মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্য রচনাই শুধু নয়, আলোচনা, বিশ্লেষণ, স্মৃতিচারণ বিষয়ে কয়েক দশক ধরে তরুণদের ভেতর অনাগ্রহ তৈরি করে চলেছে কারা? এতে তাদের কী লাভ!
যুদ্ধে পরাস্ত পক্ষ এবং যুদ্ধ বেচে খাওয়া/ রাজনীতি করা পক্ষ, অর্থাৎ উভয়পক্ষ বিকৃতি, অতিরঞ্জন ও অতিচর্চার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে নতুনদের কাছে হাস্যকর ও জাদুঘরের বিষয় করে তুলছে। তাই অভিভাবক হিসেবে আমাদের দায় রয়েছে। নবীন শিক্ষার্থী প্রজন্মের কাছে দেশের বাইরে চলে যাওয়া অনেক বছর ধরেই বড় স্বপ্ন হয়ে উঠছে। যারা যাবে, তারাও যেন বাংলাদেশকে বুকে পুরেই যায়, মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের সবচেয়ে বড় তাৎপর্যপূর্ণ সময় ও ইতিহাস হিসেবেই ধারণ করে দেশের সীমানা পেরোয়, এর নিশ্চয়তা পাওয়া দরকার।
যিনি মুক্তিযুদ্ধে লড়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের গূঢ় ইতিহাস সংগ্রহে নিজের জীবন বিনিয়োগ করেছেন, এমন একজন সাহিত্যিক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস লিখলে সেটি আমাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে। আমি আফসান চৌধুরীর কথা বলছি। ঈদসংখ্যা সমকালে তাঁর ‘রক্তের মেহেন্দি দাগ’ উপন্যাসটি পড়ে আমি মুগ্ধ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং উপন্যাসটি নিয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই আজ লিখতে বসা। শুনেছি উপন্যাসটি তিনি হাতে লেখেন নি, মুখে মুখে বলে গেছেন। অনুলিখনকারী রেকর্ডকৃত শব্দসম্ভার বর্ণমালায় তুলে এনেছেন। সে-বিচারেও এটি আমাদের সাহিত্যে এক অভিনব রেকর্ড হয়ে থাকবে।
একাত্তরে ‘রক্তের মেহেন্দি দাগ’ যে হাতে লেগেছিল এবং মেহেদির দাগ চাপা দিয়ে রেখেছিল যে রক্তসিক্ত হাত, দুটোই প্রত্যক্ষ করা যাবে লেখাটি হৃদয় যোগ করে পড়লে। বাস্তবতায় মানলেও, যুদ্ধাহত যোদ্ধার পরিণতি উপন্যাসে আপনি কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না।
একাত্তরের ভেতর দিয়ে যারা যান নি তারা কী করে অনুধাবন করবেন ওই নয় মাসের প্রতিটি দিনের প্রতিটি ঘণ্টাই এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে অসংখ্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছে; যা রোমহর্ষক, বিচিত্র রঙে মেশা: আনন্দের-ঘৃণার, আত্মবিসর্জনের, আত্মবিক্রির, সামান্য মানুষের মহামানব কিংবা রাস্তার কুকুর হয়ে ওঠার। কোটি বাঙালির মনের অভ্যন্তরে যে অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া কাজ করে গেছে তা এক হাজারটা বইয়েও কি ধারণ করা সম্ভব? তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে কোনো গল্প-উপন্যাসই আংশিক উপস্থাপনা। খ-িতও বটে। হুমায়ূন আহমেদের মতো পেশাদার লেখকও মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লিখতে ত্রিশ বছর অপেক্ষা করেছেন।
আফসান চৌধুরীর উপন্যাসটি একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ভূখ-ে চলমান যুদ্ধের দুটি প্রধান প্রতিপক্ষ থাকে; আর যুদ্ধে অংশ না নিয়েও যুদ্ধে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন সময়ের প্রতিটি বাঁকে এসে নিজের সঙ্গেই যুদ্ধে রত হয়। যুদ্ধের ভেতরে সেঁধিয়ে থাকা ব্যক্তিমানুষের নিজ জীবনের যুদ্ধের গল্প কত করুণ/ নির্মম/ অসম্ভবপ্রায় হতে পারে তার কিছু নমুনা আছে উপন্যাসে। এমন সব মানুষের দেখা পাই, যাদের জীবন গড়িয়ে গেছে এরকম অবাস্তব-অসম্ভব সংকট ও ঘটনার মধ্য দিয়ে যা পৃথিবীর সেরা ঔপন্যাসিকও যেন কল্পনা করে উঠতে পারবেন না। তাই বাস্তব সব সময়েই ফিকশনের তুলনায় অভিনব, অবিশ্বাস্য, অবাক-করা হয়ে থাকে।
একাত্তরে ঢাকার বিহারি জনগোষ্ঠির অভূতপূর্ব সংকট ও মিশ্র অভিজ্ঞতালাভের সারাৎসার উঠে আসার কারণেও আফসান চৌধুরীর উপন্যাসটি গুরুত্বপূর্ণ। ‘বিহারিদের মোহাম্মদপুর’ ইতিহাসের আলোয় যেন অতিস্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। ধারণা করি আমাদের আর কোনো উপন্যাসে একাত্তরের প্রেক্ষাপটে বিহারি জনপদের কথা এত গভীরভাবে অর্থপূর্ণভাবে উঠে আসেনি। সে-বিবেচনায় উপন্যাসটিকে আমি বিশেষ মর্যাদা দেব। পিতৃমাতৃহীন বিহারি যুবক গফুরের হাতে মেহদি লাগানোর অপেক্ষায় কনের পরিবার; কিন্তু সে মেহেদির দাগ চায় না, রক্তেরও; তার কবিমন জানে নজরকাড়া তরুণীটিকে সুরক্ষা দেয়ার সামর্থ্য তার নেই। একাত্তর তার মন পুড়িয়ে দিয়েছে, সে পথের কুকুরের সঙ্গে নিজের সাদৃশ্য আবিষ্কার করে। তার স্বগতোক্তি: মোহাম্মদপুরের কুকুরগুলো সবাই কবি (ইয়ে কুত্তালোগ সব শায়ের হ্যায়)।
চরিত্র সৃষ্টি, তার পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে বার্তা ও অভিমত প্রকাশ-- এমনটি হরহামেশাই উপন্যাসে আমরা লক্ষ্য করি। মারাত্মক শোনাবে যদি বলি এতে মুক্তিযুদ্ধের সমালোচনা আছে, ষোলই ডিসেম্বরের পরে একদল যোদ্ধার কর্মকা-ের সমালোচনা আছে। অবরুদ্ধ মাতৃভূমিকে রক্ষা করার লক্ষ্যে আত্মোৎসর্গকৃত মানস কখনো কি দেশের কোনো ক্ষুদ্র সম্পত্তি বা সম্পদ কেড়ে নিতে বা দখল করতে পারে? যুদ্ধশিশু বলতে আমরা বুঝে আসছি পাকিস্তানী সেনার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার বাঙালি নারীর গর্ভজাত সন্তানকে। এ লেখাতেই প্রথম অন্য প্রশ্নও ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে। যে শিশুটির বাবা পাকিস্তানি এক সেনার কব্জায় আছে, এবং ওই সেনা অফিসারটির শয্যাসঙ্গী হলেই তাকে হত্যা না করে মুক্তি দেয়া হবে, এমন টানাপড়েনে থাকা যে-নারীকে মাসের পর মাস ভোগ করা হয়, সে-দম্পতির শিশুটি অবশ্যই যুদ্ধের সন্তান। ‘এই মেয়ে কি যুদ্ধশিশু নয়?’
‘রাঙা আপু’-র, দারুণ রূপসী এক অসাধারণ নারীর, দীর্ণবিদীর্ণ জীবন, পরিমিতিবোধসম্পন্ন চিত্রকরের রঙ-তুলিতেই যেন মূর্ত করা হয়েছে উপন্যাসে। উপন্যাসটি যিনি পড়বেন, সমগ্র জীবনেও ভুলবেন না কঠোর সিদ্ধান্তগ্রহণে সমর্থ দুর্ভাগা ওই ধ্বস্ত নারীকে। এখানেই লেখকের লিখনশৈলী ও প্রকাশদক্ষতার প্রশংসা করব; গড়পড়তা মানের একজন লেখকের হাত দিয়ে এ লেখা বেরুতে পারে না। সংশয়হীনভাবে আরও বলি, একাত্তরে রক্তেবারুদে নিবিষ্ট ও নিমজ্জিত না থাকা কোনো ব্যক্তির পক্ষেও এমন লেখা অসম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধের কথা আমাদের নানা মাধ্যমে বলতে হবে অর্থপূর্ণভাবে, বাক্যের অর্ধেকটা গিলে ফেলে নয়, সত্যকে কবরচাপা দেবার মন লালন করে নয়। কাজটি করতে হবে একাত্তরের আলো-অন্ধকারে আরো একবার প্রদক্ষিণ করে এসে; বুকে সাহস নিয়ে। হায় এই কাজ সম্পাদনের মতো মুক্তিযোদ্ধা আজ আর খুব বেশি আমাদের মাঝে নেই। আফসান চৌধুরীর তাই সুস্থ ও সক্রিয় থাকা চাই। সেই প্রার্থনাই করছি।
উপন্যাসের শরীর থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি মন্তব্য-বিশ্লেষণ ছাড়া।
ক. ব্রিগেডিয়ার ধরনের কারো সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না। সেদিক থেকে বোধহয় আমরা ছেঁচড়া মুক্তিযোদ্ধা হবো।
খ. যারাই পঁচিশে মার্চ দেখেছে, শত্রুকে হত্যা করার বাইরে তাদের পক্ষে আর কিছু ভাবা সম্ভব না।
গ. বিহারি মানুষ না। আমরা বাঙালিদের কাছেও মানুষ না, পাকিস্তানিদের কাছেও না।
ঘ. তুমি ভাবছ, যখন ঢাকা শহরে প্যারেড হয় সেটাই মুক্তিযুদ্ধ। তুমি তো পত্রিকার সাপ্লিমেন্ট পড়ে বলো, এটাই মুক্তিযুদ্ধ। তুমি তো কবিতা আবৃত্তি শোনো, সিনেমা দেখ, গান শোনো, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পড়, আরও অন্যদের লেখা পড়, তারপর ভাবো, এই হলো একাত্তর।...
-মারুফ রায়হান
লেখক আফসান চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া
আমার বলার কিছু বাকি নেই। আমি এটাই বলতে চেয়েছিলাম এই লেখায়, একাত্তর অনেক জটিল, লক্ষ কষ্টের সূতিকাগার ও আমরা সেই কষ্টের অংশীদার। এ আলোচনা আমার জীবনের বড় পাওয়ার মধ্যে একটি কারণ এটাই আমার কথা একাত্তর নিয়ে। প্রায় সবই সত্য ঘটনার আলোকে লেখা, এমনকি বিহারীদের নিয়ে লেখা বা তাদের কথা, ভাবনা ও রাঙা আপু ছিলেন, হয়তো আজও আছেন - আমি কিছুই লুকাইনি শুধু তাদের নাম ঠিকানা পাল্টে দিয়েছি। সুলেমান মারা যায় বছর ১৫ আগে, আমার একটা কবিতার বই আছে তাকে নিয়ে। অন্যরা যে যেমন আছে লিখেছি। কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। মাহবুব আজিজ চাপ না দিলে লিখতাম না। আর এই সব ঘটনা লেখা যায় না, নিজের কষ্ট লাঘবের জন্য কেবল বলা যায়। হামীম কামালকে ধন্যবাদ।
মারুফ, ঋণী হলাম।
রক্তের মেহেন্দি দাগ: আফসান চৌধুরী
প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ