করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





হাম দেখেঙ্গে
লুনা রুশদী
এই যে মানুষেরা মারা যায়- কারো পরিচিত, কারো প্রিয়। মরা মানুষের জীবিত চেহারা দেখি ফেসবুকে কখনো বুলেটে চৌচির শহর আর মর্গ, আর লাশ, আর দেখি ধ্বংসস্তুপের উপরে বসা করুণ সুন্দর ছেলেটার ছবি। তার মুখের উপরে সূর্যের আলো, আনত চোখ। হয়তো তার আব্বা-আম্মা মারা গেছে বোমা হামলায়। হয়তো শীতের দিকে ধাবমান দুর্বল সূর্যের মায়াময় স্পর্শ ছাড়া তার আর কোন আশ্রয় নাই।
একটা এনজিওর পাতা থেকে শেয়ার করা ছবি, তারা ডোনেশন চায়। যদি ধরেন দিলাম ডোনেশন, আমি কি বসতে পারবো ছেলেটার পাশে? বলতে পারবো ভয় নাই রে বাবা আমার, আমি তো আছি? অথবা হাত বুলায়ে দিতে পারবো তার মাথায়? আমি না হইলে অন্য কেউ? ডোনেশনের টাকাগুলা কই যায়? কয় টাকা যায় ছবিতে বসা ছেলেটার কাছে? এনজিও কর্মীর বেতন কই থেকে আসে?
এনজিও আমি পছন্দ করি না - কেন জানি করি না? এরা কাউরে বানায় দাতা, কাউরে গ্রহিতা। এদের বেতনভুক কর্মচারীরা নিজেদের অ্যাক্টিভিস্ট ভাবতে থাকে। তারা বলে ‘গরীবের জন্য আমি যাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, দেশে-বিদেশে এমন জায়গাতে গেছি যেখানে টয়লেট বলতে আছে জঙ্গল এবং গাছের আড়াল’।
তারা এমনও বলে যে তারা এলিট, ঢাকায় বইসাই বেতন পায় মাসে দুই লাখ বা চার লাখ এবং তাদের গাড়ি আছে। বাংলাদেশে অবশ্য জিও আর এনজিও কোন ভেদাভেদ নাই, পরের টাকায় পোদ্দারী, তারা ভাবে ‘আমরা দিতেছি, আমি খাওয়াইলে তোমরা খাও’। তারা বিদেশে বুড়াবুড়িরে ফোন করে, নইলে টোকা দেয় তাদের দরজায় আর ইমেইল করে, তারা দেখায় অভাব আর অপুষ্টি আর অন্ধকার আর লাশ।
আবার কেউ বলে, কয়জনরে দিবা তুমি? এত অভাব! তারা কাউরেই দেয় না। নিজেরাও খায় না, তাদের টাকা জমে ব্যঙ্কে। ‘লিটল প্রিন্স’ এর তারাগোনা লোকটার মতোন। আকাশ ভরা তারা গোনে আর সিন্দুকে ভরে। একদিন তারাও মরে। মাটিতে মেশে তাদের শরীর। টাকা জমা থাকে ব্যঙ্কে।
অথচ ইউটিউবে সেদিন দেখলাম ব্রাদার উমর সোলাইমান খুতবা দিতেছেন - ইব্রাহীম নবীরে যখন আগুনে পুড়ায়ে মারতে নিছিল তাঁর বাবা আর নিজের লোকেরা তখন আকাশ, বাতাস আর পশু পাখিরা সাক্ষী ছিল।  ব্যাঙেরা মুখভর্তি পানি নিয়ে সেই আগুন নিভাইতে চাইছিল,  কোরানে আল্লাহ বলছেন - ‘হে বিশ্বাসীরা, ন্যায়ের সাক্ষী হও তোমরা আর কারো প্রতি তোমাদের ঘৃণার কারণে যেন অন্যায়ের পথে যেও না’।
এই জন্যই ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ লিখছিলেন ‘হাম দেখেঙ্গে লাজিম হ্যায় কি হাম ভি দেখেঙ্গে’। আর গান গাইছিলেন ইকবাল বানো ১৯৮৬ সালে,  ৫০ হাজার লোকের সামনে একটা কালো শাড়ি পরে আর ময়দানে ফেটে পড়ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। সেই রেকর্ড ২০১০ সালে অরুন্ধতি রায় শোনালেন মাওবাদী কমরেড সুখদেবকে ছত্তিসগড়ের জঙ্গলে ‘পঞ্চাশ হাজার দর্শকের স্পর্ধিত উচ্চারণ এই জঙ্গল ঘিরে - বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক - সত্যিই কি অদ্ভুত এই যোগাযোগ’। আরো পরে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে যখন টুপটাপ মানুষ মরতেছিল ডেংগুতে আর যখন কাশ্মীর আবার চাইতেছিল আজাদ হইতে, আর আমার পুরান অফিসের সামনের মরা ডালে ফুল আসতেছিল, আমি একা একা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শুনছিলাম ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ আর কানছিলাম, আমার হার্টবিট বেড়ে যাইতেছিল।
এরকম কান্না আমি মাঝেমাঝেই কাঁদি সবসময়েই কেউ না কেউ মারা যায়।  কারো বাচ্চা, কারো মা, কারো বাবা, কারো বন্ধু কেউ বিকালে আড্ডা দিয়ে রাতে মারা যায়। কেউ কবি হওয়ার জন্য গ্রাম থেকে শহরে আসে আর মারা যায়। কেউ মোটর সাইকেল চালাইতে চালাইতে বাসের তলায় চাপা খেয়ে মারা যায়।  গুলি আর বোমায় ঝাঁঝরা দেয়ালের গায়ে যে লেখে ‘একদিন যুদ্ধ শেষ হবে, আর আমি আমার কবিতার কাছে ফিরবো’, তার আর ফেরা হয় না। যে আজকে শোকবার্তা লিখে, সে কালকে মারা যায়। টেম্পলেটেড কমেন্ট পড়ি ফেসবুক স্টেটাসে।  প্রতিমুহূর্তে এত কিছু আমার মাথায় আর আঁটে না।
যে বইটা পড়তেছি তার নাম  ‘দ্য সারাহ বুক’, সেখানে লেখা -  ‘জীবন সম্পর্কে আমি শুধু একটা কথাই জানি। যথেষ্ট লম্বা সময় বাঁচলে সব হারাতে থাকে। চুরি হয়ে যায় -  প্রথমে তারুণ্য তারপরে বাবা-মা, তারপরে বন্ধু-বান্ধব আর সবশেষে নিজেকেও হারাই’ ইউটিউবে দেখি ‘হাম দেখেঙ্গে’-র নতুন ফিউশন - কোক স্টুডিও পাকিস্তান।  আমার কানতে কানতে হঠাত মনে পড়ে আচ্ছা কোক স্টুডিও কাদের সম্পত্তি? কোকা-কোলা কোম্পানি? তার মালিক কে?  গুগল সার্চ দিয়ে দেখলাম,  এর সবচেয়ে প্রভাবশালী শেয়ারহোল্ডার একজন মার্কিনী।
শুনছি এই যে এত মানুষ হজ্জ্বে যায় প্রতিবছর, সেই হজ্জ্বের টাকাও শেষমেশ যায় আমেরিকায়। মার্কিন দুনিয়া ঘুরে সেই টাকার এক অংশ যায় ইজরায়েলে। এই যে মেলবোর্নে আমি চাকরি করি, ট্যাক্স দেই, রেস্টুরেন্টে খাই, বেঁচে থাকি, খরচ করি, সেইগুলাও কিছুটা ইজরায়েলে পৌঁছায়। আর ওরা বোমা বানায়, হামলা করে ফিলিস্তিনের হাসপাতালে। কইয়ের তেলে কই ভাজা। এত বিশাল জাল যে চোখেই দেখা যায় না। ইউনুস নবীর মতোন তিমির অন্ধকার পেটের মধ্যে আমাদের অসহায় কান্ত উচ্চারণ - লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জালিমিন - হে আল্লাহ, আমিও তো অন্যায়কারীদের একজন।
কবীর সুমনের সাক্ষাৎকার দেখলাম ইউটিউবে। তিনি বললেন তাঁর সবচেয়ে দুঃখের, একাকী, গৃহবন্দী সময়ে তিনি কোরান পড়েছেন – ‘প্র্যাকটিস ফরবিয়ারেন্স ও মোহাম্মদ’- এই একটি বাক্য আমাকে অসম্ভব শক্তি দিয়েছে - প্র্যাকটিস ফরবিয়ারেন্স ও মোহাম্মদ- হে মোহাম্মদ তুমি ধৈর্য্য অনুশীলন করো, সহ্যশক্তি বাড়াও’; আর পড়েছিলেন মারিও পুজোর - ‘দ্য লাস্ট ডন’ সেখানে বৃদ্ধ পিতামহ, নাতিকে বলছেন ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ইজ হোয়াট ইট ইজ অ্যান্ড ইউ আর হোয়াট ইউ আর’।
দুইদিন পরে হ্যালোয়িন। ভূত আর পেত্নীদের দিন। সুপার মার্কেটে চকলেট সেল-এ দিছে। বাচ্চারা ভূত আর পিশাচের ছদ্মবেশে আসবে ভয় দেখাতে। ট্রিক অর ট্রিট। হায়, আমার অবাক চোখের স্বপ্নময় শিশুরা কেমন দুনিয়ায় তোরা আসলি? এখানে প্রতিদিন পিশাচেরা হাঁটে মানুষের ছদ্মবেশে। সেই সব ট্রিক থেকে তোদেরকে আড়াল করার ক্ষমতা আমার নাই তাই ট্রিট, তাই চকলেট। রেডিওতে বলছে এই বছর প্রায় ৩০০ টন মিষ্টিকুমড়া বিক্রি হয়েছে। তাদেরকে খুঁড়ে, গর্ত করে, ভিতরে আলো দিয়ে ভূতের মুখ বানানো হবে।
বিভিন্ন পডকাস্টে হরর আর অদ্ভুত বই নিয়ে আলাপ হচ্ছে। এই উছিলায় সেইদিন শুনলাম কোরিয়ান লেখক বোরা চাং এর লেখা  ‘কার্সড বানি’-র কথা।  তাঁকে বলা হয়েছিল বইটা কী নিয়ে? এখানে আপনি কী বলতে চান? উত্তরে তিনি বলেন -  ‘আই অ্যাম সো স্কেয়ার্ড, আই অ্যাম সো কনফিউজড আই ডোন্ট নো হোয়াট ইজ গোয়িং অন’।
শনিবার সকাল। আম্মা বুটের ডাল আর আম দিয়ে রান্না করছে। আর আলু ভর্তা। মামি পাঠাইছে ঘরে তোলা ঘি আর আমের আচার। সানিয়া আমাকে চা করে দিলো। দুনিয়ায় কত কিছু হয়। কত লোক মারা যায়। কত লোক জন্মায়। আমি চা’য়ে চুমুক দেই। তিনদিন আগের আমার জন্মদিনের ছবি দেখতে দেখতে ফিলিস্তিনি লেখক মোহামেদ আলী তালহার গল্পের সামিহার কথা ভাবি। যে জন্ম থেকে থাকে ফিলিস্তিনের ক্যাম্পে। প্রতিদিন একটা প্রাচীন জলপাই গাছের গুড়িতে বসে বাসন মাজে। আর স্বপ্ন দেখে তার প্রেমিক তাবিত - যার নামের অর্থ অবিচল সে, একদিন সূর্য তুলে এনে সাজাবে সামিহার ফুলদানিতে। যে ফুলদানি ফুল চেনে না,  ক্যাম্পের স্কুলের কারুশিল্প কাসে বানানো তাদের বাড়ির একমাত্র ফুলদানি। সে প্রশ্ন করে - আমার কেন একটা বাড়ি থাকবে না?  একটা মার্বেল এর সিংকওয়ালা রান্নাঘর, নিজের একটা ঘর, একটা খাট, একটা জানালা, সেখানে পর্দা  আর পর্দার ওইপাশে রূপালী চাঁদ সে বলে ক্যাম্পের ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালন করা হয় না।
আমি চায়ে চুমুক দেই। বাইরে অনেক বাতাস। বোধহয় ঝড় হবে। কাকাতুয়াগুলি ডাকতেছে।
‘আমি এত ভীত আর বিভ্রান্ত, কি হইতেছে আমি বুঝতেছি না’।

২৮ অক্টোবর ২০২৩
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া