ছোটবেলায় তেলাপোকাকে খুব ভয় পেতাম। এখন পাই না। তবে তেলাপোকার প্রতি ঘেন্না ভাবটা আছে। গায়ের উপর পড়লে চিৎকার দিয়ে উঠতাম। বিয়ের আগে মা এ নিয়ে অনেক বকতেন। এখন বকেন না। মা আমাদের মহল্লাতেই থাকেন। বিবাহিত মেয়েকে তো আর ছোটবেলার মতো বকলে হয় না! টিকটিকির ব্যাপারে আমার অন্যরকম আগ্রহ ছিল। একবার একটা টিকটিকির লেজ ছুঁয়ে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে লেজটা ছিড়ে মাটিতে পড়ে গেল। খুব মজা পেয়েছিলাম। এ মুহূর্তে আমি টিকটিকি দেখছি। ছোটবেলার লেজ ছুঁয়ে দেওয়া টিকটিকিটার কথা মনে পড়ছে। এখন ওটার জন্য একটু কষ্টও লাগছে। অবশ্য আমি এরচেয়ে অনেক বেশি কষ্টে আছি।
হৃদয় ছিড়ে রক্ত ঝরছে। চোখ শুকনো। কাউকে বুঝতেও দিই না। লাভ কি? আমার পায়ের পাশে এখনো বসে আছে মাসুদ। আমার স্বামী। মাফ চায়। এখন আর মাফ চেয়ে কি হবে? সিলিংয়ে ঝুলে থাকা টিকটিকিগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। তিনটা টিকটিকি। দুইটা একসঙ্গে, সঙ্গমরত। আরেকটা অদূরে থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে এই যুগলের দিকে। দৃশ্যটা দেখে অন্য সময় হলে হয়তো একা একাই হাসতাম। পাশে কেউ থাকলে হয়তো সামান্য লজ্জাও পেতাম। অথচ আজ আমার খুব আগ্রহ ভরে এদের সঙ্গম দেখতে ইচ্ছে করছে। দেখব আর কাঁদব, দেখব আর কাঁদব...। এই কান্না কেউ দেখবে না। পাশে বসা মাসুদও না। ও এখন আমার কেউ না। আরেকটা বিয়ে করে ও আমাকে একা করে দিয়েছে। একলা টিকটিকিটা যেমন, এখন আমিও তেমন।
মাসুদের সঙ্গেই থাকতে হবে আমাকে। অন্তত ছেলেমেয়েদের একটা অবস্থায় পৌঁছানো পর্যন্ত। আমার সামাজিক মর্যাদা, দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ এসবের জন্যই এই বিশ্বাসঘাতকটার সঙ্গে থাকতে হবে। হয়তো একই বিছানায়। কিন্তু দুটি মন কি আর এক হবে? রক্তের শ্বেতকণিকার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। কোথাও কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধে সহায়তা করে। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধে কি এমন কোনো কণিকা আছে?
মাসুদের সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছিল বেশ নাটকীয়ভাবে। প্রেমের বিয়ে। কত ভালোই না বাসত ও আমাকে। কত শত পাগলামি করেছে আমাকে পাওয়ার জন্য! মা প্রথমে আমার প্রতি বেশ নাখোশ ছিলেন। প্রেমটেম তার একদম পছন্দ নয়। মায়ের বিয়ে হয়েছিল একেবারেই ছোট বয়সে। ৯-১০ বছর বয়স ছিল হয়তো। আমি খুব ছোট থাকতেই বাবা মারা গেছেন। আমাদের ভাই-বোনকে মানুষ করতে খুবই কষ্ট করেছেন মা। বিয়ের সঠিক বয়স হওয়ার আগেই সুন্দরী-যুবতী মা আমার বিধবা হয়ে গেলেন। মুরব্বীদের শত অনুরোধেও আর বিয়ে করলেন না। অথচ পুরুষ মানুষগুলো কত নিষ্ঠুর! আমাকে রেখেই অন্য মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করে ফেলল মাসুদ! আমারই অফিসের এক সুন্দরী কর্মীর সঙ্গে। এলাকার ছোটবোন, সরকারি কলেজের অনার্সের ছাত্রী। পড়াশোনার খরচ চালাতে কষ্ট হতো বলে আমি মেয়েটাকে চাকরি দিয়েছিলাম। অথচ আমার কপাল পুড়ল! মেয়েটি এখন আমার সতীন? নিমক হারাম! অন্যকে দোষ দিয়ে আর কি হবে? যে আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, সেই যখন আমার সঙ্গে প্রতারণা করতে পারল...।
উন্নয়নকর্মী হিসেবে কত মানুষ চেনে আমাকে। নারী অধিকারের ব্যাপারে উচ্চ-কণ্ঠ হয়ে কত নারীর উপকার করেছি। সংসার জোড়া লাগিয়ে দিয়েছি। আজ আমার সংসারই ফেটে গেল! হ্যাঁ ফেটেই তো গেল। ভেঙে গেছে বলা যাবে না। আমিই বরং ভাঙতে দিচ্ছি না। আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই আমাকে এটা করতে হচ্ছে। ভাঙা জিনিস জোড়া লাগে। কিন্তু ফাঁটা জিনিস? একসঙ্গে এঁটে থেকেও যেন আলাদা। আমি আর মাসুদও এখন তাই। আমার মেয়ে তমা, সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথমবর্ষে পড়ছে। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে। আহারে, মেয়েটা আমার কদিন ধরেই মন মরা। হবেই-বা না কেন যে মেয়ের বাবা তারচেয়ে মাত্র ২-৩ বছরের বড় একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে, সেকি ভালো থাকতে পারে? তাও বিয়েটা পড়িয়ে দিয়েছি আমি নিজে!
হ্যাঁ, মাসুদের দ্বিতীয় বিয়েটা গোপনে আমিই দিয়ে দিয়েছি। কি আর করার ছিল আমার। হিমেল খুবই লাজুক। ছেলেটা আমার ক্লাস নাইনে পড়ছে এবার। সহজে কোনো কিছু চায় না আমাদের কাছে। এ ঘটনায় ছেলেটা আমার আরো চুপসে গেছে। অফিসের মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়লে আমার চোখেই প্রথম ব্যাপারটি ধরা পড়ে। অবিবাহিত মেয়ে গর্ভবতী! মাসুদের আচার-আচরণও ভাল ঠেকছিল না। মেয়েটি প্রথমে স্বীকার করতে চায়নি কিছুই। সামান্য ধমকেই হুড়হুড় করে বলে দিল সব। আমার বুকে মুখ গুঁজে সে কি কান্না সুপ্তির। বারবার বলতে লাগল, ‘আমি মস্ত ভুল করে ফেলেছি গো তানজিন আপু। বিশ্বাস করুন, আপনি কষ্ট পান এমন কিছুই করার ইচ্ছা ছিল না আমার। দুলাভাই প্রায়ই জ্বালাতন করতেন। লজ্জায় কাউকে বলতেও পারিনি।’
সুপ্তি বলেই যায়, ‘আপনি তো মাসের বেশিরভাগ সময়ই ঢাকা, চট্টগ্রাম... ট্রেইনিং-সেমিনার করে বেড়ান। এদিকে দুলাভাই আমাকে জ্বালাতেন। পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্যই তো চাকরিটা করি। তাই চাকরিটা হারাতে চাইনি আমি। দুলাভাইয়ের কাছে আত্মমর্পণ করতে বাধ্য হওয়া ছাড়া কিইবা উপায় ছিল বলেন!’
হয়েছে, হয়েছে। আর অভিনয় করতে হবে না, ডাইনি। তুই তো আমার কপালটাই পুড়ালি। থামিয়ে দিয়ে বলি আমি। বিশ্বাস করুন আপু, আমি একটুও মিথ্যে বলছি না। বলেই আমার পা জড়িয়ে ধরে সুপ্তি। সে বলেই যায়, আপু, আমি বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আপনি আমাকে মাফ না করলে আজই আত্মহত্যা করব আমি। আর যদি আপনি আমাকে মাফ করেন তাহলে সন্ধ্যায় কোন একটা ক্লিনিকে গিয়ে গর্ভপাত করিয়ে নেব। তারপর এ শহর ছেড়ে চলে যাব। আর কোনোদিন আপনার মুখোমুখি হব না। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। মনের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে। একদিকে আমার সংসার-সন্তানের ভবিষ্যৎ, অন্যদিকে সুপ্তির অবস্থা। ওর গর্ভের সন্তানটা কি নষ্ট করতে বলব? পৃথিবীর আলো দেখার আগেই একটা নিরপরাধ শিশুকে খুন করার নির্দেশ দেব আমি?
আমার কক্ষে প্রায় আধা ঘণ্টা চুপচাপ বসে আছি দু’জন। পায়ের কাছে বসে তখনও ফুপিয়ে কাঁদছে সুপ্তি। শেষ পর্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্তটাই নিলাম আমি। সুপ্তি আর মাসুদের বিয়ে দেব! তবে গোপনে। এক ফাঁকে সুপ্তি আমার কাছে একটা কঠিন সত্য কথা ফাঁস করে দিয়েছে। মাসুদ নাকি আমার মধ্যে এখন আর কোনো সুখ পাচ্ছে না। এ কথা ও নিজেই সুপ্তিকে বলেছে। মেয়েটির মন ভুলানোর জন্য হয়তো এটা একটা ছল ছিল। তবু তো বলেছে। কাঁপুরুষ কোথাকার! এবার না হয় সুখ খোঁজ গিয়ে। উপদেষ্টা পদবী দিয়ে আমিই ওকে আমার অফিসে বসার সুযোগ করে দিয়েছি। এই ছিল তার প্রতিদান! বিয়ের সিদ্ধান্তে মাসুদ প্রথমে একটু থতমত খেয়েছে। কিন্তু আমার দৃঢ়তার কাছে হার মানতেই হলো ওকে।
রাত গভীর হচ্ছে। আজ মাসুদ-সুপ্তির বাসর হওয়ার কথা! অথচ কাঁপুরুষটা আমার পায়ের কাছে বসে আছে। আরে ব্যাটা, কিসের মাফ চাস তুই! আমার মধ্যে যেহেতু সুখ পাস না, পাশের বেডরুমেই যা। আমি তো এখন এই একলা টিকটিকিটার মতো। পার্থক্য একলা টিকটিকিটা পাশের যুগলকে দেখছে, আমি দেখব না। টিকটিকিটার হৃদয় আছে কি না জানি না। আমার আছে। সেখানে এখন শুধুই রক্তক্ষরণ চলছে। কবে থামবে জানি না। শ্বেতকণিকা কি হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারে?