করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





গুচ্ছ গুচ্ছ জীবনফুল
কল্যাণী রমা
শাদা পালের জাহাজ
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি একটা শাদা পালতোলা জাহাজ । স্কূনার। বাচ্চারা খেলছে। বালুর দূর্গ, পাশে বালু খুঁড়ে ছোট নদী। সমুদ্রের জল তাতে। জলে সমুদ্রের শ্যাওলা ভাসছে। দূর্গের মাথায় কাঠি আর পাতা গুঁজে সাজ সাজ রব। পতপত ক’রে লাল রঙের তেকোণা পতাকা উড়ছে। একটু দূরে শহর, ছোট ছোট গ্রাম। পুরো পৃথিবী।
নখ দিয়ে দেয়াল খাবলে ধরে, নখের দাগে বাঘের থাবার মত দেয়াল আঁচড়ে দিয়ে আমি মৃত্যুর পথ থেকে ফিরলাম। আস্তে আস্তে দেয়াল বেয়ে বেয়ে মাটিতে বসে দেখি তখনো জাহাজটা চলেছে। বাচ্চারা দৌড়ে যাচ্ছে। লাল রঙের তেকোণা পতাকা উড়ছে।
আমার ঘরের রেলিঙে তিরিশটা শাদা গোলাপ। লালের ভিতর ছোট ছোট বুনোফুল আঁকা এক রিবন দিয়ে বাঁধা। ফুল শুকিয়ে গেছে। পাপড়ি ঝরে পড়ে নি।
১৭ই মার্চ, ২০১৫


সোনালি মাছ
সোনালি শরীর চোখ ঝলসে দেয়। জলে ভেসে ভেসে ঠোঁটের কাছে চলে আসে। সবুজ শ্যাওলা হাত জড়িয়ে ধরে। মাটি নরম হয়েছে । এখানে সেখানে বরফ । খাবলে খাবলে মাটি খুঁড়ে চলি। নখের নীচে মরণ শুয়ে থাকবে। আজ খুব ভোরে সোনালি মাছ মারা গেছে। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে পাথরের স্তূপ। মৃত্যুর উপর ঝাউপাতা পড়ে থাকে।
১৩ই মার্চ, ২০১৫



ম্যাগনোলিয়া
যত বছর ম্যাগনোলিয়া ফোটেনি ওই গাছটায়, ঠিক তত বছর দেখা হয়নি তোমার সাথে।
জানালার কাচ চুইয়ে চুইয়ে বৃষ্টির জল পড়েছে। আর আমার হাত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বুনোলতার মত ভালোবাসা শরীর বেয়ে গলার কাছে এসে আমার দমবন্ধ ক’রে দিয়েছে।
বৃষ্টির জল জানালার কাচ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। সেই জল আমার চোখের পাতায়। চোখের পাতায় যখন জল পড়ে, সেখানে তখন  কচুরিপানা ফোটে। নীল আর বেগুনি রঙ্গের মর্নিং গ্লোরি, দোলনচাঁপা।
একটা মাটির পথ ধুলো উড়িয়ে পিছনের দিকে চলে গেছে। যে সব পথ সামনে না গিয়ে পিছনের দিকে চলে যায়, সে পথে লাল হলুদ ছোপ ছোপ শাড়ি পড়ে শ্যামলা রঙ্গের মেয়েরা হেঁটে যায় । তাদের হাত ভর্তি কাচের চুড়ি। খালি পা। ওরা তুলির এক আঁচড়ে আঁকা।
আর যে পথগুলো তোমার কাছে যায়নি সে পথে হেঁটেও আমি তোমার কাছেই গেছি। আমার হাতে লাল হলুদ কাচের চুড়ি ছিল। শরীরে ছোপ ছোপ শাড়ি।
১৬ই মার্চ, ২০১৫


স্মৃতি
বকুলফুল ঝরে পড়ছে। আমার মনে পড়ছে না। সমুদ্রপাড়ে একটা লাল রঙের কাঁকড়া বালিতে গর্ত করে একবার উধাও হচ্ছে আবার বালির উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমার মনে পড়ছে না।
ক্রমশঃ আমার স্মৃতি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর আমি বাঁশগাছটার পিছল শরীর আঁকড়ে ধরে কোনমতে বাঁশপাতার শন্শন্ শব্দ মনে রাখবার চেষ্টা করছি।
চুপ ক’রে বসে আছি। আঙিনায় আলপনা। লাল, শাদা রঙ। কল্কে তোলা। পদ্মফুল, লক্ষ্মীর পা আঁকা। ঢোলক বাজাচ্ছে ঢুলি। সানাই। আমার স্মৃতির ভিতর থেকে সব মুছে যাচ্ছে। সব মুছে গেছে।
১৫ই এপ্রিল, ২০১৫


সূর্য ওঠেনি বলে
কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের জীবনে সারাদিন ধরে শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকে। সন্ধ্যার। জলের নীচে জল  আছে? শরীরে? আলোর নীচে আলো? অনেক দূরের একটা আকাশ থেকে সীগাল নেমে আসে। অথচ শরীরে তো সমুদ্র নেই।
দূরের রাস্তাটা কমলা রঙ ধরেছে। ওই রাস্তা ধরেই আমার যাওয়ার কথা ছিল। আকাশেও কমলা কমলা, ছাই রঙের মেঘ। ঝড় এভাবে হয়। আর যে আলোটা আকাশে ঝুলে আছে, সেটা বাসি আলো। কাল রাতের আলো। ভোর হ’লে ডুবে যেতে হ’য়, এ চাঁদটা সে কথাটা ভুলে গেছে।
শাদা শাদা সীগাল। আমি ওদের জলের দিকে চলে যাওয়ার কোন একটা পথে পড়েছি? যেমন পড়ে থাকি? সকলের?
বহুদিন সূর্য ওঠেনি বলে আমার হাতের পাতা জলে ভিজে আছে। কেউ কেউ বলেছিল স্বপ্নের ভিতর কোন কোন পথে নাকি সিংহদরজা আছে। সেইসব দরজা দিয়ে হেঁটে গেলে খোলা বনের মাঝে বাকিটা জীবন দাঁড়িয়ে থাকা যায়। আমি সেই পথগুলো চিনতে পারিনি। হাত থেকে টপ্টপ্ ক’রে জল ঝরে পড়ছে। এইসব জলে শুধু মাটি ভিজে যায়। সমুদ্র হয় না।
[জন্মদিনে সুস্মিকে-
১১ই মার্চ, ২০১৫]


আলো নিভছে
আকাশের সব বৃষ্টি হাহাকার হয়ে ঝরে গেছে। পুরোপুরি আলো ফোটে নি এখনো। কোথাও।গত কয়দিন ধরে যত আঁকিবুকি কাটা হয়েছিলো, সব মুছে পরিষ্কার স্লেট হয়ে গেছে আজকের সকাল। পাখীগুলো ডাকবে কিনা ভাববার কোন সুযোগ না পেয়ে অভ্যাসবশেই ডাকতে শুরু করেছে।  
আমি সকলের আগে ঝরা পাতা দেখব বলে বাড়ীর সব ক’টা দরজা খোলা রেখেই দৌড়ে বের হ’য়ে পড়েছি। এত্ত ভয় করছে। কেবলই মনে হচ্ছে সময় বুঝি আমার শেষ হতে চলেছে। আমি হয়ত সত্যিই সেই হেমন্তে কোনদিন আর পৌঁছতে পারব না। আসলে আজ বসে আমি যে এক সামনের হেমন্তের কথা ভাবছি। সেই হেমন্ত যা কোনদিন কোথাও আসে না।
তবু এক হাঁটু কমলা পাতার উপর দাঁড়িয়ে আমি মচ্ মচ্ শব্দ তুলে মনে করছি  পৃথিবীটা এখন বুঝি পুরোপুরিই আমার হাতের মুঠোয়। যদি চাই এই এখনি এই বাদামী পাতার ভিতর মাটির উপর আমি তার পাশে হয়ত সত্যি সত্যিই শুয়ে পড়তে পারব। এবং হাত দিয়ে যদি তার মুখ ছুঁয়ে দেখি তবে চেষ্টা করেও তার মুখে শতাব্দীর পায়ের ছাপ আমি একটাও কোথাও খুঁজে পাব না। হয়ত বিশ্বাসও করে ফেলব যে আমাদের চামড়ায় মাটির উপর লাঙ্গলের মত সময়ও শেষ পর্যন্ত কোন বলিরেখাই কাটতে পারে না।
তাকে আমি চব্বিশ বছর দেখি নি। জানি না কেন ভেবেছিলাম মানুষের চোখ আর ঠোঁট বুঝি পাথরে খোদাই করা থাকে। এবং মানুষের চোখের আলো এতটাই শক্তিশালী হয় যে পাহাড়ের ওপারে সব ডাইনোসর হেঁটে চলে যাওয়ার পর ঘাসের রঙও উপত্যকায় সবুজ ম্যালাকাইট হয়।
তবু ভোরবেলা গ্রামের বাড়ীর আঙিনা গোবর দিয়ে লেপা না হ’লে যেমন ফেটে ফেটে ধূলো হয়ে যায়, মানুষের সব চামড়াও সেভাবেই খসে পড়ে গেল। এবং মানুষ ভুলে গেল সেই সব পথের গল্প। যেখানে সে আমার সাথে হেঁটেছিলো। হলদে মধু ফুল পায়ের কাছে ছড়িয়ে পড়েছিলো সেদিন। আমি দশ আঙ্গুলে মধুফুলের টুপি পড়ে সেই ভোরবেলায় কত যে হেসেছিলাম। আর মধুফুল শুষে মধু খেতে গিয়ে ভুল করে তাকে জীবনের প্রথম চুমু খেয়েছিলাম। এক ফোঁটা ছটফটে শিশির পায়ের কাছে ঝরে পড়ে গিয়ে বলেছিলো ইচ্ছে করলেই পৃথিবীটাকে যে কোন সময় রাজপ্রাসাদ করে ফেলা যায়। এবং ইচ্ছে করলেই সারা জীবন হাতের ভিতর হাত আঁকড়ে ধরে হেঁটেও যাওয়া যায়।
সেই সব ইচ্ছেগুলো এখন আমার পায়ের কাছে কমলা, বাদামী, লাল পাতা হয়ে ঝরে পড়ে আছে। আর আমি বোকার মত কয়েকটি লাল রঙের সুগার ম্যাপল, হলদে রঙের রিভার বার্চ, সোনালি রঙের এ্যাস্পেনের পাতা কোনমতে দুই আঙ্গুল দিয়ে ছুঁতে পেরেই ফ্যালফ্যাল চোখ করে ভাবছি এইবার আমিও বুঝি এই কমলা পৃথিবীর উপর তার পাশেই শুয়ে থাকব। অথচ এদিকে আমার সব তাড়াহুড়োর অনেক আগেই তার মুখের সব বলিরেখা আমার পায়ের নীচে, ওই পাতার স্তূপে ঝুরঝুর করে আমার জন্মের আগে ঝরে গেছে।
মধুফুল শুধু স্বপ্নের হেমন্তেই ফোটে।
১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০১১


কপালের দাগ
(১)
বরফ বাড়ছে। প্রথমে এক ইঞ্চি, দুই ইঞ্চি, তার পর ফুট ফুট বরফ। কমলা চাঁদের মত রঙের শীতকালের তাপহীন সূর্য। তার আলো পড়েই বরফটাকে যেন আরো বেশি শাদা মনে হচ্ছে।
আমার এত্ত অস্থির লাগছে। কেবলই মনে হচ্ছে একটাই পশমী চাদর দু’জনে মিলে একসাথে গায়ে দিয়ে তোমার কোমর জড়িয়ে, তোমার বুকে নিজেকে সম্পূর্ণ এলিয়ে দিয়ে যদি আজ সারারাত হাঁটি; হয়ত সত্যিই বরফ গলে যেতে পারে। চাঁদের আলোয় প্রেইরী আবার ভেসে যেতে পারে। হয়ত ঘননীল সাটিনের মত ব্লু ট্রি সোওয়ালোগুলো ফিরে এসে আবার বাসাও বাঁধতে পারে। কিংবা সোনালি রঙের ব্ল্যাক সুজান সামনের পুরো সাতাশ একর জমি জুড়ে হঠাৎ ফুটে উঠতে পারে।

এভাবে কিভাবে বাঁচব আমি বলো তো? বেশী কিছু তো চাইনি। শুধু মনে হয় কাচের জানালার উপর বরফের নিঃশ্বাস যখন শক্ত আইসিকল্ হয়ে যায়, তখন যেন পা ছড়িয়ে বসে আছি ঘরের কোণে ঠিক যেখানে দু’টো দেওয়াল এসে মিশেছে ঠিক সেই মাটিতে। তুমিও আমার পাশে আছো। দু’জনে মিলে একটাই যেন কবিতার বই পড়ছি। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে কিংবা জ্বলছে না। তোমার মুখটা তবু শেষ সূর্যের আলোয় কেন যেন কমলা মত দেখাচ্ছে।
আসলে এই স্বপ্নটা কিন্তু এমন কিছু অসাধারণ এবং দুষ্প্রাপ্য কিছু নয়। তবু আমার জীবনে কখনো ঘটবে না বলেই সব সময় কেমন যেন মনে হয় কোনদিন যদি হঠাৎ এমনটা ঘটে যায়, আমি বুঝি ঠিক তখনই মরে যেতে পারব। পৃথিবীতে চাইবার মত আমার আর সত্যি কিচ্ছু থাকবে না!
খুব বুক ব্যাথা করছে। গলার কাছটা ধরে আসছে। আজ আর ডায়েরি লিখতে পারছি না। অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। তুমি ভালো থেকো। কবিতা লিখো।

জলরঙ
(২)
ধড়ফড় করে ঘামতে ঘামতে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে বিছানার উপর উঠে বসেছি। এমন স্বপ্ন কি কখনো কারো দেখা উচিত? সত্যি দেখলাম তুমি বলছ, ‘বাকি জীবন তোমার বাম ঊরুর ওই কালো তিলটাতেই মুখ গুঁজে কাটিয়ে দেব!’
রাতে ঘুমানোর আগে এ্যাডভেয়ার স্টেরোয়েড, ভেন্টোলিন ইনহেলার, লোরাটাডাইন, সিনগুলেয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি এ্যাজমার সব ওষুধ নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন তো আর একটুও নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। কি করব আমি? সারা জীবনে কথা হয়নি তোমার সাথে কোনদিন। দেখা হবে না কখনো। তবু...
সব সময় এত্ত পাগল পাগল লাগে আমার। দশ আঙ্গুল দিয়ে মাথার দুই পাশের রগ দু’টো চেপে ধরে বাকি জীবন লেপের নীচে মাথা পর্যন্ত ঢেকে, অন্ধকারে শুয়েই কাটিয়ে দেওয়া যেত যদি!
আচ্ছা, ছেলেবেলার গোলাপি-শাদা দোপাটি ফুলের কথা মনে আছে তোমার? আলতো, নরম পাপড়ির নীচে কেমন জন্মদিনের বেলুনের মত গাল ফোলানো থাকতো! ফুলগুলোকে নিয়ে ওই বেলুনগুলো আমরা কপালের ঠিক মধ্যিখানে দুম করে ফোটাতাম। বাজি ফোটার মত শব্দ হ’ত আর কি সুন্দর যে ফুলের জল দিয়ে একটা করে টিপ হয়ে যেত! বড় বেশি ইচ্ছে করছে নিজের সমস্ত অস্তিত্বকে ওই দোপাটি ফুলের মত এক নিঃশ্বাসে শেষ করে, তোমার কপালে সারা জীবনের মত একটা দাগ করে দেই। অনেক চোখের জল দিয়েও কপালের ওই দাগ কিছুতেই আর মুছবে না! কোনদিন!


(৩)
বাইরে আজও কেবলই বরফ পড়ছে। আর আমি ঠান্ডা কাচের জানালার পাশে বসে সে রাতের অবিশ্রান্ত বৃষ্টির কথা ভাবছি। ভাবছি শাদা প্রজাপতির মত দেখতে দোলনচাঁপা ফুল, দিনের আলো নিভে যাওয়ার একটু আগের ওই রঙধনু আর ভীষণ জ্বরে পুড়ে যাওয়া তোমার গরম শরীরের কথা। মোমের আলোতে দেওয়ালের উপর কেঁপে কেঁপে ওঠা নিজের কথাও ভাবছি, অল্প।
শাদা বরফ আমার সামনে পড়ে আছে সত্যিকারের জীবনের মত। যা কিছু আসলে মানুষের জীবনে ঘটে কিংবা ঘটতে পারে তার মত। সারাদিন এত শাদা দেখতে দেখতে রঙধনুর রঙগুলোকে এত বেশী দূরের অবাস্তব গল্প বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনভাবেই অত রঙ মানুষের চোখ আসলে সহ্য করতে পারে না।হয়ত সে জন্যই মানুষের চোখে ঠাকুর পলক দিয়েছে। বারবার ভুল ভাঙ্গাতে চোখের পলক ফেলতে থাকলে মানুষের স্বপ্নগুলোও হাঁটতে শুরু করে। চোখ থেকে হেঁটে হেঁটে তারা সবাই মাথার খুলির ভিতর ঢুকে পড়ে। খুলির ভিতর কোনভাবে একবার ঢুকে পড়তে পারলে পাল্কি চেপেও লাল রঙের নতুন বউ হয়ে স্বপ্নরা আর কোথাও যেতে পারে না। ওরা শুধু আগুনের ফুলকি হয়ে, জোনাক পোকার মত তারপর থেকে জ্বলতে থাকে। সারাটাক্ষণ এক অনন্ত হাহাকারের মত।
খুলির চারপাশে শাদা হাড়ের কবর। মানুষের মাথার শাদা হাড় হাতুড়ি দিয়েও তো গুঁড়িয়ে ফেলা যায় না। চিতার আগুনে সব পুড়িয়ে মানুষ তাই শেষ অস্তিত্বে নারকোলের মালসার মত কপালের একটা হাড় হয়েই বেঁচে থাকে। তুলসীতলায় প্রদীপের তেল পড়ে সেই একাকী হাড় যতবার আলো পায়, হাড়ের গায়ে লেপ্টে লেগে থাকা স্বপ্নগুলো ঠিক ততবার সরীসৃপের মত নিঃশ্বাস ফেলে।
আর তাই মানুষের স্বপ্ন মানুষের জীবনের থেকে অমর। আর মানুষের জীবন তার স্বপ্নের থেকে পুরানো। এবং স্বপ্ন, জীবন এই সবকিছুই টিনের একটা ভাঙ্গা ট্রাঙ্কে, ন্যাপথলিন দিয়ে জমিয়ে রাখা ছেঁড়া কাঁথা আর লাল শালু লেপের শাদা মার্কিনের ওয়্যারের মত। অনেক শীতের পরও তার পরের শীতে ঠিক আবার দিব্যি ব্যবহার করা চলে। শুধু একদিন ভোরবেলা থেকে সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় রোদ লাগালেই হয়ে যায়। কিংবা একটা দু’টো শুধু এদিক ওদিক তালি। সাথে সাথেই সব স্বপ্ন আর সব জীবন শীত দুপুরে পা ছড়িয়ে খাওয়া কমলালেবুর মত চনমনে হয়ে ওঠে। খোসার নীচে শাদা রঙের মাংসের চামড়া উপচিয়ে সোনালি।
(৪)
সেই কোন সন্ধ্যারাত থেকে শেষরাত শ্মশান ঘাট থেকে নদীর বাতাস বেয়ে পোড়া মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে।
আগুনে দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে শরীর। শুধু পুড়ছে না কপালের ওই হাড়। আর সেই হাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা সেইসব স্বপ্নের ধ্বংসস্তুপ। হাড়ের গায়ে লেপ্টে স্বপ্নগুলো কি অদ্ভুতভাবে দিব্যি বেঁচে থাকছে, ঠিক যেভাবে বেঁচে থাকে অনেক প্রেমে জড়িয়ে থাকা মানুষ আর তার মানুষীর শরীর। প্রেম মরে না কোনদিন...স্বপ্ন মরে না।

শুধু মহেঞ্জোদারোর পাথর হয়ে যাওয়া ভেঙ্গে পড়া কাদামাটির জানালার ফাঁক গলে একসময় সব ভৌতিক স্বপ্ন আর সব ভৌতিক প্রেম তোমাকে দখল করে ফেলে। আমাকে দখল করে ফেলে। কবরের ভিতর আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কোথাও পালানোর পথ থাকে না।
আজ কোথায় যাবে তুমি?  শেষবারের মত? এই অবেলায়?
১৫ই নভেম্বর, ২০১০