“তত্তচান মুখ কাত করা অবস্থায় নাম ফলকে লেখা আওয়াজ করে পড়লো, তোমোএ গাকুএন বিদ্যালয়। সে মাকে জিজ্ঞাসা করলো তোমোএ অর্থ কী? তখন তত্তচানের চোখে পড়লো এমন একটা জিনিস যাকে স্বপ্নে দেখেছে বলে তার মনে হলো। তত্তচান একটু নিচের দিকে ঝুঁকে গেটের গাছগুলোর ফাঁকের ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিলো। তত্তচান বিস্মিত হয়ে বললো ‘আমি দেখেছি’। সে মাকে জিজ্ঞাসা করলো,‘মা, এগুলো সত্যি রেলগাড়ি?’ খেলার মাঠে সারি সারি রেলগাড়ি।...রেলগাড়ির কামরায় ক্লাসঘর...। তত্তচানের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হলো।
রেলগাড়ির জানালা সকালের আলোতে ঝলমল করছিলো। উজ্জ্বল চোখে উঁকি দেয়া তত্তচানের গালও চকচক করছিল।
খারাপ মেয়ের অভিধা পেয়ে শিশুকালেই কয়েকটা স্কুল ছাড়তে হয়েছিলো তত্তচানের কিন্তু ওর কপাল ভালো ছিলো, একটা অসাধারণ মা পেয়েছিলো। মায়ের বদৌলতে পেয়েছিলো তোমোএ স্কুল আর তার হেডমাস্টার কোবাইয়াশি স্যারকে, যিনি শিশু তত্তচানের সাথে প্রথম সাক্ষাতে টানা চার ঘণ্টা গল্প শোনার পরও বলেছেন ‘আর নেই?’
তত্তচানের মনে হলো এটা খুব দুঃখের কথা যে তার সব কথা জানানোর এমন চমৎকার সুযোগ পেয়েও তার কথা শেষ হয়ে গেছে।”
তত্তচান আসলে কে?
তত্তচানের আসল নাম কুরোইয়ানাগি তেৎসুকো। ১৯৮০এর দশকে তিনি জাপানে সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপিকা ছিলেন। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় বাল্যস্মৃতিমূলক গ্রন্থ ‘জানালার ধারে তত্তচান’। কয়েক বছরের মধ্যে বইটির ষাট লাখ কপি বিক্রি হয়ে বেস্টসেলারের মর্যাদা পায় জাপানে। জাপানের প্রকাশনা জগতে এটি একটি রেকর্ড।
বইটির অনুবাদকও একজন জাপানি, হিরোকো কাসুইয়া মুখবন্ধে জানান, ‘এটি কোনো জটিল ও অসামান্য চিন্তাভাবনায় পরিপূর্ণ বই নয়, এটি একটি ছোটমেয়ের স্কুল জীবনের কাহিনি। ওই মেয়ে মেধাবী ছিলো না, প্রথাগত ভাবে যে-সব মেয়েকে ভালো বলা হয়, সে তা ছিলো না। সে ছিলো একটু অস্বাভাবিক, যে খুব কথা বলতে ভালোবাসত, সবার সঙ্গে মেলামেশা করতে পারত না, কিন্তু যাকে ভালো লাগত, তার জন্য সব কিছু উজাড় করে দিতে পারতো।... প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় তত্তচান ‘খারাপ মেয়ে’ হিসাবে বহিস্কৃত হয় তার স্কুল থেকে। তার মা অনেক খোঁজ করে একটি অভিনব স্কুল পান। সে স্কুলে তত্তচানকে ভর্তি করে দেন। ওই স্কুলের নাম তোমোএ বিদ্যালয়। তত্তচান যেমন অদ্ভূত ও অসাধারণ, ওই স্কুলটিও অদ্ভূত ও অসাধারণ। এই স্কুলে সাধারণ কোনো স্কুলঘর ছিলো না। ছিলো ছয়টা ট্রেনের বগি, সেখানেই ক্লাস হতো। পড়াশোনা যে কতটা আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে পারে তা তত্তচান এ মরা ট্রেনের বগীর ক্লাসের মধ্যে খুঁজে পায়। কিন্তু যিনি তত্তচানের জীবনকে বদলে দেন, পতন থেকে রক্ষা করেন, তিনি তোমোএ স্কুলের প্রধান শিক্ষক কোবাইয়াশি সোসাকু।’
তত্তচান প্রকারান্তরে এই বইতে তার প্রিয় শিক্ষকের প্রতিই গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, যিনি তার ও তার মতো আরো আরো ছাত্রছাত্রীদের জীবন সত্যিকারে বিকশিত করে তুলেছিলেন। যাঁর বিশ্বাস ছিলো প্রতিটি শিশুই কোনো না কোনো সদগুণ নিয়ে জন্ম নেয়, বাধা না পেলে বিকশিত হয়ে উঠবেই। আর বিকশিত হওয়ার পথে বাধা প্রতিবেশ ও বয়স্করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তোমোএ বিদ্যালয় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় কিন্তু বিধ্বস্ত হলেও বিনষ্ট হয় না প্রধান শিক্ষকের স্বপ্নের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বুনে দেয়া ফসল।
তত্তচানের জন্ম টোকিওতে, বাবা ছিলেন বেহালা বাদক ও অর্কেস্ট্রা প্রধান। বাবার প্রভাবেই হয়ত শিশু বয়সে তত্তচান বেহালা বাদক হতে চায় এমনকি একদা রাস্তার বেহালা বাদককে ( চিন্দোন্ইয়া-সান) স্কুলে ডেকে এনে বাদন কাজ চালাতে বলে স্কুলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটায়, যা কিনা তাকে স্কুল থেকে তাড়ানোর একটা বিশেষ কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ( স্কুলে জানালার কাছে বসে পাখিদের সাথে কথা বলা, ডেস্ক বার বার সশব্দে খোলা বন্ধ করাও স্কুল থেকে তাড়ানোর কারণ হয়েছে)। তত্তচান অনেক কিছুই হতে চেয়েছে জীবনে, ট্রেনের টিকেট চেকার পেশাটি যখন তার পছন্দ হলো তখন সে ঠিক করেছিল গোয়েন্দাগিরির পেশাটাকে অব্যাহত রাখার কাজে সে টিকেটচেকারের কাজটাও করতে পারে, এসব সবই তার শিশু বয়সের স্বপ্ন।
স্কুল নিয়ে তার এত এত সমস্যা, মানে ঘন ঘন স্কুল থেকে বিতাড়ন তার শিশুমনে উপর কুপ্রভাব না ফেলার কারণ তার আপাতঃ নির্বুদ্ধিতা আর তার মায়ের তাকে আগলে রাখার অসাধারণ ধৈর্য ও দক্ষতা এবং প্রাণ অবদমিত কি অবনমিত হওয়ার আগেই তোমোএ স্কুল পেয়ে যাওয়া। ফলস্বরূপ তত্তচানের বিশাল সাফল্য। তিনি প্রথম এশিয়, এশিয়ার ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হয়ে সারা এশিয়া সফর করে শিশুদের জন্য কাজ করার সুযোগ পান। আর ‘জানালার ধারে তত্তচান’ বিক্রিলব্ধ অর্থ দিয়ে গড়ে তোলেন ‘তত্ত ফাউন্ডেশান’, এ ফাউন্ডেশান ‘জাপান বধির অভিনেতা সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠা করে।
আশির দশকে তেৎসুকো ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হয়ে বাংলাদেশে আসেন। যতদূর মনে পড়ে আমাদের সামরিক সরকারের সাথে দেখা করেন এবং বাংলা একাডেমি থেকে বাংলায় অনুদিত তাঁর গ্রন্থখানি সরকার প্রধানের হাতে দেন।
‘জানালার ধারে তত্তচান’ বইটি বাংলা একাডেমি থেকে বের হওয়ার পর এটা নিয়ে কতটা আলোচনা হয়েছে আমি জানি না। হয়ত হয়েছে, আমি স্বল্প পড়–য়া মানুষ, চোখে পড়েনি। আমি নিজে এই বইটি পড়ি নব্বইয়ের ফেব্রয়ারিতে, পড়ে অভিভূত হই। তার আগের বছর থেকে আমি শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হই, সে কারণেও বইটি আমার কাছে বিশেষভাবে ধরা দেয়। এখন আমার ছাব্বিশ বছরের শিক্ষকতার জীবনে স্কুল থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত যত হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছি ( পড়ান যায় না, যৎসামান্য পড়তে সহযোগিতা করা) তাদের সকলের সাথে এই বইয়ের গল্প বলেছি, তারা অভিভূত হয়ে তত্তচানের গল্প, তোমোএ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের গল্প শুনেছে। কেউ কেউ এমন স্কুল কেনো আমাদের নেই সে কথা বলতে গিয়ে বিমর্ষ হয়েছে।
সঙ্গীত আর কৃষি যে জীবনের প্রাণ, আমাদের সন্তানেরা জানে না। জানে না বলেই জীবনে কোনো ছন্দ নেই। আমরা শিক্ষক নামে অশিক্ষক, আমাদেরই কি ছন্দ আছে মনে প্রাণে দেহে? কখনো তাদের প্রাণের স্পন্দনটুকু শোনার চেষ্টা করেছি কি! আমাদের প্রধান শিক্ষক কখনো আমাদের ডেকে বলেন নি, ছেলেমেয়েরা তোমার পিয়ানোর তালের মতো হাঁটে না। মানে শিক্ষক যদি তার ছেলেমেয়েদের শ্বাসপ্রশ্বাস কেমন তা না জানে তো পড়াবে কেমন করে!
আমি নিজে আজিমপুর গার্লস স্কুলের ছাত্রী, ৬৭ থেকে ৭৮ পর্যন্ত এক নাগাড়ে পড়েছি, ৭৯তে আমার এসএসসি। ক্লাস থ্রিতে দু’বছর পড়েছি। টাইফয়েড হওয়ার কারণে থ্রি থেকে ফোরে উঠতে পারিনি প্রথম বছর, পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আমার মনে আছে থ্রিতে দ্বিতীয় বছরে প্রথম তিন মাসে আমি রোজ ইংরেজি ক্লাসে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার ইংরেজি শিক্ষক সাহিদা আপা আমাকে স্কুল ছুটির পর আটকে রেখে পড়া করাতেন আরো দু’একটা মেয়ের সাথে। তাকে আমার একজন নির্দয় নিষ্ঠুর মানুষ ছাড়া কিছুই মনে হতো না। তিনি কোনো দিন আমার কাছে কিংবা আমার পরিবারের কাছে জানতে চাননি মেয়েটির কী সমস্যা। প্রবল জ্বর আমার কি ক্ষতি করে গেছে সে খবর বাবামা জানতেন, বলতেন মেয়েটি বেঁচে আছে তাতেই আমরা খুশি। মা অনেক পরে বলতেন, মেয়েকে পানি আনতে বললে পান নিয়ে আসত, কোনো দিন বই নিয়ে বসাতে পারবো সেই আশাই তো ছেড়ে দিছিলাম! কপাল ভালো, মার্চে যুদ্ধ লেগে গেলে আমি রেহাই পাই। কিন্তু স্কুলের শাসন আমার পড়ার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাতে সাহায্য করলেও আমার প্রাণটুকু পুরোপুরি কেড়ে নিতে পারেনি শুধু মাত্র স্কুল প্রাঙ্গণের বিশাল মাঠের কারণে আর স্কুল রুটিনের অসাধারণ কিছু ক্লাসের কারণে।
আমি জানি না আজিমপুর স্কুলের মত এত বড় মাঠ আর কয়টা প্রাইভেট ( এখন সরকারি) স্কুলে সে সময় ছিল। মাঠ থাকলেও এমন উদার মাঠ? যার মাঝখানে একটা বিশাল ফুলকড়ই গাছ, যার বিস্তৃত শিকড়গুলো ছিলো আমাদের ব্যাগ রাখার উত্তম জায়গা। শিকড়ে ব্যাগ রেখে সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়াতাম। আর ফুলকড়ইয়ের হালকা সবুজাভ হলুদ ফুলগুলোকে পাফ বানিয়ে পরস্পর গালে বুলিয়ে রেণুতে মাখামাখি হয়ে হাহা হিহি..., আহা! সারা বছর সেই মাঠের উপরের উদার আকাশ কত কত রঙে আমাদের মনের উপর আলো ফেলত! কোন ঋতু কেমন আলো কোন ছন্দের বাতাস নিয়ে আমাদের মনে মধুর আবেশ দিয়েছে? বিস্ময়, আজো মনে আছে বৈশাখের প্রথম ঝড়বৃষ্টির পর দিন গিয়ে দেখতাম সারা মাঠ এখানে ওখানে পানি। আকাশে হালকা মেঘের উদাস চলাচল, জলমগ্ন ঘাসে ছপছপ পা ফেলে খেলে বেড়িয়েছি। আর শীতের শেষে বৃষ্টি হলে পরদিন গিয়ে দেখতাম মাঠে এখানে ওখানে ঢিবি, মরা ঘাসের ঢিবি, তাই দিয়ে ঘর বানাই, বাগান বানাই, মাঠ বানাই। কোন ভাষায় লিখলে সেই আকাশ বাতাস মাঠ আর ফুলকড়ইয়ের বর্ণনা দেয়া যায়? আমার প্রিয় অভিনেতা কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আকাশবাণীতে একবার একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যে শিশুটির সামনে একটি উদার মাঠ নেই তার কাছে তোমরা কি আশা কর?’ বাক্যটি নিয়ে আমি একটা পুস্তক রচনা করতে পারি, আমার মতো আরো অনেকেই পারেন। কারণ আমাদের দীর্ঘ এক শৈশব ছিলো। একবার শরতের এক বিকেলে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছি দেখি গভীর নীল আকাশের নিচে সাদা মেঘ, মনে হয়েছিল ছাদে গেলেই ধরতে পরবো, এত নিচে! ব্যাপারটা আজো আমার কাছে অলৌকিক মনে হয়। শরতের মেঘ কেনো এত নিচে নামে! আর আমার স্কুলের বিশাল বাগান! নানা ঋতুতে নানা ফুলের উদ্যান নাকি বেহেস্তের এক টুকরা! শুধু বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। বাগানের বেড়ায় বিষল্যাকরণীর ফুলের সাদা সাদা ফুল ছিঁড়ে মধু পান ছিল নিত্যকর্ম। নিত্য খেতাম ছোটজবার (কলকে জবা) মধুও। আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম আমাদের বাসার সামনেও স্কুলের মতো বিশাল মাঠ ছিল জহুরুল হক হলের আর ছিল সমৃদ্ধ বাগান, যে বাগানের ফুল চুরি ছিল আমার নিত্যকর্ম।
বলছিলাম স্কুলের রুটিনের কথা। ক্লাস ফোর থেকে আমাদের যে রুটিন ছিলো তাতে সপ্তাহে একদিন করে লাইব্রেরি আর সঙ্গীত ক্লাস ছিল, ছিল দু’দিন ড্রিল ক্লাস। এই ক্লাসগুলোর দিন আমাদের প্রাণে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। এই ক্লাসগুলো ক্লাস ছিলো না, ছিল স্বর্গ, বেহেস্ত! সঙ্গীত শিক্ষক মফিজ স্যার আমাদের গান শেখাতেন যদিও তিনি বড়দের গান শেখাতে বেশি পছন্দ করতেন। কারণ আমাদের স্কুলে সারা বছর কিছু না কিছু অনুষ্ঠান লেগেই থাকত, রিহার্সেলের প্রয়োজন হতো। অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ আড়ম্বরতা ছিলো না, সেটা আজ বুঝি কিন্তু তখন এর চেয়ে জাঁকজমক কিছু হতে পারে বলে মনে হতো না। স্কুলের লম্বা-চওড়া বারান্দায় স্টেজ আর সামনে বিশাল মাঠে আমরা শতরঞ্জিতে বসে দর্শক, হাজার হাজার ছাত্রী। নাচেগানে অভিনয়ে জমাটি অনুষ্ঠান। আমাদের মতো খারাপ ছাত্রদের প্রাণ সে কারণেই বেঁচে গেছে সেকালে। শুধু বোর্ডের পরীক্ষাতেই আজিমপুর স্কুল প্রথম ছিল না, আন্তঃস্কুল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা কি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও আমরাই চাম্পিয়ন ছিলাম। প্রসঙ্গত বলি, ১৯৭২এ আমাদের স্কুল বার্ষিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার দেয়া হয় না, পুরস্কারের টাকায় যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ পাঠিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। আর পুরস্কার পুষিয়ে দিলো দারুণভাবে। বঙ্গবন্ধু এলেন পুরস্কার দিতে, হ্যান্ডশেক করে হাতে দিলেন পুরস্কার, সার্টিফিকেট। আমি অভিভূত হয়ে তাঁকে দেখছিলাম! মানুষ এত সুন্দর হয়!
তো গান শেখার জন্য আমরা অনেকটা ভিখিরির মত দাঁড়িয়ে থাকতাম সঙ্গীত রুমের কাছে, অধিকার থাকা সত্ত্বেও। তিনি আমাদের বলতেন, তোদের তো বোলই ফোটেনি, গান শিখবি কি! আমরা প্রাণপণ গান মুখস্ত করে যেতাম “খেলিছে জল দেবী, সুনীলও সাগর জলে, তরঙ্গ লহরও তুলে, লীলাইত কুন্তলে...জলছল উর্মি নূপুর... কিংবা ‘যদি বারণ কর তবে গাহিব না’ কিংবা ‘আমার গানের মালা আমি করবো কারে দান’। স্যারকে বলতাম, আমরা সব মুখস্ত করে এসেছি, আপনি মুখস্ত ধরুন! স্যার পান খাওয়া মুখে হেসে ফেলে হারমোনিয়ামে হাত রাখতেন, এক মুহূর্তে চল্লিশ মিনিটের ক্লাসটা শেষ হয়ে যেত, সত্যি!
সুষমাদি ক্লাস ফোরে আমাদের ক্লাস টিচার, পড়ান ইংরেজি, সময়টা ১৯৭২। সব শিক্ষককে বলতাম স্যার, কি আপা কিন্তু তিনি দিদি। বয়স্ক অথচ হাসিখুশি মিষ্টভাষী। আঁটসাট করে শাড়ি পরতেন পায়ে পাম্পসু (সে কালে মহিলারা কেউ শাড়ির সাথে পাম্পসু পরতেন না)। এমন এক মাধুরী তাঁর অবয়বে, তার পড়া না করে স্কুলে কে আসবে? চুল খুলে আসলে মিষ্টি করে বলতেন, মাকে বলবি দুটো বিনুনি করে দিতে। আমি সেই প্রথম শিখি বিনুনি মানে বেণী। সত্যিকারের শিক্ষকের একটা শব্দও কত খাঁটি! সিক্সে উঠে পাই বাংলায় রাফিয়া আপাকে, সময় ১৯৭৪, বুদ্ধদেব বসু মারা গেলে তিনি পাঠ্য কবিতার সিরিয়াল ভেঙে ‘নদীর স্বপ্ন’ পড়িয়ে আমাদের ভিতর পদ্মায় ঘুরে বেড়ানো রুপোলী ইলিশের স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন বড় হলে জানবি, তিনি কত বড় কবি ছিলেন..। আসলে তো শিক্ষকই পারেন স্বপ্ন বুনে দিতে, বইয়ের পড়া কয়টা তিনি পড়াবেন? তার চেয়ে স্বপ্নটা বুনে দিলে, মনোজগতটা তৈরি করে দিলেই তো ইঞ্জিন চালু হয়ে যায়!
আজকের দিনে একজন নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রকে যত বিষয়ে পড়াশোনা করতে হয় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে কি বহির্বিশ্বের প্ররোচনায়, তাতে ছাত্রছাত্রীর আর যা হোক প্রাণবায়ু সে চাপে যায় আসে! তাদের কোনো দিন শৈশব ছিলো না, কৈশোরও ছিলো না, থাকতেও নেই। শিশুকালের পরেই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সে, ‘সবাই পারে তুমি কেন পারো না!’ জন্মেই এক বিষাদ জীবনভার পালন করে চলে স্কুলপাঠ্য নিয়ে। কি প্রতিভা, কোথায় প্রতিভা এ সব সন্ধান করতে চাইলে তাকে পাগল ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না এখন। একটা সন্তানকে এইভাবে আর যা হোক মানুষ করা যায় না। যেখানে সঙ্গীত নেই যেখানে কৃষি নেই সেটাকে সত্যিকার মানুষের জীবন বলা যায় কি? এ মানুষকে দিয়ে না নিজের মঙ্গল, না দেশের দশের মঙ্গল। নাচগান বৃক্ষবাগান খোলামাঠ উন্মুক্ত আকাশ এসব দিলে এমনি মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে, কেবল পিঠ ভর্তি বই দিলে ভারবাহী জানোয়ারের মতো নির্বুদ্ধি প্রাণীই তৈরি হয়।