করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০১ সংখ্যা
আগস্ট ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





বিজিতা
রুখসানা কাজল
গেটটা পেরুলে মাত্র একশ তিরিশ ফুট রাস্তা। হাঁটতে হাঁটতে একটা গল্প বানিয়ে  ফেলে পাঁচতলার ইঞ্জিনিয়ার রাইসা। অফিসের কেঊ যদি জিগ্যেস করে কি করে হল তাহলে বলে দিবে বাথরুমের দরোজায় হঠাত ঘা লেগে ফুলে গেছে বাঁ চোখটা। রাশেদ ত আজ অফিসে আসতে  বারণ  করেছিল। কিন্তু ছুটি  জমাচ্ছি বলে এলাম রে। শুধু শায়লা ঠিক বুঝে যাবে। একটা  পেইন কিলার  দিয়ে বলবে, এভাবে আর কতদিন বাঁচতে পারবি বল ত!  
দরকারি ফাইলটা ঝাপসা হয়ে যায়। আজকাল মন খুব দুর্বল হয়ে যাচ্ছে রাইসার।  শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। তবু কষ্ট চেপে অফিস করছে। কে যেন বলেছিল স্বামীর একটা চড়ও অনেক ভাল বাইরের পুরুষের চড় খাওয়ার চেয়ে। তবু ত নিজের স্বামী, নিজের সংসার, হোক সে মশারির মত পলকা পাতলা। একেবারে বেআবরু ত করে তোলে না! কিন্তু কত দিন ? রাশেদ সাধারণ বোধবুদ্ধির বাইরে চলে যাচ্ছে দিন দিন। পাঁচ বছরের ছেলের সামনেই ড্রিংক করে মার লাগাচ্ছে। গালাগাল করছে। এভাবে কি কোন সংসার বাঁচে ? বাঁচানো সম্ভব! প্রথম শিশুটি কাঙ্ক্ষিত কিন্তু এই দ্বিতীয় শিশুটি কি ভুল হল নেওয়া ? পনেরদিন আগে ঘর ছেড়ে ওর বড় বোনের বাসায় চলে গেছে রাশেদ। কাল এসেছিল আলমারি থেকে কিছু নিতে। এসেই এই মারপিট। এক ই অফিস ওদের। আজ রেজিগ্নেশন লেটার ড্রপ করে দেখা করে গেছে রাশেদের  বড় বোনের ছেলে। মামি মামা খুব অসুস্থ। সেরে  গেলে বাসায় চলে আসবে। চিন্তা করেন না। রাইসার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট ভাগ্নেটি ।  বন্ধুর মত সম্পর্ক। জানে মিথ্যা কথা বলতে কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটি। ওদেরও ত কিছু করার নেই। রাশেদ ত শিশু নয়!  
রোজ একবার তরকারির দাম যাচাই করে চারতলার হেলেনা বেগম।  অফিসের গাড়িতে ওঠার আগে চকচকে নতুন লাউয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে রেখে দেয়। নতুন আলু, মটরশুঁটি, পেঁয়াজকলির দাম আকাশ ছোঁয়া। শোল মাছ আর লাউয়ের সাথে ভাজা জিরা বেরেস্তা পেয়াজ বাটার সম্বার আর নামানোর আগে ধনেপাতা ছড়িয়ে একটু  দমে রেখে দিলে, আহা অমৃত। নাহ, রান্নাই ভুলতে হবে দেখছি। কতদিন আর দাম কমার অপেক্ষায় থাকা যায়। ছেলেমেয়ের বাড়ন্ত বয়েস তার সাথে পাল্লা দিয়ে  বাড়ছে পড়ার খরচ। তানিম কোন টাকা পয়সা না দিয়েই চলে গেছে । জমি ফ্ল্যাট সব বিক্রি করে ব্যাংকে টাকা রেখে খাচ্ছে, ঘুরছে, ফিরছে ।  এরমধ্যে দু দুটো বিয়ে করেছে। ছোট বউটাকে নিয়ে দেশের বাড়িতে থাকে এখন। সেখানে হেলেনা বেগম বাগান করেছিল।
পেয়ারা ধরে ছুঁয়ে থাকে মাটি। করলার সবুজ গন্ধে বুনো করে তোলে দেহ। ওই বাড়িতে আর যাওয়া হবে না কোনদিন।  একার সংসার একার আয়ে টানতে আজকাল খুব ক্লান্ত লাগে হেলেনার! একেবারে না লড়ে ডিভোর্স মেনে নেওয়া কি ভুল হল ?     
বেশ আছে তিনতলা। ধারালো পায়ে সিঁড়ি ভাঙ্গে দুই বোন। হলুদের অনুষ্ঠান, জন্মদিনের পার্টি বা কারো সাথে একদিন দুদিনের হ্যাপি ট্রিপ দিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখছে। ভাইটা পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম ইশকুলে। ওদের মা নিলু আক্তার পাড়ার একটি ইশকুলে পড়ায়। বলেছিল ছাড়িয়ে আনি বাংলা মিডিয়ামে দিয়ে দিই। এত খরচ। বোনেরা আপত্তি করে। না মা, লোকটা দেখুক তাকে ছাড়াও আমরা চলতে পারি। নীলু আক্তার  চুড়ান্ত আপোষের সুরে বলেছিল, তাহলে ফিরিয়ে আনি শত হলেও ত তোদের বাবা! মায়ের আপোষে বার্তায় ক্ষেপে যায় মেয়েরা। আর কত মা ? ক্ষয়া চাঁদ আলো ফেলেছে ছাদের কোণে । বড় মেয়ের লাগানো  চন্দ্রমল্লিকা ফুটেছে , পাশে সাদা গাঁদার ফুল। বিদ্রোহ জাগে মনে। কেন লম্পট স্বামী বা সন্তান ই কি জীবনের শেষ চয়েস হবে ? আমার বলে কি কিছু নেই? একটু একা থাকা, প্রিয় কিছু বই, মানুষ , কিছু গান !  সিঁড়িতে চাপা শব্দ করে কেউ আসছে। ছোট মেয়ে এসে জড়িয়ে ধরে। এই মেয়েটা খুব আদরের ছিল বাবার। জানো মা লোকটার সাথে দেখা হয়েছিল কক্সেসবাজার। লিফটে  ঊঠতে গিয়ে আমাকে দেখে চলে যায়। এই আশংকাটি ছিল মনে মনে। ওদের বাবা যে আদিরসের খেলায় ঘর ছেড়ে গেছে মেয়েরা সেই পথে গিয়েই ঘর বাঁচাচ্ছে। একই খেলার মাঠ যে। একদিন না একদিন দেখা ত হতেই হবে। চাঁদের আলো কেমন কঠিন হয়ে উঠছে। খুব স্বাভাবিক গলায় মায়ের পিঠ থেকে মুখ তুলে  মেয়েটা বলে, ক্লান্ত লাগছে মা। আমি ঘুমুতে গেলাম।
একটা হলুদ  অসুখ ছাদটাকে  ঘিরে ফেলে। শরীর কি নিত্য দিনের  খাওয়ার প্লেট ? ধুয়ে ফেললেই আবার ঝা চকচকে ঝলক দেখায়। আর মন ? তার মনে কেন অবিচ্ছেদ্য প্রতিরোধ জন্মে ? সে কি কোন অশরীরী নারী! তার কি জাগরণ নেই ? নেই কোন উত্তাপ ? আগ্রাসী আগুনে তার কি ইচ্ছা করে না কাউকে পুড়িয়ে  মারতে? কিম্বা কোন নরম শ্যাওলা বুকে মুখ ডুবিয়ে ভালবাসা তুলে নিতে?  কেন সে নিজেকে মন্দির মসজিদ গির্জার মত দূরাগত করে রেখেছে? সেও ত নারী। তাহলে বেলালের কথাই ঠিক। সে কোন নারী নয় কেবল বদ্ধ লাইব্রেরী মাত্র। উইপোকা খেয়ে নিয়েছে কামনার নির্যাস।  ছাদের  দরোজা বন্ধ করে খুলে ফেলে রাত পোশাক। শরীরের খাঁজে জমে থাকা হালকা মেদে বেজে ওঠে জলতরঙ্গ। জ্বলে  ওঠে শরীর। চন্দ্রমল্লিকার মত প্রস্ফুটিত বুকে চুমু খায় ভেজা জ্যোৎস্না । শিশির ঝরছে নম্র বিহ্বলাতায়। শত মুখে কথা বলছে শরীর। চাতকের মত জ্যোৎস্নার আদরে ভেসে যায় সে।
হেলেনা বেগম থলে উপুড় করে খুশী হয়। কেউ একজন সামান্য উপকারের বিণিময়ে শীতের আনাজ পাঠিয়েছে । গন্ধ আসছে তাজা তরকারির। করলা ক্ষেতের নিচে ঘন সবুজের তাজা গন্ধ জমে থাকে। বেগুনের গায়ে ভোরের শিশির। লাউ পাতার আড়ালে পথ করে কেমন পুষ্ট হয়ে ঝুলে থাকে লাউগুলো।  ছবিগুলো মনে পড়ে যায়। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। মেয়েটা মেধাবি চুপচাপ শান্ত । ছেলে শুভর মনে গনগনে আগুন সারাক্ষণ। উদয়স্ত পরিশ্রমের পরে রাতে শোয়ার  সময় বিছানাটাকে মনে হয় কবুতরের বুক। এখন আর শরীর নিয়ে কেউ নিষ্ঠুরের মত  টানাহেঁচড়া করে না। প্রতি রাতের প্রেমহীন কামের হাত থেকে পালাতে হয় না ছেলেমেয়েদের ঘরে। এখন নিরম্বু শান্তি। কেবল মাঝে মধ্যে লুকিয়ে রাখা একটা প্রশ্ন কুরে খায় , কি পেলাম এই জীবনে ? শুধু ছায়া দিয়ে গেলাম । আমারও ত ইচ্ছা করে একটু ছায়া পেতে ! ভাবনাটা জেঁকে বসে কোন কোন দিন, সে কি শুধু পাখি মানুষ ?    
অনেক রাতে রাইসার শরীর মুচড়ে ব্যথা নামে। কোন মতে চারতলায় এসে হেলেনা বেগমকে বলে ভাবী আমাকে বাঁচান । শুভ ছুটে যায়  তিনতলায়। ফোন দেয় শায়লাকে। সেই রাতে স্বামীকে নিয়ে চলে আসে শায়লা। ফোন নম্বর নিয়ে ছুটে ছুটে কাজ করে শুভ। রাইসার বোনদের আর ভাশুর ননদদেরও জানিয়ে দেয়। ওরা কেউ আসেনা। খুব ভোরে ডাক্তার জানায় এবার্ট মাস্ট। এই বাচ্চা রাখা যাবে না। রাইসা নিজেই সিগনেচার করে শায়লার হাত জড়িয়ে বলে, যদি ফিরে না আসি অহমকে কোন বিদেশী অরফ্যানে দিয়ে দিস প্লিজ। তবু ত বেঁচে থাকবে। শায়লার স্বামী মাথায় হাত রাখে, আমরা ত আছি ভাবিস না তুই।”   
সমস্ত পৃথিবীকে ঘৃণা দেখিয়ে একটি মৃত মেয়ে জন্ম নেয়। কেউ কোন দুঃখ পায় না। এমনকি রাইসাও নিজেকে ভারমুক্ত মনে করে। তবু স্টিলের ট্রেতে মৃত মেয়ের মুখ দেখে মুচড়ে ওঠে বুক । ব্যাকুল হয়ে বলে, অহম কোথায় ? আমি সুস্থ আছি। আমাকে ঘরে নিয়ে চলুন ভাবী। হেলেনা বেগমের দারুন রাগী ছেলে শুভর কোলে ঘুমিয়ে আছে অহম। ওদের ঘিরে বসে আছে ফ্ল্যাটের  অন্য ছেলেমেয়েরা। শায়লার স্বামী নৃতাত্ত্বিক । দৃশ্যটি ভাবায় তাকে। চারপাশের ভাঙ্গন মেনে এই নতুন প্রজন্ম কেমন একে অন্যকে জড়িয়ে নিয়েছে। তবে কি নতুন কিছু  সৃষ্টির জন্যেই কি এই লাগাতার ভাঙ্গন ? কিম্বা দৃশ্যটি কি মানব সভ্যতায় নবতর কোন সংযোজন ? যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রক্তের সম্পর্ক ই সভ্যতার শেষ কথা  নয়! তিনি যেতে যেতে আবার ঘুরে দাঁড়ান । তিনতলার বড় মেয়েটি ঘুমন্ত অহমকে নিতে চাইছে। শুভ না বলছে । আপু কষ্ট হচ্ছে না। আপনি বসেন। নৃতাত্ত্বিক বোঝেন এক খন্ড  নতুন ভূমি তৈরি হচ্ছে। মানবতার ভূমি। পৃথিবীর আর কোন চিন্তা নেই।  
দু মাস পরে একেবারেই মুক্তি নিয়ে নেয় রাইসা। যে যেতে চায় একেবারেই চলে যাক।  কি হবে জোর করে  ধরে রেখে ? সকাল  সাড়ে সাতটায় ছেলের হাত ধরে নেমে আসে রাইসা। একশ তিরিশ ফুটের রাস্তা পেরিয়ে তিন জন  নারীই জীবনের টুটি চেপে এগিয়ে যায় যে যার পথে।