ওপাশ থেকে যখন এই এক ঘন্টা আগেও ভূ-গর্ভস্থ ট্রেনের অন্দরে ঢুকি, দিব্যি পরিষ্কার আকাশ ছিল। এপাশে বেরিয়ে দেখি, বৃষ্টি। মাটির তলায়, ট্রেনের ভেতরের ঝকঝকে আলোয় কোনোভাবেই বোঝার উপায় ছিল না যে উপরের পৃথিবীর যে আকাশ, তার মতিগতি পাল্টে গেছে, নীল ঢেকে কখন ঘন মেঘ জমেছে, সেই মেঘ কখন বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করেছে। আমার মতো আরো যারা হন্তদন্ত হয়ে স্টেশান থেকে বেরোচ্ছিলেন, দেখলাম, সবাই থমকে গেছেন। বেশিরভাগেরই বিরক্তিতে কুঁচকানো মুখ। অবশ্য সেটা মূহূর্ত কয়েকের জন্য। ব্যাকপ্যাকের চেইন খোলার শব্দে সহসা চারপাশ সচকিত হয়ে উঠল, কারো ব্যাগ থেকে বেরুলো ছাতা, কারো রেইনকোট। বিলেতের ঝপ করে নামা বৃষ্টিকে বৃদ্ধাঙ্গুল (আক্ষরিক অর্থে নয়, বিলেতে কাউকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো মানে হচ্ছে, প্রশংসা করা, ধন্যবাদ জানানো) দেখিয়ে লোকজন আবার যার যার মতো রাস্তায় নেমে পড়লো। আমি এত সহজে বেরুতে পারলাম না। এত বছর বিলেত থেকেও অন্য আরো অনেক কিছুর মতোই এই ছাতা-রেইনকোটের রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ঘর থেকে বেরুনোর কথা আমার কিছুতেই মনে থাকে না। সকালে উঠে ফোন কিংবা টিভির আবহাওয়া বার্তা নয়, আমার অভ্যাস জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের অবস্থাটা দেখা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে ঘন্টাখানেক পরেই যে বিলেতের বহুরূপী আকাশ - দিনের শুরুর আবহাওয়া দেখে সন্ধ্যার আবহাওয়ার ধারণা পাওয়ার যে প্রচলিত প্রবাদ, তা ভুলে- নিমেষে অপরিষ্কার হয়ে উঠতে পারে, সেটা মনে থাকে না। যার ফলস্বরূপ যা হওয়ার, তাই হয়। প্রায় দিনই এমন রূপ বদলানো আবহাওয়ার খপ্পরে পড়ি, প্রতিবারই এর পরেরদিন ছাতা কিংবা রেইনকোট নিয়ে বেরুবো - সেটা ঠিক করি, প্রতিবারই ঐ প্রতিজ্ঞার কথাটা পরেরবারের খপ্পরে পড়ার আগে মনে পড়ে না।
স্টেশান ঘর থেকে মাথা বের করে বাইরে উঁকি দিলাম। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। চেহারায় একেবারে খাঁটি বাঙালি বৃষ্টি। বেশ খানিকটা অবাকও হলাম। বিলেতের বৃষ্টির প্রতি আমার কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই। আমার কাছে বিলেতের বৃষ্টি মানে হলো অহেতুক ঠা-ার কামড় বাড়িয়ে, মানুষজনকে কাক ভেজা করে দুর্ভোগ বাড়ানোর পাঁয়তারা। না হলে, আর কী কারণ থাকতে পারে শীতকালে বৃষ্টি হবার! সুযোগ পেলেই যে কথাটি বলি আমার বিদেশি সহকারিদের, তা হলো: বৃষ্টি দেখতে হলে যেতে হবে বাংলাদেশে। পৃথিবীর আর কোন জায়গায় ও জিনিসের মূল সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যাবে না। বৃষ্টি শুরু হলেই যদি হাত না বাড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, যদি মাথার উপর থেকে রিকশার হুডটি ফেলে দিয়ে বোকা-বোকা মুখে বসে না থাকতে ইচ্ছে করে, যদি জামা-কাপড় ভিজে যাওয়ার ভয় বেমালুম ভুলে গিয়ে জলধারায় কাঁপনলাগা ফুটপাত ধরে উদ্দেশ্যহীন হাঁটা শুরু করতে ইচ্ছে না জাগে, তবে অমন বৃষ্টি নেমে লাভ-ই বা কি! আজ যে বৃষ্টি নেমেছে, একেই বোধহয় ইংরেজিতে বলে ’ক্যাটস অ্যান্ড ডগস’ রেইন। শব্দটা বড় অদ্ভুত। বৃষ্টির সাথে এর ’ক্যাটস অ্যান্ড ডগসের’ সম্পর্ক কী - এর কোন সোজাসাপ্টা উত্তর নেই। ঠিক কোথা থেকে এই শব্দবন্ধের উৎপত্তি - তারও সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ইটিমলজিস্টদের (শব্দের উৎস বিষয়ে প-িত) বর্ণনা থেকে এ শব্দের নানান বুৎপত্তি পাওয়া যায়। কারো কারো মতে, নর্সদের ঝড়ের দেবতাকে-যার নাম ওডিন-সবসময় কুকুর এবং হায়নার মিলিত আকৃতিতে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে, ঝড়ের সময় ঝাড়–র উপরে এক স্থান থেকে আরেকস্থানে উড়ে যাওয়া ডাইনীদেরকে সবসময় কালো বিড়াল সহ আঁকা হয়, যা নাবিকদের জন্য খুব ভারী বৃষ্টির প্রতিক হিসেবে প্রচলিত। অতএব এই দুইয়ের মিলনে, অর্থাৎ, ঝড়ো বাতাসের জন্য কুকুর আর সাথে ভারী বৃষ্টির জন্য বিড়ালের মিলিত প্রতীকে ঐ ক্যাটস এন্ড ডগস। কেউ কেউ বলেন, শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ’কাটা ডক্সা’ থেকে, যার মানে হলো অবিশ্বাস্য, বা অভিজ্ঞতার অতীত কোনো কিছু। সুতরাং, ক্যাটস অ্যান্ড ডগস দিয়ে অবিশ্বাস্য রকমের ভারী বৃষ্টিপাতকে বোঝানো হয়। কেউ কেউ মনে করেন, ’ক্যাটাডুপ’ নামক একটি খুব পুরনো শব্দ আছে, যার অর্থ হলো জলপ্রপাত। নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ঝরতে থাকা বৃষ্টিকে বোঝানোর জন্য তাই ’ক্যাটাডুপ’ শব্দের অপভ্রংশরূপ হিসেবে দাঁড়িয়েছে: ক্যাটস অ্যান্ড ডগস। এ বিষয়ে আরো একটি প্রচলিত তত্ত্ব আছে। বলা হয়ে থাকে, প্রাচীনকালে যখন ঝড় শুরু হতো, তখন ঘরের পালিত কুকুর এবং বেড়ালগুলো নিজেদের বাঁচাতে খড়ের ছাদের নিচের চাতালে আশ্রয় নিতো, কিন্তু খুব জোরে বৃষ্টি হলে ঐ চাল ওদেরকে রক্ষা করতে পারতো না, ওরাও জলের তোড়ে নিচে বৃষ্টির সাথে ঝরে পড়তো। সেজন্য, বৃষ্টির তীব্রতা বোঝাতে ঐ ক্যাটস অ্যান্ড ডগসের প্রচলন। আবার কেউ মনে করেন, খুব জোরে বৃষ্টি হলো বৃষ্টির সাথে রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর এবং বেড়ালগুলো জলের তোড়ে ভেসে যেতো। এ ঘটনা থেকেই ঐ শব্দবন্ধ।
বুৎপত্তি যাই হোক না কেন, ভারী বৃষ্টিকে বোঝানোর জন্য ’ক্যাটস অ্যান্ড ডগস’ শব্দের প্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ কবি ওলর ইসকানুস, সেই ১৬৫১ সালে। এর এক বছর পরে ইংলিশ নাট্যকার রিচার্ড ব্রুম তার নাটকে ব্যবহার করেন: “It shall rain dogs and polecats.” পলিক্যাট অবশ্য ঠিক বিড়াল নয়, আমাদের ভাষায় যাকে বলে খাটাশ, সেই ধরনের প্রাণী। এরপরে ১৭৩৮ সালে জোনাথন সুইফট উচ্চবিত্তদের কথোপকথনকে কেন্দ্র করে রচিত একটি স্যাটায়ারে লিখেন: “rain cats and dogs.” বলা যায়, তখন থেকেই এই শব্দটির বহুল প্রচলন শুরু হয়। অবশ্য, এরপরে অন্যান্য লেখকরা ভারী বৃষ্টিকে বোঝানোর জন্য আরো নানা ধরনের শব্দবন্ধ প্রচলন করার চেষ্টা করেছেন। যেমন, “it’s raining pitchforks” কিংবা, “it’s raining stair-rods,” কিন্তু ক্যাটস অ্যান্ড ডগস বলা ও মনে রাখার সুবিধাজনক কারণেই বোধহয় মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। সুইফট তার কবিতা সিটি শাওয়ারে (১৯১০) একটি শহরের বর্ণনা করেন, যেখানে খুব ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে, এবং এর ফলে রাস্তার কুকুর বিড়ালগুলো জলে ভেসে যাচ্ছে। ফলে আবহাওয়াটিকে সাধারণ মানুষরা বর্ণনা করছেন: “raining cats and dogs.”
স্টেশান চত্বরে দাঁড়িয়ে, বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতে করতে এইসব এলোমেলো ভাবনার গবেষণা আর কতক্ষণ চলতো, কে জানে, হঠাৎ কয়েকটা বাংলা বাক্য কানে ঢুকতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। দুটো ছেলে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মতই স্টেশান থেকে বেরুনোর মুখে বৃষ্টি থেকে থমকে গেছে। বাংলায় কথা বলছে, অতএব বাঙালি, বলাই বাহুল্য। আড়চোখে চেয়ে দেখে বুঝলাম, লন্ডনে নতুন এসেছে। গায়ে পোশাকের বহর দেখে এটা অনুমান করা খুব শক্ত কিছু নয়। এদেশে আসার প্রথম দিকে সামান্য ঠা-াকেই কনকনে ঠা-া বলে মনে হতে থাকে। দেশ থেকে আনা সবচেয়ে ভারী জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে, হাতে হাতমোজা পরে, মাথায় গরম টুপিতে কান মাথা ঢেকে রাস্তায় বেরুতে হয়। চোখে মুখে নতুন জায়গা দেখার উত্তেজনা, এবং অনিশ্চয়তার ছাপ যুগপৎ খেলা করে যায়। দিন যত যায়, ধীরে ধীরে ঠা-াটা গা সওয়া হয়ে যায়, নতুন জায়গায় নতুন মানুষের ভীড়ে নিজের অবস্থানটা পোক্ত করে নিতে পারার আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে চেহারায়। এরা খুব সম্ভবত স্টুডেন্ট হয়ে এসেছে। ইদানীং স্টুডেন্ট ভিসার প্রক্রিয়া সহজতর হওয়ায় প্রচুর ছেলেমেয়েরা আসছে যুক্তরাজ্যে। আমি শুনলাম, ওদের একজন আরেকজনকে বাইরের বৃষ্টি দেখিয়ে বলছে, ইস, এমন বৃষ্টিতে মামুর দোকানের এক কাপ চা দরকার ছিল রে-। অন্যজনের ত্বরিত উত্তর, এই তো, আবার মামুর দোকানের কথা মনে করিয়ে দিলি-! দুজনের গলাতেই বিষাদ। সদ্য ছেড়ে আসা দেশের জন্য অমোঘ নস্টালজিয়া। আমার কান খাড়া হয়ে উঠল ওদের কথোপকথনের বাকি অংশ শোনার জন্য। কিন্তু বিধি বাম! আমাদের পেছন থেকে সদ্য আসা ট্রেনে আরেক দঙ্গল যাত্রী হুড়োহুড়ি করে বেরুতে শুরু করতেই আমি ওদের থেকে ছিটকে অন্যদিকে সরে গেলাম। লোকজনের ভীড় পাতলা হতে দেখি, ওরা নেই। খুব সম্ভবত সবার সাথে বেরিয়ে গেছে।
বাইরে আবার উঁকি দিয়ে দেখলাম, বৃষ্টি ধরে এসেছে। আমি আর দেরি না করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। মাথায় রয়ে গেলো ওদের ঐ ’মামুর দোকানের চা’-এর কথা। নিজের অজান্তেই একটি ছবি ফুটে উঠতে শুরু করল ভেতরে: বিলের ধারে একটা চায়ের দোকান। উঁচু মাচানের উপর তৈরি করা টংয়ের দোকান যেরকম হয় - সেরকম। নেহায়েত বাহুল্য-বর্জিত, সাজ-সজ্জা হীন। ভেতরে মালপত্র বলতে নানান বয়ামে সাজিয়ে রাখা নানান ধরনের বিস্কুট, চানাচুর, এক কাঁদি কলা ঝুলছে বাঁশের খুঁটির সাথে, হয়তো নিত্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি দুয়েকটা পণ্য, পান, সিগারেট। কিন্তু যে দ্রব্যটির জন্য এ দোকানটি মানুষজনে ভরা থাকে সকাল সন্ধ্যায় - সেটি হলো ’মামুর চা’। সারাদিন ধরে জ্বাল দিতে থাকা দুধের ঘন মালাইয়ের চা। হুটহাট করে বৃষ্টি নেমে গেলে গ্রামের উঠতি যুবকেরা পা মুড়ে দোকানের ভেতরের মাচানের দিকে উঠে যায়। মামুর স্পেশাল চায়ের সাথে শুরু হয় রাজ্যের গপ্পো। বাইরে তখন অঝোরে ঝরছে বাদল ধারা। আদি ও অকৃত্রিম বাংলার বর্ষা।
এমন একটা ছবি মাথায় আঁকতে আঁকতে আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ি ফিরতে শুরু করলাম। দূরে কোথায়ও রবীন্দ্রনাথ বাজছেন: তুমি যদি না দাও দেখা, কর আমায় হেলা, কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা -। বিলেতের হতচ্ছাড়া বৃষ্টিতে পথ চলতে চলতে বাংলার বৃষ্টির জন্য মন কেমন করতে থাকলো আমার সারাটাক্ষণ।