যেগুলোর কারণে পাঠকের কাছে তিনি ‘লেখক’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। শামসুদ্দীন আবুল কালাম সারা জীবনে যা লিখেছেন, বাছাই করতে গেলে একাধিক গল্প-উপন্যাসের সন্ধান পাওয়া যাবে, যেগুলোর কারণেই তার নামটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অক্ষয় আছে।
তাঁর উপন্যাসের কথা থাক, অন্যান্য গল্পের কথাও থাক, আমার আলোচনার বিষয় তার ‘পথ জানা নাই’ গল্পগ্রন্থটি। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে, যখন তাঁর বয়স প্রায় সাতাশ। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক জ্ঞান এতটা প্রখর ছিল, ভাবতে গেলে কিছুটা অবাক হতে হয় বৈকি। এই গ্রন্থে গল্পের সংখ্যা দশটি। যথাক্রমে বন্যা, মেঘনায় কতো জল, জীবনের শুভ অর্থ, বজ্র, মদন মাঝির গেলেপতার, সরজমিন, বাণ, কাল-রাত্রি ভোর, অনেক দিনের আশা ও পথ জানা নাই। মোট দশটি গল্পের অধিকাংশেরই পটভূমি বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল। অর্থাৎ গ্রাম। গল্পগুলোর ভাষা ও বিষয়বস্তুর মধ্য দিয়ে বাংলার গ্রাম জীবনের একেবারে গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছেন তিনি। গল্পগুলো পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে চিরায়ত বাংলার প্রতিচ্ছবি।
গ্রন্থের সর্বশেষ গল্পটির নাম ‘পথ জানা নাই’। গল্পটি আমাদের কোন ক্লাসে পাঠ্য ছিল মনে নেই। পাঠ্য ছিল, শুধু এটুকু মনে আছে। না বুঝেই, শুধু পরীক্ষায় পাসের জন্য গল্পটি পড়েছি। পরবর্তীকালে পড়েছি নিজের গরজে। গরজ? হ্যাঁ গরজ। যেসব গল্পকার-ঔপন্যাসিকদের নিয়ে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ভীত, তাঁদের মধ্যে শামসুদ্দীন আবুল কালাম অন্যতম। বাংলায় কথাসাহিত্য করতে হলে তাকে তো পড়তেই হবে। তিনি তাঁর গল্প-উপন্যাসের মধ্য দিয়ে যে ভূগোল সৃষ্টি করেছেন সেই ভূগোলটা তো জানা থাকা চাই। ‘পথ জানা নাই’ বাংলা সাহিত্যে এমন একটি গল্প, যেটিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সাহিত্যের পাঠকরা গল্পটির কথা জানেন, গল্পটি পড়েছেন। বাংলা সাহিত্যের একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে নিজের গরজেই আমাকে পড়তে হয়েছে এটি।
বাংলা ভাষায় হাজার হাজার গল্প লেখা হয়েছে। পাঠক কটি মনে রেখেছে? খুব বেশি নয় কিন্তু। টিকে যাওয়া গল্প একেবারেই হাতেগোণা। বহু বড় বড় গল্পকারের গল্পও কালের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। কাল সেগুলোকে মনে রাখেনি। কালের বিচার এমনই। কিন্তু শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্পটি, পথ জানা নাই, মনে রেখেছে কাল। নইলে এত এত বছর পর কেন আমি গল্পটি নিয়ে লিখছি? নিশ্চয়ই কালকে উত্তীর্ণ করতে পেরেছে গল্পটি। বাংলা গল্পের ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নিতে পেরেছে এই গল্প। শামসুদ্দীন আবুল কালাম নামটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে আমার যে গল্পটির নাম মনে পড়ে সেটি ‘পথ জানা নাই।’ তিনি যে কটি গল্প লিখেছেন, সব কটি একত্রিত করে যদি শ্রেষ্ঠ গল্প বাছাই করতে বলা হয় আমাকে, তবে নির্দ্বিধায় এই গল্পটিকে শ্রেষ্ঠ গল্পের মধ্যে এক নম্বরে রাখব। কারণ? নিশ্চয়ই আছে। লেখক সমাজের বাইরের কেউ নন, তিনি রাজনীতিরও বাইরে নন। লেখক যে সাহিত্য করেন তা সমাজ ও রাজনীতিকে নিয়েই। ‘পথ জানা নাই’ গল্পে সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতা খুব স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় আমাদের কাছে। স্পষ্ট, কিন্তু শৈল্পিকভাবে। এই গল্পে সমাজটা কোথায়? মউলতলায়। এই মউলতলা গ্রামের গফুর আলী ওরফে গহুরালি একজন সামান্য কৃষক। মাত্র পাঁচ কুড়া জমির মালিক। শহরফেরত জোনাবালী হাওলাদারের ইচ্ছে হলো শহরের সঙ্গে মউলতলার একটা সংযোগ-সড়ক নির্মাণ করবে। তাতে গহুরালির পাঁচ কুড়া জমির মধ্যে দুই কুড়াই সড়কের পেটে চলে যাবে। গহুরালি আপত্তি নেই তাতে। কেন থাকবে? কাঁহাতক এভাবে দুটি দুটি ধান খুঁটে জীবন চালানো যায়! জোনাবালী বলেছে সড়ক হলে আয়-রোজগারের অনেক রাস্তা খুলে যাবে, নতুন জীবন হবে, জীবনে সমৃদ্ধি আসবে। জোনাবালীর মতো মানুষ, দশ বছর আগেও যার বাবা দিনমান খেটে এক মুঠো অন্নের সংস্থান করতে পারত না, অথচ তারই পুত্র শহরের কল্যাণে অগাধ ধন-সম্পদের মালিক এখন। জোনাবালী যদি পারে গহুরালি কেন পারবে না? রাস্তাটা হলে তার জীবনেও তো পরিবর্তন এসে যেতে পারে।
হ্যাঁ, রাস্তার কল্যাণে তার জীবনে পরিবর্তন আসে বটে। রাস্তা হলো। মউলতলার পরিবর্তন হতে লাগল ধীরে ধীরে। পরিবর্তনটা কী? গ্রামবাসীর আয়-রোজগার বাড়তে লাগল। গহুরালিরও। বছর তিনেকের মধ্যে খোড়োঘরের চাল ফেলে সে টিন তুলে ফেলল। মোটাদাগে এই হচ্ছে মউলতলার সমাজের অর্থনৈতিক পরিবর্তন। কিন্তু অর্থনীতির বাইরেও সমাজের সংস্কৃতি বলে একটা জিনিস আছে, যা প্রত্যেক সমাজেই থাকে। শহরগামী সড়কের কারণে মউলতলার সংস্কৃতির পরিবর্তন হতে লাগল। পরিবর্তন না বলে ‘ভাঙন’ বলাটাই শ্রেয়। মউলতলার সংস্কৃতিতে ভাঙন ধরল। সড়কটির ফলে মউলতলা গ্রামের মানুষের আর্থিক উন্নতি হতে লাগল সন্দেহ নেই, তবে সেই সঙ্গে বহুদিনের শান্তিপূর্ণ গ্রামটিতে অশান্তিও হানা দিতে লাগল। শহরের ফৌজদারী-দেওয়ানীতে ছোটাছুটি শুরু করল গ্রামের মানুষ। সাদামাটা সরল জীবনে আসতে লাগল কূটবুদ্ধি আর কৌশলের দড়িজাল। মউলতলা ধীরে ধীরে জটিল হয়ে উঠল। একদিন খুনের ঘটনা ঘটে গেল একটা। মউলতলা স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি গ্রাম ছিল। হয়ত জীবনে তাদের কষ্ট ছিল, কিন্তু উপোস থাকতে হয়নি, দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে পেরেছে। শান্তিপূর্ণভাবে। কিন্তু ইংরেজ শাসনের শেষদিকে এই গ্রামে দুর্ভিক্ষ হানা দিল। চাল-ডালের দাম বাড়তে লাগল ধীরে ধীরে। দাম চড়ল সব জিনিসের, কমলো শুধু জীবনের। রোগ-ব্যাধি, চোরাবাজার আর দুর্নীতির উত্তাল জোয়ার এলো। সুশাসনে নিযুক্ত সরকারি কর্মচারী আসে এই রাস্তা ধরে, আবার ঘুষ পকেটে নিয়ে ফিরে যায়। আর আসে তরি-তরকারী, কাঠ, হ্যানোত্যানো নানা জিনিস কিনতে মিলিটারির দালাল। ঘটনাচক্রে তাদের একজনের সঙ্গে গহুরালির পরিচয় হয়, ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে গহুরালি তার স্ত্রী হাজেরাকে খুঁজে পেল না। কোথায় গেল হাজেরা? কোথায় আবার, মিলিটারির দালালের সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
অতঃপর একদিন গহুরালি একটা কোদাল নিয়ে রাস্তাটি কোপাতে লাগল। এই রাস্তা সে কেটে ফেলবে। কারণ? কারণ এই রাস্তা দিয়েই গ্রামে এসেছে সমস্ত অশান্তি, এই রাস্তাই টেনে নিয়ে গেছে তার ঘরের মানুষটিকে। তাই রাস্তাটি সে আর রাখবে না। রাস্তা তৈরি ছিল একটা ভুল।
গল্পটি পড়ে সচেতন পাঠক ধরে ফেলবেন শামাসুদ্দিন আবুল কালামের সমাজ-রাজনীতি ও ইতিহাস সচেতনতা। মউলতলা শুধু একটা গ্রামই নয়, যেন গোটা প্রাচীন বাংলা। মউলতলা স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলার সেই সমৃদ্ধির কাল। বাংলার গুটিপোকা থেকে রেশম, তাঁত ও মসলিন দখল করেছিল সমগ্র ভারত, তুরস্ক, সিরিয়া ও আরবদেশের বাজার। ধান থেকে শুরু করে সব রকমের শস্য, মাংস, চিনি ও তুলার জন্য বিখ্যাত ছিল এই জনপদ। স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল এই বাংলার মানুষ, মউলতলার কৃষকরা যেমন। কিন্তু হায়, দিল্লি সুলতানের দু’বার বাংলা অভিযান, চট্টগ্রাম নিয়ে ত্রিপুরা ও আরাকান রাজাদের কাড়াকাড়ি, আহোম ও উড়িষ্যার রাজাদের আক্রমণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজ্যগুলি উত্থান, পর্তুগীজদের বাংলায় অনুপ্রবেশ ও বঙ্গোপসাগর দখল, শেরশাহ ও মুঘলদের গৌড় দখল, মুঘলদের বাংলা বিজয়, তারপর ইংরেজদের আগমণ, সব মিলিয়ে বাণিজ্যজাত লাভ বাঙালি বণিকদের হাত থেকে চলে যায়। বাঙালির জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ। বাংলার প্রকৃত সম্পদগুলো হারিয়ে গেল, যেমন হারিয়ে যায় মউলতলার কৃষিসম্পদ, যেমন হারিয়ে যায় গহুরালির বউ হাজেরা। বাঙালির সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির বন্ধন টুটে যায়, যেমন টুটে যায় মউলতলা গ্রামবাসীদের চিরায়ত সম্প্রীতির বন্ধন। বাংলায় শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মউলতলায় যেমন খুনের ঘটনা ঘটে যায়। শেষ পর্যন্ত বাংলার মানুষরা রাস্তাটা কেটে দেয়ার উদ্যোগ নেয়, যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল ইংরেজ বণিকরা। বহিঃশক্তির সঙ্গে তাদের লেনাদেনা চুকিয়ে, তাদেরকে এই ভূমি থেকে খেদিয়ে আবার ফিরে যেতে চায় নিজেদের সুর্বর্ণ অতীতে, গহুরালি যেমন ফিরে যেতে চায়।
কিন্তু ফিরে কি সত্যি যেতে পেরেছে? আমরা কি এখনো ঔপনিবেশিক অবলেশ থেকে নিজেদের পুরোপুরি মুক্ত করতে পেরেছি? পারিনি তো। গহুরালিও কি ফিরে যেতে পেরেছিল? গল্পে সেকথা বলা নেই। তবে আমরা নিশ্চিত মউলতলা তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। ‘পথ জানা নাই’র ধাঁধাটা এখানেই। অর্থাৎ মউলতলাবাসী আসলে প্রকৃত পথের সন্ধান পায় না। সমাধান কোনপথে? সড়ক কেটে দেয়ায়, নাকি পুনঃস্থাপনে? মউলতলাবাসী সঠিক পথের দিশা পায় না। এ কারণেই গল্পের নাম ‘পথ জানা নেই।’ গল্পটির মধ্য দিয়ে গল্পকার একদিকে আধুনিক সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। বলতে চেয়েছেন সভ্যতা মানুষকে যা দিয়েছে, নিয়েছে তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সভ্যতার খারাপ দিকটিই দেখাতে চেয়েছেন গল্পকার। আবার একই সঙ্গে এই প্রশ্নও তুলেছেন, সমাধান আসলে কোন পথে? গল্পের শেষ লাইনটিতে এই প্রশ্ন রয়েছে : “সকলের ইচ্ছা হইল জিজ্ঞাসা করে ঠিক হইত কী হইলে, কিন্তু গহুরালি দূরের কথা, তাহারাও কি তাহা জানিত! অন্য কোনো নয়া-সড়কের স্বপ্ন তো তাহাদের মনে কেহ জাগায় নাই।”
তার মানে এটাও ভাবার কারণ নেই সভ্যতার সব কিছুই খারাপ। তাই বলে এই নয় যে মানুষ মউলতলাবাসীর মতো যুগের পর যুগ একটা বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে থেকে যাবে। মানুষ প্রতিনিয়িত তার গ-িকে অতিক্রম করতে চায়। মানুষ চায় অন্যের সঙ্গে মিলতে, নতুনের সঙ্গে নিজেকে মিলাতে। মউলতলার জোনাবালী হাওলাদার ঐ মিলানোর কাজটিই করেছে। শত শত বছর ধরে বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে থাকা মউলতলাবাসীকে সে উন্নত জীবনের সন্ধান দিতে চেয়েছে। একটি সড়ক নির্মাণ করে সে দেখিয়েছে, এই মউলতলার বাইরেও আরো জীবন আছে, জীবনের আরো অনেক রঙ-রূপ আছে। জোনাবালী এই সড়ক নির্মাণ না করলেও একদিন কেউ-না-কেউ করতই। এটাই স্বাভাবিক। কেননা মানুষ প্রতিনিয়তই তার গ-িকে অতিক্রম করে। ক্ষুদ্র থেকে মানুষ বৃহত্তের সঙ্গে মিলে। সেই মিলনের মধ্য দিয়ে সভ্যতার অগ্রগতি সাধিত হয়। এই মিলনের মধ্য দিয়ে প্রাপ্তি যেমন থাকে, তেমনিভাবে হারানোর ব্যাপারও থাকে। ভাগ্যান্বেষণে যে বৃটিশরা এই দেশে এসেছিল তারা আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে অনেক, কিন্তু দিয়েছে কি কম? মোটেই না। তুর্ক, আফগান, মোগলের পরে নতুন এই বিদেশিরা এসে এ দেশে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করল। এই বিদেশিরা সদূর ইউরোপ থেকে সওদাগরি জাহাজে চড়ে আসে। সঙ্গে আনে ইংরেজি ভাষার বইপত্র। গঙ্গার ঘাটে নামিয়ে দেয় সেসব বই। নাটক উপন্যাস কাব্য প্রবন্ধ। রাজনীতি অর্থনীতি দর্শন বিজ্ঞান সন্দর্ভ। ইংরেজদের ঘরে ঘরে ক্লাবে ক্লাবে বইপত্র জমে উঠে। বাঙালিরাও কি ক্রমে ক্রমে জমতে থাকা এসব বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। রামমোহন কি হননি? মাইকেল হননি? বঙ্কিম হননি? বিবেকানন্দ বা অরবিন্দ হননি? রবীন্দ্রনাথও কি হননি? ইংরেজ কর্তৃক ভারত শাসনকে কে বলেছিলেন ‘বিধাতার আশীর্বাদ’? রবীন্দ্রনাথই তো। তিনি বিশ্বাস করতেন পূর্ব আর পশ্চিম পরস্পরের পরিপূরক, মহামানবের সাগরতীরে তাদের মিলন হবে।
সুতরাং প্রাপ্তি আমাদের কম নয়, আবার হারানোর বেলায়ও কম হারায়নি। পেয়েছি যেমন, দিয়েছিও তেমন। এটাই স্বাভাবিক। বন্যা যখন আসে তখন বদ্ধ জলাশয়ের পচা-গন্ধ জলকে টেনে বের করে নিয়ে যায়, মাছগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আবার কিছু মাছ বন্যার জলের সঙ্গে ঢুকেও পড়ে। অর্থাৎ যায় যেমন, আসেও তেমন। মউলতালার ওই রাস্তা দিয়ে বন্যার জল ঢুকেছে। এই বন্যা মউলতলাবাসীকে যা দিয়েছে, সমপরিমাণ নিয়েও গেছে। প্রাপ্তি ও হারানো সমান সমান। এই কারণেই মউলতলার সমস্যার সঠিক কোনো সমাধান পাওয়া যায় না। এই কারণেই গল্পের নাম ‘পথ জানা নাই’। অর্থাৎ সমস্যা সমাধানের পথটি জানা নাই।
যাই হোক, শামসুদ্দীন আবুল কালামের এই গল্পগ্রন্থে ‘পথ জানা নাই’ ছাড়াও আরো নয়টি গল্প রয়েছে, আগেই বলেছি। বলছি না, আলোচ্য গল্পগ্রন্থভূক্ত প্রতিটি গল্পই কালোত্তীর্ণ, সুখপাঠ্য। একজন লেখকের সারা জীবনে লেখা সব লেখার মান সমান হয় না। মান বিচারে ভালো-খারাপ থাকে। শামসুদ্দিন আবুল কালামেরও আছে। দুর্বল গল্প তারও কম নেই। ‘বজ্র’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। মা-বাবার ওপর অভিমান করে, হাস্যচঞ্চল বোন ফুলি, কারুণাময়ী ভাণুকে ছেড়ে দেশ ছেড়ে ইটালী চলে গিয়েছিল গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আনোয়ার। আড়াই বছর পর নাড়ির টানে দেশে ফিরে পরিবারের কাউকে সে খুঁজে পায় না। তারা কোথায় চলে গেছে গ্রামের কেউ জানে না। আনোয়ার তার মা-বোনকে খুঁজতে আসে সদর-শহরে। রাতের আলো-অন্ধকারে শহরের এক যৌনকর্মীর সঙ্গে তার দেখা হয়। লোভনীয় তার সজ্জা। খোঁপায় পরেছে ফুল। বুকের কাপড় ইচ্ছে করেই অসংবৃত। সিল্কের আবরণীতে তার উদ্ধত স্তন জ্যোৎ¯œায় চকচক করছে। মুখের চেহারা চেনাচেনা। আনোয়ারের দেহে একটা শিহরণ বয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত পাঁচ টাকার বিনিময়ে মেয়েটির সঙ্গে সারা রাত কাটানোর জন্য তার আস্তানায় রওনা হয়। সারা রাত সে মেয়েটির সঙ্গে কাটায়। ভোরে যখন সে মেয়েটির আস্তানা থেকে ফিরবে তখনই সে আবিস্কার করে যার সঙ্গে রাত কাটিয়েছে সে আর কেউ নয়, তারই বোন ফুলি ওরফে কামরুন্নেসা!
গল্পের কাহিনি সত্যও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। মিথ্যা হলেও আপত্তি নেই। কিন্তু গল্পকার তার বিশেষ কুশলতায় মিথ্যাকে এমনভাবে উপস্থাপন করবেন, পাঠকের মনে হবে তারা সত্যি কাহিনি পড়ছেন। অর্থাৎ কাহিনিকে গল্পকার বিশ্বাসযোগ্য মাত্রায় উপস্থাপন করবেন। ‘বজ্র’ গল্প পড়তে পড়তে বিশ্বাসে ঘাটতি দেখা যায়। মানুষের স্মৃতিশক্তি এত দুর্বল নয় যে মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে আজন্মের পরিচিত মুখ, পরিচিত কণ্ঠ ভুলে যাবে! মেনে নিলাম রাতের আলো-আঁধারিতে রূপসি ওরফে ফুলি ওরফে কামরুন্নেসার চেহারা ভালো করে ঠাওর করতে পারেনি আনোয়ার। তাই বলে কণ্ঠস্বরও নয়? আচ্ছা, কণ্ঠস্বরও না হয় অচেনা ঠেকেছে। কিন্তু রূপসীর আস্তানায় কি কোনো কুপি ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। কুপির আলোয় আনোয়ার নিশ্চয়ই ফুলিকে দেখে চেনার কথা। দু-বছর এমন কোনো দীর্ঘ সময় নয়। আচ্ছা, আনোয়ার না হয় চিনল না, তাই বলে ফুলিও চিনতে পারল না? নাহ্, একেবারেই অবিশ্বাস্য। আড়াই বছরের জায়গায় সাত-আট বছর হলে গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য মাত্রায় যেত। এখানেই অংকে ভুল করে ফেলেছেন গল্পকার। ‘পথ জানা নাই’ বইয়ের দশটি গল্পের পড়ে এই গল্পটি সম্পর্কে আমার ‘অভিযোগ’ থাকল। লেখক জীবিত থাকলে এই অভিযোগটি তার কাছে করতাম। বলতাম, ইটালী থেকে আনোয়ারের ফেরার সময়টা আড়াই বছর নয়, দশ বছর বা এক যুগ করে দিন। তাহলেই গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য মাত্রায় পৌঁছে যাবে।
শামসুদ্দীন আবুল কালাম দীর্ঘদিন মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। জীবনের অনেকটা সময় তিনি কাটিয়েছেন রোমের মতো একটি মহানগরে। ফলে তার গল্প-উপন্যাসে মধ্যবিত্ত সুলভ যে ভাবালুতার অভিযোগ করা হয়, সেই অভিযোগ উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই অভিযোগের কথা এখন থাক। অন্য কোনো সময় অন্য কোনো লেখায় সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। এই লেখায় শুধু তার প্রতি পাঠক হিসেবে আমার মুগ্ধতার কথাই জানিয়ে রাখলাম। বাংলা সাহিত্যের শেকড়ে যে কজন সাহিত্যিক রয়েছেন তাঁদের মধ্যে শামসুদ্দীন আবুল কালাম নিঃসন্দেহে একজন। আমাদের সাহিত্যের শেকড়টাকে জানতে হলে এই কথাসাহিত্যিকের সাহিত্য পাঠের বিকল্প নেই।