করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০১ সংখ্যা
আগস্ট ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





আমার বড়দিন
কেকা অধিকারী
ডিসেম্বর মাস পড়তেই মনে আমার বড়দিন শুরু হয়ে যায়। পঁচিশ তারিখ এলো বলে! বয়সের কারণে বড়দিনের ভাবনা এখন আর খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো কিম্বা পোশাক-আশাককে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না। বরং আত্মিক জীবনের ভাবনাই মনের মধ্যে ঘুর-পাক থেতে থাকে। এবার দেখছি একটা সুর নিয়তই আমার অন্তরে বেজে চলেছে . . . ‘.তাই তোমার আনন্দ আমার পর, তাই এসেছো নিচে, আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে।’ কি জানি আমার কথা ভেবেই হয়তো যীশু পৃথিবীতে এসেছিলেন! রবিঠাকুরের এ গান কেন আমার মনে বাজছে?  হয়তো তুচ্ছ এই ‘আমি’কে একটু মহিমা দেয়ার লোভে। হয়তো এ অনুভূতি লোক চক্ষুর অন্তরালে বড়দিনে নিজেকে বড় করার ক্ষুদ্র প্রয়াস। বাস্তব হল উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা আমাকে ততোটা স্পর্শ করে না। কিন্তু ছেলে, পরিবার আর আত্মীয়-স্বজনের কথা মাথায় রেখে কিছু প্রস্তুতি তো নিতেই হয়। ঘর গোছানো, ঘরে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, বাজার ঘুরে যেটুকু না করলেই নয় তেমন কেনাকাটা, উপহার সামগ্রী প্রস্তুত করা আর মায়ের সার্বিক সহায়তায় ভালোমন্দ কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা - এই হল আমার বড়দিনের প্রস্তুতি। জীবিকার তাগিদে খুব বেশি কাজের চাপে আছি বলে এবার এখনো ক্রিসমাস ট্রি  সাজানো হয় নি। ছেলে অন্বয়কে সে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি। আশা করছি সবুজ গাছটা বড়দিনের আগে যে কোন দিন ঝলমল করে উঠবে। ছেলেকে দেখেই আমি আমার শৈশবের বড়দিন গুলিতে ফিরে যাই। সংসারের দায়িত্বভার কাঁধে চাপার আগের আর পরের বড়দিনগুলির মধ্যে কত্তো না তফাৎ!
শৈশবে আমরা থাকতাম কলাবাগানে। সব মুসলিম আর দু’ঘর হিন্দু প্রতিবেশির মধ্যে আমরাই ছিলাম একমাত্র খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী পরিবার। পড়তাম লেক সার্কাস স্কুলে। একটা সময় ছিল যখন ক্লাশে তো বটে, পুরো স্কুলেও একমাত্র খ্রিস্টান ছাত্রী ছিলাম আমি। ২৫ ডিসেম্বর কাছে এলেই বন্ধুরা বলতে আরম্ভ করতো, ‘বড়দিনে তোরা কি করিস্?’ ‘এবার বড়দিন কোথায় করবি?’ আমাদের গীর্জায় নিয়ে যাবি? বড়দিন দেখবো।’
বড়দিনের কথা বলতে পেরে আনন্দ পেতাম, আবার মাঝে মাঝে কারো কারো বড়দিনে বাসার আসার আগ্রহ দেখে মনে মনে রাগও হতো খুব - ‘প্রতিবছর দু’দুটো করে ্ঈদ যায়, কই তখন তো একাবারও আমার কথা মনে পড়ে না, ক্লাসে একটামাত্র খ্রিস্টান মেয়ে আমি!’ মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল আমাদের। তাই সবাইকে তো আর বলা সম্ভব হতো না, মা’কে বলে কয়েকজন কাছের বন্ধুকে নিমন্ত্রণ জানাতাম। তৃষ্ণা, নাজমা, নিগার, শায়লা, লুনাকে সত্যি সত্যি মন থেকেই চাইতাম। কারণ প্রতিটি ঈদে ওদের সব বাসায় আমার নিমন্ত্রণ অবধারিত ছিল। ছোট বেলাও বড়দিনের সকালে গীর্জায় যেতাম। কোন কোন বছর গীর্জায় প্রীতি ভোজ হতো অর্থাৎ গীজর্ ার সদস্য পরিবারগুলি একসাথে দুপুরের খাবার খেতাম। গীর্জার পরে আর খাবার আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলা-ধূলা ও গিফট এক্সচেঞ্জ বা উপহার দেয়া নেয়া হতো। আমার উপহারটি কে পান আর আমিই বা কার কাছ থেকে উপহার পাচ্ছি তা ভেবে মনে খুব উত্তেজনা হতো। কিন্তু দুপুরের পর বাসায় ফিরে অন্তরটা কেমন যেন মিইয়ে আসতো আশে পাশের বৃহত্তর পরিবেশে উৎসবের কোন চিহ্ন থাকতো না বলে। কিন্তু বন্ধুরা বিকেলে বাসায় আসতে শুরু করলে মনটা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতো। কলেজ জীবনে মুসলিম বান্ধবী মুক্তাকে না পেলে আমার বড়দিনের আনন্দ পূূর্ণ হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আভা, টগর, জিল্লুর আর রুবেলকে নিয়েই বড়দিনের দিনটি কাটাতাম। পেছনের দিনগুলির দিকে ফিরে তাকালে দেখি আমার বড়দিনগুলো আনন্দে ভরিয়ে রেখেছে আসলে আমার মুসলিম বন্ধুরাই। তাদের ধর্ম বিশ্বাস আমার আনন্দে বাধা হয় নি কোনদিন, কখনো। আনন্দ আর ভালোবাসাটাই যে সেখানে মূখ্য ছিল।  এখন দেখছি বড়দিন উদযাপন যেন দিন দিন সার্বজনীন হয়ে উঠছে। আকাশ সংস্কৃতি আর নানা টিভি চ্যানেলের কারণে বড়দিন উদযাপন সম্পর্কে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও অল্প-বিস্তর ধারণা আছে। উচ্চবিত্তরা পাঁচতারকা হোটেলে গিয়ে বড়দিন উদযাপনে অংশ নিতে পারেন। এ বিষয়টা অবশ্য অনেক বছর আগে থেকেই প্রচলিত। আজকাল বাংলাদেশের বাজারেও বিদেশের বাজারের মতো বড়দিনের আভাস মেলে। ঢাকার রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ বড়দিনের শুভেচ্ছাবাণী সম্বলিত ব্যানার ঝুলতে দেখা যায়। সবার মধ্যে আনন্দের সহভাগিতা, হোক না তা ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক কারণে, দেখতে ভালোই লাগে। বিভিন্ন গীর্জা, খ্রীস্টান সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে বড়দিনের আগেই সদস্য বা কর্মীদের জন্যে আয়োজন করা হয় প্রাক-বড়দিন উৎসব। তাতে প্রায়ই তাদের পরিবারের সদস্যরাও আমন্ত্রিত থাকেন।
এবার আমার গীর্জা মিরপুর ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ এর মহিলা সমিতি গত ১৬ ডিসেম্বর প্রাক-বড়দিন উৎসবের আয়োজন করেছিল। সেখানে মহিলা ও আমন্ত্রিত অতিথিরা মিলে বিজয় দিবস ও যিশুর জন্মউৎসব পালন করেছি। ‘বড়দিনের ভাবনা’ বিষয়ে একটি সেশন পরিচালনা করতে হয়েছে আমাকে। সে জন্য প্রস্তুতির নিতে গিয়ে অন্তরে একটা সুন্দর অনভবের স্পর্শ পেয়েছিলাম যেন। গীর্জা ও খ্রীস্টান বিভিন্ন যুব সংগঠনের উদ্যোগে সন্ধ্যায় বড়দিনের কীর্তণ আয়োজন করা হয়। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা শীতকে অগ্রাহ্য করে শহরময় বাড়ি বাড়ি ঘুরে নেচে গেয়ে কীর্তণ গান করে বড়দিনকে স্বাগত জানান। পাড়ার মধ্যে পায়ে হেঁটে যেমন সংকীর্তন করা হয়, তেমনি আবার অধিক উদ্যোগী দল গাড়ী নিয়ে শহরের এ মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত ঘুরে যিশুর জন্মবারতা ঘোষণায় আকাশ বাতাস মুখরিত করে থাকে। বর্তমানে ঢাকার সবচেয়ে বড় খ্রিস্টান কমিউনিটি আছে মিরপুর এলাকায়। বিগত ১৮ বছর ধরে মিরপুর আন্তঃমান্ডলিক বড়দিন উদযাপন কমিটি ২৫ ডিসেম্বরের আগে বিশেষ আনন্দ উৎসবের আয়োজন করেন। যুব সংগঠক প্রলয় সমদ্দার বাপ্পি এ উৎসব আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন যেখানে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অতিথিরাও আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন। গত ২০ ডিসেম্বর মিরপুরের ব্যাপ্টিষ্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে এবারও অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল। মাননীয় স্পিকার ড: শিরিন শারমীন চৌধুরী সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন, স্থানীয় এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ সহ অনেক বিশিষ্টজন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রতিবারের মতো আমাদের পরিবারের অনেক সদস্যই সে উৎসবে যোগ দিয়েছেন।  
এ বছরটা আমাদের জন্যে একটু অন্য রকম। জীবনে এবারই প্রথম বাবাকে ছাড়া বড়দিন করবো আমরা। সত্যি কি তাই? আসলে বাবাকে অন্তরে নিয়েই দিনটি অতিবাহিত হবে জানি। অন্য দিকে এ বছরই হারিয়েছি মেঝ জ্যাঠাকে, হারিয়েছি কলেজ জীবনের বন্ধু রাশেদকে। তাই ভেবেছি এবার বড়দিনটিতে থাকবো মা, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীর সান্নিধ্যে। পরিবারে সবাইকে নিয়ে সকালে গীর্জায় যাব। সুসমাচার প্রচার শুনবো, প্রার্থনা করবো, গান গাইবো -
‘আজ শুভ বড়দিন ভাই, আজ শুভ বড়দিন... খ্রিষ্ট যিশু এলেন ভবে পাপীরে করিতে ত্রাণ”। আর দুপুর থেকে বিকাল কাটাব রাশেদের স্ত্রী মেরী ও মেয়ে তিনা এবং অন্য বন্ধু সাদিয়া ও বেবির পরিবারকে নিয়ে। ছেলেও হয়তো নিমন্ত্রণ করবে তার স্কুলের ৩/৪ জন বন্ধুকে। আর তার বাবা গীর্জার পর ব্যস্ত থাকবেন প্রীতিভোজ ও বঙ্গভবনে মাননীয় প্রেসিডেন্টের সাথে খ্রীস্টবিশ্বাসীদের সাক্ষাতের অনুষ্ঠান নিয়ে। রাতে পরিবারসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করার কথা ভাবছি। সারাদিনের মধ্যে মাঝে মাঝেই মোবাইল ফোনে বিদেশে  কিম্বা দূরে থাকা আত্মীয়-বন্ধুদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় হবে। কাছের বন্ধু, প্রিয়জনদের সাথে বিশেষ সময় কাটাবো বড়দিনের পরের কোন সুবিধাজনক সময়ে। আসলে নতুন বছর পর্যন্ত বড়দিনের রেশ থাকবে যেমনটা থাকে প্রতি বছর। কিছু দিন বাদে কাজের ব্যস্ততা বাড়বে, সাথে সাথে মিলিয়ে যাবে এবারের বড়দিন আমেজ। কিছু দিনের মধ্যে শুরু হবে মাস গণনা, ডিসেম্বরের অপেক্ষা - আবার কবে বড়দিন আসবে?