টরে টক্কা, টরে টক্কা, টক্কা টরে !!!
মুগ্ধকর এক বাজিয়ে আব্দুর রাজ্জাক খান, ঢুলি, মানসিক অবসাদে হঠাৎ ক্লান্ত-তৃপ্তিকর মদ্যপানে নিজেকে উৎসর্গ করে ঝিমোচ্ছিলেন এফ, ডি, সি’র ষ্টুডিও দালানের বারান্দায়। মুহূর্ত সুরের এক অনবদ্য বাদ্যের ক্লান্ত যবনিকায় তিনি তখন আশ্চর্য স্বপ্নভুক জ্যোতিতে সুস্নাত। তার কানে বয়ে যাচ্ছিলো সমুদ্রের জলকল্লোল। মুখম-লে চন্দ্রালো মেখে, তেলযুক্ত গোঁফ উঁচিয়ে- তিনি নিদ্রামগ্ন শায়িত ছিলেন চৌকিদারের দুর্গন্ধময় শয্যায়। তার মুখের সমস্ত কালিমা শুষে নিয়ে চাঁদেরা চক্রাকারে ফিরে যাচ্ছিলো কৃষ্ণগুহার আড়ালে। রাজ্জাকের কর্কশ নাসিকাধ্বনি, হৃৎপেিন্ডর অমোঘ অস্থিরতা যে কোলাহলের জন্ম দিয়েছিলো তাতে তার পোষ্য সারমেয় রাধা ভড়কে গিয়ে এক পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো পশ্চাতদেশ রাজ্জাকের মুখায়বয়বে অধিষ্ঠান করে। নক্ষত্র ও অন্ধকারের এক অদ্ভুতুড়ে মিথস্ক্রিয়ায় জ্ঞানহারা রাজ্জাক নিদ্রাতুর ওষ্ঠে অনুধাবন করেছিলেন-লবনাম্বুরাশির ছটা।
সমুদ্রজলের নোনা স্বাদ আছে, কোথাও সমুদ্র নেই।
ঢুলী রাজ্জাক পাশ ফিরে নিদ্রাহীন নেত্র উন্মোচিত করে বিষদৃষ্টি হেনেছিলেন পোষ্যের দিকে। পোষ্য তখন নিজেকে বাঘ জ্ঞান করে পাড়া দিয়েছিলো রাজ্জাকের শখের লেজে। যে লেজ প্রস্তুত হয়েছিলো আন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দর্জি খানায় দক্ষ নির্মাতার বিশেষ যতেœ। সোনালী জরির নকশায় তাতে ছাপ স্ফুটিত করা হয়েছিলো ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। সারমেয় রাধা লেজে পাড়া দিয়ে ভেবেছিলো “আমার এমন নরম তুলতুলে লেজ নেই কেন?” শখের বহুবর্ণ লেজ, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে, সেই লেজে পাড়া দেবার স্পর্ধা দেখিয়ে সারমেয় রাধা চিড়িয়াখানার বাঘ হয়ে ঢুকে পড়েছিলো খাঁচায়।
সবাই বন্দী কারাগারে, তখন সবাই বন্দী ক্ষুধার্ত খাঁচায়।
রাজ্জাক খানের অপলক নেত্র ভেদ করে ছারপোকা বসিয়েছিলো সূক্ষ্ম ছোবল। এতে খান প্রায় অন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিলেন যদি না পোষ্য সরমেয় থাবা দিয়ে ছারপোকা মেরে প্রতিদান না দিতো। কাওরান বাজারের সবগুলো করাত কলের শব্দ পরিশ্রান্ত রাত্রিকে আরো ক্লান্ত করে ক্রমশ নিশব্দ হয়ে এসেছিলো। করাত কলগুলোতে বৃক্ষের অন্তেষ্ট্যি প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে পড়েছিলো। তাই ট্রাকগুলো তখন বাক্সবন্দী, এরা বাক্সের ভেতরে ক্রমশ বামনে পরিণত হয়ে পড়েছিলো। বামন ট্রাকগুলো এখন ট্রাফিকের হাবিলদার প্রামাণিকের মুঠোবন্দী। সেই থেকে বামন ট্রাকেরা অলস ওরা দৌড় প্রতিযোগতায় প্রথম হয়ে সোনার মেডেল কন্ঠহারে ঝোলানোর কথা আর ভাবছিলো না।
মেডেল নাই-নাই-নাই-মেডেল নাই রে!
ট্রাফিক পুলিশের স্থূলকায় হাবিলদার প্রামাণিকের কর্কশ বাঁশির সুর আর নেই। বাঁশী তখন অচল। বহু বহু দিন আগে ওর মধ্যের ঠ্যাং কেটে নিয়ে পেট্রলে কাবাব ভেজে খেয়েছিলো রমনা পার্কের কোমল প্রাণ সুন্দরী কমলা। পেট্রলে ভাজা সেই ঠ্যাং উদর অন্তরালে লাফাচ্ছিলো। কমলা থাবাড় দিয়ে থামিয়ে ছিলো তাকে, তবু পেট্রলে ভস্ম ঠ্যাং কাতরে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো কণ্ঠনালী বেয়ে। ঠ্যাং এখন বন্দী, কমলার উদর অন্তরালে পেট্রলের পোড়া গন্ধ। তবু বিবমিষাসঙ্গী কমলার নিশি জাগরণ থামে না। রমনা পার্কের রিরংসাকাতর ফেরীওয়ালা, অলস ট্রাক চালকের দল মধ্যরাতে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো তাকে। উন্মুক্ত শয্যায় তাকে বশ করতে অধীর প্রতিযোগিরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো প্রতিরাত্রে। অভ্রদল ঢেকে দিয়েছিলো নক্ষত্রের মৃদু আলো, টিনের বাক্সে রিরংসা অভিলাষীরা টাকা প্রবেশ করিয়ে একে একে যাচ্ছিলেন কমলা অভিসারে। কিন্তু, যেই তাঁরা উপগত হচ্ছিলেন উদর অন্তরাল থেকে প্রামনিকের পেট্রলভস্ম মধ্যের ঠ্যাং লাথি কষাচ্ছিলো তাদের। বিফল রিরংসাপ্রত্যাশীরা মুদ্রা ও রিরংসা হরণের দ্বিধাসংকটে দিশেহারা হয়ে পার্কের দীঘিতে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ দিচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন ‘পেট্রলে পুড়ে মরার চেয়ে দীঘির জলে ডুবে মরা ভালো’। ট্রাকগুলো বামনে রূপান্তরিত হওয়ায় চালকেরা কর্মহারা হয়ে দল বেঁধে ভিন্ন পেশার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন। একদল গিয়েছিলেন এফডিসিতে “ট্রাক ড্রাইভারের বউ” ছবির নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার অডিশন দিতে। সেখানে রাজ্জাক খানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো বগুড়া থেকে আগত ড্রাইভার রফিকের। রাজ্জাক খান তাকে ‘গোয়ালা’ চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রফিক অবগত করেছিলেন যে তার ‘গাভী, শুকরী, ছাগী, মুরগী, ব্যাং এমনকি মানবীর দুধ দোয়ানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু তিনি এর প্রমাণে গ্রাম মাতবরের প্রশংসা সনদ সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছিলেন।’ ট্রাকের দল বামনে রূপান্তরিত হবার পূর্বে বহনরত চোলাই মদ লুট করে নিয়েছিলো পুলিশের দল। কাওরান বাজারের বাংলামদের দোকানগুলো হোটেল রেষ্টুরেন্টের বাসী পচা ভাতের অভাবে বন্ধ হয়ে পড়েছিলো।
ঢুলী, আব্দুর রাজ্জাক, ঢুলী খান ঢোল বাজাও রে।
আব্দুর রাজ্জাক খানের ঝাকড়া চুলে মল ঢেলে দিয়েছিলো কুঁজো টিকটিকি। টিকটিকি প্রাতঃভ্রমণে ঢুকে পড়েছিলো তার মগজে জ্ঞান চুরির উদ্দেশ্যে। কিন্তু উদ্দেশ্যে ব্যর্থ ক্রুদ্ধ টিকটিকি ধরা পড়েছিলো সত্যজিৎ বাবুর ক্যামেরায় জ্ঞানের বদলে ঘিলুর পচা ঘা চুরি করে টিকটিকি হয়েছিলো লাল পিঁপড়ে। সে তখন সত্যজিৎ বাবুর মধ্যমায় কামড় বসিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। সেই থেকে সত্যজিতের ক্যামেরা অচল।
আব্দুর রাজ্জাক খানের সিনেমা নির্মাণের সাধ মিটিয়েছিলো কাওরানবাজারের মৎস্যব্যাপারী হুরমুজ আলী প্রধান। তবে এই বিনিয়োগ ছিলো শর্তযুক্ত- গুপ্ত কামরায় নায়িকা কুসুমকুমারীর নৃত্য অবলোকনের, নৃত্য আস্বাদনের সুযোগ করে দিতে হবে। সিনেমার বিনিয়োগ শর্তের দলিল স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্টপতিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছিলো। রাষ্ট্রপতি অনুষ্ঠানে নাতিদীর্ঘ ভাষণে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির উন্নয়নে বিশিষ্ট মৎস্য ব্যাপারীদের আগ্রহের ভূয়সী প্রসংসা করেছিলেন।
হুরমুজের চোখে সর্ষেফুল জড়ো হয়েছিলো। বিবর্ণ। হলুদ। সে লুঙ্গির কোচড়ে রক্ষিত তার ভাঙ্গা চিরুনী দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিলো। তাঁর দাঁতে সেই শৈশবে মাগুর মাছের কাঁটা বিধে গিয়েছিল। তার বিখ্যাত কবি বন্ধু সিরাজুল ফালু তাকে নিয়ে গান বেঁধেছিলো,
‘বিড়ালং যদি কন্টক খায়
কটে কৌটো কট নং হয়
এ যে শুনি মাংসের গন্ধ
....পচে পৌচ পচনং হয়।’
(‘কবি সরকার মাসুদের কাছে লেখক কবি এনায়েত কবীরের ঋণস্বীকার’।)
সেই থেকে হুরমুজের দাঁতের গন্ধ নর্দমার মলের গন্ধকেও হার মানায়। এ কারণে কুসুমকুমারীর আপত্তি। হুরমুজকে তার দশাগজী সতীবৃত্তে উপস্থিত করা যাবে না। অন্যথা হলেই প্যাকআপ। কুসুমকুমারী ভেবেছিলেন ‘এক চড়ে হারামজাদার দাঁত ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। নৃত্য পর্যবেক্ষণে হারামজাদা পিকেটিং দেয় নেত্র কষাঘাতে। এক পিকেটিং-এ কেমন বুড়ো আঙ্গুল গেলো ভেঙ্গে। হারামজাদা।’
ক্রন্দসী কুসুমকুমারীর কণ্ঠস্বরের রেকর্ড ভেঙ্গে গিয়েছিলো। হিজ মাষ্টার ভয়েসের সারমেয় এখন রাজ্জাক খানের লেজে পাড়া দিয়ে খাঁচায় বন্দী।
ঢোল বাজাও রে, ঢুলী, বাজাও রে ঢোল।
মৎসব্যাপারী হুরমুজ আলী প্রধান কুসুম কুমারীর প্রতি কামবাসনা পোষণ করেছিলেন। বাসনা চরিতার্থে চলচ্চিত্র বিনিয়োগের বিপরীতে তার দাবি যে একদিনের জন্য কুসুমকুমারীকে ভোগ করবে। ফুলশয্যা পাতা হয়েছিলো পাঁচতারা সোনারগাঁও হোটেলের বর্ণাঢ্য শয়নকক্ষ ভাড়া করে। আব্দুর রাজ্জাক খান হুরমুজকে তথ্য পরিবেশন করেছিলেন যে, কুসুমকুমারী উদর পীড়ায় আক্রান্ত। তাকে কুপ্রস্তাব দেওয়াটা অপ্রীতিকর-ই শুধু নয় অমানবিকও বটে। কিন্তু হুরমুজ অনমনীয়। তার মধ্যের ঠ্যাং কামানের গোলা আকৃতি নিয়েছে। কুসুমকুমারী বিনা গোলা উৎক্ষেপনের কোনো বিকল্প নাই।
কুসুমকুমারীকে নিয়ে তিনটি অশ্বারোহী সৈন্যদল গার্ড অব অনার দিয়ে পাঁচতারা হোটেলের অভিমুখে যাত্রা করেছিলো। মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশে কুসুমকুমারীকে দ্রুত বেগে শকটে করে সৈন্যদল হোটেল লবিতে পৌঁেছ দিয়েছিলো সবার অলক্ষ্যে। অবগুণ্ঠিতা কুসুম লিফট চালকের তেলযুক্ত গোঁফে সোনার মোহর সঁপে দিয়েছিলেন। জন্ম লগ্নে বহু দিন আগে কুসুম এই মোহর পেয়েছিলেন তাঁর পিতামহীর উপহার স্বরূপ, যা পিতামহী পেয়েছিলেন তাঁর পিতামহীর কাছ থেকে বংশের রীতি হিসেবে।
লিফটের মধ্যে লিফট চালকের দল পিকেটিং শুরু করেছিলো-এতে হুরমুজ আলী প্রধান আটক হয়েছিলেন। তাঁর কাঁটা বিদ্ধ স্বর্ণমন্ডিত দাঁত উধাও হয়ে গিয়েছিলো। মুখে শত শত কুঞ্চন দেখা দিয়েছিলো।
সবচেয়ে ভয়ানক যে কা- হয়েছিলো -সেটি হলো তার শৈশবসঙ্গী ভাঙ্গা চিরুনী ভেঙ্গেচুরে ছত্রখান হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো লিফটের পাদুকা বাহিত ধুলো বালিতে। হুরমুজকে লিফট থেকে বেরুতে হয়েছিলো প্রায় দ্বিগম্বর অবস্থায়, উদভ্রান্ত। চিরুনীর শোকে তার ঘুম কুম্ভকর্ণ চিরদিনের জন্য কেড়ে নিয়েছিলো। চেতনার ব্যবচ্ছেদে তার বোধ হয়েছিলো যে সৈন্যদল কুসুমকুমারীকে বহন করে নিয়ে এসেছিলো পৌণপুণিক বুটের লাথিতে তারা তার পাশ্চাতদেশে স্থায়ী চিহ্ন রেখে গিয়েছিলো।
কুসুম অভিসারে ব্যর্থ হুরমুজ আলীকে অবলোকনে আব্দুর রাজ্জাক খান ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে প্রবেশ করেছিলেন পার্শ্ববর্তী আর্ন্তজাতিক দর্জি সমিতির সুউচ্চ দালানে। বোতাম খুলে তার বহুবর্ণ শখের লেজ লাউডগার ন্যায় ঝুলে পড়ে বিদেশী অতিথিদের সম্ভাষণ জানাচ্ছিল।
দর্জি সমিতির নেতা আমিরুল মাওলা তখন আমেরিকার বিখ্যাত বস্ত্রপট্টি ওয়ালমার্টের ষ্টোরকিপার হাডসন ওয়ার্নারকে হাতীরঝিলে ভাসমান মল ফুলের সৌন্দর্য দেখাচ্ছিলেন। হাডসন সাহেবের দৃষ্টি অনির্দিষ্ট, তিনি হাত নেড়ে কথা কইছিলেন “বুঝলেন আমেরিকার দরিদ্র জনেরা আমাদের ক্রেতা, আমেরিকার দরিদ্র সমাজ বাংলাদেশের দরিদ্র সমাজকে খুবই সম্মান জানায় সস্তায় শ্রম দিয়ে সুলভে বস্ত্রাদি পরিধানে সহযোগিতার জন্য।” আমিরুল মওলার কান ছিলো হাতিসম বৃহৎ, হাডসনের বয়ান তার কানে মধুস্মৃতি বর্ষণ করেছিলো। কিন্তু তার দৃষ্টি অনুসরণ করেছিলো রাজ্জাক খানের ঝুলন্ত লেজের দিকে, ক্রুদ্ধ এক উত্তেজনায় আচ্ছন্ন হয়ে তিনি কঠিন হাতে চেপে ধরেছিলেন হাডসনের হাত আর ভাবছিলেন,‘ব্যাটা রাজ্জাক সেই যে কুসুম কুমারীর দেহবল্লরী দর্শন করিয়ে মহা সস্তায় এক মূল্যবান লেজ বানিয়ে নিয়ে গেল, আর তো এলো না।” আমিরুলের তীব্র হস্তচালনায় যন্ত্রণা কাতর হয়ে ক্ষিপ্ত হাডসন ঘোষণা করেছিলেন “সব ক্রয়াদেশ বাতিল।” আর তখনই রাজ্জাকের বিচিত্রবর্ণ ঝুলন্ত লেজ তার দৃষ্টি সীমার প্রান্তে নেচে গিয়েছিলো নৃত্যরতা এক তরুণীর কটিদেশ যেন ঘুর্ণায়মান চাঁদের অপরূপে বাঁধা পড়েছিলো। ‘হৈ হৈ ম্যান’ উচ্চস্বরের আহ্বানে লেজের রঙ্গীন মোহ সাড়া দেবে এই আকুলতায় তিনি বেগে পশ্চাতনুসারণ করেছিলেন রাজ্জাকের। রাজ্জাক খান দ্রুত নির্গমনের পথ খুঁজেছিলেন, বাতাসে রঙিন লেজের তরঙ্গ অন্যদের চোখে উদ্দীপনা তৈরী করেছিলো। আর হাডসনের পশ্চাতে সর্বস্বান্ত ভিক্ষুকের অভিব্যক্তি ধারণ করে আমিরুল মাওলা বেগে ধাবমান হয়েছিলেন এই উচ্চারণে, ‘এই খান, এই রাজ্জাক, কুসুম কুমারীর মধুভান্ডার কই। তুমি যে মধুভান্ডার মাছ ব্যপারীর হাতে তুলে দিলে? আমার তো চেখে দেখাও হলো না!!!
রাজ্জাক খান দেশী-বিদেশী দুই ধাবমান অনুসরণকারীর সম্মুখ থেকে যোদ্ধার তীব্র গতিতে অদৃশ্য হতে চেয়েছিলেন। তিনি আত্মরক্ষা করেছিলেন হাতিরঝিলে ঝাঁপ দিয়ে। পরবর্তী সময়ে তিনি যখন কর্দমাক্ত মল মিশ্র জলের উপরে ভাসমান হয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তখন চাওয়ালী মোজরেফা মিজুর দৃষ্টি গোচর হয়েছিলো। এ ঘটনা তাকে দীর্ঘদিন পরে আবার স্লোগান মুখর হতে বাধ্য করেছিলো :‘জলহস্তীর চামড়া, তুলে নেব আমরা’।
‘কসাই ও সৈনিক’ নামধারী পেশা- পরিচয়ের মানুষগণ চর্ম-ব্যবচ্ছেদে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন আদিকাল থেকে। ঢাকা শহরে চর্ম-ব্যাবচ্ছেদকারীদের উপদ্রব বেড়ে গিয়েছিলো। পেশাদার চর্ম-ব্যাবচ্ছে দ কারীদের পাদুকা আবিষ্কারের কাহিনী মুখে মুখে ফিরেছিলো ভূতপূর্ব কাল থেকে। সোনারগাঁও হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে প্রাক্তন সৈনিক আজগর সম্রাট আকবরের আত্মা ধারণ করতে চেয়েছিলেন। আজগরের বিপ্লবের স্বপ্ন তার প্রেআত্মা বহন করেছিলেন লালঝুটি পরিধান করে। প্রেতাত্মা সোনারগাঁওয়ের লবিতে বালকের নিতম্বে বন্দী। অসংখ্য বালকের নিতম্ব তার হৃদয় অনুসরণ করেছিলো। প্রতিটি বিপ্লবীর হৃৎপি- বালকের নিতম্বের প্রতিরূপ। প্রতিটি পুরুষের হাতে বিপ্লবের লাঠি সুউচ্চ দালানের ন্যায় স্থবির। প্রাক্তন সৈনিক আজগর যুদ্ধাহত হয়েও ছিলেন সম্রাটের অদম্য চিত্তধারী। তার বিপ্লব আকুল চিত্ত অতলান্তিক মহাসাগরের ছোট্ট তিমি মাছ হয়ে ঘুরেছিলো। কখনো যুদ্ধবাজ ট্যাকের ঘুর্ণায়মান চাকা হয়ে ঘুরেছিলো সেনানিবাসের প্রাক্তন সৈনিকের বুটের তলায়। বিপ্লবীরা কখনো সৈনিক, কখনো সৈনিকেরা বিপ্লবী তবু আজগরের চিত্ত আত্মঘাতী। বসরাই গোলাপের মধ্যে অস্ত্রের বারুদ দেখেছিলেন তিনি। আকবরের রাজদরবার তার চিত্তের কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়েছিলো। ঢাকার সেনানিবাস তখন যুক্তরাষ্ট্রের পাতি আমাত্য বোস্টারের দুই আঙ্গুলের নীচে দমবদ্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
আজগরের সহচরেরা পাতি আমাত্যের যাদুতে মুগ্ধ। কিন্তু দূর সংকেতের মাধ্যমে খেলা দেখাচ্ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। অতলান্তিক মহাসাগরের ছোট্ট তিমি মাছ সোনারগাঁও হোটেলের লবিতে তার প্রেতাত্মাকে স্থায়ী বন্ধক দিয়েছিলেন। প্রেতাত্মার মাথায় লাল ঝুটি। সে তখন বালকের নিতম্বে নিজের হৃৎপিন্ডের প্রতিচ্ছবি নিয়ে হোটেলের রক্ষীর পদে যোগ দিয়েছিলো। চাওয়ালী মোজরেফা মিজু তাকে প্রাতঃরাশে প্রতিদিন গোখরো সাপের বিষের চা পরিবেশেনে আপ্যায়ন করেছিলো। ‘‘নিঃসন্তান রাজার চেয়ে, ফলবতী লতাগুল্ম শ্রেয়।’’লালঝুটি প্রেতাত্মা বিল্পবের ভয়ে ইঁদুর হয়ে পালিয়েছিলো। সে শিখে নিয়েছিলো বোতলবন্দী ভূত আর পেট্রল বোমার গল্প। বালকেরা প্রতিরাতে আধাজাগরণে পেট্রল বোমা হাতে এক একজন সম্রাট হয়ে উঠেছিলো। বোতল বন্দী পেট্রল, বোতলবন্দী ভূত, বোতলবন্দী ভূতের সঙ্গে বাস করেছিলো অনাগত শিশুরা। ভূতের ভয়ে তারা কাতর ছিলো না।
‘ঢুলী ঢোল বাজাও রে, ঢুলী বাজাও ঢোল
মোজরেফা মিশুর মুখর স্লোগানে জলহস্তী রাজাক খানের ভাসমান দেহ উঠে এসেছিলো কাওরান বাজারের রেলক্রসিংয়ে। সঙ্গে উঠে এসেছিলো ভাওয়াল রাজার হাতীর পাল। ওরা ইঁদুর হয়ে ঢুকে পড়েছিলো কাওরান বাজারের মাছের পট্টিতে। মিজুর স্লোগানে আত্মহারা হাতির ঝিলের চুনোপুটিও নাচতে নাচতে হাতির পালের সঙ্গে উঠে এসছিলো। মানুষের মল ভক্ষণে পুটির মৃত্যু আতঙ্ক দেখা দিয়েছিলো। মরতে মরতে বেঁচে সে ডাঙ্গায় উঠে এসেছিলো।
হাতীর পাল ইঁদুর হয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলো আর আব্দুর রাজ্জাক খান তার “ট্রাক ড্রাইভারের বউ” ছবির শুটিং আয়োজনে মত্ত। মানুষের মল-বিষ্ঠায় হাতির ঝিলের জল আর মাছেদের বসবাস যোগ্য কিনা এই নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো ভাওয়াল রাজার হাতির পাল। পুটি ভেবেছিলো “ছিঃ মানুষের গু, ছিঃ।” চাওয়ালী মোজরেফা মিজু পুটির গলা জড়িয়ে ধরে লালঝুটি প্রেতাত্মাকে চা পান করা”িছলেন আর বলেছিলেন “বন্ধু দেখ, দর্জিখানার লোকেরা তোদের ঝিল দখল করে বড় অট্টালিকা বানিয়েছে। ওরা এত বলশালী যে উচ্চ আদালতের আদেশেও মানে না। ঐ দেখ বিল্পবীর লালঝুটির আমেরিকান বন্ধুরা ঐ দালান থেকে তোদের ঝিলে মল ঢেলে দিচ্ছে। ওরা তো আমাকে চা’য়ের দোকান বানিয়ে দিয়েছে। লালঝুটি আর ওর সাগরেদদের চা দিতে দিতে আমার জীবন শেষ। আমাকে দিয়ে আর দালান ভাঙ্গা হবে না, বিল্পবের লাঠি ভাঙ্গাও হবে না। পুটিরা গিয়ে জোট বাঁধ, বেঁধে ঐ দালান ভেঙ্গে দে। নাহলে ওরা তোদের ঝিলে মল ঢালতেই থাকবে। তোদের আর বাঁচা হবে না।’
মিজুর কাঁধে চড়ে পুটি ভেবেছিলো ‘উহ-ডাঙ্গায় কতো সুখ, মলের দুর্গন্ধ নেই।’ সে মিজুর কাঁধ থেকে হাতীর পিঠে লাফ দিয়ে বসে হাতীর কান মলে দিয়েছিলো আর বলেছিলো বলো হাতি ‘‘মাছ ব্যাপারী হুরমজ আলী প্রধানের নিতম্বে লাথি কষাই। ইস, শখ কতো নায়িকাকে ভোগ করতে চায়। যা খালি বাসায় গিয়ে মাছি মার যা।” মিজুর কাছে সে বায়না ধরেছিলো ‘‘একবার এফডিসিতে ঢুকে কুসুম কুমারীর নাচ দেখবে।’’
কুসুমকুমারী পাগলা বন্ধু রকিব আনসারীর পঙ্খীরাজে চড়ে সামরিক ক্রীড়া উদ্যানে সঙ্গীত আস্বাদনে গিয়েছিলেন। কবি সিরাজুল ফালুকে গতরাতে তিনি হাতীর শুঁড় হয়ে ঘুঁতো দিয়েছিলেন। শুঁড় ঢুকে গিয়েছিলো ফালুর নাকের ভেতর দিয়ে মস্তিকের সামান্য নিচে। নিঃশ্বাসে হাঁচি দিতে দিতে ফালুর কাব্য চিন্তা তখন গোবর আর ফুলের সৌন্দর্য নির্ধারণে ব্যস্ত। তিনি ভেবেছিলেন “প্রেয়সী হচ্ছেন পুষ্পসম, আর স্ত্রী হচ্ছেন গোবরসম।” শুঁড় ঝাঁকিয়ে কুসুমকুমারী ফালুর কাব্য ভাবনা উদ্দীপ্ত করতে চাইছিলেন আর ভাবছিলেন “আমি তাহলে তোমার কাছে এখন গোবর কবি।”
ঢুলী ঢোল বাজাও, ঢোল বাজাও রে
সামরিক ক্রীড়া উদ্যানের বিশাল অস্থায়ী তাবুর নীচে মঞ্চে বক্তৃতা পর্ব চলেছিলো। সংস্কৃতি মন্ত্রী যুদ্ধক্ষেত্র ও সামরিক বিজ্ঞানে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সংযোগ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় ব্যস্ত। কুসুমকুমারী বক্তৃতায় মনোসংযাগ রাখতে ছিলেন আপারগ। তিনি রকিব আনসারিকে বলে চলেছিলেন, ‘সিরাজুল ফালুকে কবি বানাতে গিয়ে আমি হলাম নায়িকা। রাজ্জাক খানের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে যে চলে এলাম সঙ্গীত অবগাহনে, সে তো এখন হাতীরাগে ফুঁসবে। আর দেখ, যাকে কবি বানাতে গেলাম সে এখন হাতির ঝিলে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে। সে নাকি জলের মলে পদ্মফুল দেখেছে বুঝলি? হারামজাদা কবিকে বলিস আমি আবার ঈশ্বরচন্দ্র কলেজে চাষাভুষোর ছেলেমেয়েদের পড়াতে চলে যাবো। ওর জন্য মৎস্যব্যাপারি হুরমুজ আমার নাচের মধ্যে পিকেটিং দেয়। ঐ দেখ, আমার বুড়ো আঙ্গুল ভাঙ্গা আর হারামজাদা এখন মলের মধ্যে পদ্মফুলের ঘ্রাণ শুকে বেড়াচ্ছে।
(কবি-ঔপন্যাসিক এনায়েত কবীরের গদ্যকাব্যআখ্যানের ক্ষুদ্রাংশ)