করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





ফেরার পথে আরো কয়েকটা ছবি তুললো সুফী। ইলোরার পাহাড় কেটে হাতির ছবি আর কিছু ভাস্কর্যের। কিন্তু অজন্তার পর ইলোরা ওর কাছে অতো ভালো লাগলো না - যদিও দুটোর সৌন্দর্য দু’রকমের। অজন্তার হাতে আঁকা রঙিন ছবিগুলো অনেক জীবন্ত। বুদ্ধের ছবি ছাড়াও তখনকার  সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এগুলোতে তুলে ধরার চেষ্টা আছে। ইলোরার পাথর কেটে লীলায়িত ভঙ্গীতে নর্তকীর মূর্ত ভাস্কর্যগুলো ঠিক তখনকার দিনের সাধারণ মানুষের জীবনধারার সাথে খাপ খায় না। দেখতে সুন্দর কিন্তু আপন বোধ তাতে নেই।
সংঘমিত্রাও সায় দিলো সুফীর অভিমতে।
আওরাঙ্গাবাদ পৌঁছে চা খেলো ওরা। রেস্টুরেন্ট একেবারে সদর রাস্তার ধারে। প্রচুর ধুলো উড়িয়ে কতো লরী দৌড়–চ্ছে। প্রত্যেকবার সংঘমিত্রা সুফীকে মনে করিয়ে দিচ্ছে পিরিচ দিয়ে চায়ের কাপ ঢাকতে হবে। তা নইলে রাস্তার ধুলোবালি চায়ের সাথে পেটে যাবে। এ রকম অভিজ্ঞতা সুফীর কখনো হয় নি।
আওরঙ্গজেবের কেল্লা পাহাড়ের ওপর দেখতে খুব চমকদার। কিন্তু ওরা সিঁড়ি বেয়ে উঠলো না। সবাই বেশ ক্লান্ত তখন। শুধু ছবিই তুললো। হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাত্রে বম্বে মেইল ধরতে কোন অসুবিধা হলো না।
বেশ সকালে বম্বে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাল স্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছলো।
ড. গুপ্ত বললেন, ‘আমি চার্চ গেটের কাছে থাকার বন্দোবস্ত করেছি। বম্বে ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের প্রফেসর ড. শ্রীবাস্তব আমার বন্ধু। উনি আমাকে তার বাড়িতে থাকতে বলেছেন। তিনি আমার জন্য গাড়ি পাঠাবেন বলেছিলেন।’
সংঘমিত্রা ঠিক করেছিল ওর মামা সম্পর্কের এক পরিচিত নেপালী পরিবারের সঙ্গে থাকবে। তারা ডাক্তার স্বামী-স্ত্রী। জে. জে. হাসপাতালের ক্যাম্পাসে তারা থাকেন। ঠিকানা আছে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সে চলে যেতে পারবে।
সুফীকে যেতে হবে মেরিন ড্রাইভের কাছের একটা হোটেলে। ওর এডিটরের সাংবাদিক বন্ধু পিটিআই-তে আছেন। তিনিই এই হোটেল ঠিক করে দিয়েছেন। একটা পারসী পরিবার এই ছোট হোটেলটি চালান। ওকেও ট্যাক্সি নিতে হবে।
ড. গুপ্ত আবার বললেন, ‘কাল সকালে আমাদের সায়েন্স কংগ্রেসের উদ্বোধনী হবে। টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল স্টাডিজ বিল্ডিং-এ। জানো তো এটা কোথায়? কোলাবায়। তোমরা দু’জন তো আগে কখনো বম্বে আসো নি। যাহোক, আজ রেস্ট নাও। অন্তত আমি তো নেবো। আমার শরীরটা বেশ ভালো ঠেকছে না। গলা খুশখুশ করছে, জ্বর জ্বর লাগছে। ... আমি চলি। কাল দেখা হবে।’
ট্যাক্সিতে ওঠার আগে সংঘমিত্রা সুফীকে বললো, ‘আমার ফোন নাম্বার আর ঠিকানা লিখে নিন। আমার মনে হয় বাড়ি গিয়ে স্নান করে খেয়ে নিয়ে একটা ঘুম দেবো। আপনি কী করবেন?’
‘আমারও তাই। বিকেলবেলার দিকে চাঙ্গা হয়ে যাবো আবার আশা করি।’
‘তাহলে চারটার দিকে দেখা করা যাক একবার। তারপর দু’জনে মিলে শহরটাকে দেখা দরকার। কংগ্রেস একবার শুরু হয়ে গেলে হয়তো সময় পাবো না। আমি বলি কি, বম্বে শহরের নামকরা দ্রষ্টব্য জায়গা হচ্ছে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া। চারটার দিকে চলে আসেন সেখানে। তারপর দেখা যাবে কি করতে পারি দু’জনে মিলে।’
‘আমি গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া চিনি না। তবে ছবি দেখেছি। ট্যাক্সিকে বললে হয়তো ঠিকই নিয়ে যাবে। তবে ওখানে কোথায় আপনার দেখা পাবো?’
‘সেটা তো আমিও জিজ্ঞেস করতে পারি। তবে আপনাকে দেখলে আমি চিনতে পারবো।’
‘আপনি আমাকে চিনতে পারবেন তো? মাত্র দু’দিন আমাকে দেখছেন। হয়তো ভুলেও যেতে পারেন, তাই না?’
‘তাহলে একটা কাজ করলে হয় না। আপনি নেপালের একটা ফ্ল্যাগ নিয়ে আসবেন।’
‘আপনি নেপালের ফ্ল্যাগ দেখেছেন? বলুন তো নেপালের ফ্ল্যাগের একটা বিশেষত্ব কী? পৃথিবীর অন্য কোন দেশের ফ্ল্যাগে সেটা নেই।’
‘তা তো জানি না।’
‘নেপালের ফ্ল্যাগ পাঁচ কোনা। দেখলেই চেনা যাবে। কোনদিন ভুলতে পারবেন না। আপনিও আপনার দেশের ফ্ল্যাগ আনবেন তো?’
‘ঝামেলায় পড়া গেল। কে জানতো বিদেশে গেলে নিজের দেশের ফ্ল্যাগ নিয়ে যাওয়া উচিত।’
‘আচ্ছা ফ্ল্যাগ যখন নেই, তখন আপনার ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে আসতে ভুলবেন না। আমি আপনাকে ঠিকই খুঁজে নেব। আর আমাকে যদি না দেখতে পান তাহলে খুব জোরে জোরে আমার নাম ধরে চেঁচাবেন। বম্বে শহরে যেখানেই থাকি আপনার চিৎকার শুনতে পাই যাতে। তাহলে আপনাকে পুলিশে ধরার আগেই আমি ধরে ফেলবো।’
‘বেশ তাহলে আজ বিকেল চারটার দিকে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়াতে দেখা হবে।’
বিকাল চারটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে সুফী দেখলো হলুদ শাড়ি পরা মেয়েটা বাস থেকে নামলো। দেখে প্রথমেই সুফী ওকে চিনতে পারেনি। সংঘমিত্রাকে এ রকম রূপে আগে কখনো দেখেনি। ট্রেনে দু’রাত আর দিনে অজন্তা ইলোরার মাঝে একদিন ওকে দেখেছে। বেশ কাছে থেকে এখনকার দেখা আগের থেকে আলাদা। আর একটু কাছে হেঁটে এলো মেয়েটি। হলুদ শাড়িটায় খুব মানিয়েছে। হয়তো গোসল করেছে দিনে। বোধহয় একটু ঘুমিয়েছে। আরো কাছে এলে মনে হলো এমন কিছু প্রসাধন করেনি কিন্তু তবুও কি রকম একটা ভালো লাগা ভাব মেয়েটিকে ঘিরে রেখেছে। সংঘমিত্রাও সুফীকে দেখেছে।
হাত নাড়লো। বললো, ‘আরে আপনি দেখছি আমার আগেই এসে গেছেন। আমি ভাবছিলাম আপনাকে হারিয়ে দেবো। কিন্তু হলো না আর। আপনাকে আজ বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছে কিন্তু। আপনার এই নীল চেক শার্টটা বেশ মানিয়েছে। স্নান করেছেন তো, আর দিনের বেলা একটু ঘুমিয়ে ছিলেন নিশ্চয়ই। তা নইলে এতো ফ্রেশ দেখাচ্ছে কেন?’ একনাগাড়ে বলে গেলো সংঘমিত্রা, ‘ট্রেনে আপনাকে দু’দিন দেখেছি। তখন কিন্তু সর্বদা আপনাকে সবসময় ক্লান্ত লাগতো। এখনকার মতো না।’
সংঘমিত্রা একটা সবুজ টিপ পরেছে কপালে। কিন্তু হলুদ শাড়ি আর সবুজ টিপ, রঙটা ঠিক যায় কি? আচ্ছা ব্লাউজটা সবুজ, সেজন্যই সবুজ টিপ। রঙ দুটো যায় কিনা সেটা কে বিচার করবে? যে পরেছে তাকে সুন্দর লাগলেই তো হলো।
সংঘমিত্রা জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কতক্ষণ আগে এসেছেন? আমার দেরী হয়ে গেল।’
‘দেরী কোথায়? চারটার ঠিক আগেই তো পৌঁছেছেন। আমি ট্যাক্সি নিয়েছিলাম। কারণ জায়গাটা আগে তো দেখিনি। জানতাম না কতক্ষণ লাগবে। ট্যাক্সিতে চট করে এসে গেলাম। প্রায় আধঘণ্টা আগে। তাই একলাই ঘুরে ফিরে দেখছিলাম এই গেটওয়েটা। আর সমুদ্রের ধারের এই আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিলাম।’
‘আমি যেখানে উঠেছি Ñ আমার মামা সম্পর্কের ডাক্তার, তাঁর ফ্ল্যাটে। তিনি বললেন, সবচেয়ে সস্তা আর তাড়াতাড়ি হবে প্রথমে জে. জে. হসপিটাল থেকে ট্রেন নিয়ে চার্চগেটে যাওয়া। আর সেখান থেকে বারো নম্বর বাস সোজা এই গেটওয়ের কাছে আসে। সময় একটু বেশি নিলো। কিন্তু সত্যিই বেশ সস্তা। পাঁচ রুপীর মতো পড়লো।’
সংঘমিত্রা এতক্ষণ হাল্কা গলায় কথা বলছিল। হঠাৎ তার গলার স্বর বদলে গেল। সুফীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি এতো ঘন ঘন আমার কপালের দিকে চাইছেন কেন? হলুদ শাড়ি আর সবুজ ব্লাউজের সঙ্গে সবুজ টিপ যায় না?’
আমতা আমতা করে সুফী জবাব দিলো, ‘তা কেন? বেশ লাগছে। খুব সুন্দর লাগছে।’
‘হলুদ চাঁপা ফুল যখন ফোটে গাছে তখন সবুজ পাতার সাথে সুন্দর লাগে না? হলুদ করবীর সাথে গাছের সবুজ পাতা দেখেন নি? ব্রাজিলের পতাকা দেখেছেন? তাতে সবুজের সাথে হলুদ আছে পাশাপাশি। এজন্যই তো ওদেরকে কেউ ফুটবলে হারাতে পারে না। আর রংধনুতেও ঠিক সবুজের পাশে আছে হলুদ।’
‘আমি তো বললাম আপনাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। হলুদ আর সবুজ সত্যিই একটা মিষ্টি কম্বিনেশন। আপনার জন্য।’
‘ও শুধু আমার জন্য! এই যে এতোগুলো উদাহরণ দিলাম, তাতেও আপনার সন্দেহ গেল না? আরো উদাহরণ দিতে হবে? কাঁঠাল ভালো লাগে আপনার? কাঁঠালের রসের শরবত একেবারে হলুদ। তাতে কুচি কুচি করে সবুজ পেস্তা দিয়ে খেতে যা মজা। আমার মা বানাতেন। এখনও স্বাদ লেগে আছে জিভে। আমি কখনো পারলাম না অমন করে শরবত বানাতে।’ ওর গলাটা ধরে এলো একটু।
কিছুক্ষণ ওরা আর কথা বললো না। একটু পরে সংঘমিত্রা নিজেই বললো, ‘আমার মা ছোটবেলায় মারা যান। আমার বাবাই আমাকে বড়ো করেছেন। যদিও আমি লেখাপড়ার জন্য বাড়ির বাইরেই থেকেছি অনেক বছর।’
সংঘমিত্রা আর কিছু বলতে চাইলো না তক্ষুণি। তাই সুফীও চুপ করে রইলো। ওরা দু’জনে কিছুক্ষণ পাশাপাশি হাঁটলো সমুদ্রের ধারে। বেশ ভিড়। অনেক লোকজন হাঁটছিলো ওদের মতই। ওরা হারিয়ে রইলো ওদের মাঝে।
সংঘমিত্রা বললো, ‘আপনার ক্যামেরা কোথায়? আনেন নি?’
‘না, আনলাম না। ফিল্ম ফুরিয়ে গেছে। এখানে কোথায় ফিল্ম পাবো জানতাম না। তাই।’
রাস্তার ওপাশে একটা বড় প্রাসাদের মতো বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে সুফী জিজ্ঞেস করলো, ‘ওই বাড়িটা বেশ বড়। জানেন ওটা কী?’
সংঘমিত্রা বললো, ‘ওটা তো তাজমহল হোটেল। ছবিতে দেখেছি। চলুন না একবার এক্সপ্লোর করে দেখি।’
‘আমরা তো ওখানে থাকি না। আমাদেরকে ওখানে ঢুকতে দেবে ওরা?’
‘দেবে না কেন? অবশ্য এমন ভাব দেখাতে হবে যেন আমরা ওখানে থাকি। না হয় হোটেলটা আমাদেরই সম্পত্তি। যেতে চান একবার? তাহলে যা বললাম, আমার সাথে সাথে চলুন। নিজের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন এ রকম ভাব দেখাতে হবে। নার্ভাস হবেন না।’
বিকেলের ট্রাফিক জ্যাম আস্তে আস্তে বেশি হতে শুরু করেছে। সাবধানে রাস্তা পার হতে হলো। উর্দিপরা দারোয়ান দরজা খুলে দিলো। লবীতে ঢুকলো ওরা। এ রকম রাজকীয় ব্যাপার সুফী জীবনে কখনো দেখেনি। কতো লোকজন। সবাই ফিটফাট। পোশাকে চলাফেরায় ওদের চাইতে অনেক স্মার্ট। আসছে যাচ্ছে কিন্তু কেউ বোধহয় ওদের দিকে লক্ষ্য করছে না। সবাই নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত।
সংঘমিত্রা সুফীকে বললো, ‘আচ্ছা, আমার হাত ধরে থাকুন। ওরা যাতে মনে করে আমরা দু’জন একসঙ্গে আছি। আমি বুঝতে পারছি আপনি এখনো বেশ সহজ হতে পারছেন না। ... আচ্ছা ওই বড় দোকানের কাচের সামনে দেখুন তো Ñ সুন্দর সুন্দর স্যুট আর শার্ট টাঙানো আছে। আর তার পাশের জানালায় আছে কতো সুন্দর শাড়ি পরা ম্যানিকিন। চলুন দেখা যাক আমাদের কোনটা পছন্দ হয়।’
সংঘমিত্রার আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে নিয়ে সুফীর সাহস অনেকটা ফিরে এলো। সেই কাপড়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো ওরা।
‘আচ্ছা এই চারকোল গ্রে স্যুটটা আপনার পছন্দ হয়? রঙ দেখে মনে হয় আরও অনেক বয়সের লোকের এটা মানাবে। আপনার জন্য হয়তো ওটা ঠিক নয়। দাম কতো দেখতে পাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ, লেখা আছে দেখছি বারো হাজার টাকা। মাত্র বারো হাজার! রঙটা আরো একটু হাল্কা হলে আমি কিনেই ফেলতাম। দাম আর কী এমন, আমার ছয়মাসের বেতনের মতো হবে।’
‘চলুন, ওই শাড়িটা দেখি। মনে হচ্ছে মাইশোর সিল্কের তৈরি। দাম লেখা আছে পনের হাজার রুপী। আমারও রঙটা পছন্দ নয়। একেবারে ক্যাটকেটে নীল। না, এদের খুবই রুচির অভাব। তাই না?’
হাত ধরাধরি করে ওরা দু’জন সব দোকান দেখতে লাগলো কিন্তু কোন জিনিসই ওদের পছন্দ হলো না। দাম নিয়ে যেন ওদের কোন চিন্তাই নেই, শুধু দোকানীদের একদম সৌন্দর্যবোধ নেই। স্টাইল কাকে বলে তারা তা মোটেই জানে না। রুচি বিষয়টা কী টাকা দিয়ে কেনা যায়?
সংঘমিত্রার হাত ধরে বড়দের এ রকম খেলায় বেশ মজাই লাগতে লাগলো সুফীর।
‘এই দোকানটা দেখা যাক, দেখুন কতো রকমারী গয়না। এই হীরার আংটিটা মোটামুটি ভালই লাগছে। বলছে, হীরার ওজন দুই ক্যারাট। প্লাটিনাম দিয়ে তৈরি আংটিটা। দাম দশ লক্ষ রুপী। না, সবশুদ্ধ আমার পছন্দ নয়। হীরাটা মনে হচ্ছে একেবারে ক্লিয়ার না, ইনক্লুশন আছে ভেতরে। দুই লক্ষ রুপী কম করলে না হয় দেখা যেত। কিন্তু দরজার ওপর লেখা আছে ফিক্সড প্রাইস। অতএক এরা একজন ক্রেতা হারালো।’
এসব দোকান দেখতে দেখতে করিডোরের শেষ প্রান্তে চলে এলো ওরা। সেখানে একটা বইয়ের দোকান। বেশ বড় দোকান। প্রচুর বই কিন্তু খুব বেশি লোকজন নেই দোকানে।
সংঘমিত্রা বললো, ‘এবার আমার হাত ছেড়ে দিন। আমি নিজে নিজে একটু ঘুরে বেড়াতে চাই এই বইগুলোর মাঝে। দেখি কিছু পছন্দের পাওয়া যায় কীনা।’
ওরা দু’জনে নিজের ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াতে লাগলো। একসঙ্গে কিন্তু আলাদা আলাদা। এতক্ষণ দামী দামী কাপড়, শাড়ি আর গয়নার দোকান দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল দু’জনেই।
ঘুরতে ঘুরতে সুফী একটা পছন্দের বই পেলো। রুমীর কবিতার বই একটা। ইংরেজিতে অনুবাদ করা আর তার প্রিফেস লিখেছেন আনমারি শিম্মেল। ওটা কিনে নিয়ে সুফী খুঁজছিলো সংঘমিত্রাকে। পাশেই একদিকে গানের ক্যাসেট টেপগুলো। সংঘমিত্রা সেখানে নিবিষ্ট চিত্তে ওগুলো দেখছে।
‘আপনার জন্য এই বইটা কিনলাম। রুমীর বই। ভালো লাগবে হয়তো।’
সংঘমিত্রার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। একটা স্মিত হাসির রেখা ওর দুই গালের পাশে খেলা করলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, ‘আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না, আপনি কী করে জানলেন রুমী আমার প্রিয় কবি? যদিও বেশি পড়ি নি। সত্যি সত্যি এটা আমার জন্য কিনেছেন? একটু আগেই ভাবছিলাম রুমীর বই পেলে আমি কিনবোই। ... ধন্যবাদ দিতে হবে নাকি?’
সংঘমিত্রা ততক্ষণে বইটিকে বুকের ওপর দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো, ‘এই হাজারো বইয়ের ভেতর আমি যে বইয়ের খোঁজ করছিলাম সেইটাই আপনি কেমন করে বেছে নিলেন?’
সুফী বললো, ‘আমি নিজেও কবিতা লিখি কিনা, বোধহয় সেজন্য। আমি ঠিকই বুঝেছিলাম আপনার ভালো লাগবে। তিনদিন ধরে আপনাকে দেখছি তো।’
‘আপনি কবিতা লেখেন? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি একজন কাঠখোট্টা সাংবাদিক। এখন দেখছি একজন ছুপে রুস্তম।’
সুফী বলেই ফেললো। নিজেকে আর আটকাতে পারলো না, ‘আমার তিনটি কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। আর একটা উপন্যাস।’
‘বলেন কী, আমি একজন পাবলিশড পোয়েট আর অথরের সঙ্গে কথা বলছি। আরো কিছু আছে যা আমাকে এখনো বলেন নি?’
সুফী আবার বললো, ‘আমার একটা কবিতার বই আমাদের দেশের বাংলা একাডেমীর পুরস্কার পেয়েছে গত বছর।’
‘কনগ্র্যাচুলেশন! আপনি আমাকে রুমীর বই দিলেন। আমি আপনাকে কী দেবো? ... আপনি নিশ্চয়ই গান ভালবাসেন। বিশেষ করে রবীন্দ্র সঙ্গীত, তাই না? তাহলে আমি আপনাকে এই গানের ক্যাসেট দেবো। এখানে বাংলা গানের ক্যাসেট পাবো ভাবি নি। কিন্তু এই দেখুন, একটা রবীন্দ্র সঙ্গীতের সংকলন পেলাম।’
‘ধন্যবাদ’ বলে সুফী ক্যাসেটটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো।
‘রবীন্দ্রনাথ শীত নিয়ে বেশি গান লেখেন নি। এর প্রথম দুটো গানই শীতের। আর আমরা এখানে শীতের ঋতুতেই এসেছি, যদিও ঠাণ্ডা বেশি নেই।’ বললো সংঘমিত্রা।
সুফী ক্যাসেটটা হাতে নিয়ে গানগুলোর নামের ওপর একটু চোখ বুলালো। তারপর আস্তে আস্তে গাইলো, ‘একি মায়া, লুকাও কায়া, জীর্ণ শীতের সাজে, আমার সয়না, সয়না সয়না যে। এটা আমার বিশেষ প্রিয় গান।’
সংঘমিত্রা বললো, ‘আমরা ঘরের ভেতরে আছি বলে হয়তো ঠাণ্ডা লাগছে না। বাইরে দেখছি প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। বেরিয়ে দেখা যাক, আবহাওয়াটা কী রকম। হোটেলটা আর ভালো লাগছে না।’
‘ওদিকে দেখছি একটা রেস্টুরেন্টের মতো। আমার একটু চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। এই অভিজাত হোটেলে চায়ের দাম নিশ্চয়ই বেশি বেশি হবে। কী দরকার? বেরিয়েই দেখা যাক নিশ্চয়ই আমাদের মতো সাধারণ লোকের জন্য যুৎসই কিছু পাওয়া যাবে।’
কাছেই একটা ছোট ক্যাফে পাওয়া গেল। তারা কয়েকটা টেবিল চেয়ার ফুটপাথে এনে রেখেছে। দু’একজন বসে আছে সেখানে। ওরাও বসলো। দুই কাপ চা আর গোল গাপ্পা অর্ডার দিলো। ওয়েটার বললো, একটু দেরী হবে গোলগাপ্পার অর্ডারে। কারণ একেবারে টাটকা তৈরি করা হবে।
গানের ক্যাসেটটা বের করলো সুফী। বললো, ‘এই দুটো শীতের গানের মধ্যে কোনটা আপনার বেশি ভালো লাগে।’
সংঘমিত্রা বললো, ‘আমার বেশি ভালো লাগে প্রথম গানটা। একি মায়া, লুকাও কায়া, জীর্ণ শীতের সাজে। কথাগুলো কী সুন্দর! মহারাজ তোমার ভাণ্ডারে কতো বৈভব। তবুও তুমি ভিখিরির মতো সেজে আছো। সয়না সয়না সয়না প্রাণে। আর আমরা যত অন্তঃসারশূন্য মানুষ, আমরা ভান করি আমাদের থলি উপচে পড়ছে ঐশ্বর্যের আতিশয্যে। আমাদের পা মাটিতে পড়ে না আমাদের জ্ঞানের গরিমায়। মহারাজ যখন নিজের কায়া দৈন্যের সাজে লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত, আমরা সেখানে নিজেদের ময়ুর পুচ্ছে সাজিয়ে জাহির করতে ব্যস্ত।’
সংঘমিত্রা গুন গুন করে লাইন ক’টা গাইলো, ‘একি মায়া, লুকাও কায়া, জীর্ণ শীতের সাজে আমার সয়না সয়না সয়না প্রাণে, কিছুতে সয়না যে ...’।
সুফী বললো, ‘আপনি বেশ সুন্দর গান করেন তো!’
‘বাবা পাঠিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। আশা করেছিলেন আমি ভালো গান করবো। কিন্তু আমি বেছে নিলাম নিউক্লিয়ার ফিজিক্স।’
‘হ্যাঁ, ফিজিক্স পড়–ন কিন্তু গান ছাড়বেন না। ... আমার কিন্তু পরের গানটাই বেশি ভালো লাগে Ñ শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আমলকির এই ডালে ডালে। আপনার পছন্দের গানের মতো অতো গভীর মর্মার্থ হয়তো এটাতে নেই। নিতান্তই শীতের প্রকৃতির একটা বিবরণ। তবে আমার বড় ভালো লাগে শুনতে।’
এবার সংঘমিত্রা গাইলো, ‘শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আমলকির এই ডালে ডালে, পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’ তারপর সুফীর দিকে তাকিয়ে রইলো জিজ্ঞাসু ভাবে।
সুফী বললো, ‘আপনি দ্বিতীয় লাইনটা যখন গাইলেন তখন আমার ঘাড়ের পেছনে আবার একটু একটু কী যেন শিরশিরিয়ে উঠলো।’
সংঘমিত্রা গুন গুন গান থামিয়ে সুফীর দিকে আবার কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, ‘আপনি কী মেয়েটিকে ভালবাসতেন?’
সুফী কিছু বলার আগেই বললো, ‘আপনার সঙ্গে মাত্র তিনদিন দেখা। এর মধ্যে এ রকম একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা উচিত হয়নি, তাই না? তবে কেন এ রকম প্রশ্ন করলাম জানেন?’
‘কেন?’
‘আপনি শুনতে চান? ... আমি যখন গুন গুন করে গাইছিলাম, তখন আপনার চোখে ক্ষণিকের জন্য একটা হারিয়ে যাওয়া ভাব দেখেছিলাম। এটা একটা মেয়ের চোখকে এড়িয়ে যাওয়া মুসকিল। তবে আপনার গায়ে শিরশিরানি যে তৈরি করতো তার কথা আপনি যদি চান বলতে পারেন নির্ভয়ে।’
একটু থেমে একটু ভেবে সুফী বললো, ‘আপনি জিজ্ঞেস করছেন আমি মেয়েটিকে ভালোবাসতাম কীনা? না, ভালোবাসতাম বলতে পারবো না। ভালো লাগতো। ওইটুকুই। হয়তো সময় আর সুযোগ পেলে আরো এগুতে পারতাম। কিন্তু সেটা আর হয়নি।’
‘কেন, আপনি পছন্দ করতেন মেয়েটিকে কিন্তু সেটা ওকে বলেন নি কখনও? কোথায় দেখা হলো ওর সাথে?’
‘আমাদের ক্লাসেই পড়তো মেয়েটি।’
সংঘমিত্রা জিজ্ঞেস করলো, ‘ক্লাসে তার পাশে বসেন নি?’
‘ওরে বাব্বা! আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ছিল বড় কঠিন ব্যবস্থা। মেয়েদের জন্য ছিল আলাদা জায়গা। একেবারে সামনের বেঞ্চে। মেয়েরা সংখ্যায় ছিল হয়তো আট-দশজন। আর আমরা ছেলেরা প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন। বোঝেন কী রকম কম্পিটিশন। ক্লাস শুরু হবার আগে মেয়েরা বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতো। প্রফেসর যখন ক্লাসে ঢুকবেন, তাঁর সঙ্গে মেয়েরাও ঢুকবে। আর লেকচারের শেষে প্রফেসরের সঙ্গে মেয়েরাও বেরিয়ে যাবে। এ রকম মধ্যযুগীয় নিয়মে অন্য মেয়ের পাশে বসার সুযোগ কোথায়?’
‘এ তো একেবারে হৃদয়বিদারক ব্যবস্থা!’
‘অবশ্য দু’একজন ছেলেমেয়ে ক্লাসের বাইরে যে মেলামেশা করতো না, তা নয়। প্রেম-ট্রেমও করতো। বিশেষ করে যারা ডিবেটিং বা ড্রামা সোসাইটিতে যোগ দিতো তারা অবশ্য এত কড়াকড়ির বাইরে ছিল।’
‘আর আপনি আপনার মানসীকে দূর থেকে দেখেই হা হুতাশ করতেন? কবিতা লিখতেন না?’
‘তা লিখেছি কয়েকটা। এই বয়সে প্রেমে পড়ে বাংলাদেশের সব ছেলেমেয়েরা কবিতা লেখে। আমিও লিখতাম। কয়েকটা কয়েক বছর পর পড়েছি, যেগুলো খাতায় রয়ে গিয়েছিল। এ রকম নিকৃষ্ট ধরনের কবিতা আমি লিখতাম ভেবে এখন লজ্জা লাগে। ওই নিচু মানের কবিতা কোন কাগজেই ছাপাতে রাজি হয়নি। সেজন্য সম্পাদকদের আমি এখন ধন্যবাদই দিই।’
‘কি নাম ছিল মেয়েটির?’
‘ওই দেখুন, নামটিও ভুলে গেছি। অবশ্য নামে কী এসে যায়।’
‘চাইলে আমাকে মেয়েটার সম্বন্ধে আরো কিছু বলুন। শুনতে মজা লাগছে। নামটাই বলতে পারলেন না এখনও। আরো একটু চিন্তা করুন। নাম মনে রাখাটা খুব দরকার। কি করে যে বলেন নামে কী এসে যায়?’
‘আচ্ছা মনে পড়েছে এবার। লামিয়া ছিল মেয়েটার নাম। বাঙালি মেয়ের এ রকম নাম কখনো শুনিনি। এটা একটা বিদেশী, তুর্কী কিংবা ফারসী নাম। আর নামের মানেও জানি না। বড়োলোকের মেয়ে। আসতো যেতো গাড়ি করে। আমাদের সাথে কখনো ক্যান্টিনে খেতে যেতো না। ড্রাইভার বোধহয় বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতো আর নির্জনে বসে খেতো। কারোর দিকে ফিরেও তাকাতো না।’
‘একেবারে অ্যান্টিসোশ্যাল।’
‘তা ঠিকই বলেছেন। তবে দেখতে খুব সুন্দর ছিল। আর অন্য ছেলেরাও ওর ব্যাপারে আমার মতো দূর থেকে হা হুতাশ করতো।’
‘অন্যরাও কবিতা লিখতো নাকি?’
সুফী হেসে ফেললো। বললো, ‘হয়তো তাই। হয়তো আমার চাইতেও নিকৃষ্টমানের কবিতা। শীতের শেষে গোটা ক্লাস মিলে পিকনিকে যেতাম। যাবার জায়গা ছিল একটাই Ñ মধুপুরের জঙ্গল। এখন অবশ্য আরো অনেক পিকনিক স্পট হয়েছে। ও রকম লালমাটির দেশ পূর্ববঙ্গে আর কোথাও নেই। তাই এখানে আছে বিস্তীর্ণ শালবন। আর শীতের শেষে লাল পলাশ, শিমুল ফুটতো প্রচুর। আবহাওয়া আর পরিবেশ এই বয়সে এতো রোমান্টিক মনে হতো। ওখানে খেলা হতো, হুল্লোড় হতো, গান হতো। রান্নাবান্না আর খাওয়া দাওয়া তো হতোই। কিন্তু লামিয়া আর দু’একটা মেয়ের সাথে বসে নিজেদের মধ্যেই গল্পগুজব করতো। শুধু গান যখন শুরু হলো, তখন লামিয়া অন্য কয়েকটা মেয়ের অনুরোধে নিজে একটা গান করলো। শীতের এই গানটা Ñ শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে। কী অপূর্ব যে লাগছিল তখন। ওর গলাটা যে অতো মিষ্টি তা আমি আগে কখনো ভাবি নি। যখন সুর করে গাইছিল হারমোনিয়াম বাজিয়ে, পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে। তখন আমার বুকের ভেতরেও কি রকম শিরশিরিয়ে উঠলো। আমি তখন কোথায় Ñ মধুপুরের জঙ্গলে না আর কোথাও হারিয়ে গেছি। এর পরেও তো কতোবার এই গানটা শুনেছি। কিন্তু সেবারের মতো কখনও বুকের মাঝে শিরশিরানি অনুভব করিনি।’
যে দু’জন লোক বাইরের চেয়ার টেবিলে বসে ওদের মতো চা খাচ্ছিলো, তারাও কিছুক্ষণ আগে উঠে চলে গেছে। এখন ওরা দু’জন শুধু বাইরে বসে আছে।
সংঘমিত্রা চারদিকে একটু চেয়ে নিচু গলায় গাইলো, ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে / পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’
তারপর সুফীর দিকে চেয়ে একটু হেসে বললো, ‘শিরশিরানি অনুভব করলেন একটুও? নাকি একদম না?’
‘না সে রকম কোন শিরশিরানি বোধ হলো না। দুঃখিত।’
‘দুঃখ পাবার কিছু নেই। আফটার অল আমার নাম তো লামিয়া না।’
সংঘমিত্রার প্রশ্নের ধরন দেখেই সুফী বুঝতে পারলো, ও একটু প্রচ্ছন্ন ঠাট্টা করছে। একটু লেগ পুলিং।
বললো, ‘না, ও রকম কিছু প্রতিক্রিয়া তো হলো না। যদিও আপনি গান করেন অনেক সুন্দর। তবে পরিবেশটা এখানে সম্পূর্ণ অন্য রকমের। শীতকাল বটে কিন্তু ঠাণ্ডাও ও রকম পড়েনি। আমলকি গাছ ধারেকাছে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পীচের রাস্তা। সেখানে অনেক মোটর গাড়ি চলছে। শিরশিরানি অনুভব করার মতো সুযোগ একদম নেই। তবে এটাও বলা যায় যে, এখানে এই শহুরে পরিবেশে বসে রবীন্দ্রনাথও এ রকম একটা গান লিখতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না। আপনার গাইবার কোন দোষ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আপনি লামিয়ার চাইতে অনেক সুন্দর গান করেন।’
‘কিন্তু জীবনের এই প্রথম শিরশিরানির শেষ হলো কী করে? না, এখনও হয়নি?’
‘খুব সোজা। আমাদের দেশে এ রকম প্রায়ই হয়। বেশ কিছুদিন লামিয়া ক্লাসে এলো না। পরে শুনলাম বিয়ে হয়ে গেছে খুব বড়লোক একজন ব্যবসায়ী বরের সঙ্গে। পড়াশোনায় ইতি। ব্যস, এখন যখন নো ভ্যাকেন্সি তখন অন্য আরো ছেলেদের মতোই আমিও অন্যদিকে মন দিলাম।’
‘তারপর দ্বিতীয় বা তৃতীয় শিরশিরানি কবে হলো?’
সুফী কিছু বলার আগেই সংঘমিত্রা নিজেই বললো, ‘আচ্ছা আজ থাক এই পর্যন্ত। আপনাকে আর বিব্রত করতে চাই না।’
সুফী বললো, ‘বেশ তো। তবে পরের অধ্যায়ে যাবার আগে আপনার শিরশিরানির কথা শুনতে হবে। নিশ্চয়ই হয়েছে আপনার জীবনে। বলবেন কী?’
একটুখানি ভাবলো সংঘমিত্রা। তারপর বললো, ‘আমার ঘটনা অতো সুখদায়ক নয়। আপনি যেমন সহজে বললেন আপনার শিরশিরানির অভিজ্ঞতা আমারটা বলতে গেলে ভাবতে গেলেও বেশ কষ্ট হয়। আমার মনে হয় ছেলেরা যত সহজে এ রকম মনের কথাগুলো চটপট ভুলে যেতে পারে, মেয়েরা ততো সহজে মন থেকে এগুলো মুছে দিতে পারে না। তাদের মনের ক্ষত অনেক গভীরে চলে যায়। বিশেষ করে এ রকম অভিজ্ঞতা যদি একতরফা হয় তাহলে তার স্মৃতিচারণা খুবই বেদনাদায়ক হতে পারে। তাই এ মুহূর্তে আমি মনের ক্ষতটাকে শুধু শুধু খোঁচাতে চাই না। আপনি জানতে চেয়েছেন তবুও। তবে আমরা তো আরও কয়েক দিন এখানে থাকবো। আবার দেখা হবে। নিশ্চয়ই। আরো সুযোগ আসবে এসব কথা বলার। বলবো, সবই বলবো। শুধু আজ থাক। আজকের সুন্দর সন্ধ্যাটা আমি উপভোগ করতে চাই। ... আচ্ছা আপনার বাড়ির কথা বলুন না? কে কে আছেন দেশে আপনার? ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার দিনগুলোর কথা। আর তারপর কী করে গেলেন খবরের কাগজে?’
‘ইউনিভার্সিটিতে প্রথমে কেমিস্ট্রি পড়ছিলাম বাবা-মায়ের চাপে। মন ছিল না পড়াশোনায়। বিএসসি পরীক্ষা দিলাম না। অথচ আমি ছাত্র ভালই ছিলাম। আমার ঝোঁক তখন সাহিত্যে Ñ কবিতা আর গল্প লেখা নিয়ে। সবই বাংলায়। কিন্তু এগুলো নিয়ে তো আমাদের দেশে অন্ন সংস্থান সম্ভব নয়। তাই ঢুকে পড়লাম জার্নালিজম বিভাগে। আমি মনে মনে আমার ভবিষ্যৎ পথ ঠিক করে ফেলেছি। সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে নিয়ে অন্তত কিছু রোজগার করতে পারবো। আর আমার লেখালেখির কাজও চালাতে পারবো। এই সাংবাদিকতা বেছে নেয়ার ব্যাপারে আমাকে নৈতিক সাহায্য জুগিয়েছিলেন আমার ওয়াহাব চাচা। আবদুল ওয়াহাব প্রবীণ সাংবাদিক, আমার বাবার বন্ধু। দেশ বিভাগের আগে কলকাতার স্টেটসম্যান কাগজে কাজ করতেন। ঢাকায় এসে স্টেটসম্যানের প্রতিনিধি ছিলেন। কোন খবরের কাগজে নিয়মিত চাকরী করতেন না। একেবারে ফ্রি ল্যান্সার ছিলেন। আমার আগ্রহের কথা শুনে তিনিই আমার বাবাকে রাজী করালেন এই লাইনে যেতে। বাবা-মা মনে খুব কষ্ট পেলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন এ ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’
‘আপনার আর ভাইবোন নেই?’
‘হ্যাঁ, বড়বোন ডাক্তার আর ছোটভাই ইঞ্জিনিয়ার। দু’জনেই বিবাহিত। আর ছোটবোনটা মেডিকেল কলেজে পড়ে। আমাদের পরিবারের মধ্যে ওই শিখার সঙ্গেই আমার সবচাইতে বেশি বনে। আমার মনের কথাগুলো ওকেই বলা যায়। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য সবচাইতে নিরাপদ পেশা। আমাদের পরিবারে আমিই একমাত্র কুলাঙ্গার। আমার বাবা-মা দু’জনেই এখন অবসরপ্রাপ্ত। বাবা ছিলেন উকিল। আর মা স্কুলে পড়ানোতে ইস্তফা দিয়েছেন। আর এক কাপ চা খাবেন? সত্যি বলতে কী, আমার আজ এখান থেকে উঠে যাবার ইচ্ছে করছে না। এসব কথা বলতে শুনতে ভালই লাগছে।’
নতুন করে দু’ কাপ চা এলো।
সংঘমিত্রা বললো, ‘প্রথমে আমি ভাবছিলাম আপনার ভাবসাব দেখে যে আপনি খুব লাজুক মানুষ। জোর করে পেট থেকে কথা বের করতে হবে। কিন্তু এখন দেখছি আপনি অনেক সহজ হয়ে গেছেন। নিজে থেকেই কথা বলছেন। ভালই।’
‘তাই নাকি? তবে একটা কথা বলি। আপনার নামটা কিন্তু বেশি ভারী। বেশ এনার্জি খরচ হয় সংঘমিত্রা পুরোটা উচ্চারণ করতে। এটাকে ছোট করে মিত্রা করলে আপনার কোন আপত্তি আছে?’
‘মোটেই না। তবে একটা শর্তে। মিত্রা বলে ডাকলে আমাকে আর আপনি বলা যাবে না। তুমি বলতে হবে। ঠিক আছে?’
‘বেশ তো। শর্তটা মানা খুব সহজ। তাহলে আমরা দু’জনে বন্ধু। তুমিও আমাকে তুমি করে বলবে।’
সুফী হাত বাড়িয়ে দিলো। মিত্রাও হাসিমুখে হাত মেলালো।
মিত্রা বললো, ‘তুমি আমাকে আমার প্রিয় কবি রুমীর কবিতার বই দিলে। আরও তুমিও তো কবি। আমার অন্য প্রিয় সুফী কবি হলো হাফিজ। কিন্তু রুমী নামটা হাফিজের চেয়ে ছোট। আর কেমন একটা ঘরোয়া ভাব আছে এতে। তোমার আপত্তি না থাকলে আমি তোমাকে রুমী বলেই ডাকবো এখন থেকে। শুধু আমি না, সবাই তোমাকে রুমী বলবে।’
‘কোন আপত্তি নেই। তবে এ যে অনেকটা শেষের কবিতার মতো হয়ে গেল। আমরা দু’জনে দু’জনার নাম বদলে দিলাম। এখন শেষটা শেষের কবিতার মতো না হলেই হলো।’
‘কেন? শেষের কবিতার শেষটা তোমার পছন্দ না? আমার তো মনে হয় গল্পের শেষটা আর অন্য কোন রকম হলে কারুরই হয়তো ভালো লাগতো না। তোমারও না।’
‘হয়তো ঠিকই বলেছো। তবু শেষের কবিতার শেষ কথা Ñ ‘হে বন্ধু বিদায়’ কথাটাতে যে এক রকম ফাইনালিটির রেশ আছে, আমাদের বাস্তব জীবনে সেটা যেন কবিত্বের মোলায়েম ভাবটা বয়ে আনে না। বরং একটা কঠিন রূঢ় ধাক্কার মতো মনে হয়।’
‘আমি বলি কি Ñ মাত্র তিনদিন আমাদের দেখা হয়েছে। এরই মধ্যে শেষ বিদায়ের কথাটা কী হবে, কী হবে না ভেবে, আরো কতো কথা তার আগে থাকতে পারে সেগুলো ভাবলে অনেক ভালো লাগবে। আগামীকাল সকালের কথাই মনে করো। সকালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনীর বক্তৃতার পর শুরু হবে আমাদের প্রথম সায়েন্টিফিক সেশন। সেখানে সভাপতিত্ব করবেন পল ডিরাক। আমাদের পেপারটা পড়তে হবে।’
‘আচ্ছা, পল ডিরাকের নামটা যেভাবে তুমি করলে মনে হচ্ছে একজন জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক তিনি। কিন্তু আমি তো কিছুই জানি না তাঁর সম্বন্ধে। একটু বলবে তাঁর সম্বন্ধে আমাকে? যাতে আমি আমার খবরের কাগজের জন্য লিখতে পারি।’
মিত্রার মুখে একটু দুষ্টু হাসি এসে গেল যেন। বললো, ‘আমি কেন বলবো? তুমি জানো না, সেটা তো তোমার দোষ। তুমি একজন জার্নালিস্ট। এসব খবর তোমারই খুঁজে পেতে বের করা উচিত। আমি কেন বলতে যাবো?’
‘মহা মুসকিল। সময় কোথায় বইপত্র পড়ে সব খবর জানার। কাল সকালেই তো আমাকে লিখতে হবে।’
‘সে তোমার সমস্যা। আচ্ছা, তুমি দেখতে পাচ্ছো রাস্তার ওপাশে সমুদ্রের ধারে একটা ক্লাবঘরের মতো যেটা, সেখানে কতো রঙিন বাতি জ্বলছে এখন। বেশ কিছু লোক অনেকে জোড়ায় জোড়ায় ওদিকেই যাচ্ছে। একটা উৎসব উৎসব ভাব।’
‘তোমার বুঝি যেতে ইচ্ছে করছে ওখানে?’
‘তা একটু যে করছে না তা বলতে পারি না।’
মিত্রা এবার সুফীর হাত ধরে বললো, ‘চলোই না। দেখা যাক কী ব্যাপার। তুমি নাচতে পারো?’
‘না, জীবনে কখনও চেষ্টা করি নি। এ বয়সে শুরু করতে গেলে লোকে হাসবে।’
রাস্তার ওপাশে ক্লাবঘরটার মতো জায়গায় যে গানবাজনা শুরু হয়েছিল কিছুক্ষণ আগে, অন্ধকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা আরও জমে উঠেছে। সমুদ্রের ধারে অনেক লাল, নীল আলোয় ঘেরা একটা উৎসবের সমাবেশ।
বিল চুকিয়ে সুফী বললো, ‘চলো ওদিকে একটু ঢুঁ মারি। ঢুকতে হয়তো পারবো না কিন্তু কৌতূহল হচ্ছে জানার জন্য ব্যাপারটা কী?’
রাস্তা পার হবার জন্য ওরা দু’জনে ফুটপাথের পাশে দাঁড়ালো। বেশ ট্রাফিক জ্যাম Ñ অফিস ফেরতা গাড়ির ভিড়। তাছাড়া সমুদ্রের ধারে বেড়াবার জন্য দলে দলে অনেকে বেরিয়েছে।
সুফী ভাবছিল রাস্তাটা পার হবে কেমন করে। ও ইতস্তত করছিল দেখে মিত্রা বললো, ‘আমার হাত ধরো। আমার সাথে এসো। ওরা একজনকে চাপা দিতে পারে কিন্তু দু’জনকে একসঙ্গে চাপা দেবে না। এসো।’
ওরা হাত ধরাধরি করে রাস্তা পার হলো। ক্লাবঘরের গেটের বাইরে একটা বক্সঅফিসের মতো ঘর। ওরা ঢুকবার জন্য তৈরি হয়ে সেখানে দাঁড়াতেই একটা উর্দিপরা লোক জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনারা আমাদের মেম্বার? কার্ড এনেছেন?’
‘না, আমরা মেম্বার না। বিদেশ থেকে এসেছি।’
‘সরি, আমাদের অনুষ্ঠান শুধু মেম্বারদের জন্য।’
ওরা পাশে সরে দাঁড়ালো। আরো কয়েকজন ওদের পেছনে লাইন করে দাঁড়িয়ে গেছে।
একজন টাক মাথাওয়ালা বয়স্ক লোক সুফীর কাঁধে টোকা দিয়ে বললো, ‘এক্সিউজ মি, আপনারা বিদেশ থেকে এসেছেন বললেন। আর আমাদের ক্লাবের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চান? কোত্থেকে এসেছেন আপনারা?’
টাকওয়ালা ভদ্রলোকের বয়স ভালই হয়েছে মনে হলো, প্রায় সত্তরের মতো। কিন্তু বেশ ঋজু কাঠামো শরীরের। মুখে আভিজাত্যের ছাপ। হাতে একটা ছোট ছড়ি। তাঁর সাথে ভদ্রমহিলাও বেশ বয়স্ক। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, স্লিম চেহারা। লাল শাড়ি পরা ভদ্রমহিলার হাবভাবে একটা নানী-দাদীর ছাপ স্পষ্ট।
সুফী বললো, ‘আমি এসেছি ঢাকা থেকে। আর আমার বন্ধু নেপালের। আমরা বম্বেতে এসেছি সায়েন্স কংগ্রেসে যোগ দিতে। আজকেই আমাদের প্রথম দিন এ শহরে।’
‘বেশ ভালই হলো তাহলে। আপনারা দু’জনেই বিদেশী। আপনারা যদি চান আপনাদের আমি এই ক্লাবের গেস্ট হিসেবে নিতে পারবো। শুনলেনই তো এ ক্লাবের অনুষ্ঠানে অ-সভ্যরা ঢুকতে পারবেন না। আপনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন সায়েন্স কংগ্রেসে যোগ দিতে। অতএব আপনাদের নিমন্ত্রণ জানানো আমার কর্�