করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





নদীর গল্প
ক্যামেলিয়া আহমেদ
ওকে পেয়েছিলাম রাস্তায়, ইভনিংওয়াকে। পেছন থেকে কে যেন ডাকলো -আপা, থমকে দাঁড়ালাম। এই অরণ্যের ভেতরতো আমার কোন স্বজন আসে না। কে এতো আপন করে ডাকলো! শুদ্ধ ভাষা আপা, নাকি অন্য কাউকে। পেছনে তাকিয়ে দেখি একটি মেয়ে। বয়স আমার চেয়ে কিছু কম। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। হেসে বললো -আপা ভালো আছেন?
জি ভালো, আপনি?
না আপা আমাকে তুমি বলেন।
ও আচ্ছা, তা তুমি আমাকে চেন?
হাঁ আপা, আপনি প্রতিদিন আমার বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে আসেন আমি দেখি। কতবার আপনার সাথে দেখা করতে চাই। সুযোগ হয় না। তাই আজ আপনাকে আসতে দেখে পিছনে পিছনে চলে আসলাম।
ও আচ্ছা তা কেন বল, আমাকে কি প্রয়োজন?
মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে-আপনাকে খুব আপন মনে হয়। আমাকে কাজে রাখবেন ? ভীষণ অবাক হলাম, ওর চেহারা পোষাক পরিছন্নতা সব সাক্ষ্য দিচ্ছে কোন ভদ্রঘরের সন্তান। সে আবার কাজ করে!
তোমাকে দেখে তো তা মনে হয় না।
হাঁ আপা, কাজ করি। যাদের বাসায় ছিলাম তারা বিদেশ চলে যাচ্ছে কয়েকদিনের মধ্যেই আমি থাকবো কোথায়। দারোয়ান বললো আপনার কথা Ñ ওই ম্যাডাম খুব ভালো, যদি তোমাকে নেয় তাহলে তোমার চৌদ্দপুরুষের সৌভাগ্য। বলতে বলতে হাঁ হাঁ করে হাসে। কনতো আপা আমার তো একপুরুষও নাই উনি চৌদ্দপুরুষের কথা বললো কেনো, উনি আমার সব জানে।
ওর কথার ভেতর কেমন যেন রহস্য মনে হলো।
চলোতো তোমার দারোয়ানের কাছে।
আপা উনি আপনাকে চিনে। অনেক সুনামও করে।
আচ্ছা তাই নাকি!
ভাবতে ভাবতে হাজির হলাম দারোয়ানের কাছে, সে আসলেই চেনে আমাকে। আমিও তাকে চিনি। বছর দশেক আগে যে বাড়িটিতে ভাড়া ছিলাম, উনি ওই বাড়ির দারোয়ান ছিলেন। এতোদিনেও উনি আমাকে মনে রেখেছেন জেনে ভালো লাগলো। এখন সে বুড়ো হয়ে গেছে যদিও।
চাচা আপনি ভালো আছেন?
হ্যা গো মা আমি বেঁচে আছি। আপনি কেমন আছেন? আমার বইনেরা ? মাগো আপনি কতো ভালো মানুষ আপনার হাতের কতো খাবার খাইছি, বিপদে -আপদে কতো সাহায্য করছেন আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক। চাচার দোয়ায় কৃতজ্ঞ হয়ে চাচাকে কিছু খাবার জন্যে দুইশত টাকা দিলাম। চাচা কি যে খুশি হলেন, চাচার দুইচোখে তখন আনন্দ অশ্রু। বললেন-
মাগো, আপনে আগের মতোই রইয়া গেলেন সেই হাসি, সেই দরদ। মাগো জীবনে তো অনেক মানুষেরই উপকার করলেন এইবার আপনারে আমি আরেকটা অনুরোধ করতে চাই। এই যে মাইয়্যাডা ওর কেউ নাই। যে বাসায় ছিলো তারা বিদেশে চইলা যাইতাছে, ও থাকবো কই। ওরে আমি মেয়ের মতোই দেহি, ওরে যদি আপনে এট্টু জায়গা দিতেন। আল্লাহ আপনারে বালো রাকবো। ও সব কাজ জানে। আরে বালো গরের মাইয়্যা, কপাল দোষে রাস্তায় পইড়া রইছে।
চাচা সব খুলে বললেন। ভীষণ মায়া হলো মেয়েটির জন্য ।

পরের সপ্তাহেই মেয়েটি চলে আসে আমার কাছে। সত্যি ও সব কাজে পারদর্শী। ভালোই হলো আমার, দিনে দিনে ওর প্রতি আমার আগ্রহ বাড়তে লাগলো। ভীষণ আকৃষ্ট আমি ওর ব্যবহারে, জানতে চাইলাম ওর বৃত্তান্ত। ওর কোথায় জন্ম, কে বাবা, কে মা, কোন জেলা বা গ্রাম তার কিছুই জানে না সে। ভাবতে অবাক লাগে কোন পরিস্থিতির কাছে সমর্পিত হলে মানুষ নিজের পরিচয় জানতে পারে না, শুধু অস্তিত্বটুকুই বয়ে বেড়ায়। যার সঠিক জন্ম পরিচয় নেই । ইতরজনেরা যাকে বলে বেওয়ারিশ। ওর নাম নদী। ও যা জানে তা হলো, কোন এক নিঃসন্তান দম্পতি তাকে দত্তক নিয়েছিল ওর বয়স যখন সাত। তখন ওই দম্পতিদের ঘরে সন্তান আসে, সেই সন্তানের বয়স যখন ছয় মাস তখন তাকে রাস্তায় বসিয়ে রেখে তারা বাসাবদল করে চলে যায়। কোন এক পথচারী তাকে রাস্তায় কাঁদতে দেখে তুলে নেয়, তারপর বাসায় কাজের মেয়ে হিসাবে রাখে। কিন্তু ওর যে চেহারা, স্বভাব তাতে ওকে কাজের মেয়ে হিসাবে মানায় না। এটা ওরাও বুঝতে পারে ওর নাম ছিল রেণু পরে তারা নাম দেয় নদী। এখন ওর নাম নদী। হাঁ আসলেই নদী। যথাযথ নামটিই ওকে দেওয়া হয়েছে। ওর অঙ্গে, রূপে যে ঢেউয়ের মাতম আমি দেখেছি তাতে নামের সার্থকতা রয়েছে বটে।
একদিন হঠাৎ নদী আমাকে ডেকে বলে, আপা আমার তো কোন পরিচয় নেই- আমার কি বিয়ে হবে না ? ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যে করুণ মিনতি আমি দেখেছিলাম তাতে ভীষণভাবে দাগ কেটেছে আমার হৃদয়ে। ক্যান্রে বিয়ে হবে না কেন ? আমিই তো তোর অভিভাবক, ঠিক আছে তোকে আমিই বিয়ে দেব।
নদী যে যৌবনে সন্তরণ করছে তাতে ¯্রােতের কমতি নেই, গতি আর লাবণ্যের প্রকাশও তেমনি। নদী যখন গোসল করে চুলগুলো ছড়িয়ে দিতো মনে হতো স্বর্গের দেবী। এমন মেয়েকে কোন পুরুষেরই পছন্দ না হয়ে উপায় নেই। বহু প্রেমিক নাকি জুটেছে ওর, কিন্তু যখনই শুনেছে পরিচয়হীন -তারা পালিয়েছে। কে জানে কেউ ওর সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে কি না! একবার জানতে চেয়েছিলাম  এড়িয়ে গেছে, অনেক পাত্রকে দেখিয়েছি সবাই পছন্দ করেছে  কিন্তু ঘটনা জানার পর কেউ এগোয়নি। আমার পরিচয় তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। কতোটা হতভাগ্য হয়ে ওর জন্ম হয়েছিলোÑভীষণ কষ্ট হয়। আমি দেখেছি তার যৌবন তৃষ্ণা, দেখেছি পরিচয়হীন, নামহীন এক নদীর ভাঙ্গা-গড়া। এমন একটি উত্ত্বাল নদী তার পরিচয় নেই এই সমাজে। এ দায়বোধ আমাদেরই। আমরা পারি না, নতুন কোন পরিচয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে এ লজ্জা চিরকালের।

মহল্লার এক যুবকের সাথে নদীর পরিচয় ঘটে। সে দোকান করে মুদি দোকান। মাঝে মধ্যে ওকে পাঠাতাম দোকানে। যুবকটিও দেখতে বেশ। আমাদের আগেরই চেনা। কখন যেনো ওদের মধ্যে একটি সোহার্দ্য গড়ে ওঠেছিলো। একবার আমার অনুপস্থিতিতে ওই যুবকটিকে নদী বাসায় ডাকে। ও অবশ্য আমাকে ভয় পেত না, কারণ ওকে আমি কখনই গালমন্দ করতাম না। তা ছাড়া নদীও এমন কিছু করতো না যে তাকে বকতে হয়।
বাসার দারোয়ান দেখে ফেলেছিল ওই যুবকটিকে  আসতে, সে বিষয়টি খেয়ালে রেখেছিলো। বেশ সময় কাটিয়েছে ওরা একসঙ্গে। হঠাৎ দারোয়ান আরও দুজন যুবককে নিয়ে দরজায় এসে হাজির। তারা জেরা করতে করতে একপর্যায়ে যুবকটিকে ধরে বেদম মেরেছে। ততোক্ষণে আমি এসে হাজির। হতবাক হলাম এ কি কান্ড! লজ্জায় আমার মাথা নুয়ে পড়ে।
 
সেই মুহুর্তে আমার ঘর থেকে নদীকে ওরা বের করে দেয়। আমার সাধ্য ছিল না ওকে ধরে রাখি। যদিও ওর ওই কর্মকান্ডে আমার বিন্দু পরিমানও অভিযোগ ছিল না। অথচ, হায়রে সমাজ ...... । ঘরের ভেতর তল্লাশি করে এভাবে কলঙ্ক মেখে দেয়া ! যে ভরা নদীর যৌবনে কেউ পাল উড়াতে পারবে না,যে নদীর ঢেউ কাউকে ভাসিয়ে নিতে পারবে না- সে নদীর মৃত্যু হওয়াই শ্রেয়। নদীর চোখে আমি কখনো নষ্টামি দেখিনি। আমার ঘরে পুরুষের অস্তিত্ব ছিল। যদি এমনটি হতো কোনদিন নদীর চোখে তার ছায়া দেখতাম আমি স্বইচ্ছায় তাকে বিলিয়ে দিতাম নদীর ঢেউয়ে এভাবে ওকে কলংকিনী হতে দিতাম না । কিন্তু নদী তা চায়নি, হতভাগী আমিও নদীকে ধরে রাখতে পারলাম না।
দু’চার, পাঁচ বছর কেটে গেল নদীকে ভুলতে পারি না, জানি না ও কোথায় থাকে।
এর মাঝে বাসা বদল হয়েছে। হঠাৎ একদিন আবার সেই ইভনিংওয়াক ফেরার পথে দেখি রাস্তার পাশে একটি পাগলি বসে আছে আধাপোষাকে। কৌতূহল বশে দাঁড়ালাম। হতভম্ব হয়ে গেলাম! এ যে নদী! জরাজীর্ণ শরীর উসকো খুসকো চুল ছড়িয়ে আছে শরীরময়  আমার বুকের ভেতর ভাংচুর শুরু হলো, হায় এ কি  অবস্থা দেখছি আমি ! অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম দেখি কিছু বলে কি না। ও হয়তো দূর থেকে আমাকে দেখেছে নয়তো স্মৃতির বিভ্রাট ঘটেছে তাই চিনতে পারছে না অথবা কথা বলছে না অভিমানে। ও একবারও আমার দিকে তাকালো না। নির্বাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলো সমুখে। নাম ধরে ডাকলাম নদী, আরে এই নদী, শোন আমার উপর বুঝি তোর খুব রাগ ? বল, আমার কি করার ছিল সেদিন ? কী করে তোর এই অবস্থা হলো ! তোর সব জল কে কেড়ে নিলো।  আমাকে কেন বলিসনি সেদিন তোর মনের কথা, প্রয়োজনে আমার যা ছিল সেটাই তোকে দিতাম, আবার হাত ধরে টান দিলাম। বললাম, উঠ- তোকে আবার আমি নিয়ে যাই। নদী হাতটা ছাড়িয়ে নিল । ওর অভিমান যেন বলে দিল আমাকে, যাও এখন আমার আর কিছুই লাগে না। আমি রাস্তাই থাকি ওসব এখন ছেলেখেলা। নদী তখন আসলেই মৃত, ঢেউ নেই-শব্দ নেই। ওর ভাঙ্গন আজো আমাকে ভাঙ্গেÑতছনছ করে।