আমি জল এবং বৃক্ষের প্রতি বড় দুর্বল। জল ভালবাসি বলেই বৃষ্টি, নদী, সাগর এমনকি এ্যাকুরিয়ামও ভালবাসি। একটা ডাব কাটতে দেখলে আমি চলতি পথে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাই। যতক্ষণ না ডাব থেকে টলটলে পানি বের হয়ে আসে ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করি। তারপর আবার হাঁটতে থাকি আপন পথে। মাঝে মাঝে ভাবি, বৃষ্টির ফোঁটায় যদি জল না থেকে অন্য কিছু থাকতো তবে নিশ্চিতভাবেই আমি বৃষ্টি ভালবাসতাম না। দীর্ঘজীবন স্যাঁতস্যাঁতে পানিতে বাস করা অসহায় বস্তিবাসীর মতো আকাশে মেঘ দেখলে, কপাল কুঁচকে তাকাতাম। আমার এই জলপ্রেম সম্ভবত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আমি আজন্ম শহরের মানুষ হলেও আমার পূর্বপুরুষরা ছিল ছয়মাস জলমগ্ন এলাকার মানুষ। জলের সাথে পূর্বপুরুষদের দীর্ঘদিনের বাস আমার মস্তিষ্কের অন্দর মহলে ভালবাসার বীজ রোপণ করে দিয়েছে। সেই বীজ থেকে বের হওয়া ভালবাসার গাছটি দালান কোঠার মাঝে বাস করা আমার মধ্যে জলের প্রতি অনুরাগ ধরে রেখেছে।
আমার পূর্ব পুরুষরা যদি জলচর হয়ে থাক তবে ইরিনার পূর্ব পুরুষ ছিল বৃক্ষচারী। এ কারণে তার মন-প্রাণ জুড়ে থাকতো কেবল বৃক্ষ। বৃক্ষের প্রতি আমার যে প্রেমÑ তা সংক্রামিত হয়েছিল ইরিনার কাছ থেকে। ধানমন্ডি লেকের পাশেই যে কত শত ধরনের বৃক্ষ আছে তা আমার জানা ছিল না। ইরিনার সাথে পরিচয় না হলে মজাদার ফল আর বাহারি ফুলের বৃক্ষ ছাড়াও যে এই বাংলাদেশে আরো কত রকমের বৃক্ষ আছেÑ তা আমার অজানাই থেকে যেত। কত দিন প্রখর রোদে, সূর্যকে ফাঁকি দিতে, কত গাছের নিচে দাঁড়িয়েছি । কতদিন টিপ টিপ বৃষ্টির মাঝে পাতাময় বৃক্ষের নিচে আশ্রয় নিয়ে বড় দৌড়ের প্রস্তুতি নিয়েছি কিš‘ সেই গাছগুলোর উপর মনোনিবেশ করার সময় হয়নি। কোন্ গাছের নীচে দাঁড়িয়েছি? তার পাতা কেমন? কোথায় তার ডাল-পালার শুরু? কোথায়ই-বা শেষ? তা আমার ভাবনার উপযুক্ত বলে বিবেচনা করিনি। সুস্বাদু কোন ফল দেয় না, বাহারি কোন ফুল হয় না Ñ এমন গাছগুলো শুধু ’বৃক্ষ’ হয়েই আমার জীবনে থেকে যেত পারতো। কিন্তু ইরিনার কল্যাণে তা হয়নি। বৃক্ষের পাতা, ডাল, খাওয়ার অযোগ্য ফল কিংবা বর্ণহীন ফুলও যে দেখার মতো একটা বিষয় তা ইরিনা আমাকে শিখিয়েছিল। ইরিনাকে একদিন জিজ্ঞেস করছিলাম, ‘তুমি এত এত বৃক্ষ চিনো কি করে?’
ইরিনা হাসত হাসতে বলেছিল, ‘বৃক্ষ-দেবতার সাথে আমার এক সময় ভাব ছিল। সেই দেবতা আমাকে চিনিয়েছে।’
আমার আর সত্য-মিথ্যা নিরূপনের সাহস হয়নি। দেবতার বেশে থাকা পেছন জীবনে ফেলে আসা ইরিনার কোন এক অদৃশ্য প্রেমিককে কল্পনা করে আমি কষ্ট পেয়েছি। ধানমন্ডি লেকের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি একটা ছায়াকে আমাদের সাথে নিভৃতে হাঁটতে দেখেছি বহুবার। ইরিনার ভালবাসা পেতে, একটা অদৃশ্য ছায়াকে মুছে দিতে আমিও বৃক্ষকে আঁকড়ে ধরেছিলাম। ইরিনাকে ভালবাসার বন্ধনে আরো দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করতে বৃক্ষ, বৃক্ষের পাতা, বৃক্ষের শেকড়ের গভীরতা মেপে মেপে আমি অনেকগুলো দিন কাটিয়েছি। কিন্তু ইরিনা যেমন সেই বৃক্ষ-দেবতাকে ধরে রাখতে পারেনি, আমিও তেমনি পারিনি ইরিনাকে ধরে রাখতে। এক বছরের বেশি কিছু সময় আমার সাথে কাটিয়ে একদিন ইরিনা আমাকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিল। আমি বেশ ক’দিন ইরিনার কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ওদের বাসায় যেয়ে হাজির হয়েছিলাম। তার মা খুব অবাক হয়ে বলেছিল, ’ওতো জার্মানী চলে গেছে সপ্তাখানেক হলো।’
আমি বিস্মিত হয়ে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। মানুষ এমন হয়! একটা জলজ্যান্ত মানুষকে আরেকটা মানুষ এভাবেও উপেক্ষা করতে পারে? ইরিনা যদি আমাকে ভালবাসতে না পারার কথাটা জানিয়ে অন্য কারো হাত ধরে চলে যেত তাতেও আমি এতটা কষ্ট পেতাম না। যতটা পেয়েছিলাম তার উপেক্ষায়। এরপর থেকে অনেকদিন আমি ইরিনাকে যেমন ঘৃণা করতে চেয়েছি তেমনি ঘৃণা করতে চেয়েছি এই পৃথিবীর সব বৃক্ষকে। ইরিনার প্রস্থানের পর অনেকদিন বৃক্ষের দিকে তাকালে আমি তাতে প্রাণের স্পন্দন পেতাম না। বৃক্ষকে আমার পাথর কেটে বানানো এক একটি ভাস্কর্য ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না। জগদীশ চন্দ্র বসু যে গাছের মধ্যে প্রাণ থাকার ধারণা প্রকাশ করে মানুষকে কত বড় প্রতারণা করে গেছেÑ তা জানানোর জন্য নতুন করে উদ্ভিদ বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করারও ইচ্ছে জেগেছিল কিন্তু কোন ইচ্ছেই পূর্ণ হয়নি। ইরিনাকে আমি একদিন সত্যি সত্যিই ভুলে যেতে পেরেছিলাম। তবে আরো অনেক দেরীতে। কিন্তু ইরিনার সাথে ভনিতা করতে করতে বৃক্ষকে আমি সত্যি সত্যি-ই ভালবেসে ফেলেছি। জীবনের চলার পথে প্রায় প্রতিদিনই আমি সেই ভালবাসার প্রমাণ পাই।
২
পেশাগত কারণে আমাকে এক সময় ইচ্ছের বিরূদ্ধে ঘন ঘন কারাগারে যেতে হতো। প্রতিবার কারাগারে গেলেই এক ধরনের অস্বস্তিবোধ কাজ করতো। বিশাল তালা খুলে যখন ভেতরে ঢুকতাম তখন কেন যেন মনে হতো, আমি যখন বের হতে চাইবো তখন তালা খুলবার জন্য আর কাউকেই পাবো না। বিচার শেষের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে যেমন মানুষ নিঃশেষ হয়ে যায় তেমনি তালা খোলার অপেক্ষা করতে করতে আমিও নিঃশেষ হয়ে যাবো একদিন। যদি বের হবার সময় তালা খোলার জন্য কাউকে না পাই তবে যেন অন্তত চিৎকার করে একটা নাম ধরে ডাকতে পারি সেজন্য প্রতিবার কারা ফটক অতিক্রমের সময় আমি অবচেতন মনে প্রধান কারারক্ষীর বুকে ঝুলানো নাম ফলকটি বারবার দেখে নিতাম। যদিও এমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা একদমই ছিল না তবুও আমি যতটা দ্রুত সম্ভব কারাগারের ভেতরের প্রশাসনিক কাজ শেষ করে বের হয়ে আসতাম। প্রতিবার বের হয়ে এলে এক ধরনের স্বস্তিবোধ করতাম।
বছর পাঁচেক আগে শেষবার, দাপ্তরিক কাজে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি প্রিজনের অফিস কক্ষে গিয়েছিলাম। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের দেয়াল ঘেঁষেই ছিল সেই অফিস কক্ষ। দুপুরের খাবার শেষে কিছুটা সময় পায়চারী করছিলাম কারাগারের মূল দালানের পাশ ঘেঁষে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে দেখছিলাম, লাল দালানের ফাঁকে ফাঁকে নির্দিষ্ট বিরতির পর সাজানো নীল জানালাগুলো। অধিকাংশ ছোট ছোট কাঠের জানালার শিকগুলোর ঐপাশটা ছিল শূন্য। আমরা যেমন মনে করি, জেলখানার মানুষেরা সারাদিন মুক্ত পৃথিবীর দিকে হা-করে তাকিয়ে থাকে তেমনটা মনে হয়নি। দু’চারটি জানালায় ছিল মানুষের মুখ। সেই সব মানুষদের কেউ কেউ ছিল উদাস। কেউ হয়তো অন্য জানালার কোন মানুষদের সাথে ইশারায় কথা বলছিল। কোন একটা জানালায় একজন আরেকজনকে দূর আকাশে কাটাকাটি খেলায় মত্ত দুটি ঘুড়ি দেখাচ্ছিল। বন্দিদের মুখ খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎই নজরে পড়েছিল এক জানালার শিকে বাঁধা এক টুকরো কাঠ । সেই লম্বা কাঠের টুকরোর উপর পানিপূর্ণ একটি বড় বোতল। বোতলের মুখ কেটে তাতে লাগানো হয়েছে একটি ছোট গাছ। বোতলের ভেতরের অল্প মাটিতে জায়গা করে নেয়া শেকড়ের তুলনায় পাতাগুলো অনেক বড় আর উজ্জ্বল মনে হয়েছিল। কী গাছ? অত দূর থেকে বুঝে উঠতে পারিনি। আমি অনুভব করেছিলাম, পরিবার পরিজন ছেড়ে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি মানুষদের নিজস্ব বলে কিছু থাকে না। কিন্তু অন্য বন্দিদের সাথে ঐ বন্দিটির পার্থক্য এই যে, তার একটি নিজস্ব বৃক্ষ আছে। হয়তো ঐ গাছটিই তার একাকিত্বের সঙ্গী। বন্দিত্বের দিনগুলোতে একটু আপন করে নিতে একটা গাছ পুষতে চাওয়া সেই বন্দি মানুষটির সাথে পরিচিত হতে খুব ইচ্ছে করেছিল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কারারক্ষীকে বলেছিলাম, ‘ঐ গাছের মালিকের সাথে দেখা করা যাবে?’
সে মুখ বাঁকা করে বলেছিল, ’ যাবজ্জীবন মামলার আসামী। দেহা কইরা কি করবেন, স্যার?’
আমিও মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিয়েছিলাম। লোকটিকে ডেকে এনে কি বলবো? বৃক্ষ কেন ভালবাসেন? এ ধরনের কাব্যিক ভাবনা আমাদের পেশাগত জীবনের সাথে বড় বেমানান। তবে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া আসামীর বৃক্ষপ্রেম আমাকে স্পর্শ করেছিল খুব। বিকেল বেলা কাজ শেষ করে ফেরার পথে গাড়িতে উঠতে উঠতে আবার তাকিয়েছিলাম সে জানালায়। দেখেছিলাম সেই বন্দি খুব যতেœর সাথে বোতলটি সরিয়ে নিয়ে কাঠের টুকরোটি খুলে নিচ্ছে জানালা থেকে। খাবার শেষ হওয়ার পর টেবিল গুছানোর মতো বিষয় যেন। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই সেই বন্দি লাজুক একটা হাসি দিয়েছিল। তার হাসি বলে দিচ্ছিল, হাতে যার গ্রেনেড থাকার কথা, সে ভুল করে একটা গাছ তুলে নিয়ে বড় লজ্জার কাজ করেছে।
নাজিমুদ্দিন রোড ধরে বের হতে হতে নাম না-জানা সেই বৃক্ষের সূত্রে ইরিনার কথা মনে পড়েছিল। ইরিনা ঠিক ঠিক বলে দিতে পারতো। গাছের কি নাম? কত বছর বাঁচে। এমনকি হয়তো বৈজ্ঞানিক নামটিও। ইরিনার সাথে যোগাযোগের একটা উপায় থাকলে আমি ভালো না বেসেও ছাত্রের মতো করে জানতে চাইতাম, কী সেই গাছ? কিন্তু ইরিনা সেই রাস্তাটাও বন্ধ করে রেখেছে। সেইবার আমার মনে হয়েছিল, আমার মধ্যে বৃক্ষপ্রেম ঢুকিয়ে দিয়ে কোন এক কানাগলিতে আমাকে রেখে চলে গেছে ইরিনা। আমি এই গলি থেকে কোনদিনই বের হতে পারবো না।
আরো একবার আমি খুব অসহায় বোধ করেছিলাম, হাওড়ের জলে ভাসতে ভাসতে। বৃক্ষ না চেনার জন্য নয়। বৃক্ষের গল্পটি ইরিনাকে না বলতে পারার জন্য। তখন বর্ষার হাওড় ছিল উত্তাল। ধর্মপাশার রাজাপুর গ্রাম পার হয়ে সুরমায় পড়েছি মাত্র। এ সময় স্পীডবোটটি হঠাৎ করে অচল হয়ে জলে ভাসছিল। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। ঢেউয়ের আঘাতে স্পীডবোট এক দিকে কাত হয়েছিল। পরিস্থিতি বিপদসংকুল হলেও কর্তব্যের খাতিরে জেলা শহরে যেতেই হবে। স্পীডবোট চালক ওয়াসিম বারবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বোটটিকে সচল করার জন্য। আর আমি হাওড়ের জলে ভাসতে ভাসতে দেখছিলাম দূরের গ্রাম, তটরেখা আর হঠাৎ হঠাৎ উড়ে যাওয়া কিছু পাখি। আমাকে ভাসমান রেখেই খুব ধীর গতিতে অতিক্রম করে যাচ্ছিল কখনো ব্যবসায়ী নৌকা, কখনো জেলে নৌকা এবং ক্ষণে ক্ষণে বালু ভর্তি একটির পর একটি ট্রলার। চলতি বা যাদু নদী থেকে তুলে আনা বালু ঐ পথ দিয়েই চলে যায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ কিংবা ভৈরব। জলে ডুবে যাবার আগ পর্যন্ত ট্রলারের খোলের ভেতর বালু ঢুকানো চলতেই থাকে। ফলে ট্রলারের পুরো শরীরই পানির নিচে প্রায় ডুবো ডুবো হয়ে থাকে। শুধু ট্রলারের একপাশে একটা ঘর থাকে মাথা উঁচু করে। সেই উঁচু ঘরটিতে ট্রলারের মাঝি-মাল্লারা থাকে। সেখানে তারা ভাত খায়, ঘুম দেয়। নদী থেকে জল তুলে গোসল করে। তাদের শরীরে মাখা সাবানের ফেনা জলের সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে আবার জলেই মিশে যায়। আমাদের স্পীড বোটটিকে অতিক্রম করতে থাকা ট্রলারগুলোকে দেখতে দেখতে একসময় বড় একঘেঁয়ে মনে হচ্ছিল।
এ সময়েই একটি ট্রলারের উঁচু ছাদে আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল। আমাকে অতিক্রম করার সময় দেখেছিলাম, ট্রলারের মাথা উঁচু ঘরটার ছাদে একটা বড় স্টীলের ড্রাম। সেই ড্রামের মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে এসেছে একটা ঝিঙ্গে গাছ। লতানো গাছটিকে ডালপালা বিস্তৃত করে দেয়ার জন্য ট্রলারের ছাদেই যতœ করে একটা ছোট মাঁচা বেঁধে দিয়েছে গাছের মালিক। ড্রামের মাটি থেকে বের হয়ে ঝিঙ্গে গাছটি সেই যতœ করে বাঁধা মাচার উপর খুব বলিষ্ঠভাবে ঝুলে আছে। গুটি কয়েক ফুল আর একটা শিশু ঝিঙ্গের জন্ম দিয়ে নিজের তৃপ্তির প্রকাশও ঘটিয়েছে ঝিঙ্গে গাছটি।
আমি জলের নিচ থেকে বিশাল আকারের কোন বোয়াল কিংবা চিতল মাছকে স্পীডবোটের উপর লাফিয়ে উঠতে দেখলে কিংবা মানুষকে চিরকাল অবিশ্বাস করে আসা কোন এক পানকৌড়িকে আমার কাঁধে এসে বসলে যতটা অবাক হতাম তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম ঐ ঝিঙ্গে গাছটিকে দেখে। হাওড়ের জলে ভাসতে ভাসতে সেই ঝিঙ্গে গাছটিকে মনে হয়েছিল মঙ্গল গ্রহে খোঁজ পাওয়া কোন বৃক্ষ। ট্রলারটি জলপথ দিয়ে মাল টানতে টানতে কত শহর, গ্রাম, জনপদ অতিক্রম করে। গাছটির তা জানা নেই। বোবা এবং অন্ধ বৃক্ষ শুধু জানে তার ফল দেয়ার কথা। সে শুধু ফল দিয়ে যায়। তার শেকড় যতটুকু মাটি পেলে সন্তুষ্ট ততটুকু পেলেই চলে। সেই জেলখানার যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া কয়েদীর মতো ট্রলারের ছাদে যতেœর সাথে লালন করা ঝিঙ্গে গাছটির মালিকের সাথেও পরিচিত হতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল। সেই বৃক্ষপ্রেমী সারেংয়ের ঘর কোথায়, সংসার কোথায়? ঘাটে ঘাটে নোঙর ফেলা সারেং একটা গাছকে কেন জড়িয়ে নিলো তার জীবনের সাথেÑ তা আর জানা হয়নি। চোখে ভৈরব বা নারায়ণগঞ্জের কোন ঘাটের স্বপ্ন নিয়ে সেই সারেং আমাকে অতিক্রম করে চলে গিয়েছিল।
ইরিনাকে সেই ট্রলারের নিঃসঙ্গ ঝিঙ্গে গাছটির কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব। খুব বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, সেই ট্রলারের দেশান্তরী সারেংয়ের গল্প। মানুষ যেমন মমতায় বিড়াল পোষে, ময়না পোষে তেমন মমতায় বৃক্ষকেও যে পোষে Ñ তা ইরিনাকে জানাতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল। আমি যে ভান করতে করতে সত্য সত্যই বৃক্ষপ্রেমিক হয়ে ওঠে এবং পৃথিবীর সব বৃক্ষপ্রেমিকদেরকে যে আপন মনে করি Ñ তা ইরিনাকে না জানাতে পারার কষ্ট নিয়ে আমি সেদিন হাওড়ের জলে ভেসেছিলাম অনেকক্ষণ।
৩
এ ঘটনার বহুদিন পরে একদিন ইরিনা আমাকে ফোন করেছিল দূর দেশ থেকে। অজানা নাম্বার দেখে ফোন রিসিভও করেছিলাম। আমার সাথে যে দীর্ঘদিন তার দেখা নেই, কোন কথা নেই, সে যে আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছিল তার জন্য তার মুখেতো নয়; গলার স্বরেও কোন অপরাধবোধ ছিল না। কোন বাহুল্য ছাড়াই সে বলেছিল, ‘শমীক, তুমি যে ক্যাডেট কলেজ জীবনের একটা ছাতিম গাছের কথা প্রায়ই বলতে সেই গাছটি কি এখনো আছে?’
আমি কেমন আছি, বেঁচে আছি কেমন করে? আমি ইরিনাকে ভুলে গেছি কি-না ? সেই পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে কি-না Ñ এমন অনেক কিছুই ইরিনা জানতে চাইতে পারতো। কিন্তু ইরিনা যে গাছটির কথা বারবার শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল একসময় Ñ শুধু সেই গাছটির কথা জানতেই ইরিনা আমাকে ফোন করেছিল। ছাতিম গাছটির কথা তুলতেই আমি সব অতীত ভুলে কিছু সময়ের জন্য স্মৃতিকাতর হয়ে উঠেছিলাম।
সম্পর্কের সেই দিনগুলোতে ইরিনা যখন বৃক্ষপ্রেম আর বৃক্ষ বিষয়ক বিশাল জ্ঞানের কথা বলতো তখন আমি নিজেকেও সমঝদার প্রমাণের জন্য এক-দুইটা বৃক্ষ নিয়ে কথা বলতে চাইতাম। আমার বৃক্ষ বিষয়ক জ্ঞান এবং স্মৃতির অপ্রতুলতা হেতু সেই ছাতিম গাছটিই ছিল একমাত্র অবলম্বন। বারবার একই বৃক্ষের বর্ণনা শুনতে শুনতে ইরিনাও বোধ হয় বিরক্ত হতো। একবার চলে যেতে যেতে খুব আস্তে করে বলেছিল, ‘আর কোন বৃক্ষের কথা তোমার জানা নেই? একই ছাতিম গাছের কথা আর কতবার বলবে?’
আমি জবাব দিইনি। ঐ ছাতিম গাছের সাথে জড়িয়ে ছিল আমার শৈশব জীবনের অনেক স্মৃতি। কঠোর নিয়ম-শৃংখলায় আবদ্ধ আমার শৈশবের প্রতীক ছিল ঐ ছাতিম গাছটি। প্রতিদিন নিয়ম করে খুব ভোরে আমরা শরীর চর্চার জন্য ঐ গাছটির নিচে দাঁড়াতাম। আবার বিকেল বেলা খেলা শেষ করার পর করুণ সুরে যখন বিউগল বাজতো তখনও আমরা সেই গাছের নিচে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বছরের অন্য সময় ঐ ছাতিম গাছটির উপস্থিতি আমাদের তেমন আলোড়িত করতো না। কিন্তু শীতের শুরুতেই তার শরীর জুড়ে নেমে আসতো ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া লতানো ফুল। ছাতিমের ফুলের আহামরি কোন রং ছিল না। তবুও আমরা মাথা তুলে সেই ফুলগুলোকে দেখতাম তার উৎকট আর তীব্র গন্ধের জন্য। ছাতিম ফুলের গন্ধ আমাদের জানিয়ে দিত, শীত আসছে এবং পরিবার থেকে আমাদের দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার সাময়িক অবসানও আসন্ন। আমরা প্রতিবছর, ছিয়াত্তর বছর পর একবার উদয় হওয়া হ্যালির ধূমকেতু দেখার মতো ধ্যানমগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতাম ছাতিম ফুল ফুটবার জন্য। সেই গল্প একবার না হাজার বার বললেও আমার ক্লান্তি লাগতো না। প্রতিবার বলার পর মনে হতো, ছাতিম গাছটিকে নিয়ে আরো অনেক কিছুই বলার আছে। সব বলা হয়নি।
ইরিনাকে বলা হয়নি কিন্তু আমি জানতাম ঐ ছাতিমের গন্ধ আমার মনে এমনভাবে আবাস গড়েছে যে, শুধু ঐ গন্ধের কারণে রমনা পার্কে আর কী কী গাছ আছে বলতে না পারলেও আমি নিশ্চিত ভাবে অন্তত একটি ছাতিম গাছ থাকার কথা বলতে পারি। ক্যাডেট কলেজ জীবন শেষ করে যখন ঐ গাছটিকে ভুলে যেতে বসেছিলাম তখন একদিন রমনা পার্কের পাশের রাস্তায় জ্যামে বসে থাকতে থাকতে চমকে উঠেছিলাম সেই ছাতিম ফুলের গন্ধে। শীতের দিনে এই ঢাকা শহরের দ্রুত জীবনে অভ্যস্ত হয়েও যে ক’জন মানুষ রমনার পার্কের পাশের রাস্তার জ্যামে একটা উৎকট এবং তীব্র গন্ধ নেয়ার জন্য আটকে থাকতে চায়, আমি সেই দলের মানুষ।
বিশ বছর পর ক্যাডেট কলেজের রিইউনিয়ন-এ যেয়ে সব কিছু আগের মতোই মনে হয়েছিল। বিশ বছর আগে ক্যাডেট কলেজটাকে যেরকম রেখে গিয়েছিলাম তা ঠিক তেমনি করে হাজির হয়েছিল আমার সামনে। আর সবার মতো আমিও বিস্তৃত সবুজ মাঠের ভেতরে পরিপাটি করে কাটা দুর্বা ঘাসের ভেতরে স্মৃতির মায়াজাল ভেদ করে হাঁটছিলাম, খেলছিলাম, চিৎ হয়ে শুয়ে নীল আকাশের দিকে চেয়ে ছেলেবেলার গল্প করছিলাম। আচমকাই আমার মনে হয়েছিল, মাঠে সবই আছে কিন্তু কি যেন একটা নেই। কি নেই, কি নাই - এই ভাবনা আমাকে অস্থির করে দিয়েছিল। অনেকক্ষণ পর আবিস্কার করেছিলাম, মাঠের একপাশে ছিল সেই ছাতিম গাছটি। এখন আর সেই গাছটি নেই। আমি যেখানটায় সেই গাছটি ছিল সেখানে যেয়ে কাটা গুড়ির চিহ্ন খুঁজলাম অনেকক্ষণ। তাও পেলাম না। আমাদের চলে যাওয়ার দশ কিংবা বার বছর পরও যদি এই গাছ কাটা হয়ে থাকে তবুও সেই গাছের কাটা গুড়িটির আমাদের জন্য অপেক্ষা করার কথা নয়। প্রকৃতির নিয়মে সে হারিয়ে গেছে। সব চিহ্ন মুছে দিয়ে তার গুড়ির উপর জন্ম নিয়েছে দূর্বা ঘাস। সুতরাং বিশ বছর পর একটা বিশাল মাঠে এসে একটা ছাতিম গাছ খোঁজা অযৌক্তিক বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু সেই বিকেলে একটি হারিয়ে যাওয়া বৃক্ষের বেদনায় আমি অবসন্ন হয়ে গিয়েছিলাম।
এতদিন পর ইরিনা আবার সেই গাছটির কথা মনে করিয়ে দেয়ায় আমি ইরিনাকে ক্ষমা করে দিই। অতি আপনজনকে হারাবার বেদনা নিয়ে আমি ইরিনাকে জানাই, ‘গাছটি নেই।’
ইরিনা কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। আমাদের মধ্যে শোকার্ত গাছের সম্মানে ‘এক মিনিট নীরবতা’ চলেছিল অনেকক্ষণ। সেই নীরবতার সময় আমি অনুভব করেছিলাম, ইরিনা আমাকে পৃথিবীর তাবৎ বৃক্ষকে ভালবাসতে শিখিয়েছিল আর আমি তাকে শিখিয়েছিলাম না-দেখা একটি ছাতিম গাছকে ভালবাসতে। আমাকে নয়, আমার ভালবাসার ছাতিম গাছের প্রতি ইরিনার ভালবাসা দেখে দীর্ঘদিন বুকের ভেতরে পুষে রাখা উপেক্ষার কষ্ট লাঘব হয়ে গিয়েছিল। ‘ভাল থেকো’ বলে ইরিনা ফোন রেখে দেয়ার পর দীর্ঘদিন রোগে ভুগে অতঃপর সতেজ হয়ে ওঠা মানুষের মতো আমিও সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম। মোবাইল ফোনটা অনেকক্ষণ হাতে রেখে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার আর ইরিনার মধ্যে থাকা একমাত্র অমীমাংসিত বিষয় ছিল ঐ ছাতিম গাছ। আমি বুঝেছিলাম, ছতিম গাছটির প্রয়াণের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে থাকা একমাত্র অমীমাংসিত বিষয়ের মীমাংসা হয়ে গেছে।
তারপর আমাদের আর কোন দিন কথা হয়নি। হবেও না হয়তো। তবে, আমি এখন ইরিনাকে স্মরণ না করেও বৃক্ষ ভালবাসতে পারি।
ব্যবহৃত শিল্পকর্ম:
জগন্নাথ পাল