পৃথিবীর নামকরা অভিধানে (অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ অভিধানের কথাই ধরি) যখন একটা নতুন শব্দ যুক্ত হয়, তখন ধরে নেওয়া হয় শব্দটির বহুল প্রচলই এর কারণ- যদিও এমন হতে পারে, শব্দটির ব্যবহার ঘোরতর অশুদ্ধ। তেমনই একটি শব্দ চিটার (cheater) আমজনতার মুখে এত বেশি উচ্চারিত হয়েছে যে মজা করে হোক বা আমজনতার মুখের বুলিকে সম্মান জানতে হোক, কেমব্রিজ ডিকশনারিতে এর জায়গা হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। জনপ্রিয় হওয়ার সুবাদে জে কে রাউলিং এর বিখ্যাত হারি পটার থেকে মাগ্ল (muggle) শব্দটির সৌভাগ্য হয়েছে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার। এমন আরও আছে। প্রসঙ্গটা এ জন্য যে, ২০১৬ সালে একটা নতুন শব্দ অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে যোগ হয়েই থেমে থাকেনি, বছরের সেরা আন্তর্জাতিক শব্দের তকমাও পেয়েছে। শব্দটি বা শব্দবন্ধটি পোস্ট ট্রুথ। অভিধানে এর মানে এক কথায় না বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই বলে- এটা একটা বিশেষণ যার প্রয়োগ সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে বস্তুনিষ্ঠ সত্য মানুষের মতামত ও আবেগকে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারে না (an adjective relating to circumstances in which objective facts are less influential in shaping public opinion than emotional appeals).
আমরা এত কাল ফেক নিউজ (fake news) বলে যা জেনে এসেছি তা থেকে পোস্ট ট্রুথ আলাদা। একে সরাসরি মিথ্যাচার বলা মুশকিল। যদিও বন্তুনিষ্ঠ সত্যের বিপরীতে যা থাকে তা মিথ্যা ছাড়া কী! কিন্তু পোস্ট ট্রুথ মিথ্যা নয়, আধাআধি সত্য বা আধাআধি মিথ্যাও না। তাহলে? বলা হয়ে থাকে বস্তুনিষ্ঠ সত্যের চেয়ে এর প্রভাব বেশি, কারণ এর আবেদন মানুষের আবেগকে আন্দোলিত করে, আর তা এতটাই যে, জনমত গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ইংরেজি পোস্ট শব্দটির যে আভিধানিক অর্থ অর্থাৎ ‘পরে’, যেমন- পোস্ট ওয়ার, পোস্ট কলোনিয়েলিজম, পোস্ট মডার্নিজম ইত্যাদির সঙ্গে মিল রেখেই নাকি এর উদ্ভব। সেদিক দিয়ে দেখলে সত্য-পরবর্তী বলতে আমরা যাকে সত্য বলে জানি-প্রতিষ্ঠিত ও ধ্রুব-তা মেয়াদউত্তীর্ণ, তামাদি, অতএব পরিত্যাজ্য। এই যে পরিত্যাজ্য বলা হলো, এ কোনো দর্শন-উদ্ভূত মতাদর্শ নয়, এমনকি সাধারণ অর্থেও একে কোনো মতবাদ বলা যাবে না। বর্তমানের অসহিষ্ণু সময়ে সত্যের প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন এসেছে বা সত্য বলতে যে একটা ঘটনাকে কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ চরিতার্থের প্রয়োজনে সুবিধামতো ব্যবহার করা হয়, আর এর ফলে মানুষ যে প্রভাবিতও হয়, সেটাই এর সারকথা।
সার্বিয়ান-আমেরিকান নাট্যকার স্টিভ টেসিচ (Steve Tesich)-কে বলা হয়ে থাকে শব্দটির প্রবর্তক। ১৯৯২ সালে তিনি তাঁর A Government of Lies শিরোনামের প্রবন্ধে শ্লেষাত্মক অর্থে একে ব্যবহার করেন। যুক্তি হিসাবে তাঁর সামনে ছিল তখনকার কিছু বৈশ্বিক পরিস্থিতি (যেমন- ১৯৮৫-৮৭ সময়ব্যাপী ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি, ১৯৯০-৯১ এর গাল্ফ যুদ্ধ) যা রাষ্ট্রব্যবস্থানায় সংগঠিত মিথ্যাচারে ‘বিকল্প সত্য’ বলে প্রচার পেয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে তাঁর মনে হয়েছিল, মুক্তমনা প্রাণী হিসাবে মানুষ জেনে-বুঝেই এই পোস্ট ট্রুথের যুগে বাস করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে (we, as a free people, have freely decided that we want to live in some post-truth world).
যে ঘটনাগুলো স্টিভ টেসিচকে বিচলিত করেছিল, পরবর্তীতে অবশ্য এর চেয়ে বড় বড় পোষ্ট ট্রুথের ঘটনা ঘটেছে, আর তা বলতে গেলে পৃথিবীর সবখানেই। অনেক বড় ঘটনার প্রচারের পেছনে পোস্ট ট্রুথের অবদানের কথা বলা হয়ে থাকে। ২০০১ সালে নিউ ইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রমণে আল কায়দার ভূমিকাকে কেউ কেউ শতাব্দীর অন্যতম পোস্ট ট্রুথ বলে থাকেন। আবার এ তো নিঃসন্দেহেই বলা যায় আমেরিকার ইরাক দখলের পেছনে উইপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশনের বিশ্বময় প্রচার ¯্রফে পোস্ট ট্রুথেরই ফল। ২০১৬ সালে আমেরিকার নির্বাচন ও ইংল্যান্ডে ব্রেক্সিট প্রচারণার তুমুল হৈচৈ এর মূল ইন্ধনদাতা বলা হয়ে থাকে পোস্ট ট্রুথকে। বস্তুতপক্ষে তখন থেকেই পোস্ট ট্রুথ কথাটির বহুল ব্যবহার শুরু হয়।
বলা হয়ে থাকে এ সময়টা পোস্ট ট্রুথের, অথবা এটা পোস্ট ট্রুথের জামানা। মার্কিন লেখক-অধ্যাপক রাল্ফ কিস (Ralph Keyes) দ্য পোস্ট ট্রুথ এরা (The Post-truth Era, 2004) নামের বইতে পোস্ট ট্রুথ যুগের বড় বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, এ সময় মিথ্যা অমার্জনীয় আচরণ বলে বিবেচিত হচ্ছে না, তদুপরি অনেক মানুষের কাছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এর গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ছে। তাঁর মতে মিডিয়াশাসিত এ সময়ে মিথ্যাকে এই যে ছাড় দেওয়া, এ থেকেই পোস্ট ট্রুথের শুরু। মোদ্দা কথাটাকে অস্বীকার না করেও বলা যায়, শুধু মিথ্যা দিয়ে চটজলদি পোস্ট ট্রুথকে সংজ্ঞায়িত করা এক ধরনের সরলিকরণ। ব্যাপারটা অন্যভাবে, প্রশ্নের আকারে দেখা যেতে পারে। মানুষ যদি সত্যটা (তা হতে পারে ইতিহাস সংক্রান্ত বা ঘটমান কোনো ঘটনা সম্পর্কে) না-ই জানে, তাহলে তার পক্ষে মিথ্যা যে মিথ্যা কী করে বুঝবে? ফলে অনেকের ধারণা আমরা পোস্ট ট্রুথের যুগে বাস করছি। এ কথা বলার মানে এই নয় সত্য আর কাজে লাগছে না, কিংবা সত্য নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা নেই। কথাটাকে এভাবে বলাই সংগত যে আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যেখানে সত্য বিপন্ন, আর ভবিষ্যতে সত্যের আদল-প্রকৃতি কেমন হবে এ নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
এখানে কথা উঠতে পারে, সাধারণভাবে আমরা যে ধরে নিই সত্য যেকোনো পরিস্থিতির একমাত্র নিয়ামক, তা হলে এও চিন্তা করতে হবে পোস্ট ট্রুথ বস্তুটা মানুষের চিন্তায় গেড়ে বসল কী করে? সেই সঙ্গে ভাবা প্রয়োজন কেন সত্যকে সামাজিকভাবে কাক্সিক্ষত ভাবছি, কিংবা যদি বর্তমান সময়ে এর ব্যত্যয় ঘটে গিয়ে থাকে ও সত্যকে ‘পুনরুদ্ধারের’ দরকার পড়ে, তা হলে দেখতে হবে পোস্ট ট্রুথের ধারণা আমাদের চেনা-জানা সত্য থেকে কতটা আলাদা। ব্যাপার কি এ রকম- পোস্ট ট্রুথ এমন এক ধারণা যা আদতে সত্য থেকে উৎসারিত, যেমন আধুনিকতা থেকে উত্তরাধুনিকতা?
উত্তরাধুনিকতার কথা যখন উঠল তখন বলা প্রাসঙ্গিক উত্তরাধুনিকতা একক কোনো সত্যের চেয়ে নানা বিষয়ে আপেক্ষিক ও ব্যক্তিগত উপলব্ধিজাত সত্যকে গুরুত্ব দেয়। শুধু গুরুত্বই দেয় না, একক সত্যকে প্রত্যাখ্যানও করে এ যুক্তিতে যে, একক সত্য বলে কোনো তত্ত্ব বা মেটা ন্যারেটিভ নেই, বরং বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নানা তত্ত্ব, তথ্য ও ব্যক্তিগত উপলব্ধিতে যা বেরিয়ে আসে তাকেই একটা বিশেষ সময়ের সত্য বলে ধরে নেওয়া সংগত। উত্তরাধুনিকতাবাদী এই চিন্তার সূত্রপাত যদিও শিল্প ও সাহিত্য সমালোচনা থেকে শুরু হয়েছিল, এর প্রভাব মননশীল ভাবনার জগতেও লক্ষ করার মতো। জ্যাক দেরিদার বিনির্মাণবাদী তত্ত্ব যা বলে- কোনো পাঠেরই একক অর্থ বা চূড়ান্ত ব্যাখ্যা নেই; একই টেক্সট বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা চলে, আর এই ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা থেকে যা পাওয়া যায় তা পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। উত্তরাধুনিকতাবাদে আপেক্ষিক সত্যের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে, একক সত্য নয় বরং বহু তত্ত্ব ও আখ্যান যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আপেক্ষিক সত্যটি তৈরি করে তার কোনোটিই একে অন্যের ওপর প্রাধান্য পায় না। এই ধারণাটি সমাজবিজ্ঞানীদের এক অংশ আগ্রহভরে গ্রহণ করেছিলেন এবং যুদ্ধ, রাজনীতি, সমাজনীতি, যৌনতা ও নানা মানবিক আচরণে প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁরা প্রতিটি মানুষের আচরণে এক একটি টেক্সটের খোঁজ পেয়েছিলেন যা বিষয়গত দৃষ্টিকোণ থেকে বহু ধরনের ব্যাখ্যা পেতে পারে। সুতরাং যা দাঁড়াল- যেহেতু একক কোনো টেকস্ট নেই, প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজস্ব শিক্ষা, মূল্যবোধ, ইতিহাসজ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে নিজস্ব সত্যের খোঁজ পাবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, পোস্ট ট্রুথ যেহেতু কোনো মতাদর্শ নয়, তত্ত্ব তো নয়ই, একে পোস্টমডর্নিজমের ধারায় বিবেচনার কোনো অবকাশই নেই।
পোস্ট ট্রুথকে কি গুজব বলা যাবে? কেউ কেউ বলেন। তবে বাস্তবে তা নয়, কারণ গুজব দীর্ঘজীবি নয়। তবে কিছুটা সময়, কখনো লন্বা সময় ধরে যখন একটা গুজব এক কান থেকে অন্য কানে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমায়, তখন যে উদ্দেশ্যে গুজবটি ছড়ানো হয়েছে তার ফায়দা অনেকটাই হাসিল হয়ে যায়। আমাদের এখানকারই একটা ঘটনা মনে পড়ছে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, করোনাভাইরাস সবে জেঁকে বসেছে এমন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুকে) রটানো হলো দেশে লবণের ঘাটতির জন্য পরের সপ্তা থেকে বাজারে লবণ পাওয়া যাবে না। বলা প্রয়োজন, বেশ আঁটঘাঁট বেঁধে, কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্যসহ পরিকল্পনামাফিক কাজটা করা হয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষ যেমন দোকানে-দোকানে লবণ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল, শহুরে শিক্ষিত লোকজনও বিভ্রান্ত হয়েছিল। গুজবটা টিকেছিল বড়জোর সপ্তাখানেক, আর এর মধ্যেই রটনাকারীদের উদ্দেশ্য যে সফল হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন কথা হচ্ছে, যদি এমন গুজব রটানো হতো যে এক সপ্তা পরে সোনার দাম তিনগুণ বেড়ে যাবে, তাহলে কিন্তু মানুষ তাতে মোটেও প্রভাবিত হতো না। তার মানে, স্বার্থ উদ্ধারের এমন প্রচেষ্টার পেছনে সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি খাটাতে হয়। লবণ সংক্রান্ত ঘটনাটি অবশ্যই গুজব; স্বল্পমেয়াদী পোস্ট ট্রুথও একে বলা যাবে না। দীর্ঘমেয়াদী যেসব গুজব বা মিথ্যা সমাজে প্রচলিত ছিল বা আছে, সেসবকেও পোস্ট ট্রুথের নিরিখে দেখা যেতে পারে। ভূত কেউ না দেখলেও ভূত যে আছে এ বিশ্বাস যাদের মনে প্রোথিত তারা কি পোস্ট ট্রুথের ভিকটিম? সে যাক। অতীতে অনেক ঘটনা ঘটেছে, বিশেষত ধর্মকে কেন্দ্র করে, যার স্থায়িত্ব ছিল দীর্ঘকাল। সেসব ঘটনা পরে গুজব বলে প্রমাণিত হলেও, আজকের বিবেচনায় পোস্ট ট্রুথ বলাই সংগত। আবার আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্থায়ও যে আমরা প্রায় অহরহ পোস্ট ট্রুুথের চর্চা করি থাকি, এও অস্বীকারের উপায় নেই। একটা ধর্মীয় জলসায় বড় জমায়েত হয়েছে- এ কথাকে যখন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলা হয় (প্রচার করা হয়) যে জমায়েতে দশ লক্ষ লোক হয়েছে, তখন অনেকে না জেনে না ভেবে নিজেদের আবেগের সমর্থনপুষ্ট বিবেচনায় কথাটা বিশ্বাস করতে পারেন ও জনে জনে বলে বেড়াতেও পারেন। সামাজিক নানা কুসংস্কারও যে সাধারণ মানুষের মন থেকে যুক্তিকে হটিয়ে অসত্যের শিকড় গাড়ে তারও অনেক নজির রয়েছে। যেমন বড় কোনো স্থাপনা বিশেষত সেতু নির্মাণে বাচ্চাদের মাথার প্রয়োজন পড়ে- একে যত উদ্ভট বা হাস্যকরই বলা হোক, এ তো সত্যি যে বছর কয়েক আগে (২০১৯-এ) রটনা করা হয়েছিল পদ্মা সেতু তৈরিতে বাচ্চাদের মাথার দরকার পড়ছে বলে দেশের এখানে ওখানে ছেলেধরার উৎপাত বাড়ছে ও বাচ্চারা হারিয়ে যাচ্ছে। ছেলেধরা সন্দেহে কয়েকজনকে গণপিটুনিতে হত্যাও করা হয়। এমনকি খোদ ঢাকাতেই এক নারী স্কুলে তার সন্তানের ভর্তি বিষয়ক খোঁজখবর করতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। সেতু নির্মাণে মানুষের, বিশেষত শিশুদের মাথা উৎসর্গের এই আজগুবি কুসংস্কার পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার দু-একটি দ্বীপাঞ্চলে ও বর্নিও জনগণের মধ্যে প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। বলা নিষ্প্রয়োজন, কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাসের সঙ্গে পোস্ট ট্রুথকে এক করা যাবে না- যদি না সেসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়।
মধ্যযুগে বা তারও আগে ইহুদিদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার চালিয়ে অনেক রোমহর্ষক ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। ত্রয়োদশ শতকে ইংল্যান্ডের লিংকন শহরে এক বিধবার হিউ নামের আট-নয় বছরের ছেলের মৃতদেহের খোঁজ পাওয়ার পর জোর গুজব রটে যে স্থানীয় ইহুদিরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। রটনা চারদিকে এমনভাবে পল্লবিত হতে থাকে যে তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই উনিশজন ইহুদিকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয় এবং এর কয়েক বছর পর ইংল্যান্ড থেকে ইহুদিদের বহিষ্কার করা হয়। ঘটনাটা সে সময়ের ইংল্যান্ডবাসীদের এতটাই আলোড়িত করেছিল যে ঘটনার শতাধিক বছর পরেও জেফরি চসার তাঁর বিখ্যাত দ্য ক্যান্টরবেরি টেলস-এ হিউয়ের মূত্যুর রটনার আদলে দ্য প্রায়োরেসেস টেল নামে একটি আখ্যান ফেঁদে বসেন। হিউকে লিংকন ক্যাথিড্রালে সমাহিত করা হয়েছিল। কয়েক শতক পর্যন্ত হিউকে খ্রিষ্টধর্মীরা সেইন্টের মর্যাদা দিত। গত শতকের মাঝামাঝি (১৯৫৫) প্রকৃত ঘটনার জন্য যে ইহুদিরা দায়ী ছিল না তা বেরিয়ে পড়ে।
পোস্ট ট্রুথের পেছনের মনস্তত্ত্ব নিয়ে অনেকে বিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন। ফলে অনেক সময় এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা নানা দিকে ডালপালা ছড়িয়েছে। কারো কারো মতে মানুষ মূলত পোস্ট ট্রুথের বাসিন্দা, আর যে মানসিকতা থেকে পোস্ট ট্রুথের জন্ম তা আজকের নয়, যদিও পোস্ট ট্রুথ কথাটা সাম্প্রতিক কালের। বলা হয়ে থাকে, মানুষ যে জীবনযাপন করে তাতে সে অহরহই সত্যকে এড়িয়ে, এমনকি মিথ্যাকে মিথ্যা জেনেও আঁকড়ে থাকতে আপত্তি করে না। দৈনন্দিন জীবনে সে সীমাহীন মিথ্যা নিয়ে টিকে থাকে। সে যে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র বাজার থেকে কেনে, তা নিজ বুদ্ধিতে কেনে না। এ কাজে তাকে উৎসাহী করে বানোয়াট বিজ্ঞাপন যেখানে অনেক সময় পণ্যের ভুয়া গুণাগুণ নিয়ে লম্বা ফিরিস্তি থাকে। আবার এই বিজ্ঞাপনের জোরেই যে আধুনিক জীবনযাত্রা সচল তা কে অস্বীকার করবে! ফলে হালাল সাবান বা হালাল টুথপেস্ট বলতে কী বোঝায় বা গায়ের চামড়া উজ্জ্বল করার কী মানে এমন তর্কে না গিয়ে সে বিজ্ঞাপনের পোস্ট ট্রুথেই আস্থা রাখে বা অন্যদের দেখাদেখি রাখতে উৎসাহিত হয়। এ প্রসঙ্গে কিছু কিছু প-িতের এমন বয়ানও শোনা যায়- শিক্ষিত মানুষ যে গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালোবাসে, তার কারণ তারা বাস্তববিবর্জিত কল্পজগতেই থাকতে চায়, যা তাদের মনে পোস্ট ট্রুথের ভিত তৈরি করে দেয়। এ ধরনের কথা একেবারেই লাগামছুট। মানুষ যখন সৃজনশীল লেখাজোখা পড়ে, সে তার অবিশ্বাসকে সচেতনভাবে খারিজ (willing suspension of disbelief) করেই কাজটা করে।
সত্য পক্ষপাত মানে না, সত্য খোলামেলা, কখনো কখনো নির্মম। এ কারণে সাধারণভাবে এমন সত্যকেই মানুষ বিশ্বাস করতে চায় যা তার নিরাপত্তায় আঘাত করবে না। তাই যারা মানুষকে কোনো উদ্দেশ্যে সংগঠিত করেন, তারা জানেন সত্যের নিরাভরণ বাস্তবতা দিয়ে বেশি মানুষকে সংগঠনে (তা সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি ধর্মীয় যা-ই হোক) টানা যাবে না। এ ক্ষেত্রে মিথ্যা বা কল্পকাহিনি বা প্রেরণাউদ্দীপক গল্পগাথা হতে পারে মানুষকে একত্রিত করার অন্যতম উপায়।
পোস্ট ট্রুথ নিয়ে যারা কথা বলেন তারা এর বিপথগামিতা নিয়েই বলেন। মিথ্যাচার ও গুজবের সাথে গুলিয়ে ফেলে অনেকে অবান্তর কথাও বলেন। ইসরাইলি ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারিরি (Yuval Noah Harari) বিষয়টাকে এতটা একপেশে ও সরল-সোজাভাবে বিচার করেন না। এ প্রসঙ্গে হারিরি যা বলেন- মানুষের একই সময়ে জানার ও না-জানার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। তাদের পক্ষে তখনই সঠিকভাবে পূর্ণ তথ্যসহ কোনো বিষয় জানা সম্ভব যখন তারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করবে ও প্রশ্ন করবে। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তারা চিন্তা করে না, তাই তারা জানে না। ফলে একটা কথা যখন প্রচার পায়, এর সত্যাসত্য বা প্রামাণিক তথ্য নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না; আর মূল বিষয় হলো তারা তাদের চিন্তা-ভাবনা-স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার সহগামী বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে নারাজ। এ হলো মানবিক প্রবৃত্তি ও চিরাচরিত ইন্দ্রিয়তাড়িত মানসিকতা যাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। হারিরির বক্তব্য : ... humans have always lived in the age of post-truth. Homo sapiens is a post-truth species, who conquered this planet thanks above all to the unique human ability to create and spread fictions. We are the only mammals that can cooperate with numerous strangers because only we can invent fictional stories, spread them around, and convince millions of others to believe in them. As long as everybody believes in the same fictions, we all obey the same laws and can thereby cooperate effectively (Sapiens-- a brief history of humankind).
হারিরি পোস্ট ট্রুথকে দেখেছেন খানিকটা অন্যভাবে, তাঁর বক্তব্যে মানুষের কল্পনাশক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছেন যা নানাভাবে যুগ যুগ ধরে আমাদের জীবনকে চালিত করে আসছে : ঝযধৎবফ ভরপঃরড়হং -- Shared fictions -- in the form of news, religions, novels, sports, money, even brands -- fill our lives, but that’s OK. It’s these shared beliefs that have helped humans cooperate and conquer the planet.
এ কোনো আরোপিত আশাব্যঞ্জক বাণী নয়; তবে এও সত্য, আজকের দিনে যা আমাদের জীবনকে প্রভাবিতই না, বিকারগ্রস্থও করছে তা এর অপপ্রয়োগের ফল যা সত্যের শক্তিকে অনেকটা ছেঁটে ফেলছে। সোজা কথায় ব্যাপারটা তাই দাঁড়ায়।
সত্যের শক্তি কত দূর যেতে পারে- এ প্রশ্ন এখানে প্রাসঙ্গিক। এর সাথে অন্য যে বিষয়টি ওতপ্রোত জড়িত তা সত্য বনাম ক্ষমতা। সত্যের নিজস্ব শক্তি রয়েছে, আবার ক্ষমতা নামে একটা আলাদা শক্তিও রয়েছে। ক্ষমতা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীলালিত হতে পারে, তবে বড় পরিসরে এর নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রই একে লালন করে, ব্যবহার করে। দুর্নীতিদমনে একে ব্যবহার করতে পারে, সন্ত্রাসদমনে করতে পারে, তবে মূলত যে উদ্দেশ্যে এর প্রসার ঘটানো তা নিজের ক্ষমতাবলয় বৃদ্ধি করতে যার প্রকাশ ঘটে বিরুদ্ধপক্ষকে-হতে পারে রাজনৈতিক সংগঠন বা মিডিয়া-দমনের মধ্য দিয়ে। সেই সাথে এও অনিবার্য, ক্ষমতার প্রভাববলয় বৃদ্ধির সুবাদে সরকার অনুসারীদের সুবিধাবলয়ও বৃদ্ধি পায়, তারাও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে, যাকে সরকার তার ক্ষমতার ইতিবাঁচক ব্যাপ্তি বিবেচনা করে। এখানে সংগতভাবেই যে প্রশ্নটা আসতে পারে- রাষ্ট্র কি সত্যের শক্তি দিয়ে এ কাজ করতে পারে? আরও সোজাসাপটা বললে- সরকার কি জনমত তার পক্ষে টানতে সত্যকে ব্যবহার করতে পারে? জবাবটা না-বোধক হবে এ নিয়ে তর্ক অবান্তর। সরকার কখনোই বলবে না দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হঠাৎ পড়ে গেছে, বা স্টক মার্কেটে দুর্বৃত্তদের কারসাজিতে বিনিয়োগে ধস নেমেছে, যাতে তার নিজের লোকজনও জড়িত। কিন্তু যদি এসবে সামান্যতম ইতিবাঁচক কোনো লক্ষণ দেখা যায়-যা হয়তো সাময়িক-সরকার উঠেপড়ে লাগবে সেসবকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করতে। এখানে পোষ্ট ট্রূথ হয়ে উঠবে তার গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন। দেশভেদে এর তারতম্য থাকলেও মূল ব্যাপার একই। এ ধরনের আচরণকে তেমন গর্হিত কিছু মনে করা হয় না। ধরে নেওয়া হয়, সরকার তার নিয়ন্ত্রিত বিধি-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে এ ছাড়া আর কী করবে- তা পোস্ট ট্রুথ বা প্রি ট্রুথ যা-ই হোক!
তবে রাষ্ট্র চরম মিথ্যাচার দিয়েও এ কাজ করতে পারে, আর অনেক সময় তা হতে পারে দেশপ্রেমের নামে। প্রয়াত প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক-সাংবাদিক খুশবন্ত সিং একবার মুখরোচক একটা তথ্য দিয়েছিলেন যা হালকা চালের হলেও বেশ কৌতূহলউদ্দীক। উনিশ শ পয়ষট্টির ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কয়েক বছর পর নতুন দিল্লতে পাকিস্তান দূতাবাসে এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে বিস্তর পানাহারের পর খুশবন্ত সিংহের মনে প্রশ্ন জাগল অনুষ্ঠানটির উপলক্ষ কি তা তো জানা হলো না। কিন্তু ততক্ষণে অতিথিদের বিদায়পর্ব চলছে। পরে তিনি জেনেছিলেন পয়ষট্টির যুদ্ধে ‘পাকিস্তানের বিজয়’ উপলক্ষে অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল, সেই সাথে এও- দিনটি পাকিস্তানে প্রতি বছর উদ্যাপন করা হয়। খুশবন্ত সিং মজা করে লিখেছিলেন পানাহারের এমন ব্যবস্থা থাকলে তিনি প্রতি মাসেই এ উদ্যাপনে অংশ নিতে চান। মজা করতে গিয়ে খুশবন্ত সিং যা লিখেছিলেন তার সত্যতা যাচাই না করেও এ কথা তো পরিষ্কার পয়ষট্টির ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের ‘জয়’ হয়েছিল তা সে আমলে স্কুলে পড়–য়াদের থেকে শুরু করে বয়স্কদের অনেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।
সত্য ও ক্ষমতার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। দুটি বিষয় প্রথমেই চোখ পড়ে। প্রথমত, সত্যের শক্তি ও ক্ষমতার শক্তি এক নয়; দ্বিতীয়ত, সত্যের শক্তি ক্ষমতার শক্তিকে জোরদার তো করেই না, বরং প্রায়শই দেখা যায় সত্যকে চাপা দিয়ে বা খর্ব করে বা বিকৃত করে ক্ষমতার শক্তি নিজেকে জাহির করে। ফলে ক্ষমতার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে পোস্ট ট্রুথের, বিশেষত রাজনীতির ক্ষেত্রে।
কথা থেকে যায়, সত্য বলতে আমরা যা বুঝি বা বুঝতে চাই, তাতে বিস্তর তাত্ত্বিক ঘোরপ্যাঁচও রয়েছে। উনিশ শতকে পাশ্চাত্যের নিওকাসিক ধারণা থেকে শুরু করে বিশ ও একুশ শতকের বহুত্ববাদী ধারণা সত্যের আদল-আকৃতিকে কিছুটা হলেও ঝাপসা করে দিয়েছে। বাট্রান্ড রাসেল ও লুডউইগ উইটগেনস্টাইন সত্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যার ওপর গুরুত্ব দিতেন তাকে তাঁরা বলতেন correspondance theory of truth (সম্পর্ক তত্ত্ব)। এ তত্ত্বের সারকথা- সত্য স্বয়ম্ভু কিছু নয়, এর চাবিকাঠি অন্য বা একাধিক সত্যে সন্নিহিত। মূল ব্যাপারটা সম্পর্কের- সত্য বলে যে প্রস্তাবনাটি করা হচ্ছে তার খাটিত্ব নির্ভর করে অন্যান্য বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা বা প্রস্তাবনার সঙ্গে তার সম্পর্কের ওপর। কেউ কেউ এই সম্পর্কতত্ত্ব ও অধিবিদ্যাগত বাস্তববাদের (মেটাফিজিক্যাল রিয়েলিটি) ঘনিষ্ট সম্পর্ক আবিষ্কারে আগ্রহী, যার মোদ্দা কথা- সত্য ও বাস্তবতা মূলত বস্তুনিষ্ঠ (অবজেকটিভ), যে-কারণে এরা আমাদের চিন্তাভাবনা, উপলব্ধি ও প্রতিষ্ঠিত ধারণার বাইরে স্বাধীনভাবে বিরাজ করে। দ্বিতীয় যে তত্ত্বটি তাত্ত্বিকদের মনোযোগের বিষয় তা অনেকটা সম্পর্কতত্ত্ব প্রভাবিত, তবে পুরোটা নয়। এর নাম দেওয়া হয়েছে coherence theory (সমন্বয় তত্ত্ব), যার মূল কথা- সত্য বলে যে বিষয়টিকে বা প্রস্তাবনাকে উপস্থাপন করা হয় তার যথার্র্থতা তখনই নির্ধারিত হয়ে যখন সেটি একটি সুসমন্বিত ও সাজুয্যপূর্ণ এক বা একাধিক বিষয় বা প্রস্তাবনার অংশ হিসাবে গণ্য হয়। এ ক্ষেত্রে সত্যের সত্যতা নির্ভর করে অন্যান্য ঘটনাবলীর বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। তৃতীয় তত্ত্বটিকে বলা হয়ে থাকে pragmatic theory of truth (বাস্তববতা তত্ত্ব) যার সার কথা- সত্যের মূলমন্ত্র এর উপযোগিতা। একটি প্রস্তাবিত সত্যের মূল্য তার ব্যবহারিক উপযোগিতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। এ তত্ত্বের অনুসারীদের মতে আমরা কখনোই কোনো একটি বৈজ্ঞানিক সূত্রের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি না। বড়জোর যা জানতে পারি তা বৈজ্ঞানিক সমাজে সূত্রটির গ্রহণযোগ্যতা এবং একে দিয়ে বাস্তবকে যেমন ব্যাখ্যা করা যাবে, তেমনি বাস্তবের ভবিষ্যত সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব হবে। বিশ ও একুশ শতকে সত্যকে যাচাই করার বহুত্ত্ববাদী তত্ত্বের (pluralistic theory) উদ্ভব হয়েছে। এ তত্ত্ব অনুসারে সত্যেকে যাচাই করার কোনো সুনির্দিষ্ট পন্থা বা মাপকাঠি নেই; সত্য হলো একটা ফাংসন (function) যাকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ও প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে সত্য কোনো স্বচ্ছ ধারণা নয় বরং বহু ধারণার সমাহার। বৈজ্ঞানিক সত্য, জাতীয় নিরাপত্তা সত্য, নৈতিক সত্য, শৈল্পিক সত্য, রাজনৈতিক সত্যের মতো বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যের নিরিখে সত্যের চেহারা ও প্রকৃতি নানাভাবে বিভক্ত হতে পারে। আবার এই ভিন্ন ভিন্ন সত্য এক অন্যের পরিপূরকও হয়ে ঊঠতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে।
তত্ত্ব বিচারে মানুষের ব্যবহারিক জীবন চলে না। কারণ তাকে প্রায় প্রতি পদে এমন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় যাতে তার নিজের উপলব্ধি, বিবেচনা ও সচেতনতাই তাকে সাহায্য করতে পারে। তবে এও সত্য যে, এই উপলব্ধিজাত ধারণা কোনো না কোনোভাবে তত্ববিশ্বের আওতাভূক্ত।
পোস্ট ট্রুথ নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায়/ বিতর্কে যে বিষয়টি প্রায়ই অনুপস্থিত তা হলো আধুনিক বিশ্বের অন্তর্নিহিত সামাজিক সম্পর্ক ও রীতিনীতির পূর্ণবিবেচনা। রাজনীতিতে সফল অংশগ্রহণমূলক সম্পৃক্ততার প্রয়োজনে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের (যেমন বাকস্বাধীনতার) দরকার পড়ে না, এর জন্য প্রয়োজন রাজনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে নিরন্তর বোঝাপড়া ও সাধারণ জনগণের মধ্যে এই বোঝাপড়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। প্রাচীন গ্রীসে সত্যকথনের একটি প্রতিশব্দ বহুল প্রচলিত ছিল যাকে বলা হতো parrhesia (প্যারহেসিয়া)। কৌতূহলের বিষয় হলো সত্যকথন নিয়ে মিশেল ফুকো Discourse and Truth শিরোনামের একাধিক বক্তৃতায় প্যারহেসিয়ার প্রসঙ্গ এনেছেন যা এখানে প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। বক্তৃতার সারকথায় ফুকো বলেছেন তাঁর উদ্দেশ্য সত্যকে সংজ্ঞায়িত করা নয়, কারণ সত্য কখনোই সোজাসাপটা বিষয় নয়। প্রাচীন গ্রীসে প্যারহেসিয়া বলতে বোঝাত সব কিছু বলা, কোনো কিছু আড়াল না করে সরাসরি সহজবোধ্য ভাষায় বলা। তবু প্যারহেসিয়া ব্যবহার করতে বা প্যারহিয়াস্টে হতে গেলে একটা ক্ষেত্র প্রয়োজন অর্থাৎ বিতর্কমূলক কোনো বিষয় যা নিয়ে খোলাখুলি, আড়াল-আবডালহীন কথা চলবে। কিন্তু কাজটা যে সহজ নয় তা ফুকো স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেছেন। প্রথমত, এতে রয়েছে সত্য বলার চ্যালেঞ্জ। একজন রাজনীতিবিদ সত্যকথন তার জনপ্রিয়তাকে খর্ব করবে বা জনমতের বিপক্ষে যাবে জেনেও যখন যা বলার অকপটে বলেন, তখন তাকে প্যারহিয়াস্টে গণ্য করা যাবে। প্যারহেসিয়ার কাজ কিন্তু বক্তার জবানিতে সত্য উদ্ঘাটন নয়, বরং খোলামেলা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা পথ দেখানো যাতে শ্রোতা বা জনগণ নিজেরাই সত্য সম্বন্ধে নিজেদের মতামতে পৌঁছতে পারে। ফুকোর মতে প্যারহেসিয়ার অন্য একটি দিক হলো দায়িত্বসচেতনতা বা কর্তব্যবোধ। এমন হতে পারে-হওয়াই স্বাভাবিক-বিরুদ্ধবাদীদের চাপে বা নিগৃহীত হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে কেউ কেউ হয়তো সত্য বলার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও চুপ করে থাকেন। আবার উল্টোটাও হতে পারে যেখানে কেউ তার চেয়ে ক্ষমতাধর প্রতিপক্ষের পরোয়া না করে কেবল কর্তব্যের খাতিরেই সত্যটা বলবে। তখনই তার বক্তব্যকে প্যারহেসিয়া বলা যাবে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে কেউ কেউ যদিও পোস্ট ট্রুথকে সমসাময়িক একটা প্রবণতা বলতে চান, আদতে এর চর্চা ও প্রয়োগ চলে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে। রাজনীতিকদের এ ছাড়া চলে না। ব্যাপারটা এমন নয় যে কেবল বিরোধীপক্ষকে জনসমর্থন থেকে সরিয়ে রাখতে কুৎসা ও সমালোচনা দিয়েই সত্যকে ঢেকে রাখা হয়। আদতে যে কাজটা রাজনীতির অঙ্গনে পরিকল্পনামাফিক করা হয় তা প্রতিষ্ঠিত সত্যের (যা হতে পারে পূর্ববর্তী সরকারের কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান বা অতীতের কোনো প্রমাণিত ঘটনা যা তাদের বিপক্ষে যায় বা নিজেদের কোনো বড় খামতিকে ধরিয়ে দেয়) ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া। সরাসরি উল্টো ব্যাখ্যা মানুষকে সহজে প্রভাবিত করবে না, তাই এমন কিছু তাদের সামনে নিয়ে আসা যা তাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্ঠিক আবেগকে দোলা দেবে। হতে পারে তা কোনো সুপ্ত বঞ্চনার কথা বা আশাবাদের কথাও। বলা বাহুল্য, এর পেছনে লোকরঞ্জনবাদী প্রপাগান্ডার বড় ভূমিকা রয়েছে।
এ কারণে পোস্ট ট্রুথকে এক কথায় মিথ্যাচার বলা যাবে না। মিথ্যা যে বলে সে প্রথমত সত্যকে অস্বীকার করে, পোষ্ট ট্রুথ কিন্তু সত্য অস্বীকার করে না, আবার স্বীকারও করে না, ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়, আর এর মূলে যারা থাকেন তারা একে কাজে লাগান তাদের এজেন্ডা হিসাবে। অন্যভাবে বললে- পোস্ট ট্রুথ সত্য ও তথ্যের অস্তিত্বকে সরাসরি নাকচ করে না, বরং প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণযোগ্য সত্যের বিপরীতে একটা মতামত দাঁড় করিয়ে তথ্যকে দৃষ্টির আড়ালে রাখতে তৎপর থাকে। এই মতামত প্রবণতাকে বলা যেতে পারে পোস্ট ট্রুথের মূল ভিত। একজন মিথ্যাবাদী যখন জনসমক্ষে একটা মিথ্যাকে ধামাচাপা দিয়ে নিজের বক্তব্য প্রচার করে, তখন সে প্রাথমিকভাবে একে তার ব্যক্তিগত মতামত বলেই অগ্রসর হয়। আর তা করতে গিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার দোহাই দেওয়াও বিচিত্র নয়। এ প্রসঙ্গে জার্মান রাজনৈতিক ও সমাজ দার্শনিক হ্যানা অ্যারেন্ড তাঁর Truth and Politics নিবন্ধে এই বলে মন্তব্য করেছেন যে, যদিও আমাদের বাস্তব সত্য কখনোই ব্যক্তির নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি ও ব্যাখ্যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়, তবু কারো ব্যক্তিগত মতামত বাস্তবতা ও প্রামাণিক তথ্যের বিরুদ্ধে যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না; আর এ জন্য প্রয়োজন সত্য, তথ্য, ব্যাখ্যা ও মতামতকে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ, জট পাকিয়ে এদের ভেদরেখাকে ঝাপসা করা কখনোই কাম্য নয়।
পোস্ট ট্রুথকে যদি বলা হয় প্রধাণত রাজনীতিকদের অবদান, অন্য যে পরিস্থিতি এই তথাকথিত বিকল্প সত্যের পক্ষে কাজ করে চলেছে তা হলো প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা। উন্নত ও অনুন্নত নির্বিশেষে সব দেশেই পরিস্থিতি কম-বেশি এক। প্রতিষ্ঠান বলতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিংসহ তাবত গণপরিষেবা এর আওতায় পড়ে। বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যেমন, কর্পোরেট হাউজগুলোও এর বাইরে নয়। জনগণ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় নির্ভর করছে ঠিকই, কিন্তু আস্থা রাখতে পারছে না। একই ঘটনা স¦াস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে, এমনকি অনেক সময় দেখা যাচ্ছে ব্যাংক-বীমার মতো প্রতিষ্ঠানও তাদের আস্থাভাজন নয়।
এর পর এ প্রসঙ্গে যা অনিবার্যভাবে আসে তা মিডিয়া। আজকাল অবশ্য মিডিয়া বলতে ছাপা পত্র-পত্রিকা বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের পাশাপাশি অন্য যে মাধ্যমকে বোঝানো হয়ে থাকে তার ভদ্রস্থ নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশাল মিডিয়া। একটি স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ হলেই এ মিডিয়া চালু করা যায়, আর যেহেতু একে পরিচালনার জন্য দরকার একজন মাত্র ব্যক্তির, তথ্যের প্রবাহ সেই ব্যক্তির মর্জিমাফিক হতে বাধ্য। তবে এখানেও লক্ষ্য থাকে সমাজের এক অংশের, সম্ভব হলে বড় অংশের আবেগ, হতাশা ও অকাক্সক্ষার ঝোঁককে দোলা দেওয়া। এখানে গুজব ও মিথ্যা দুটোই এক সঙ্গে চলতে পারে, সেই সঙ্গে সত্যও। এই ঘোঁটপাকানো সত্য-মিথ্যা-গুজব যখন অবাধে প্রবাহিত হয়, তখন মূল বিষয় দাঁড়ায় কোন মতামত কাকে প্রভাবিত করছে, কতটা করছে। সোশাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবের দৌরাত্ম ইদানীং প্রতিষ্ঠনিক মিডিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এমন কথা অহরহ শোনা যায়। বলা নিষ্প্রোয়জন, জেনে-বুঝে বা পরিকল্পিত-অপরিকল্পিত যেভাবেই সোশাল মিডিয়া তথ্য সরবরাহ করে, তা অনেক ক্ষেত্রেই পোস্ট ট্রুথের জন্ম দেয়।
আলোচনার এ পর্যায়ে অনেকের মতামত ধার করে বলা যায়, পোস্ট ট্রুথের পেছনে যে কয়টি কারণ নিহিত বলে ধরে নেওয়া হয় তাদের মধ্যে রয়েছে- বর্তমান কালের তথ্য বিস্ফোরণ, প্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবন, প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানিক সত্যের প্রতি অশ্রদ্ধা, উত্তরাধুনিকতার ধারণার বিকৃত ব্যাখ্যা, এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বিদ্বেষ। যত কার্যকারণই থাকুক বা যত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক, বা পোস্ট ট্রুথের রমরমা যতই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে সচেষ্ট হোক, এর ফলে সত্যের জায়গায় মিথ্যা জুড়ে বসবে বা আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে বসবাস করতে গিয়ে যে ভারসাম্য মেনে চলি তা বিনষ্ট হবে, তেমন ভাববার কি কারণ আছে?
তাহলে পোস্ট ট্রুথের জামানায় কী করা? বোকা-বোকা প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত এসেই যায়। বোকা প্রশ্নের সোজা-সরল জবাব- পোস্ট ট্রুথ বলে কিছু নেই। সেই সাথে এ কথা বলাও অযৌক্তিক নয় যে, ধ্রুব ও অনড় সত্য বলেও বেশি কিছু নেই। তার মানে সত্যকে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে বের করতে হয়, তারপরও ব্যাখ্যায় তারতম্য থাকতে পারে। তাই বলে সে ব্যাখ্যা পোস্ট ট্রুথ নামক বেসাতিতে পর্যবসিত হবে এমন কথায় সায় দেওয়া যুক্তিহীন। হাজার হাজার বছর ধরে বিস্তর ভাঙা-গড়ার পথ ধরেও সভ্যতার ভিত সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
তথ্যসূত্র :
Steve Tesich: A Government of Lies, The Nation, January, 1992
Ralph Keyes: The Post-Truth Era: Dishonesty and Deception in Contemporary Life (New York: St. Martin’s Press, 2004)
Hannah Arendt: Truth and Politics, The New Yorker, February 25, 1967
Yuval Noah Harari: Sapiens: A Brief History of Humankind (Vintage, 2015)
Michel Foucault: Lectures on Discourse and Truth
Matthew d’Ancona, Post-Truth: The New War on Truth and How to Fight Back (London: Ebury Press, 2017).