করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





বৃদ্ধাশ্রম
মির্জা গোলাম সারোয়ার
রায়হান সাহেব বয়স ৬৫ এর কাছাকাছি। চুল আর দাড়ি পেকে ধপধপে সাদা।
ঠিকমত হাটতেও পারেন না এবং চোখেও কম দেখেন রিটায়ার্ড করার পর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছেলে তার স্ত্রীর প্ররোচনায় তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে। ছেলেকে দেখার আশায় চোখের পানি ফেলে প্রহর গুনে এবং অপেক্ষা করেও না আসায় তিনি তার কাছে একটি চিঠি লেখেন ঃ

খোকা,
ভাল আছিস নিশ্চয়ই। হয়তো এই চিঠি পড়ার সময় তোর হবেনা। কারন তুই এখন অনেক বড় হয়েছিস। বড় পোষ্টে চাকুরী করছিস। তবুও নাড়ীর টানে না লিখে পারলাম না। চার বছর হয়ে গেছে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছিস। কিন্তু একটি বারের জন্যেও তোর সময় হলোনা আমার কাছে আসার।আমি অনেক চিঠি লিখে তোর কাছে পাঠিয়েছি। হয়তো সেগুলি তোর কাছে পৌছালেও পড়ার মতো মানসিকতা ও সময় তোর হয়নি। কারন আমি স¦ল্প শিক্ষিত এক গরীব রিটায়ার্ড কেরানী। তাইতো যেদিন বিয়ে করে কর্মকর্তা বউ নিয়ে এলি সেদিন কেরানী বলে তোর বউ আমাকে সম্মান জানানো তো দূরের কথা কথাই বলেনি। অথচ কেরানীর পরেও তো একটা পরিচয় আছে, আমি তোর বাবা।

এরপর মাত্র একমাস। তারপরে বৌয়ের কথায় এই রিটায়ার্ড কেরানীকে জোর করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলি। বাসার কাজের ছেলেরও তো সম্মান আছে। কিন্তু এই এক মাসে বৌমার কাছ থেকে কোন সম্মান তো পাইনি পেয়েছি তির্যক, ব্যাঙ্গত্মক ও কটুকথাবার্তা যা সভ্য সমাজে কোন মানুষ অন্য একজন মানুষের প্রতি করেছে কিনা সন্দেহ। তুইও বউমার এ ধরনের আচরনে কোন প্রতিবাদ না করে চুপ  থেকে তলে তলে সমর্থন জানিয়েছিস। তোদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ অনুযোগ এমনকি অভিমান  কখনো ছিলনা এবং এখনো নেই।

তোর মা বেচেঁ থাকলে অবশ্য খুবই কষ্ট পেতো। তোর বয়স তখন ০৯ মাস যখন একদিন তুই আমার কোল থেকে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেয়েছিলি। উহ্ তোর মায়ের সেকি রাগ। পারলে আমাকে মারে আর কি। সারারাত তোর জন্য কেদেঁছে। আর আমিও না খেয়ে সারারাত ঘরের এক কোনে বসে তোর মায়ের কান্না তার বকুনি শুনেছি। সেদিন ব্যাথায় তোর চিল্লা চিল্লি দেখে সারারাত তোর মা আর আমি নিঘুর্ম কাটিয়েছি।

তোর মা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকায় আমিই তোকে প্রায়ই বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুম পাড়াতাম। প্রতি নিয়তই তুই আমার কোলে প্রস্রাব ও পায়খানা করলেও কখনো বিরক্ত বোধ বা ঘৃণা করিনি। একবার সারাদিনে সাত আট বার তুই আমার কোলে প্রস্রাব ও পায়খানা করেছিলি। এজন্য তোর মা তোর উপর ক্ষেপে যায়। আমি রাগ করতে নিষেধ করে বলি আমার খোকার জন্য আমি সব যন্ত্রনা সহ্য করতে পারি।

তোর বয়স যখন চার বছর তখন একদিন রাতে মিষ্টি খাবার জন্য তুই খুবই জেদ ধরিস। কিছুতেই তোকে বুঝানো যাচ্ছিলো না। অগত্যা আমি অত রাতে বাজারে যেয়ে দোকান খুলে মিষ্টি এনে খাইয়ে তোকে শান্ত করি। রাত্রিতে দোকানে যাবার সময় আমি পিছলে পড়ে যেয়ে পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পাই। ব্যাথায় অনেক দিন কষ্ট পেয়েছিলাম। এই বুড়ো বয়সে এখনও সে ব্যাথা অনুভব করি। এ ধরনের আরও বহু মধুর এবং কষ্টের স¥ৃতি আমাকে শুধু কাদায়। এগুলো তোর হয়তো মনে নেই আর মনে থাকার কথাও নয়।

খোকা, আমাকে বাড়ীতে রাখলে তোদের কি খুবই কষ্ট অথবা ক্ষতি হতো ? আমি তো বাহিরের চাকরের ঘরে থাকতে চেয়েছিলাম। চাকরের পিছনে তো তোরা খরচ করে থাকিস। সে খরচ টা না হয় আমার জন্য করতি। কাজের লোক হিসাবে আমাকে রেখে দিতি। বৌমার আত্মীয়স¦জন বা তোর অফিসের বসরা বাসায় এলে আমি পিতার পরিচয় না দিয়ে কাজের লোক হিসাবে পরিচয় দিয়ে তোদের সম্মান রক্ষা করতাম এবং কখনো তোদেরকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতাম না। এরপরেও তোদের যদি কষ্ট হতো তবে আমার পিছনে কোন খরচ করতে হতোনা। আর আমি পিতা হিসাবে ছেলের কাছ থেকে কি মজুরী নিতে পারি ? কখনো না । আমি শুধু বাড়ীতে থাকতে চেয়েছিলাম। কারন ঐ বাড়ীর প্রতিটি জিনিস এমনকি ইট বালু রড সিমেন্ট - এ তোর মায়ের হাতের ছোয়া লেগে আছে যা দেখে আমি তোর মায়ের অভাব খানিকটা হলেও পুরণ করতাম। এই কারনে  আমার থাকা। আমাকে খাওয়াতে তোদের যদি অসুবিধা  হতো তবে আমি নিজে রান্না করে খেতাম। তবু তোদেরকে কোন ঝামেলার ফেলতাম না। আর আমি তো সারা মাসই পানি খেয়ে নফল রোজা করতাম। কিন্তু তুই আমার কথা না শুনে বৌমার কথায় এই রিটায়ার্ড কেরানী বাপকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলি। একদিক দিয়ে ভালই করেছিস। তোদের মত পদস্থ কর্মকর্তাদের মাঝে এই ছাপোষা কেরানী তার প্রাপ্য সম্মান টুকুই পেতো কিনা সন্দেহ। আর তোদের সামাজিক মর্যাদার ও সম্মান হয়তো ক্ষুন্ন হতো।

খোকা, তুই না এলেও আমি চোখের পানি ফেলাবোনা, কারন এতে যদি তোর অমঙ্গল হয়। শুনেছি তোর নাকি একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়েছে। সে আমার দাদু ভাই। তাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে। সে আমার বংশের প্রদীপ। তাকে খুব ভাল ভাবে মানুষ করবি। দাদু হিসাবে না হলেও তোদের বাড়ীর কাজের মানুষ হিসাবে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি। তার জন্য আমার অফুরান্তদোওয়া রইলো।

তোর বয়স যখন সাত বছর তখন একদিন দুপুরে পাড়ার চৌধুরীর আম বাগানে যেয়ে কাউকে না বলে গাছ থেকে আম পেড়েছিলি। রাত্রিতে বাগানের মালিক আমাদের বাড়ীতে এসে আমাকে না পেয়ে এ কারনে তোর মাকে খুবই অপমান করে। যার জন্য তোর মা সারারাত না ঘুমিয়ে শুধু কাঁদে। পরে আমি বাড়ীতে এসে তোর মায়ের কান্না দেখে খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। অথচ তোর মা এবং আমি তোকে কিছুই বলিনি।

আরেকদিন তুই আমাদেরকে না বলে ছুটির দিনে বন্ধুদের নিয়ে পুর্নভবা নদীতে গোসল করতে যাস বিকেলে অফিস থেকে এসে শুনি তুই তখনও বাসায় ফিরে আসিসনি। টেনশনে তোর মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি চারিদকে  তাকে খুঁজে না পেয়ে বাসায় ফিরে দেখি তুই তোর মায়ের আচলে লুকিয়ে আছিস। তোর উপর আমার প্রচন্ড রাগ হলেও তোর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারিনি। আমার অবস্থা দেখে তোর মা হেসে বলে, খোকাকে কিছু বলোনা, সে আমার জান। অথচ সেই মার মৃত্যু বার্ষিকী একবারও করলিনা। আর করবিই বা কেন, কেরানীর বউ এর জন্য কেউ কি এ কাজ করে ?

খোকা, তুই যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়তিস তখন একদিন সাঝের বেলা তোর মা উঠানে চুলায় ভাত রান্না করার সময় ভাতের পানি টকবগিয়ে ফুটছিলো। তোর মা পড়তে বলায় তুই রাগ করে ঢিল মারলে তা ভাতের ফুটন্ত পানিতে পড়ে পানি ছিটে তোর মায়ের হাতে লেগে ফসকা পড়ে যায়। এতকিছুর পরও তোর মা হাসিমুখে বলে আহা খোকার উপর রাগ করছো  কেন, সে কি জেনে শুনে একাজ করেছে। কিন্তু বড়ই দুঃখ এবং আফসোসের বিষয় তোর মা মারা যাবার পর একদিনও তুই তার কবর দেখতে যাসনি।

খোকা, এসব তোকে বলছি এ কারনে যে, তোকে তোর মা আর  আমি বুকে আগলে রেখে বড় করেছি। অভাব কি জিনিস বুঝতে দেইনি। নিজেরা না পারলেও তোর জীবনের সব চাহিদা এবং চাওয়া পুরন করেছি। বিনিময়ে কিছুই চাইনি। চেয়েছি শুধু তুই যেন অনেক বড় হতে পারিস। হয়েছিসও তাই। তুই এখন অনেক বড় পদমর্যদার কর্মকর্তা, বউমাও তাই। বড় হয়ে বাবা- মাকে ভুলে গেলি। বলতো এ দুঃখ রাখি কোথায় ? পাড়ার লোকজনও ভাল না বলে এ বিষয়ে সবসময় কটুক্তি করে থাকে।

কতদিন তোকে দেখিনা। তোকে দেখার জন্য আমার মন খুবই কাঁদে, বুকটা ফেটে যায়। ক্ষনিকের জন্য হলেও তুই এখানে আসিস। তোর মুখটা দেখে প্রাণ জুড়িয়ে নেব। এই বুড়ো বাবাকে সময় দেবার জন্য তোর কি এক বারও ইচ্ছে করেনা ? নাকি এখানে এলে তোর সম্মানের হানি হবে ? কারণ আমি তো সামান্য একজন রিটার্য়াড কেরানী। ভয় নাই, তুই এলে আমি অবশ্য তোদের বাড়ীর কাজের লোক হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিবো। এতে তোর তিল পরিমান অসম্মান এবং অমর্যাদা হবেনা। পরিশেষে বৌমা, দাদু ভাইসহ তুই ভাল থাকিস। আমৃত্যু আমার অফুরন্ত দোওয়া রইলো তোদের প্রতি।

ইতি

বৃদ্ধাশ্রম থেকে হতভাগ্য কেরানী বাবা
তিন বছর পরের কথা। বৃদ্ধাশ্রম থেকে বুড়ো বাবা তার পদস্থ কর্মকর্তা ছেলেকে অনেক চিঠি পাঠালেও ছেলে চিঠির জবাব দেওয়া তো দুরের কথা একটি বারের জন্য দেখতেও আসেনি। একদিন রাত্রিতে পিতা অনেক কান্নাকাটি করে ব্রদ্ধাশ্রমের সবার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেয় এবং জানায় আজ সাত বছর যাবত সে তার ছেলের মুখ দেখতে পায়নি- এটিই তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ। এছাড়া তার আর কোন দুঃখ নাই। রাত্রিতে রুমের মধ্যে অনেকক্ষন হাউমাউ করে কেদেঁ ছেলের জন্য আহাজারি করার পর শুয়ে পড়েন। সকাল ১০ টা পর্যন্ত ঘুম না ভাংগায় তাকে ডেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে বৃদ্ধাশ্রমের ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে জানান যে, তিনি অনেক আগেই  শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এসময় তার বুকের মধ্যে ছেলের একটি ফটো পাওয়া যায় যা তিনি দুহাত দিয়ে বুকে চেপে আকঁড়ে ধরেছিলেন। তাই দেখে উপস্থিত সবাই আফসোস করে বলেন, তিনি মৃত্যুবরণ করে ছেলেকে না পাওয়ার এবং না দেখার দুঃখ চিরদিনের মতো ভুলতে পেরেছেন।