করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





পৌষের রোদের অপেক্ষায়
কাকলী আহমেদ
দুপুরের এই বিষণ্ণ রোদটুকু বড় ভালো লাগে মেঘলার। অথচ কতদিন সে গায়ে মাখেনি এমন রোদ। বারান্দায় এ কোণাটায় দাঁড়ালে রোদটা সম্পূর্ণ এসে জড়াজড়ি হয়ে যায় শরীরের সাথে। দূর থেকে আসা রোদটার তীব্রতা ম্লান হয়ে যায়, আনেকটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মতো। যেন ধূসর, একবারে ছাইরঙা। মোড়াটা টান দিতেই তাঁতের শাড়ীর কোনাটা মোড়ার বাঁশের খোঁচায় ফড়াৎ করে ছিঁড়ে গেল। মনটা খারাপ হয়ে গেল মেঘলার। অফিস ফাঁকি দিয়ে দিনটাকে উপভোগের বাসনায় ভাটা পড়লো। যাকগে এমনটা হতেই পারে ভেবে সৌন্দর্যের অবগাহনে নিমগ্ন হলো মেঘলা । এলামেলো টুকরো সব স্মৃতি মনে পড়তে লাগল । পেছনে ফেলে আসা দিন, ছোটবেলা একধারে সব। যখন ছোট ছিল, লেখাপড়ায় নিবিষ্ট ছিল তখনও দুপুরটাই তাকে ভীষণ নাড়া দিত। যেন অদ্ভুত সৌকর্য সুষমা। এর মহিমা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। কেমন অদ্ভুত আবেশে জড়িয়ে ধরে। ছাড়ানো মুশকিল। দুপুরের বিষণœতায় যেন গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে হৃদয় আমার নাচিরে আজিকে ময়ূরেরও মতো নাচেরে।
যখন ছাত্র ছিল, তখন মা অফিসে গেলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করত। ঘুমের রগরগে ভাবটাকে আহলাদ দিয়ে আয়েশের চরম মাত্রায় পুষিয়ে নিত। ঘুমের চেয়ে প্রিয় আর কিছুই হতে পারে না। মেঘলা বরাবর এমনই ভাবে, ঠিক যেন নিজ জঠর থেকে বেরিয়ে আসা তুলতুলে সোনামুখ। প্রথম দেখা মাত্রই প্রিয়তার পরিপূর্ণ অর্জন । আলস্যে গড়িয়ে গড়িয়ে সে বিছানা ছাড়ত, সময়ের নাস্তা খেতো অসময়ে। ভাবটা এমন, ক্ষতি নেই এক সময় খেলেই তো হলো। রাশি রাশি পড়ার তাড়না তিক্ত করে দিক ঘুম থেকে আহরিত বিলাস চেতনা। হয়তো পূর্ণতার  প্রাপ্তিতে ঘাটতি এনে দেয় খাদ। নাস্তা খাওয়া হয়ে গেছে, এবার বসতে হবে পড়ায়। কেন যেন মন বসে না, মনে হয় এখন না। বরং পেপার পড়া যাক, বহির্বিশ্বের খবরের ডালা ভারী করা ভালো । দুপুরটাই পড়ার উত্তম সময়। কেন যেন দুপুরের ফিকে রোদ লেখাপড়ার বিষয়গুলোকে সহজ করে তোলে । এমনটা কেন হয় ?
ঝট করে উঠে পড়ে মেঘলা । গান শুনলে কেমন হয় ? আমেরিকার ইউ ক্যান ডু ম্যাজিক। আহ্ ! চিত্তে দোলা দেয় যেন সুরটা । মুহুর্তের চিন্তায় ক্যাসেটটা অন করে। কাল রাতেও এটা শুনতে শুনতে ...মনে নেই কিচ্ছু মনে নেই। কখন ঘুমালো। কটা হবে ? ইস্কাটনের এই বাসাটায় এক বছর হলো ওরা এসেছে। ময়লা নোনা ধরা একটা বাড়িÑ একতলা । ভাল দিক শুধু এটুকুই ছোট্ট এক রত্তি উঠোন । যেন ঝিনুকের মাঝে মুক্তো। ঝিনুকটা  তখনই দামী যখন পেটে তার মুক্তো থাকে। এ বাড়ির উঠোনটা কেন যেন ভালো লাগে ওর। বরই গাছটার ছায়া কি এক মোহময় আবেশ ছড়ায়। ছায়া ছায়া রোদ। আহ! দুপুরগেুলোকে আরো দীর্ঘ করে দেয়।
মেঘলার দিন কাটে একাকীত্বের সংগে সখ্যে। নিবিড়তায়। দিনে দিনে একাতীত্ব খুঁজে পায় বহুমাত্রিকতা। যেন সহস্র দিনের অমোঘ নৈকট্য এর সংগে। ভাইবোনহীন সংসারে এমনই যাপন। একা, একাকীত্ব,শূন্যতা, সব যেন ত্রিমাত্রিক যোজনা। গানের তালে তালে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এপাড়ার আমেজ এমনো নিঃশ্বাসের সাথে ফুসফুসে পৌঁছয়নি। বুঝে উঠতে সময় লাগবে আরো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইংরেজী গানের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে। কিছু স্পষ্ট, কিছু দূর্বোধ্য। তবু ভালো লাগ । কেমন যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায় কাঁচ ভাঙ্গা দ্যোতনায় । আর সময় নষ্ট নয়, গোসলে ঢোকে। গায়ে এক মগ পানি ঢালতেই রোমগুলো বিদ্রোহ করে ওঠে। নভেম্বরের এই সময়টায় শীতের অকস্মাৎ আগমনের বার্তা এভাবেই বুঝিয়ে দেয়। বাথরুম আর গুন গুন-এ যেন দৈব যোগাযোগ। আচ্ছা কেন এমন হয় ! সময় নিয়ে গোসল সারে । বের হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় । মুখটা এখনো ফোলা  ফোলা । কেমন হাস্যকর দেখাচ্ছে। ফিক করে সহসে দেয় মেঘলা । আপা, পেপারঅলা টাকা নিয়া গেছে। ভাংতি নাই বইলা পুরাটাই নিছে। পরের মাসে কাইট্যা রাখতে কইছে। মনে কইরা কইয়েন আম্মারে। সারাদিন পর আম্মা অফিস থন ফিরলে অমার কইলাম কিচ্চু মনে থাকব না ।
বলব বলব, তুমি টেবিলে খাওয়া লাগাও বুয়া । খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে  সময় নেয় অনেক । রগড়ে রগড়ে এঁঁটো ময়লা তোলে। এ স্বভাব পুরো তার বাবার মতো । বড্ডো খুঁতখুঁতে । গুন গুন করে মনে মনে গান গাইতে হাত মোছে নীল তোয়ালেটায় । খালা এনছিল আমেরিকা থেকে সেই কবে , মনে নেই। বিদেশ ধেকে আনা জিনিষে কি যে সুন্দর একটা গন্ধ থাকে। প্রাণটা ভরে যায়। মেঘলার নাকে সেই পুরনো গন্ধটা ভেসে আসে। এ কি ! কি ব্যাপার ! গন্ধটা এখনো আছে নাকি ? বার বার নাকের কাছে নিয়ে প্রিয় গন্ধটা পেতে উন্মুখ হয়। নিশ্চিত হয় পুরনো সবকিছুই বাসি নয় বিদেশী গন্ধটার মতো। কলিংবেলের শব্দে চকিতে ফিরে তাকায় গ্রিলের দজোর দিকে। হতচকিত হয়ে ওঠে মেঘলা । ভাবতে ভাবতে কোথায় কোন ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিল সে। ছেলেবেলার দিনগুলোয় ডুবেছিল সে । ভেসে উঠেছিল এক একটি দিনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা । দুপুরের বিষণœতা তাকে টেনে নিয়ে ঘনিয়েছিল সেই কবে ...। ভাবতে ভাবতে সে যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল।্ দুপুরের বিষণœতার এত জোর। ছায়া ছায়া উঠোন, বরই গাছতলা, মাটিতে শুকনো পাকা বরই...বয়োঃসন্ধিক্ষণের ভাললাগা ...। বারান্দায় বসে বসে এতসব ভাবছিলো। মনে মনে হাসি পায় মন বুঝি আজ নিজের তালে নিজেই নাচছে তা থৈ থৈ।
মা টাকা দিবেন? কিছু কিইনা খামু। হালের ফকিররা কলিংবেল টিপে আসে। বাহ! বড় চমংকার। কিন্তু সে উপরে উঠলো কি করে? বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁকি মারে নীচে। গেট হাটখোলা। এই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করেছে আধুনিক ফকির। নীচে কোন গাড়ি নেই । কাজেই ভাড়াটেরা কেউই দরোজা বন্ধ করবার  ঝক্কি নিচ্ছে না । ক্ষতি নেই এভাবে অরক্ষিত থাকলে, এখন তো হারাবার ভয় নেই। মেঘলা শাড়ির আঁচলটাকে কটিদেশ থেকে ঘুরিয়ে সামনে আনে। বেডরুমে যায় । অফিসের ব্যাগ্ হাতড়ে খুঁজে পায় পাঁচ টাকার নোট । মলিন, ধুসর ফাটা ফাটা। হয়তো কোন ভিক্ষুকের হাত ঘুরেই এসেছে । চলে যাবে আবার অন্য কোন হাতে।
বেডরুম থেকে বেরিয়ে মাইক্রোওয়েভের  সুইচটা অফ করে সরু চিলতে গলির মতো বারান্দা পিরেয়ে, গ্রিলের দরজায় এসে দেখে ভিক্ষুকটা নেই, চলে গেছে। ভুল হয়েছে, দাঁড়াতে বলা দরকার ছিল। আজকাল ভিক্ষুকরাও সময়ের প্রপার অ্যালোকেশন করে। যুগটাই যে মেধাবৃত্তিকে ঠিকভাবে কাজে লাগানোর । পাঁচ টাকার নোটটা হাতে গুঁজে মোড়াটায় গেয়ে বসে। মনে নেই কতদিন পর এমন নিরবচ্ছিন্ন সময় কাটাচ্ছে সে। অফিস , বাসা, অফিস .সংসার , প্রাত্যহিক কাজ । সব যেন রুটিনে বাঁধা কোথাও কোন মিসম্যাচ নেই। কোন গুরুপাক নেই অসমান্তরাল জীবন বয়ে চলেছে যেন অনন্তকালের দিকে। মোড়ায় বসে মেঘলার মনে পড়ল, সে কত বিষয়ই না ভেবেছে কিছুক্ষণ আগে। ছোটবেলার কত কথাই মনে পড়েছে। কাজের বুয়া খোকার মার কথাও এভাবে মুহুর্তে দোলা দিতে পারে ভাবলে অবাক লাগে। খালার আনা বিদেশী তোয়ালেটার কথা...্ কি রঙের ফুলতোলা ছিল ডেন মেশিনে ? কেমন ছিল আঁকিবুকিটা ? নাহ । মনে পড়ছে না, গোলাপী আর বেগুনিতে মেশানো ? না না খয়েরী খয়েরী । না স্মৃতি হাতড়ে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে করবার চেষ্টা যেন। অস্পষ্ট স্মৃতিটাকে আরো বেশী দূরে ঠেলে দিচ্ছে । ঠিক চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দূরে সরে যাওয়া দৃশ্যের মতো। একসময় দূরে যেতে যেতে এক বিন্দুতে পরিণত হয় । তারপর উধাও । মেঘলার মুহূর্তে মনে হয় সব স্মৃতিই বোধহয় এমন না । নয়ত কেন সম্পর্কের সাথের দিনগুলো এখনো জ্বলজ্বলে স্মৃতি। ভোলার নয়। অথচ ভাবলে হৃদয়ের পুরনো ক্ষতটায় থেকে থেকে চোট লাগে । দগদগে হয়ে ওঠে। ছিঁড়ে খঁড়ে সব। সাপের মতে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরে ভেতরের সত্তায় । দম বন্ধ হয়ে আসে । নিঃশ্বাস আটকে যায় । মনে হয় চক্রাকারে ঘুরতে থাকে জীবনের সব না পাওয়াগুলো। কোথাও যেন কোন ভাললাগা নেই সবই ফাঁকা। এই বিত্ত, বৈভব, চাকরীর সাফল্য, দেবতুল্য স্বামী প্রতীম সব ফিকে হয়ে আসে ।
সমীকের সাথে মেঘলার প্রেম হঠাৎ করেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময়। কেবল দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতেই অঘটন সহপাঠীটির সাথে। সমীক স্মার্ট। অবয়বের নিখুঁত পারিপাট্য না থাকলেও কেমন যেন সম্মোহনী শক্তি আছে ওর। গ্রুপ স্টাডির ফাঁকে ফাঁকে কিভাবে যে কোন মুহূর্ত থেকে এ ভাললাগার শুরু নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তারপর দীর্ঘদিন দুজনের ভাবনাগুলো এক ছত্রে বাঁধা পড়লো, কি ভীষণ ভাল লাগা , কি উদ্দামতা, পাশাপাশি চলা, চিন্তা, চেতনা, মায়া, মোহ ভাগাভাগি করা। পূর্ণতায় পরিপূর্ণ আবহের ছটায় অবগাহন। যেন সোনালী সময়। প্রেমের শুরুতেই বাসায় জানালো মেঘলা। কর্মজীবি মা । বাস্তব চিন্তাভাবনা। দাম দিলেন মেয়ের ভললাগাকে। এ যেন যুগের চাওয়া, সময়ের সাথে হাত মিলিয়ে চলা। মেঘলাও কম আত্মপ্রত্যয়ী নয়। ওর সিদ্ধান্ত খেলো নয়। নিশ্চিন্ত হয়, হাজার হলেও বাড়ির ব্যাপারটা ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিল ওকে। বাবার সম্মতিও মেলে। অন্যদিকে সমীকের বাবা মা অপেক্ষাকৃত আধুনিক । তাদের দিক থেকেও বিষয়টাকে সহজ হিসেবেই গ্রহণ করেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় চত্তর পেরোতে সময় লেগে যায় অনেক। সমীকের আগেই মেঘলা চাকরী পেয়ে যায়। কাজ খোঁজার ব্যাপারে সমীকের বাছাবাছি। ইচ্ছে বিদেশ পড়তে যাবার। জি.অর. ই , জি. ম্যাঠ., টোফেল দিতে থাকে । চালাতে থাকে বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির  সাথে যোগাযোগ। সমীক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । ভাগ্যে শিঁকে ছিঁড়বেই। মেঘলার যেন তর সয় না। সেই যে আটপৌড়ে বাঙালী মেয়েদের মত সংসার করার শখ। প্রেমের ভাললাগাগুলোকে অঞ্চলে বাঁধা। তবু চাকরীর ব্যস্ততায় সময় কেটে যায়, তাছাড়া সমীকের সংগে সুখানুভূতি ভাগাভাগি খারাপ কি ! যায়, সময় চলে যায় , নিঃশব্দে কোন কথা না বলে। দিন যাপনের দ্রুততায় সময় চলে যায় । ব্যস্ততা বাড়ে। কুরে খায় সূক্ষ অনুভূতি , ভাললাগা ।
সময় অতিক্রম করে অতিক্রান্ত সময়কে, সমীক অনড়। বিদেশে যাবেই। প্রস্তুতি নিতে নিতে অনেক সময় ডিগবাজি খায় , ক্রিকেট মাঠের স্পিন বলের মতো সময় ঘুরতে ঘুরতে গড়ায় অনেকটা পথ। মেঘলাও  অধৈর্য হয়। অথচ সমিকের প্িরত ভালবাসায় হৃদস্পন্দন মাঝে মাঝেই থেমে যায়। সামনাসামনি কিছুই বলতে পারে না। ভালবাসার অটুট বুনোটে খুব মিহি এক সেলাই থাকে তা যেন টান টান করে রাখে সব। কোন কটু কথা, কঠোর পদক্ষেপ থেকে নিজেকে রাখে বিরত । অসুবিধে নেই সময়ই বলে দেবে গন্তব্য । নিয়ে যাবে সুন্দর পরিণতির দিকে। হয়ত দেরী হবে তবু  পূর্ণতার মাধুর্য খুঁজে নেবে দুটো বিলীন সত্তায়। দেখাশোনায়  ভাটা পড়ে বেশ। যোগাযোগ থমকে যায় হঠাৎ করেই।
তারপর ...অনেকদিন পর সমীক নিজেই অফিসে যোগাযোগ করে। চলো লাঞ্চ করি আজ বাইরে। হাফবেলা অফিসের পর। বেশ, হাতের কাজগুলো গোছাই, তুমিও স্টেডিয়ামের কাজটা সেরে আনো ফাঁকে।
কাঁধে নতুন কেনা ব্যাগটা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সমীক ফেরা মাত্রই চাইনিজের আলো আঁধারিতে বসে। দুপুরের খাবার পালা সারতে, কথা বলার প্রয়োজন মেটাতে। পছন্দের হট অ্যান্ড সাওয়ার স্যুপ খেতে খেতে সমীক বলে বসে , আমাকে হারালে কতটুকু কষ্ট পাবে তুমি?
প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারে না মেঘলা। কী বলছে আজ এতদিন পর হঠাৎ করে এসে ? ভাবে রহস্য করছে সমীক। ধীরে ধীরে কথার গুরুত্ব বুঝতে পারে।  কারণ পরিস্কার। সনাতন লোভ। সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছে সমীক। মেয়ের বাবা মা বিদেশে পড়তে পাঠাবে। পরিবারের ভেতরে চেনা মেয়ে , দূরসম্পর্কের খালাতো বোন। একটা চোখ পাথরের। খুঁত নিয়ে জন্মানো মেয়েটাকে পার করবার এর চেয়ে সহজ উপায় বোধ করি আর কিছু হতে পারে না।
মেঘলার গলা দিয়ে গরম স্যুপ শ্বাসনালীকে তপ্ত করে তোলে। মনে হয় যেন এখানে পৃথিবী স্থির। ভাল লাগার মৃত্যু । ভালবাসার চরম অপমানের মৃত্যু। সমীকের ছোঁয়াগুলো মুহূর্তে অসত্য হয়ে যায়। এক লহমায় ফিকে হয়ে যায় ঝকঝকে উল্লাস। জীবনের উচ্চাকাংখার কাছে নতজানু হয় রক্তমাংসের মানুষের ভালবাসা। সেই কবে শেষ। তারপর মন সামলে বিয়েতে রাজী হওয়া। প্রতীমের ঘর করা। প্রথম বছর খটাখটি তারপর সয়ে চলা। এখন মোটামুটি ভালো থাকা। তবু কেন আজো বুকের গহীনে পোড়া আঁচড়ে পড়া শ্যাওলা জমা গোপন কথাগুলো এমন দুলে উঠলো। জীবনের সব না পাওয়াই কি তীক্ষ্ম ধারসম্পন্ন চুড়ি ? কোন দিনও তার ধার কমে না। আরো বাড়ে । যা ফালা ফালা করে সত্তা। কপালের দু, পাশের শিরগুলো দপ দপ করে ওঠে।
আমি হেরে গেছি। বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে মেঘলা। শখের শাড়িটার কোনটা ঁিছড়ে যাওয়ার বেদনা পরাস্ত হয় দগদগে ঘাটার কাছে। নাহ্ ! অফিস কামাই করাটা আজ ঠিক হয়নি । ব্যস্ততাই একমাত্র মানসিক অস্থিরতার মুক্তি। বিষণœ দুপুর, অলস দিন, শৈশব, খোকার মা, রেজিষ্টার বিল্ডিঙ, ফাঁকা মাঠ... । বিকেলে বাসি চটপটি...ঘুপপাক খেতে খেতে তলিয়ে যায় সব জীবনের সোনালী সময়। চোখের কোনা দিয়ে বেয়ে পড়ে জল ...বোধ করি নিষ্কন্টক ভালবাসার পরাজয়ের গলিত লাভা। ধক করে কেঁপে ওঠে বুক । প্রতীম গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে তালাটা নেড়ে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি ফিরল ব্যবসার ঝামেলা মিটিয়ে? কটা বাজে? কোথায় অলস দুপুর, বিষন্ন দুপুরকে আস্ত গিলে খেয়েছে সন্ধ্যা । আর  রাত যেন অবারিত আবেগে মাখামাখি। সিঁিড়র আলোটাও জ্বেলে দিয়েছে মনোযোগী ভাড়াটেরা। চাবি নিয়ে উঠতেই কোঁচড় থেকে কি যেন পড়ে গেল। অন্ধকারে বুঝতে পারে ভিক্ষুকের অধিকার ...দুর্লভ পাঁচ টাকার নোট। বাজারে যা প্রায় উধাও । দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজার চাবি ঢোকায়। প্রতীম ভেতেরে ঢোকে ।
ভাবলাম আজ তাড়াতাড়ি ফিরি । ঘরে আমার অপেক্ষারত সুন্দরী স্ত্রী। কাজ তো থাকবেই, ব্যবসার লাভ ছেড়ে দিয়ে এলাম একসাথে থাকার লাভটুকু ভাগাভাগি করবার আশায়। এমন শাড়ি পরা আটপৌড়ে ঘরনীটিকে বহুদিন কাছে পাই না । প্রতীমের বলিষ্ঠ কব্জি পেঁচিয়ে ধরে মেঘলার কাঁধ। ঠোঁটে লাজুক হাসি। চোখে সেই অতি চেনা দুষ্টু হাসির ঝিলিক । ফিসফিসিয়ে বলে, আমি ভীষণ জিতে গেছি মেঘলা । আস্তে আস্তে কাঁধের চাপটা দৃঢ় হয়। মেঘলা ভাবে, ভেজা চোখটা দেখেনি তো প্রতীম ? সেও এই প্রথম লাভ ও লোকসানের সংজ্ঞাটা বোঝে। মনে পড়ে সেই অনেকদিন আগে পড়েছিল- “ওয়ান ম্যান্স লস ইজ অ্যানাদার ম্যান্স প্রফিট ’’।