বলছি মুক্তিযুদ্ধের আগের কথা। সত্তরেরও আগের কথা। মনে আছে কি না আছে আবার মনে করি ১৯৬১ থেকে ১৯৭০’এ আইয়ুবের সামরিক শাসনের চরম প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের সংস্কৃতির যে জাগরণ হয়েছিল তার কথা। ছায়ানটের আয়োজনে বৈশাখের প্রথম প্রভাতে নববর্ষ আবাহনের মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে দেশমুখিতা, আত্ম পরিচিতি ও দায়বদ্ধতার মানসিকতা সৃষ্টির প্রয়াস ছিল সেটি। রমনার অশ্বত্থ তলায় লাল পেড়ে গরদে আর খাদির পাঞ্জাবিতে সূর্যোদয়ে কোন দৃশ্যমান যুদ্ধের পোশাক ছিল না ছিল সংকল্পে। সেদিন ছিল না। সন্জীদা আপা, ওয়াহিদুল হক, কলিম শরাফী, জাহেদুর রহিম, জামিল চৌধুরী তাকেই ব্যবহার করেছেন তখন জাতীয়তা অর্জনের অস্ত্র হিসেবে। সংস্কৃতির সূক্ষ্ম ও নরম যন্ত্রে অস্ত্রোপচার করে সফল ভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন থেকে তাই কিন্তু এখনো আমাদের যে কোন আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ধারা।
আমার ৬১র কথা মনে নেই। ৬৭-র কথা মনে আছে। বাবার হাত ধরে মঞ্চে উঠে কোরাস গেয়েছিলাম, নজরুলের দারিদ্র্য আবৃত্তি করেছিলাম। মনে পড়ে সেই জয়দা জামালপুর শহরে মেয়েদের লাল পাড় পাওয়া যায়নি। কি করে যেন কজন তা ঢাকা থেকে এনে পড়েছিল। খোঁপায় ছিল জবা। আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে কুমুদিনী কলেজের ছাত্রীবাসে দেয়াল টপকে টাঙ্গাইলের শহীদ মিনারে যাই। আমি ও রহিমা খাতার চোঙ্গায় ধ্বনিকে প্রতিধ্বনি করে ফিরে আসি। কালো পাড় শাড়িতে ম্লান মুখে পাঞ্জাবি কলেজ প্রধান দ্বারা তিরিষ্কৃত ও হোস্টেল চ্যূত হই। দুলাভাই বাসে করে আমাকে নারায়নগঞ্জে আমাদের বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এসে যোগ দেই তোলারাম কলেজের আন্দোলনে। সময় বোধ করি ৬৯ এ বাধ্য হয়ে সরকার ২১ তারিখে সরকারী ছুটি ঘোষণা করে। আমরা পথে পথে ছোট ছোট আয়োজনে লাল শাদায় একাকার হতে থাকি।
যুদ্ধের পর ফেব্রুয়ারীর কালার কোড সুস্থির। মেয়েদের সাদা সূতি শাড়ি কালো পাড়। ছেলেদের সাদা পাঞ্জাবি। তাই পরে খালি পায়ে রোকেয়া হল থেকে যখন হেঁটে হেঁটে শহীদ মিনার যেতাম তখন দেখতাম রাস্তার পাশের গ্রীলহীন বারান্দা ও ব্যালকনি থেকে ঘুমচোখে দাঁতের ব্রাশ হাতে মানুষ অবাক হয়ে আমাদের দেখছে। আর ততদিনে প্রথম বৈশাখ দিনে লাল পাড় গরদ থেকে টাঙাইল সাদা শাড়ি লাল পাড় ও চুলে বেল কুঁড়ি নিয়ে মঞ্চে গান, আবৃত্তি ধারা হয়ে গেছে। জনতার সারিতেও লাল ছড়াতে লাগলো। অথবা যে কোন রঙই হবে হোক দেশী ও সূতি এবং তা নতুন হতেই হবে। সম্ভবত ঊনিশ’শ চুয়াত্তর সাল ছিল সেটা। তখন এসব ভাবনা গড়ার পথে। রমনা যাই মুক্তমনা নিজেদের বন্ধু বান্ধবদের দেখতে। নতুন বছরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে কিংবদন্তী গোলাম মোস্তফার আবৃত্তি শুনতে। সনজীদা ও ফাহমিদা আপার গান শুনতে ও গরদের লাল পাড় দেখতে। ঈষিতার হাতে বেলুন ধরিয়ে চুলে ফুল পরে স্বামী সহ বিটিভির ক্যামেরায় আল মনসুরের নির্দেশনায় নিউজ আইটেম হতে। সেবার জামি দেশে এসেছে। মা জাহানারা ইমামের কাছ থেকে আমাদের গুটি কয়েকের গল্প শুনে শুনে সবার জন্য উপহার কিনেছে। শাড়ির প্যাকেট খুলে এলিফেন্ট রোডের কণিকায় আনন্দে খলখলিয়ে বলে উঠলাম, এ শাড়ি পয়লা বৈশাখে পরবো । বুঝলাম খালাই আমার জন্য পছন্দ করেছেন নয়তো জামি কি করে জানবে আমার প্রিয় রঙ!
তখন রমনার বাইরেই গাড়ি পার্ক করা যেত। তখন ডাইভার ছাড়া একলা গাড়ি রাখা যেত। তখন ঐ ছোট সাইড গেট দিয়ে অন্যের জামা কাপড়ে ঘষাঘষি না করেই ভেতরে প্রবেশ করা যেত। ঝিলের পাড়ের ক্যাফেতে বসে গান শুনে শুনে চা খাওয়া যেত। তখন মঞ্চে লাল পাড় গরদ ছিল।
বিচিত্রা থেকে শাহাদত ভাই শুরু করলেন ডাকে বই উপহার পাঠানো। সেখানে আমার লেখা লেখিতে লাল-শাদা শাড়ি টিপ আর ভর্তা ডাল ভাত মুড়ি মুড়কি হয়ে উঠলো সেখানে চরম প্রতিপাদ্য লাইফ স্টাইল। আমরা যে কোন শাড়ি কিনতু সিনথেটিক বিদেশী না। আমিতো তখনইতো শাহাদাত ভাইর প্রণোদনায় সেই সাতাত্তর থেকেই দেশী কাপড় নিয়ে বিচিত্রার বীজতলা নিয়ে পুরাই উতলা। দেশ স্বাধীন বলে আমরা আমাদের পারফর্মেন্সের উপযোগী রঙগুলো নিয়ে আরো নিশ্চিত হতে থাকলাম।
আসলে বৈশাখ থেকে, চৈত্র সংক্রান্তি ও ফাল্গুনের হলুদ জেগে ঊঠেছে। এতদিনে ফেব্রুয়ারির শোক তরল হয়েছে। আজ আমরা অর্জনের আনন্দে ফেব্রিয়ারিতে সাদা-কালোর কত রকম না পরি! এখন আমাদের পোশাকে এসেছে কবিতা ও বাংলা ক্যালিগ্রাফি। টিভি ও মঞ্চে পুরো মাস ধরে সবাই পরেন সাদা কালো। একবার কয়েক বছর আগে বাংলা একাডেমির একুশের উদবোধনে মেয়েরা লাল পাড় পড়লে কি বিচ্ছিরি যে লেগেছিল। কি প্রতিবাদ যে হয়েছিল সব দিক থেকে! আসলে ব্যাপারটা কি? এই বিশেষ অনুষ্ঠান ঘিরে যে রঙের আবহ- যে রেখার নির্মান- এতো আর কিছু নয় ইংগিতময়তা ছাড়া। সিম্বলিজম আরকি। যার মাধ্যমে ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন- নতুনদের নিজ কৃষ্টির প্রতি আগ্রহী করে তোলা। কিন্তু এই রেখা দাঁড়িয়ে গেলে তা আবার ক্রমশ বদল হয়। বদল হয় রাষ্ট্র ও রাজনীতির জন্য। বদল হয় নানানভাবে দেশে অর্থায়নের জন্য। বদলায় বাণিজ্যের কারণেও। তখন এই বাণিজ্যিকীকরণ কৃষ্টির ওপর থাবা দেয়। যে দেশে শৈশব থেকে বিদ্যা শিক্ষার নামে রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতাধারীর ইচ্ছে অনিচ্ছায় ইতিহাসকে ফিকশন বানাতে পারে তাদের সংকট অনেক। আমরা সেই সংকটাপন্ন জাতি।
আমরা মনে রাখতে পারি না। রূপেরও অক্ষর আছে, শব্দ আছে, ঘ্রাণ আছে। আমরা তার ওপর হাঁটি। তার নির্মান সময় ও ইতিহাস সব মিলিয়েই। এভাবেই বস্তু বা অবস্তুর দ্যোতনা। আর সময়ে যদি সেই সূত্রিতা টিকে যায় তবে তাই হয়ে দাঁড়ায় ছাপ বা ব্রান্ডিং। দেশ দাঁড়ায় দৃঢ়। আমাদের দেশের বাঙালি বিশ্বের অন্যান্য বাঙলির চেয়ে ভিন্ন। তারাও আমাদের থেকে। আমাদের দেশে কিছু তারিখ, কিছু নাম, কিছু রঙ ছাপ হয়ে গেছে। এই যে এখন বৈশাখে লাল-সাদা, বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসে লাল-সবুজ, নারী দিবসে লাইলাক পরা এসব আরকি। পুনরাবৃত্তিতেই এর পুনর্নির্মাণ। তবে ভিড়ের একজন না হবার কথা ভেবে আপনি অন্য কিছু পরতেই পারেন। তাতে কারো কিছু হয় না। হয় নিজের। যে কোন মহতী যুদ্ধ ও ব্যাপক আয়োজনের নিমিত্ত বুঝে নিজেকে অনন্য করে তোলাটাই কথা। নিজেকে সাজিয়ে তুলতে হবে কুসুমে ও যতনে। এসবই এখন অস্ত্র। এর একটিও বাদ দেয়া যাবে না।
রমনার সেই অশ্বত্থ বেড়ে বেড়ে আজ সমস্ত দেশ ছেয়ে গেছে। লাল-শাদা, সবুজ-লাল ও শাদা-কালোতেই আছে আমাদের অভিজ্ঞান সেই অনুপান।