জালাল আমেদ না জালাল আহমেদ? কলকাতার বাঙালি বাবুরা তো আবার আমাদের বাঙালি মুুসলমানদের নাম ঠিকমত লিখতে পারেন না-জালাল আহমেদই তো হওয়ার কথা। আচ্ছা যাক, শংকর যেহেতু জালাল আমেদ উল্লেখ করেছেন, আমিও তাকে সে নামেই চিনব। কারণ, শংকর-এর এপার বাংলা ওপার বাংলা-র মাধ্যমেই তো তার সঙ্গে পরিচিত হলাম। সেই জালাল আমেদকে আমার একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। তার সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করছে। তিনি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আদৌ বেঁচে আছেন কীনা! শংকর তার এপার বাংলা ওপার বাংলা ভ্রমণ উপন্যাসটা লিখেছিলেনই তো আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে, দেশ তখনো স্বাধীন হয়নি, বাংলাদেশ নামের কোন দেশের অস্তিত্বই ছিল না। শংকর আমেরিকা সফর থেকে ফেরার পথে জাপান থেকেছিলেন কয়েকটা দিন। তাঁর ভাষ্যে ‘জালালের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বিকাশ বিশ্বাস। আর বিকাশের খবর দিয়েছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকার শ্রীসাগরময় ঘোষ। সাগরদা বলেছিলেন ইংলন্ড হয়ে যখন আমেরিকায় ভ্রমণে যাচ্ছো তখন ফেরার পথে জাপানে কয়েকটা দিন কাটাতে ভুলো না।’
তো, দেশ পত্রিকার টোকিও প্রতিনিধি সেই বিকাশ বিশ্বাসের বাসাতেই শংকরের পরিচয় হয়েছিল জালাল আমেদ-এর সঙ্গে। শংকর-এর বর্ণনা থেকেই জানা যাক, ‘এবার আসরে যার আবির্ভাব হলো তিনিই যে পূর্ব পাকিস্তানের জালাল আমেদ তা আমাকে না বলে দিলেও বুঝতে পারতাম। খাঁটি বাংলার উজ্জ্বল শ্যাম রঙ জালালের। বয়স বোধহয় তিরিশ-এর বিপজ্জনক রেখা স্পর্শ করতে চলেছে। বড়ো বড়ো দুটি চোখ সেই পদ্মের ইঙ্গিত যা বাঙালিকে বিচিত্র বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। নমস্কার করবার আগেই জালাল আমেদ দুটো বাংলা খবরের কাগজ এগিয়ে দিলেন। এই নিন আনন্দবাজার পত্রিকাÑ বহুদিন নিশ্চয় দেখেননি। কলকাতার সব খবর পেয়ে যাবেন। আর এইটে আমাদের ঢাকার দৈনিক সংবাদ।’ প্রথম সাক্ষাতেই যার এমন অন্তরঙ্গ সদাচারিতা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগে না। শংকরের বেলায়ও তাই হলো।
জালাল আমেদ অনেকভাবেই নিজের ঔদার্য মনের প্রকাশ দেখানোর পর একদিন শংকরকে জোর করে রেডিও জাপানে নিয়ে গেলেন একটি সাক্ষাৎকার নেবে বলে। স্বাভাবিকভাবেই শংকর তখন জানতে চাইলেন,‘আপনার সঙ্গে রেডিও জাপানের সম্পর্ক?’ জালাল আমেদের উত্তর,‘আমি রেডিও জাপানের বাংলা প্রোগ্রামের ভারপ্রাপ্ত। তাছাড়া আমি পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি। তবে এছাড়াও নিজের আদি কাজ আছে যার জন্য এতদিন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে জাপানে হাজির হয়েছিলাম। সে-সব গল্প সময়মতো বলব একদিন।’
সেই গল্পটি জালাল আমেদ করেছিলেন এক বিশেষ জায়গায় বিশেষ পরিবেশে। সেটা শংকর-এর বর্ণনা থেকেই শোনা ভালো। ‘বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ্যহীনভাবে ঘোরবার পর জালাল আমাকে একটা বাড়িতে নিয়ে গেলেন। লিফটে হু হু করে আমরা উপরে উঠে চলেছি। বহুতলা ওপরে রিভলভিং রেস্তোরাঁ। একটা পাক খেতে এক ঘণ্টা সময় লাগে। টেবিল অধিকার করলাম আমরা। জালাল বললেন, ‘ইংরেজিতে যাতে লুক-ডাউন-আপন বলে তা বাংলা মায়ের লেখকরা করেন না। কিন্তু এই উঁচু থেকে সমস্ত শহরের মোহিনী রূপ দেখাতে পারেন। আপনি শিল্পী লোক। আপনার দেখা উচিত। হয়তো কোনো নতুন অর্থ খুঁজে পাবেন।’
কফির অর্ডার দিয়ে আমরা নির্বাক হয়ে তুলনাহীনা টোকিওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাজার প্রাসাদের রাজকুমারীর বিবাহ উপলক্ষে যেন লক্ষ প্রদীপের সমারোহ!
জালালকে বললাম, ‘রেডিও জাপানে যে বাংলা বিভাগ আছে তা জানতাম না। আপনি এখানে কেমনভাবে জড়িয়ে পড়লেন?’ ‘সে এক গল্প।’ জালাল উত্তর দিলেন। ‘বলুন না শুনি।’ ‘আপনাকে আগেই বলেছি, আমি সাহিত্যের ছাত্র নই। পড়াশোনায় অবশ্য নেহাত খারাপ ছিলাম না। পরীক্ষা দিয়ে স্কলারশিপ পেলাম জাপানে মাইনিং এঞ্জিনিয়ারিং পড়বার জন্যে। আসলে আমি এখনও একজন খনিবিদ্যা বিশারদÑআর কিছু নই। জাপানে কিছুদিন থেকে শুনলামÑ রেডিও জাপানে পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার হয়।’
কফির কাপে চুমুক দিয়ে জালাল বললেন, ‘একটা আধটা নয়। ডজন ডজন ভাষা। অথচ আমাদের বাংলা ভাষার স্থান নেই। আমার ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগতো না। আামাদের বাংলা ভাষা বিশ্বের সেরা ভাষা, কেন স্থান হবে না তার জাপানে? ভাবতে ভাবতে মাথায় গোঁ চেপে গেলো। জানেন শংকরবাবু, মাথায় গোঁ চাপলে আমার আর জ্ঞানগম্যি থাকে না। রেডিও জাপানকে গিয়ে ধরলাম। ওঁদের কর্তৃপক্ষ বললেন, ‘সরকারি সূত্রে কোনো অনুরোধ এলে আমরা বিবেচনা করে দেখবো। তখন ইন্ডিয়ার কয়েকজন বাঙালিকে ধরলাম-যদি ইন্ডিয়ার এমব্যাসি থেকে চিঠি লেখানো যায়। কিন্তু ওঁরা বললেন, বাংলা ভাষার জন্য কিছু বলাটা প্রাদেশিকতাÑপ্রভিনসিয়ালিজম।’
‘তারপর।’ আমি প্রশ্ন করি।
‘তারপর খেয়াল হলো বগুড়ার মহম্মদ আলী পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছেন। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে ওকে এদিন পাকড়াও করলাম। ভদ্রলোক বাংলাভাষাকে সত্যি ভালবাসেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, লিখে দিচ্ছি।’
‘সেই চিঠি নিয়ে আবার ছুটলুম রেডিও অফিসে। কিছুদিন পরে আবার খবর নিয়ে জানলাম ওঁদের ইচ্ছে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলাপ করার। আবার মোহাম্মদ আলী সায়েব। টেলিফোেেন কথা হলো। বললেন, ‘বাংলায় প্রোগ্রাম করলে জাপান ও পূর্ব পাকিস্তানের মঙ্গল হবেÑ দুই দেশের মৈত্রবন্ধন দৃঢ়তর হবে। এবার ফল ফললো। এর জন্য কৃতিত্ব মোহম্মদ আলী সাহেবের এবং কিছু বাংলা প্রেমিক জাপানী পুরুষ ও মহিলার।’
দেখলাম, জালাল আমেদের চোখ দুটো নিজের মাতৃৃভাষার কথা বলতে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জালাল বলছেন, ‘ছোটো থেকে শুরু হয়। রেডিও জাপানের বাংলা প্রোগ্রাম আরও বাড়ানো হচ্ছে। শুনছি দু’ একজন জাপানী পন্ডিতের আগ্রহে এ বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা ভাষা চর্চা আরম্ভ হবে।’
আমি অবাক হয়ে জালালের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। শংকর-এর সেই অবাক হওয়াটা আমার মনেও সংক্রমিত হয়েছে। বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে, দেশের প্রতি, নিজের মায়ের ভাষার প্রতি এতোটা গভীর প্রেম আমাদের আছে বলেই তো আমরা বাঙালি, বাংলা ভাষার জন্য রাজপথে রক্ত ঢেলে দিতে পারি। এই যে তিনি বাংলা ভাষাকে জাপানে স্বমহিমায় স্বমর্যাদায় তুলে ধরেছেন, তুলে ধরতে অকৃত্রিম পরিশ্রম করেছেন, সাফল্য পেয়েছেনÑ সেজন্যে তাকে জানাই দূর থেকে অনেক কৃতজ্ঞতা। জানি না, এখন তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন- আদৌ বেঁচে আছেন কীনা, যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুনÑ তার প্রতি দূর থেকে অন্তরের এইটুকু শুভাশীষ।
জালাল আমেদকে চিনি না। তবে আরেকজন মানুষকে খুব চিনি, একজন কবি হিসেবে শিক্ষক হিসেবে, নেপথ্যের একজন নাট্যকর্মী হিসেবেÑ জিয়া হায়দার; নিউ ইয়র্কে যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল শংকরের, চাণক্য সেন ছদ্মনামের আড়ালে ভবানী সেনগুপ্ত লুকিয়ে আছেন যিনি, তিনি একদিন তাঁর অফিসঘরে এক তরুণ পূর্ব পাকিস্তানী লেখকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। শংকর জানাচ্ছেন তার সেই সময়কালীন পরিচয়, জিয়া হায়দার পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা আকাদেমীর সঙ্গে যুক্ত এবং এক স্কলারশিপে নাটক ও অভিনয় সংক্রান্ত বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্যে ওদেশে গিয়েছেন। শংকর লিখেছেন, ছেলেটির বড় কাব্যিক মন। বললো, ‘কাল রাত্রেও বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎ দেশের কথা মনে হতে লাগলো। বাবার শরীর খুব খারাপ, আমি বড় ছেলে, মা-ভাই বোনেরা হয়তো আমার মুখ চেয়ে বসে আছে। গ্রামের পথ, বাজার, নদীর ধার, আমাদের সেই ছোট বাড়িটাÑ সব মনের মধ্যে এসে হাজির হলো। যখনই এমন হয়, তখনই কাগজকলম নিয়ে কবিতা লিখতে বসি। আর কবিতা লিখলে একটা শ্রোতা চাই, তাই ভবানীদাকে বিরক্ত করি। ওর অসীম ধৈর্য্য, খুবই মন দিয়ে শোনেন। উৎসাহ দেন, আবার সমালোচনাও করেন।’
জিয়ার নতুন লেখা কবিতাটা প্রথম শোনার সৌভাগ্য আমারই হলো। শ্যামলী বাংলা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের ইস্পাত কঠিন শহরে এক প্রবাসী যুবকের ঘরে ফেরার কামনা। কতদিন হলো সে দেশ ছেড়েছে , গ্রামের কত না পরিবর্তন হয়েছে, বাবা হয়তো আরও বৃদ্ধ হয়েছেন, মার চুলে হয়তো পাক ধরেছে, আদরের ছোট বোনটা কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে প্রবেশ করেছে। শাড়িপরা মেয়েটার মধ্যে সেই ফ্রকপরা বোনটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি, যে আসবার সময় বলেছিল, দাদা...তুমি একটা মেম বিয়ে করে এনো। কবিতাটি অত্যন্ত আন্তরিক। কবির কল্পনায় জিয়া দেখছে তার ঘরে ফেরার দিন এসে গিয়েছে। সে এইমাত্র তার দেশের বাড়িতে মায়ের কাছে ফিরে এসেছে। পড়তে পড়তে জিয়ার চোখ দুটো সজল হয়ে উঠলো।
এ শুধু বাংলাতেই সম্ভব। সুদূর নিউ ইয়র্কে গিয়েও বাংলাকে, মাকে ভুলে যাননি যুবক জিয়া হায়দারÑসারাক্ষণই মন পড়ে থাকত দেশের বাড়িতে। অথচ সেই নিউ ইয়র্কে সেই আমেরিকায়Ñ ছেলেমেয়েরা একটু বড় হলেই স্বাবলম্বি হওয়ার নাম করে ওদেরকে ঠেলে বের করে দেওয়া হয় ঘরের বাইরে, আর সেই বাবা-মা ৬০ বছর পেরুলেই বৃদ্ধ হিসেবে অচল মানুষ হয়ে আশ্রয় খোঁজেন বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমে কাটান একা একা নিসঙ্গ সকরুণ জীবনÑ যেখানে মরলেও কেউ দেখতে আসে না, এমন কত সকরুণ জীবনকে ছেনে দেখেছেন শংকর, বর্ণনা করেছেন ছত্রে ছত্রে। সেখানে সেই পরিবেশে ঘরের জন্য বাবা-মা-ভাই-বোনের জন্য একজন জিয়া হায়দারের গভীর তীব্র আকুতি আমাদেরকে জাতি হিসেবে গৌরবান্বিতই করে, যেমন করে জাপানে জালাল আমেদের বাংলা ভাষার প্রতি অকৃত্রিম টান ও গভীর প্রেমের অনুভূতি। এসব হয়তো অজানাই থেকে যেত, শংকর-এর এপার বাংলা ওপার বাংলা বইটি না পড়লে, হয়তো এরকম কত জালাল আমেদ আর জিয়া হায়দারের মতো হৃদয় প্রবাসে প্রবাসে নিরবে-নিভৃতে দেখিয়ে চলেছে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠাÑ তাদের সবার প্রতি আমার এই বাংলা হৃদয়ের অশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি!