ঢাকার ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়, ২ আগস্ট ২০০৮, শনিবার, বিকেল সাড়ে চারটা। বাংলামাটির ওয়েব ডিজাইনার আরিফ আহসান ল্যাপটপ আর ব্যাকস্ক্রিন নিয়ে বেঙ্গল ক্যাফেতে প্রবেশ করলেন। ঠিক এক ঘন্টা পরে এখানেই বসবে অনলাইন ম্যাগাজিন বাংলামাটির জন্মদিনের আসর। আগেরদিন থেকে পর্যায়ক্রমে বাংলামাটির ম্যাটার আপলোড শুরু হলেও আজই হবে তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। কিন্তু আরিফ এসে দেখলেন যে, সাউন্ড বক্স ও প্রজেক্টর এসে পোঁছোয়নি, ঘরও সাজানো গোছানো হয়নি। এদিকে যে দুপুরে তার খাওয়াই হয়নি, রাতে ঘুমানোরও সুযোগ পাননি- ভুলে গেলেন সব। নেমে পড়লেন কাজে। স্টেজ সাজানো হলো। প্রথমে এলেন দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক। ইতিমধ্যে বাংলামাটির সম্পাদকও চলে এলেন, এলো সাউন্ড সিস্টেম ও প্রজেক্টর টিম। বেঙ্গল ক্যাফেতে কোনো খাবার নেই, অনুষ্ঠানের খাবার তৈরি হতেও অনেক সময়। আরিফ যে বাইরে যেয়ে খাবেন সেই ফুরসৎ কোথায়। সম্পাদকের ব্যাগে এমার্জেন্সি বিস্কুটের প্যাকেট আছে, মজাদার নোনতা বিস্কুক। এই দিয়েই মধ্যাহ্নভোজ।
মারুফ রায়হান জানেন যে, সভাপতি, প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি যথাসময়ে এসে পোঁছবেন- এতে কোন সংশয় নেই। তবু একটা সৌজন্য আছে না! তিনজনকেই ফোন করা হলো, ভুল বললাম, দুজনকে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার মোবাইল ফোন ব্যবাহর করেন না, টিএন্ডটি ফোন কেউ ধরছেন না তাঁর বাসায়। তার মানে তিনি রওনা দিয়েছেন। হ্যাঁ, ঠিক তাই। সেলিনা হোসেনও ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। আবুল ভাই বললেন, সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই আমি আসবো। বৌমা থাকবেন সঙ্গে, তাই তোমাদের কারো আনতে হবে না আমাকে। আসলেই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে এলেন বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনের সম্মানিত এই তিন ব্যক্তিত্ব। কয়েকজন বিশিষ্ট লেখকও এলেন, ঐঁদের ভেতর আছেন হায়াৎ সাইফ, নুরুল করিম নাসিম। আমন্ত্রণপত্রে উল্লেখিত সময় সাড়ে পাঁচটায় অনুষ্ঠান শুরু করাই যায়, কিন্তু দর্শক-আসন যে প্রায় শূন্য! অগত্যা কিছুটা বিলম্ব। প্রতিনি মিনিটই একেকটা ঘণ্টার মতো মনে হয়, অবশ্য বিশিষ্ট লেখকরা মেতে উঠেছেন গল্পে। এক পর্যায়ে কাচুমাচু সম্পাদককে মাইক্রোফোনের সামনে দিয়ে বলতেই হয় : আপনারা অনুমতি দিলে ঠিক ছয়টায় অনুষ্ঠান শুরু করবো। অনুমতি মিললো। ছয়টার ভেতর মোটামুটি পূর্ণ হয়ে গেল আসন। যেটুকু খালি ছিল তাও পূর্ণ হলো নাজিব তারেক আর ইমরাদ জুলকারনাইনের জলরঙ গ্রুপের একদল সৃষ্টিশীল সৃষ্টিছাড়া তরুন চলে এলে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনের ভারটি দিয়ে দেয়া হল সেই পুরনো একুশে টিভির জনপ্রিয় উপস্থাপক আবদুল্লাহ জাফরকে। এই গোপন পরিকল্পনার কথা মাটির, থুড়ি, এখন থেকে বলতে হবে বাংলামাটি, কারোরই জানা ছিল না। প্রধান নির্বাহী সাহিদা নাজ ফুল নিয়ে আসবেন, মাটির পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যটি তিনিই পাঠ করবেন বালে মহড়ও দিয়ে রেখেন। শুরু করলেন স্বকীয় ভঙ্গিতে : কম্পিউটারের পর্দার মতোই ছোট্ট এই আয়োজনে সাবইকে সাদর সম্ভাষণ।... শুরু হয়ে গেল স্থির ও সচল ক্যামেরার ব্যস্ততা।
বাংলামটির পক্ষ থেকে বলা হলো : তথ্য প্রযুক্তির এই স্বর্ণসময়ে বাংলাদেশ থেকে একটি নিয়মিত অনলাইন ম্যাগাজিনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্বের সকল দেশেই স্ব স্ব জাতীয় ভাষায় একাধিক অনলাইন পত্রিকা চালু আছে। সেখানে বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা দিবস প্রচলনের গৌরবদীপ্ত আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশে বাংলা ভাষার একটি নিয়মিত ইন্টারনেট প্রকাশনা কেন থাকবে না? আমরা আশা করছি বাংলামাটি সারা বিশ্বের তথ্য ও পাঠপিপাসু বাঙালির প্রয়োজন পূরণে সহায়ক হবে।
বাংলামাটি সাহিত্য সংস্কৃতি ও সমাজ বিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন, প্রতি ইংরেজী মাসের প্রথম দিনই এটা প্রকাশিত হবে। তবে প্রতি শনিবার থাকবে বিশেষ আয়োজন, যাকে বলা যায় মাসিক পত্রিকার সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র বা সাময়িকী। এ ছাড়াও হঠাৎ হঠাৎ যে কোনদিনই নতুন কোন লেখা বা ছবি, গান বা সচল চিত্র পোস্ট করা হবে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির পুরো সাবিধা নেয়ার প্রতি ঝোঁক থাকবে বাংলামটির।
১৭ বছর অগে 'মাটি' নামের যে সাহিত্য মাসিকটি পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, বাংলামাটি চালুর মাধ্যমে তারই যেন নবযাত্রা শুরু হলো।...
সেলিনা আপাকে আরেকটি অনুষ্ঠানে যেতে হবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাই তিনি আগে বললেন। বললেন, একটি ছোট ঘরে এই অনুষ্ঠান হলেও এটি বিশ্ব অআয়োজন। বিশ্বব্যাপী বাঙালি পাঠকদের জন্য বাংলামাটির এই আয়োজন। প্রবাসী বাঙালি যারা শিল্প সাহিত্যের প্রতি বিশেষ অনরাগী তারা এই অনলাইন ম্যাগাজিনের মাধ্যমে বিশেষ উপকৃত হবেন। প্রবাসে যারা বিদেশি ভাষায় পারদর্শি তারা এই অনলাইন মাগাজিন থেকে সমকালিন বাংলা সাহিত্যের খোঁজখবর পাবেন এবং উল্লেখযোগ্য কাজগুলো অনুবাদ করে বিশ্বব্যাপী বাংলা সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে পারবেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাংলামাটির আত্মপ্রকাশ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, এটি বিশ্বব্যাপী বাঙালিদের সংযোগ স্থাপনের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলামাটির উদ্বোধনী এই অনুষ্ঠান ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, মারুফ রায়হান এক সময় মাটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। কিন্তু সেটা বন্ধ হয়ে গেছ। তারে মারুফ আরো বিস্তৃত কজ করেছেন। বাংলামটি হলো তার একটি প্রকাশ। এই পত্রিকাটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকার বিকল্প হবে না এটা সত্যি কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলা ভাষার ভিন্ন এবং সম্পুর্ণ নতুন আরেকটি প্রয়োজন পূরণ করবে বাংলামাটি। সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্যের যে বিস্তৃত চর্চার দরকার বাংলামাটি তার ক্ষেত্রটা তৈরি করে দেবে। সাহিত্য হলো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যম। ইতিহাস চেতনা ও দার্শনিকতা সাহিত্যের রস ও গভীরতাকে আরো সমৃদ্ধ করে। এই অনলাইন মাগ্যাজিনের মাধ্যমে বাংলাদেশি বাঙালি এবং প্রবাসী বাঙালিদের মাধে একটা যোগসূত্র তৈরি হবে। এটা একটা ঐতিহাসিক মহূর্ত।
সভাপতির বক্তক্যে কবি আবুল হোসেন বাংলামাটিকে নতুন ও ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করে সম্পাককে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, বাংলামটি অবশ্যই অভিনবত্ব দাবী করতে পারে। এটিকে পথপ্রদর্শকের মর্যাদা দিতে হবে। (কবি আবুল হোসেনের লিখিত বক্তব্য শনিবাসীয় সাময়িকীতে প্রকাশ করা হবে)
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন লেখকদের সংগঠন রাইটার্স ইউনিনির সভাপতি সাব্বির আহমেদ সুবীর ও সমাজসেবী এনামুল হক এলেম। এর পরই বাংলামটির বিভিন্ন বিভাগ প্রজেক্টারের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয়। ওয়েবসাইটটির নির্মাতা আরিফ আহসান প্রদর্শন করেন, সম্পাদক দেন তার ধারবর্ণনা। এরপর আপ্যায়ণ এবং এক পশলা আড্ডার আসর। বাংলামাটির উপদেষ্ট সম্পাদক হলে চিকিৎসাবিজ্ঞানী, লেখক-গীতিকার সেজান মাহমুদ। থাকেন মার্কিন যুক্তরােষ্ট্রে। 'আচ্ছা, ইচ্ছে করলে কি তিনি এই অনুষ্ঠানে থাকতে পরতেন না?' এমন একটি মজার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বাংলামাটির এক কনিষ্ঠ কর্মী। আরেকজন উল্টে মজা করতে ছাড়লেন না- "হ্যাঁ, অনলাইনের উপদেষ্টা সম্পাদক অনলাইনের আছেন। শারীরিকভাবে আসতে হবে নাকি।' সম্পাদক বললেন, তিনি আসবেন আগামী শীতে, আমরা তাকে ঘিরে রাতভর আড্ডা জমাবো।
বাংলামাটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন কথাসাহিত্যিক আত সরকার, সঙ্গীতশিল্পী সুমন চৌধুরী, চিত্রশিল্পী আবদুর রোউফ সরকার, রফি হক, এসজি দস্তগীর, সুলেখা চৌধুরী, সাংবাদিক-লেখক স্বদেশ রায়, গ্রন্থ-প্রকাশক আহসানুল হাকিম, কবি ব্রাত্য রাইসু জনপ্রিয় ধারার তরুন লেখক হাফিজ আল ফারুকিসহ অনেক চেনামুখ।