সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যেয়ে জলবসন্তে আক্রান্ত হই। আমাকে শুইয়ে রাখা হতো বাইরের দিকের ছোট্ট একটা ঘরে। ওটার পাশ দিয়ে ছিল পায়ে চলা একটা সরু পথ। ঘরের পুব দিকে ছোট্ট একটা জানালা। সকালের রোদ সরাসরি এসে ঘুম থেকে ডেকে তুলতো আমাকে। জাফরি-কাটা জানালার রম্বস আকৃতির ফাঁকগুলোর জ্যামিতিক বিন্যাস এখনো আমার মনে স্থায়ী হয়ে রয়েছে। প্রতি সকালে এক বুড়ো মহিলাকে হনহনিয়ে হেঁটে যেতে দেখতাম ঐ রাস্তা ধরে। সে-সময় একটা বোঁচকা থাকতো ওর বগলে। বিকেলে দেখতাম ফিরে আসতো ছোটখাটো একটা বোঝা পিঠে ঝুলিয়ে। আমার ঐ আরোগ্য-নিকেতনটা ছিল ঘন গাছপালার নিচে। একটা শীতলতা, প্রকৃতির আদিম তন্দ্রাভাব ঐ গরমের দিনগুলোয়ও ঘরটার ভেতর লেপ্টে থাকতো। ঐ বৃদ্ধার আসা যাওয়া দেখতে দেখতে এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে অসুখ থেকে সেরে উঠার পরও রাস্তায় যেয়ে অপেক্ষায় থাকতাম ওর চলে যাওয়া বা ফিরে আসা দেখার জন্য। আমার অসুখ কিছুটা তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাওয়ায় ঐ ঘর থেকে আমাকে সরিয়ে আমার ছোট বোনটাকে ঢোকানো হয়েছিল। ওর অসুখটা ছিল আমার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ও যন্ত্রণা-দেয়া।
এমন বিশেষ কিছু ছিল না ঐ বুড়ো মানুষটার ভেতর। নাম-গোত্রহীন আর দশ জনের মতোই সে ছিল খুব সাধারণ। জানি না, তবু কেন এত গভীরভাবে আমার ভাবনা স্পর্শ করেছিল সে। গাঁয়ের মানুষেরা ওকে ‘বদির মা বুড়ি’ বলে ডাকতো। স্বামী, এক ছেলে আর তিন মেয়ে নিয়ে ছিল ওর সংসার। জেলা শহর থেকে তিন মাইল দূরে ছোট্ট একটা খালের ধারে খড়ে ছাওয়া চালে ও বাঁশের বেড়ায় বানানো ওদের কুঁড়েঘর দুটো। গ্রামের দরিদ্র মানুষদের বাড়িঘর থেকে ভিন্ন কিছু ছিল না ওগুলো। প্রতি বর্ষার আগে পালা করে ঘর দুটোর চালে কিছু নতুন খড় লাগাতে হতো। আর এজন্য সারা বছর ধরে এক পয়সা এক পয়সা করে সঞ্চয় করতো বদির মা।
ওর স্বামী আর ছেলে, দুজনেই ছিল কিছুটা উদ্ভট স্বভাবের। ঊনিশ বছর না পেরোতেই দুবার জেল খেটেছে ছেলেটা। আর একবার থানা হাজত থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছে। গাঁয়ের লোকেরা বলে সুযোগ পেলেই বুড়ির স্বামীটাও গরু চুরি করে। হাতে-নাতে অবশ্য ধরা পড়েনি কখনো। প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারে না তাই। মাঝে মাঝে দু চার কি ছয় মাসের জন্য উধাও হয়ে যায় সে। ফিরে এলে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কোথায় ছিলে? বলে, ভাটিতে গিয়েছিল ধান কাটতে, অথবা নৌকোর মাঝি খেটে এসেছে। তারপরও কোনো বিটকেল যদি জিজ্ঞেস করতো, কত টাকা জমিয়ে এনেছো বদির বাপ? তখন গামছাটা কাঁধে ফেলে আস্তে উঠে যেতো ঐ জায়গাটা ছেড়ে। চোখে এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তুলতো যে তোমাদের ভালোমন্দ নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি তো আমি। তোমাদের গোয়ালের একটা গরুও বের করে নিতে দেখোনি আমাকে। তাহলে আর আমাকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া কেন?
বৈশাখ মাসের কোনো এক দিন ধান কাটতে গিয়ে বদির মাকে বিয়ে করে এনেছিল সে। বদির মা তখন সদ্য-যৌবনা এক পল্লীবালিকা। সে-সময়টায় জীবন ছিল ওর সত্যিই সঙ্কটাপন্ন। নিজেকে আগলে রাখতে তটস্থ থাকতে হতো সারাক্ষণ। যে কৃষকের বাড়িতে কাজ করতো সে তা শুরু করেছিল অনেক অল্প বয়সে। গায়ে-গতরে বেড়ে উঠার পর ঐ কৃষকের লোভ ধরে ওর উপর। এ নিয়ে সব সময় ঝগড়া হতো ওর স্ত্রীর সঙ্গে। আর অকারণে লাঞ্ছিত হতো বদির মা।
ও কখনো চাইতো না কৃষকটার সামনে যেতে। কিন্তু তক্কে-তক্কে থাকতো সে। যখন ওর স্ত্রী ঘাটে যেতো বা দূরে কোথাও কোনো কাজে বেরোতো তখন কৃষকটা হাওয়া থেকে যেন উড়ে আসতো। একদিন সে ভাঁড়ার ঘরে ধাওয়া করে প্রায় ধরেই ফেলেছিল ওকে। হয়তো বিপর্যস্তই করে ফেলতো। যদি না ঐ মুহূর্তে ওর স্ত্রী ফিরে আসতো ঘাট থেকে। ও হেঁসেলে কলসিটা রাখতে গেলে কৃষকটা পালিয়ে যায়। আর ওকে শাসিয়ে যায়, যদি বলে দিস তো পাটকাটা দা দিয়ে কুচি কুচি করে সামনের খালে ভাসিয়ে দেবো তোকে।
মনিব-গিন্নির কাছে আর কিই বা বলতে পারতো তখন! সত্যি বিপাকে পড়া একটা মেয়ে ছিল সে। ওর বাবামা’র বিষয়ে কিছুই জানতো না সে। অথবা ওকে তা জানানোই হয়নি।
বদির বাপ ওকে বিয়ে করার পর একে একে চারটা সন্তান জন্ম দেয় সে। স্বামীর সংসারটা সুন্দর করে তোলার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করতো। মেয়েগুলো বড় হওয়ার পর ওদের সংসারী করে তোলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। একটা গাভী ও দুটো বাচ্চা সহ একটা ছাগল ছিল ওদের সংসারে। আর ছিল অনেক হাঁস, মুরগি ও কবুতর। আঙ্গিনায় ছোট সবজি বাগান। এসব কিছু করতে যেয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হতো বদির মাকে।
যে গ্রামে বাস করতো ওরা, ওটা তখনও গ্রামই রয়ে গেছিল। বাইরের দিক থেকে অবশ্য কিছু কিছু পার্থক্য দেখা যেতো। আগের মতো চকচকে সবুজ আর সব ঋতুতে মোহনীয় রূপ বদলের পালা ছিল না। প্রায় সারা বছর হয়ে থাকতো ধুলি-ধূসর, ধোঁয়াটে, জৌলুসহীন, অসংখ্য মানুষের ভারে ক্লিষ্ট ও বিদ্ধস্ত এক জনপদ।
গ্রামটার অবস্থান ছিল এমন এক জায়গায় যেখান থেকে আমাদের শহরের শেষ-সীমা প্রায় পরিষ্কার দেখা যেতো। গ্রামের উত্তর সীমানায় ছিল খাল। বাঁশের একটা সাঁকো ছিল ওটার উপর। সাঁকোটা পেরোনোর সময় বুড়ির ভয়ার্ত ও সাবধানী চোখ দুটো ছিল দেখার মতো। শহরের প্রায় সব জায়গায় এমন বুড়িদের দেখা যায় আজকাল। দোকানির ফেলে দেয়া পচা মাছ কুড়িয়ে নিচ্ছে মাছ বাজার থেকে। কিংবা কসাইয়ের কাছে মাংসের ছিটে-ফোটা টুকরো বা হাড় চেয়ে নিচ্ছে হাত পেতে। সে-সময়ের দিনগুলোয় বুড়োবুড়িরা ভিক্ষে নিতে আসতো শুধু শুক্রবারে। চাল আর পয়সা ছাড়া সাধারণত অন্য কিছু নিতো না। সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোয় ঘরে পোষা মুরগির ডিম নিয়ে হাটে বিক্রি করতো। অথবা কোনো কোনো দিন এক বোঝা শাক বা এমনই কিছু ফেরি করে বেড়াতো।
থিকথিকে বর্ষার এক বিকেলে কয়েকটা ডিম নিয়ে শহরের পথে পা বাড়িয়েছিল বদির মা। বৃষ্টি না থাকলেও আকাশ জুড়ে ছিল কালো মেঘের আনাগোনা। তাড়াতাড়ি করছিল সে যেন সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসতে পারে। সামান্য কাপড়ে ঢাকা, কিছুটা নুয়ে পড়া শরীরে বিড়বিড় করে পথ চলছিল সে। পুরোনো একটা চটের থলের ভেতর যতœ করে বাঁধা ছিল ডিমগুলো। যদিও কয়েকটাই মাত্র ডিম, কিন্তু বর্ষাকাল বলে ডিমের দাম ছিল বেশ চড়া।
মাঝ-পথ না পেরোতেই ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একেবারে কোলের কাছে ধরে রাখে ডিমগুলো। একটু পড়ে বদির মার নুয়ে পড়া কালো শরীরের উপর বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি ঝরে। ওগুলো থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য অকারণ চেষ্টা করে কিছু সময়। তারপর ধীরে ধীরে শুকনো জিরজিরে পা টেনে টেনে বাড়ির পথে ফিরে আসতে থাকে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি কমে যেয়ে বাতাসের ঝাপটায় দুর্ভেদ্য ধোঁয়ার মতো সামনের দিকটা আচ্ছন্ন করে ফেলে। পথ এত পিচ্ছিল হয়ে উঠে যে হাঁটতে যেয়ে আবার পা হড়কানোর ভয় হয়। বৃষ্টিটা আর থামে না। ভাটি বাংলার পুরোনো প্রাচীন পুঁথিপাঠের মতো সুর করে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে। আর বদির মা ঐ ছন্দ খুঁজে খুঁজে সাবধানী পায়ে ঘরের পথ ধরে হাঁটতে থাকে চুপচাপ। বাতাস আবার খুব বেড়ে যায়। এত জোরে বৃষ্টি নামে যে বদির মা বুঝতে চেষ্টা করে যে সে দুনিয়ায় আছে, না পাতালের কোনো দেশে। শরীরের কাপড় বাঁচানোর কোনো তাড়া আর নেই। সামান্য একটু অংশও শুকনো নেই তখন। জলাজমিটার ওধারে পাড়াগাঁয়ের সীমানা স্পষ্ট চোখে পড়ে। বৃষ্টিতে ভিজে গাছগুলো আরো সবুজ হয়ে উঠেছে। গাছের গোড়ার দিকগুলো কালোর কাছাকাছি। দুএকটা তালগাছ সবুজ বেষ্টনী ছাড়িয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে গাছপালার সবুজ জমিনের উপর। দিনের শেষবারের মতো এক ঝাঁক পাতিহাঁস ডুবিয়ে শামুক গুগলি খুঁজে নেয়। কোথাও কোথাও পানি কম থাকায় ওদের পা ও লেজ আকাশমুখী হয়ে থাকে অনেকটা সময়। সবুজের ফাঁকে গ্রামের বাড়িঘরগুলো খুব একটা চোখে পড়ে না।
তারপর হঠাৎ কি হল মনে করতে পারে না বদির মা। ঝড়ের বেগে একটা হাঁচি বেরিয়ে আসে ওর ভেতর থেকে। বিদ্যুৎ চমকে আকাশ পুরোপুরি আলোময় হয়ে উঠে। পরপর কয়েকটা বিকট গর্জন বদির মাকে আবার ফিরিয়ে আনে হাসি-কান্না ও দুঃখবেদনার বাস্তব জগতে। কাদামাটি থেকে খুব দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। সোজা হয়ে তাকিয়ে দেখে সামনের অচেনা জগতটা। মনে করার চেষ্টা করে এখন সে কোথায়। নিজের গ্রামের পথটা আর চেনা যায় না। দৃষ্টির আড়ালে ছুটে চলে যেতে থাকা লাল আলোয় রাস্তার দিকে তাকায় সে। উঁচু বাঁধের মতো সড়কটার দুধারে থৈ থৈ পানি। তারপর গাছ আর পানিতে ডোবা মাটি। হাঁটুতে বেশ ব্যথা টের পায়। শাড়িটা ছিঁড়ে পায়ের চামড়া ছড়ে গেছে অনেক জায়গায়। কষ্টকর জ্বলুনি অনুভব করে। রাস্তার ঢাল বেয়ে পানি পর্যন্ত নেমে যায়। হাত ধুয়ে, আঁচলের খানিকটা থেকে কাদা ধুয়ে পানি নিংড়ে ফেলে। আর তখুনি মনে পড়ে ডিমের কথা। হু হু করে কান্না এসে ভরা বর্ষার জলের মতো জাপটে ধরে ওকে।
বৃষ্টি আর চোখের জলের স্রোত একতালে বইতে থাকে কিছুক্ষণ। দুঃখ কিছুটা কমে এলে চোখের জল থামে। কিন্তু বৃষ্টির আর বিরতি নেই। কাকভেজা হয়ে ঘরে ফিরে আসে বদির মা। ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত শরীরে ঘুম আসে না। তখন শালুক-পদ্ম-ফোটা বিলে হাঁসের মতো সাঁতরে বেড়ায়। আকাশের ছায়া দেখে কালো পানির ভেতর আর ডুব দিয়ে পাতালে নেমে যায়। কিন্তু ওখানে কোনো রাজপুত্র নেই ওর। এমনকি কোনো কোটালপুত্রও নেই। দৈত্য দানো নেই। কি আর করবে সেখানে বদির মা? তন্দ্রার ভেতর স্বপ্ন দেখে শাড়ির আঁচলে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে ডিমগুলো। তলপেটের কাছে একটা একটা করে টেনে নেয় ওগুলো মুরগি মায়ের মমতায়। শরীরের উষ্ণতা পেয়ে ওগুলো থেকে বাচ্চা ফুটে বেরোয়। খোলস ছেড়ে দ্রুত বড় হতে শুরু করে ওরা। দেখতে দেখতে বিশাল দৈত্যের আকৃতি নেয় একেকটা। তারপর ঝাঁক বেঁধে ঝড়ের গতিতে ঐ রাস্তাটা ধরে ধেয়ে যায়। পেছনে এক জোড়া লাল চোখ দেখানো ঐ যন্ত্রদানবটাকে ধরে ফেলে।
ধড়মড়িয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় বদির মার। বিকেলের সব কিছু মনে পড়ে। দ্রুত কেটে যায় দুঃস্বপ্নের ঘোর। সেই অসহায় মানুষের কান্না আসে আবার ওর দুচোখ বেয়ে।