কোভিড উনিশ অতিমারির মতো বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত এতটা দীর্ঘ দুঃসময় আমাদের জীবদ্দশায় আসেনি। বিপুলসংখ্যায় মানুষের প্রাণহানি ও মানবিক বিপর্যয়ে আমরা বিমূঢ় ও বিহ্বল! অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার কম হলেও স্বস্তি নেই মানুষের। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সাহিত্যভুবনের বেশ কয়েকজন মানুষ কোভিড উনিশের গ্রাসে পড়ে লোকোত্তর হয়েছেন! তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন বার্ধক্যের আঙিনায়। সাধারণভাবে কোভিড উনিশ অতিমারি বার্ধক্য ও জরাগ্রস্ত বয়স্কদের ঝুঁকিতে রাখে। কোভিড উনিশে আক্রান্ত না হলে আমাদের সাহিত্যের অগ্রসর কয়েক জন প্রবীণ হয়তো আরো কিছুকাল আমাদের আলো দিতে পারতেন! যাঁদের হারিয়েছি তাঁদের কয়েকজনকে নিয়ে এই লেখা।
আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামান মোটামুটি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। বিদ্যায়তনিক, সাহিত্যিক ও সামাজিক মানুষ হিসেবেই সামগ্রিকভাবে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল মহলের শ্রদ্ধেয় মানুষ। অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও গ্রহণযেগ্যতায় তাঁর ভূমিকা সমাজে ছিল প্রায় অনিবার্য। কারণ বয়স ও জরা তাঁর সচলতাকে ও চেতনাকে স্থবির করতে পারেনি।
গবেষক হিসেবে আন্তর্জাতিক বিদ্যায়তনেও তাঁর সমাদৃতি ছিল। মোটা দাগে তাঁর গবেষণার উপজীব্য ছিল বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় ও বাংলা গদ্যের উৎস সন্ধান। বাঙলার মুসলমান সমাজের উনিশ ও বিশ শতকের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মূল্যায়িত হয়েছেন তাঁর কলমে। ধরা পড়েছে বাংলার সমাজমানসের রূপান্তরও। চিন্তামূলক প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন যাতে রয়েছে জাতীয় সাংস্কৃতিক মানসের ছায়াপাত। কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্যা চর্চাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও আকৈশোর তাঁর অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতা ছিল। ভাষা আন্দোলনের অংশী ছিলেন কলেজছাত্র থাকা কালেই। পরে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে ছিলেন নেতৃস্থানীয়। আরো পরে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে বাংলাদেশের লেখকদের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত রচনার যে সংকলন সম্পাদনা করেন তা রবীন্দ্রমূল্যায়নের সীমানাকে প্রসারিত করে। এই সংকলন দীর্ঘকাল ধরেই বাংলাদেশে রবীন্দ্র বিচারের দিকনির্দেশক সংকলন হিসেবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। সারা জীবন ধরে অব্যাহত ছিল তাঁর রবীন্দ্র-চর্চা। উন্মোচন করেছেন ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির রবীন্দ্রমাত্রা।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক বিভিন্ন কাজে অংশ নিয়েছেন মননিক ও কর্মপ্রয়াসিক স্তরে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কর্মসূত্রে ছিল তাঁর গভীর যুক্ততা। তার পর যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সংবিধানের বাংলা ভাষ্য প্রণয়ণের তো প্রধান ব্যক্তিই ছিলেন তিনি। শ্রণিকক্ষে তিনি কথা বলতেন সহজ ভাবে; কিন্তু বলার ভঙ্গি ছিল নৈর্ব্যক্তিক। ভাষ্য উপস্থাপনে থাকত সমাজ বিবেচনা কিংবা দার্শনিকতা। ক্লাসে তাঁর কথায় যে দার্শনিকতা এবং সূক্ষ্ম কৌতুক থাকত তা বুঝে ওঠার মতো সাংস্কৃতিক বোধে দীপিত সত্তা ছাড়া অনেক সময় বুঝে-ওঠাও সম্ভব হতো না। শ্রেণিকক্ষে তাঁর শিক্ষকসত্তা সীমিত নয়। তুলনায় জীবনের বিচিত্র পর্বে তাঁর ভূমিকার গুরুত্ব বিবেচ্য। অনুভবনীয় যে, তাঁর মতো ব্যক্তিমানুষের অভিযাত্রার সঙ্গে সৃষ্টিশীলতা বা কর্মধারার সম্পর্ক ওতোপ্রোতো। এমন মানুষদের একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া যায় না। আনিসুজ্জামানের কর্মজীবনের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের অভিযাত্রাকে নিকট থেকে দেখবার যাঁরা সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা এ কথা গভীরভাবে অনুভব করেন।
তিনি ছিলেন সময়ানুবর্তী ও বিবেচক একজন মানুষ। সময়ানুবর্তিতা এবং পূর্বপ্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশিষ্ট দিক। এটা তাঁর কাছে ছিল সাধারণভাবে সঙ্গত আচরণ, ফলে অন্যদের বিলম্বের জন্য তাঁকে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। উপস্থিতির সংখ্যা বেশি না থা কলেও কোনো আলোচনা অনুষ্ঠানকে উপেক্ষা করতে দেখা যায়নি। সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, বিবেচনা, বক্তব্যের পরিমিতি ও সূক্ষ্ম রসবোধে সামগ্রিকভাবে তিনি ছিলেন আমাদের সমাজের অন্যতম ব্যতিক্রমী মানুষ। সর্বোপরি তাঁর ছিল বাস্তবতার বোধ ও উচ্চ কা-জ্ঞান। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায়ও ছিল নিজস্ব সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়া। সামাজিক মানুষ হিসেবে তিনি যে এত বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন তার উৎস তাঁর এইসব গুণাবলি।
কখনো তাঁর ভূমিকা ও সিদ্ধান্তগুলো থেকেছে সরলভাবে আমাদের পারিপার্শ্বিকের ভাবনানুকূল, কখনো-বা প্রত্যাশার বাইরে। কিন্তু বিভিন্ন সময় তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে গিয়ে আমরা নিজেদের চিন্তাকে যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য কিছুটা অর্জন করার বৌদ্ধিক প্রণোদনা পেয়েছি সেটাই মনে হয় শিক্ষক হিসেবে আমাদের তাঁর কাছে পাওয়া শিক্ষা। তিনি ছিলেন আমাদের প্রজন্মের সেই ‘পূর্বসূরিদের একজন যাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি সামগ্র্য ও সংহতির শিক্ষা’।
কোভিড উনিশের হানায় তাঁর বিয়োগ আরো কিছুকাল তাঁর সাহচর্য থেকে আমাদের কেবল বঞ্চিতই করেছে তা নয়, তাঁর কাছ থেকে না-পাওয়া জনিত বেদনাকেও আমৃত্যু আমাদের বহন করতে বাধ্য করেছে।
মনজুরে মওলা
নানা রকম স্বাস্থ্যগত দুঃসহতাকে বহন করেও কিভাবে সৃষ্টিশীলতার হাসি হাসা যায় কবি-প্রাবন্ধিক মনজুরে মওলা তাঁর অন্যতম দৃষ্টান্ত। কোভিড উনিশ তাঁর শরীরে হানা না দিলে হয়তো জরাকে বহন করেও আরো কিছুকাল সক্রিয়তার দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে রাখতে পারতেন! স্বাধীনতার অব্যবহিত-উত্তর কালে বাংলাদেশের ব্যক্তি উদ্যোগের জাতীয় পুস্তক-প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারার বিজ্ঞাপনে তাঁর রচিত ‘নিমগ্ন কি করে পারো’ কবিতা-সংকলনের সূত্রে মনজুরে মওলার নাম কবি হিসেবে সাহিত্য মহলে প্রচারিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় বিষয়। চারণ কবির মতো অনর্গল বলে যেতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে! এমনকি কবিতায় ‘নিজেই তো গোরা তুমি’ সম্বোধনে তাঁর সুপরিচিত আত্মঘোষণার কথাও অবিদিত নয়! কিন্তু তিনি প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন আমলাতন্ত্রের প্রতিনিধি হয়েও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হওয়ার পর। সামরিক শাসনামলে মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও তিনি ব্যতিক্রমী কিছু কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। এমনকি বাংলা একাডেমির বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা মহাপরিচালকদের মধ্যেও তাঁকে বিশিষ্ট মনে করা হয়! করোনা মহামারিকালে হারাতে হলো মনজুরে মওলাকে; এ এক গভীর অবহনীয় বিয়োগব্যথা, সময়ের অনিরাময়যোগ্য ক্ষত।
কবি হিসেবে তিনি ষাটীয় প্রধানদের সগোত্র! কবিখ্যাতিতে তিনি তাঁদের সমকক্ষ না হলেও তাঁর কবিকণ্ঠ ছিল প্রথম দিকে জীবনানন্দে আর্দ্র-দূষিত হয়েও স্বতন্ত্র! সরকারি অমলা হিসেবে শিখরস্পর্শিতা ও নানা ধরনের সাহিত্যিক কর্মতৎপরতা তাঁর কবিখ্যাতিকে কিছুটা ম্লান করলেও কবিতাপাঠকদের কাছে অপাঙ্ক্তেয় ছিলেন না! ঊন ছিলেন না কবিতার রচনাপ্রাচুর্যেও! তাঁর দ্বিতীয় কবিতা-সংকলন ‘মাটি হেরে যায়’ (১৯৮৩) বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নির্দেশনায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আশির দশকের প্রথম ভাগে একটা প্রকাশনা-অনুষ্ঠানের আয়োজনসূত্রে সংগঠক হিসেবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। কাছাকাছি সময়েই তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান! সাহিত্যাঙ্গনের দাপুটে নিয়ন্ত্রক-পরিচালক হিসেবে তখনই তাঁর খ্যাতি ব্যপকতা পায়!
তখন থেকেই সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর তৎপরতার ক্ষেত্রও হয় বিস্তৃত! আমরা মনজুরে মওলার নানাবিধ পরিচয় পেতে থাকি। তখন থেকেই বিচিত্র ধরনের গদ্যের তিনি রচয়িতা, কাব্যনাট্যের অনুবাদক ও মৌলিক নাট্যস্রষ্টা, রবীন্দ্র চর্চায় ভিন্ন মাত্রার উদ্ভাবক, ব্যতিক্রমী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তরুণদেরও নৈকট্য লাভ করেন!
যিনি জীবনের শেষ দিনগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী রোগশয্যায় থেকেও কর্মক্ষম ছিলেন; সক্রিয় রয়েছেন বিচিত্র বিষয় ও মাধ্যমের রচনায়। সাহিত্যসৃষ্টি, সম্পাদনা, গ্রন্থ-পরিকল্পনার নানা কাজে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। পেশাজীবনে পালন করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব। তবে সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে হয়তো সব ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় তাঁর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পরিচয়টি। এতে এক দিকে হয়তো তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি আছে তেমনি অন্য দিকে আছে তাঁর অন্যান্য সৃষ্টিকে যাচয়ই করে না দেখাও।
আশির দশকে এক মেয়াদে প্রায় তিন বছর তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি মহাপরিচালক থাকা কালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বইমেলাটিকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে বৃহত্তর রূপ নেয়। প্রশাসক হয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঐতিহাসিক বর্ধমান ভবন সংস্কার, প্রথম জাতীয় ফোকলোর কর্মশালা আয়োজন, আরজ আলী মাতুব্বর বা খোদা বক্স সাঁইয়ের মতো লোকমনীষাকে ফেলোশিপ প্রদান, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস', ‘ডেভিডসনের চিকিৎসাবিজ্ঞান’ কিংবা আনিসুজ্জামানের ‘পুরোনো বাংলা গদ্য'র মতো বই প্রকাশে উদ্যোগ নিয়ে তা সম্পন্ন করেছেন তিনি। বিশ্বভারতীর ‘বিশ্ব বিদ্যাসংগ্রহ’ গ্রন্থমালার আদলে বাংলা একাডেমিতে তার পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত কীর্তি ‘ভাষাশহীদ গ্রন্থমালা'র ১০১টি বই। এমন অনেক বই এ সিরিজে প্রকাশিত হয়েছে, যা বিষয় হিসেবে বাংলাদেশে ছিল নতুন উপজীব্য। এমন অনেকে এ সিরিজে লিখেছেন, যাঁরা পরে সে বিষয়ে অর্জন করেছেন বিশেষ পরিচিতি; বিশেষজ্ঞ লেখক হিসেবে এই তালিকায় তাঁর নাম জ্বলজ্বলে হয়ে আছে বলে পরেও তাঁর পরিচিতি অর্জনে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়ে প্রশাসক হিসেবে তাঁর যোগ্যতাকে জনসমক্ষে চিনিয়ে দিয়েছিল। গবেষক হিসেবে তাঁকে একটু স্বতন্ত্র লাগে। সম্পাদক হিসেবেও চলকছেন নিজের পথে। কবি ও নাট্যকার হিসেবে মনজুরে মওলা লিখেছেন দুটো কাব্যনাট্য ‘আমি নই’ ও ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ'; আর অনুবাদ করেছেন ইবসেনের নাটক ‘ব্র্যান্ড’ (২০০৫), এলিয়ট ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়! এলিয়ট অনুবাদের সঙ্গে হাজির করেছেন নিজস্ব টীকাভাষ্যও। এলিয়ট নিয়ে তাঁর বই কয়েকটি! লিখেছেন বিশ্লেষণী পুস্তক ‘এলিয়ট-এর সময়’ (২০১৯), নাটক অনুবাদ করেছেন টি এস এলিয়টের ‘সুইনি ও দ্য রক’ (২০১৯) এবং ‘গির্জায় খুন’ (২০১৯)। রবীন্দ্র-বিষয়ে তাঁর আর এক কীর্তি তাঁর পরিকল্পিত ‘রবীন্দ্র সার্ধশত বর্ষ গ্রন্থমালা'। সম্পাদক হিসেবে তাঁরই পরিকল্পনায় রবীন্দ্রবিষয়ক ১৫১টি বই প্রকাশ। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘দশমী’ বইটিকে কেন্দ্র করে ‘নষ্ট নীড়’ (২০১০) নামেও ভিন্নধর্মী একটি বই লিখেছেন মনজুরে মওলা। সৈয়দ শামসুল হকের প্রায় সমকালেই তিনিও কাব্যনাট্য রচনা করেছেন। কিন্তু সৈয়দ হকের তুলনায় তাঁর নাটকের স্বভাব ভিন্ন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর কাব্যনাট্যর নাট্যরূপটি আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। কাব্য ও মনোজগতের অন্তর্গত নাট্যগুণে সে সময়কার টিভি নাটকগুলোর সাধারণ রুচির সঙ্গেও এটির ছিল বিরাট ব্যবধান! ‘আমি নই’ (২০০০) , ‘জালিনওয়ালাবাগ’ (২০০৫) তাঁর দুটি কাব্যনাট্যই তাঁর স্বমুদ্রাচিহ্নিত কাজ।
আশির দশকে মনজুরে মওলা সম্পাদনা করতেন ‘শ্রাবণ’ (১৯৮৬-৮৭) নামের একটি ব্যতিক্রমী সাহিত্যপত্রিকা। এ ছাড়াও রয়েছে তাঁর সম্পাদিত দুটি কবিতা-সংকলন যথাক্রমে ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা (২০১৭) এবং ‘বাংলাদেশের কবিতা ১৯৪৭-২০১৭’ (২০১৮) যা তাঁর নিজের উৎকৃষ্ট কাবিতারুচির চিহ্নবাহী। গোয়েন্দা-গল্পের ইতিহাস নিয়ে ‘গল্পর গোয়েন্দা’ (১৯৯৩) বই লিখেও পাঠকপ্রিয় হয়েছেন। লিখেছেন সাহিত্য সমালোচনার বই ‘গ্রহণ করেছো যত ’(২০১২), রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছেন ‘একজন কবি বিষয়ে’ (২০০৮), অল্প একটু রবীন্দ্রনাথ’ (২০১১)।
'জোরে শ্বাস নাও’ (২০২০) ছিল কবি মনজুরে মওলার শেষতম কাব্য। কোভিড উনিশ-আক্রান্ত সময়ের কথাবআছে এ বইয়ে! কবিতার বইয়ের নামগুলো আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় খুব সাদামাটা; কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে এর ব্যতিক্রমী স্বভাব বোঝা যাবে! সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের যাপন-জিজ্ঞাসার মধ্য থেকে জেগে ওঠে মনজুরে মওলার কবিতা! পুড়ে পুড়ে (১৯৮৫), শ্যাওলা ও ডিঙি (১৯৮৫), ‘এই দিন মিথ্যে‘ (১৯৮৬), ‘বন্দনা বৃষ্টির’ (২০০০), ‘না হয়’ (২০০৩), খা খা (২০০৪), ‘সুচিত্রা সেনের জন্য’ (২০০৫), ‘পেয়েছো কি’ (২০০৬), ‘তুমি’ (২০০৮), ‘হাউই’ (২০১৭), ‘তার একটু ঘুম প্রয়োজন’ (২০০৭), ‘বাঘ ও খুনী’ (২০১০), এখনও বিশ্বাস করি আমরা আপনাকে’ (২০১২), ‘সামান্য মানুষ আমি’ (২০১৬), ‘সত্য যে কঠিন’ , ‘শিখিয়েছিলাম’ (২০১৭), ‘আকাশ যেমনই হোক’ (২০০৫), ‘অকবিতা-কবিতা’ (২০১৪), , ‘সত্য যে কঠিন’ (?), ‘ও দেয়াল সাদা’ (?), কী উত্তর দেবো’ (২০১২), ‘তুমি’ (২০১৫), ‘জয়তু বৈশাখ’ (২০১৬), ‘কী হবে রাগ করে’ (২০১৯), একবারটি ভাবো (২০১৮) ‘বাঘ কি তা জানে’ (২০১৪)--এই নামগুলোর মধ্য থেকেই তাঁর কবিতার অভিমুখ বোঝা যায়! আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, জীবনের শেষ কুড়ি বছর ধরে তিনি কবিতাও লিখেছেন প্রচুর, বলা যায় যৌবনের সংরাগের চেয়ে বার্ধক্যের প্রজ্ঞা প্রাণিত করেছে তাঁকে!
আমলা হিসেবে সরকারী দায়িত্ব থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি শুধু কবিতাই নয়, নিমগ্ন ছিলেন সাহিত্যের নানামুখী কাজের গভীরেও! এখন আমাদের চালানো দরকার তাঁর রচনাকর্মে তন্নিষ্ঠ তল্লাশী; তা থেকে যেমন মূল্যবান মণিমুক্তো আমরা পাবো তেমনি এর মধ্য দিয়েই জানানো হবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাও!
ফজল-এ-খোদা
কোভিড উনিশের বৈশ্বিক মহামারি কেড়ে নিয়েছে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম'সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের বাণীকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় গানের মানুষ ও বেতারকর্মী ফজল-এ-খােদাকেও। বেতার-টেলিভিশনের বহু অনুষ্ঠানের পরিকল্পক, লেখক ও নির্দেশক এই মানুষটির গর্ব ছিল, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে বেতার বিষয়ক পত্রিকা ‘বেতার বাংলা’ ও ‘ইঅঘএখঅউঊঝঐ ইঊঞঅজ’-এর তিনি ছিলেন প্রথম সম্পাদক। উদ্যোক্তা এবং সম্পাদক ছিলেন বেতার বিভাগের ছােটদের পত্রিকা শাপলা শালুক-এরও। পত্রিকাটিকে ঘিরে শিশু-কিশাের সংগঠন ‘শাপলা শালুকের আসর’-এর তিনি ছিলেন পরিচালক ‘মিতাভাই’। কবি ও শিশুসাহিত্যিক হিশেবেও রয়েছে তাঁর বিশেষ পরিচিতি।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু তখন সবে বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেছেন সেই সময় তরুণ বয়সেই ‘ছবি সংঘ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন ফজল-এ-খোদা। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তাঁর পরিচয়। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার স্বপ্নে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ তাঁকেও অনুপ্রাণিত করেছিল; তারই প্রেরণায় ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে তিনি যোগ দেন। যুদ্ধশেষের অস্থির সময়ে বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় অনেকের মনেই যখন দেশ পুনর্গঠনের স্বপ্ন, উৎপাদন বাড়ানোর সংগ্রামের পাশাপাশি চলছিল সাংস্কৃতিক উন্নয়নেরও সংগ্রাম। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নেয়া হচ্ছিল নানা উদ্যোগ। পাকিস্তান আমলেও বেতারের পত্রিকা ছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বেতারেরও পত্রিকা বের করার কথা ভাবা হলো। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত ফজল-এ-খোদার ওপরই দায়িত্ব পড়ল বেতারের পত্রিকা বের করার। তাঁর মনে হলো ছোটোরা বাদ পড়বে কেন সেইসব উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা থেকে। কচি-কাঁচার মেলা, খেলাঘর, বয় স্কাউট, গার্ল গাইডস সহ শিশুকিশোর সংগঠনগুলো দেশ গঠনের কাজে উৎসর্গ করেছে।
বেতারের ছোটদের অনুষ্ঠানেও বিশেষ ভাবে নজর রাখা হতো। শিশুদের মানস গঠনে রেডিও-টেলিভিশনে ব্যবস্থা রাখা হতো ছোটোদের অংশগ্রহণের। বেতার ভবন থেকে ছোটদের জন্য পত্রিকা বের করার কথা মনে এল তাঁর। ভাবলেন ছোটদের জন্য গড়ে তুলবেন সংগঠন। মনে হলো সদ্য স্বাধীন দেশকে যারা গড়ে তুলবে তাদেরই তো আগে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে! বাংলাদেশ বেতারের মুক্তিযুদ্ধ ফেরত একজন কর্মকর্তা হিসেবে তাঁরও তো দায়িত্ব আছে কিছু একটা করার। এই দায়িত্বের অংশ হিসেবে তিনি জানেন বেতারে ছোটদের অনুষ্ঠানে যা প্রচার করা হয় তার সূচি তো পত্রিকায় দিতেই হবে। তাঁর আরো মনে হলো, বিশিষ্ট জনেরা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসে ছোটদের লক্ষ্য করে অনেক ভালো ভালো কথা তো বলবেনই। তার সঙ্গে কিছু লেখা যোগ করলেই তো ছোটদের জন্য একটা পত্রিকা দাঁড় করিয়ে ফেলা যায়! সেই সঙ্গে নিয়মিত যেসব ছোটরা অনুষ্ঠান শোনে তাদের নিয়ে একটা সংগঠন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি। তিনি ভাবেন সংগঠন ও পত্রিকার মধ্য দিয়ে ছোটদেরকে দেশের ভবিষ্যতের উন্নত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা যাবে।
বেতারের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ‘শাপলা শালুক’ ছিল ছোটদের কাছে আকর্ষণীয় হবার মতো পত্রিকা। ছোটদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য পত্রিকাটি রঙিন করে তোলার চেষ্টা করলেন ফজল-এ-খোদা। শিশুকিশোর সংগঠন ‘শাপলা শালুকের আসরে’ তিনি চেষ্টা করতেন বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে। সংগঠনের সুবাদে তাঁর পরিচিতি হয়েছিল ‘মিতাভাই’ নামে। তিনি চাকরিসূত্রে বাংলাদেশ বেতারের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের সকল সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও অপরিসীম মনোবল নিয়ে ‘শাপলা শালুকের আসর’ গড়ে তোলেন। দেশজুড়ে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই সংগঠন। সেইসঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘শাপলা শালুক’ পত্রিকাটিও।
ফজল-এ-খােদার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় চল্লিশটি। তাঁর বইগুলো হচ্ছে, ‘সূর্য স্বর্ণ দ্বীপ’ [কবিতা] (১৯৬৮),‘মােক্তারপাড়া [নাটক] (১৯৭০), ‘সঙ্গীতা’ [গান] (১৯৭৩), ‘বিতর্কিত জ্যোৎস্না’ [কবিতা] (১৯৭৩), ‘সানাই’ [ছড়া] (১৯৭৬), ‘ইসলামী গান’ [ভক্তিমূলক গান] (১৯৮০), ‘প্রাসঙ্গিকী’ [শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রবন্ধ পুস্তিকা] (১৯৮৩), ‘নামে যার কেঁপে ওঠে’ [কবিতা] (১৯৯০), ‘মন্দিরা’ [দেশপ্রেমের গান] (১৯৯৭), ‘গান’ [নির্বাচিত গান] (১৯৯৭), ‘বন্দেগি’ [ইসলামি গান] (২০০২), ‘তাড়া করে অশুভ সময়’, [কবিতা] (২০০৮), ‘কাজল মাটির গান’ [লােকধারার গান] (২০১২), ‘সংগীতভাবনা’ ‘প্রবন্ধ’ (২০১২),‘নির্জন পঙ্ক্তিমালা’ [কবিতা] (২০১৪)। এ ছাড়াও বিপুল অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার থেকে মাঝে মধ্যেই হাজির করেছেন স্মৃতিমেদুর গদ্যরচনা। সেসব রচনার সংকলন ‘আলোছায়ার জোয়ার-ভাটা’ (২০১৫) তাঁর সময়ের জাজ্জ্বল্যমান স্মৃতিদলিল।
তাঁর রচিত ছোটদের বইও রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। সেগুলো হচ্ছে,‘মিতাভাইয়ের আসর’ [গীতি-নৃত্য-নাট্য] (১৯৭৭),‘ফুলপাখিদের গান’[ছােটোদের গান](১৯৮৬),‘যমযম’[আরবি অক্ষরভিত্তিক ছড়া](১৯৮৯),‘আড়ি’ [ছড়া](১৯৯০),‘টুনটুনি’[ছড়া](১৯৯০),‘নাটক নাটক’ [দুটি নাটকের সংকলন](২০০০),‘জয় মুক্তিযুদ্ধ’[ছড়া-কবিতা](২০০৭),‘রবীন্দ্র নজরুল বঙ্গবন্ধু জয়নুল’[চার মহাজীবনের গল্প](২০০৭),‘জাগল বাঙালি জাগল’[কবিতা](২০১০,‘নটে গাছটি মুড়লাে’[ছড়া-কবিতা](২০১০),‘রয়েল বেঙ্গল’[বড়াে গল্প] (২০১১),‘জয় ছড়ার জয়’ [ছড়া] (২০১২),‘আড়ং’[ছড়া-কবিতা](২০১২),‘ছড়াকলাকার’[ছড়াকারদের নিয়ে ছড়া] (২০১৩),‘বাংলার ছড়া বাঙালির ছড়া’[ছড়া](২০১৪)।
এ ছাড়াও রয়েছে তাঁর সম্পাদিত দুটি বই ‘প্রেম পিরীতি’[পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা] (১৯৯৬)‘ঈদের গান’[ঈদভিত্তিক গান](২০০৪)। দেশপ্রেম ছিল কবিতায় তাঁর প্রধান উপজীব্য। বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও লিখেছিলেন বেশ কিছু রচনা। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর ছড়া ও কবিতায় ছিল লোকজ সংস্কৃতির প্রভাব।
১৯৬০ দশকের প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ছিল তাঁর সৃষ্টিশীলতার কাল। অসংখ্য দেশাত্মবোধক,আধুনিক,লোক সংগীত ও ইসলামি গানে তাঁর সৃষ্টিসম্ভার সমৃদ্ধ। ১৯৬৩ সাল থেকেই তিনি বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার। গীতিকার হিসেবে ১৯৬৪ সালে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের জন্মলগ্ন থেকেই তালিকাভুক্ত তিনি। তাঁর লেখা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’গানটি ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছে। উল্লেখ্য, ফজল-এ-খোদার লেখা এবং মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সুর ও কণ্ঠে করা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’গানটি ২০০৬ সালে বিবিসি’র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের সেরা ২০টি গানের তালিকায় ১২তম (দ্বাদশ) স্থান পায়। এ ছাড়া ১৯৭১-এ অসহযোগ অন্দোলন চলাকালে তাঁর লেখা গণ সংগীত‘সংগ্রাম, সংগ্রাম, সংগ্রাম চলবে, দিন রাত অবিরাম’গানটি তৎকালীন ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।
ফজল-এ-খোদার অনেকগুলো গানই দীর্ঘকাল ধরে জনপ্রিয়।‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’,‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু জানি না’,‘কলসি কাঁধে ঘাটে যায় কোন রূপসী’, বাসন্তী রং শাড়ি পড়ে কোন রমণী চলে যায়’, আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’,‘প্রেমের এক নাম জীবন’,‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো পথের ধুলোয় লুটোবে’--এইসব গানের প্রথম চরণের উল্লেখ করা হলে অনেকেরই সে কথা মনে পড়বে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হলে তাঁর দুঃখ এবং ক্ষোভ প্রতীকী ব্যঞ্জনায় গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। বশীর আহমদের সুরে শিল্পীবন্ধু মোহাম্মদ আবদুল জাব্বারের গাওয়া ফজল-এ-খোদার সেই গানটি হলো, ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো/ পথের ধুলোয় লুটোবে/ সাত রঙে রাঙা স্বপ্ন-বিহংগ/ সহসা পাখনা লুটোবে/ এমন তো কথা ছিলো না’। গানটি ১৯৭৬ সালে ঢাকা রেকর্ড প্রকাশ করে। ঢাকা বেতার থেকেও বহুবার প্রচারিত হয় গানটি।
তাঁর লেখা গান গেয়েছেন বশীর আহমেদ, আবদুল জাব্বার, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, রথীন্দ্রনাথ রায়ের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা। তাঁর অনেক গানে সুর করেছেন আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, ধীর আলী, সুবল দাস, কমল দাশ গুপ্ত, আবেদ হোসেন খান, অজিত রায়, দেবু ভট্টাচার্য ও সত্য সাহার মতো শ্রদ্ধেয় সুরকারেরা। দুঃখজনক যে, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ফজল-এ-খোদাকে রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মানও জানানো হয়নি।
ব্যক্তিগত ভাবেও আমি তাঁর স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর ছড়ার বই ‘ছড়াকলাকার’ ছিল ব্যতিক্রমী এক ছড়া-সংকলন। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ছড়ালেখককে নিয়ে লেখা তাঁর ছড়া দিয়ে বইটি গড়ে উঠেছে। এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত একটি ছড়া তিনি লিখেছেন আমাকে নিয়েও। তাঁর বিয়োগকালে অশ্রুসজল চোখে সে-কথা স্মরণ করছি।
আবুল হাসনাত
সত্তরের দশকের প্রথম দিকেই মাহমুদ আল জামান নামে একজন কবির কবিতা দেখতাম, দেখতাম ছোটদের লেখাও। তাই মাহমুদ আল জামান আমার চেনা ছিলেন। কিন্তু মাহমুদ আল জামানই যে সম্পাদক ও শিল্পকলা বিষয়ক লেখক আবুল হাসনাত সেটা জানতে আমার কিছু দেরি হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে একাধিক নামে লেখার ইতিহাস থাকলেও এবং সে ধারা পশ্চিমবঙ্গে চালু থাকলেও বাংলাদেশ তা বেশ ক্ষীণ। ফলে একই ব্যক্তির দুই নাম সন্ধানের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করিনি। তাঁর দুই সত্তার পরিচয় না জানবার এটাও একটা কারণ!
জীবনের একেবারে শেষের কয়েক বছরের কথা বাদ দিয়ে আবুল হাসনাতের লেখালিখির হদিস নিতে গেলে দেখা যাবে তিনি মূলত ছোটদের জন্যই বই লিখেছেন বেশি। বাঙালি মুসলমান সমাজে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বামপন্থা প্রভাবিত বঞ্চিত মানবতার প্রতি দরদ মিশ্রিত অসাম্প্রদায়িক চেতনাজাগর আধুনিকতার যে বোধ কিশোর তরুণদের মধ্যে জেগে উঠছিল মূলত মাহমুদ আল জামানের শিশুসাহিত্য তারই প্রতিনিধিত্ব করে।
তাঁর ছোটদের জন্য লেখায় মানবদরদী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। অরো উল্লখ্য, বাঙালি মুসলমান সমাজের জাগরণলক্ষণ তাঁর ছোটদের জন্য লেখা কল্পনাপ্রধান কথাসাহিত্যে স্পষ্ট। ছোটদের উপন্যাস ‘ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়’ (১৯৭৯) কিংবা ‘টুকু ও সমুদ্রের গল্প’ (১৯৮২) অথবা ‘রানুর দুঃখ-ভালোবাসা’-র (১৯৮৮) বেলায় যেমন একথা সত্য তেমনি সত্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা ‘যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুর’ (১৯৯২) বা ‘যুদ্ধদিনের পোড়োবাড়ি'-র (১৯৯৪) বেলায়ও! একই কথা প্রযোজ্য ‘ছোটদের জসীমউদদীন’ (১৯৮২) কিংবা ‘চার্লি চ্যাপলিনে’র (২০২১) জীবনীর বেলায়ও।
চিত্রসমালোচনা যেমন তাঁর অন্যতম প্রকাশ মাধ্যম তেমনি ছিলেন চিত্র সংগ্রাহকও। তাঁর অবহিতি ও নৈকট্য ছিল দুই বাংলার সেরা শিল্পীদের সঙ্গে। কামরুল হাসান কিংবা কাজী আবদুল বাসেতের শিল্পজীবনী আর ‘জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ও অন্যান্য’ বইয়ে তাঁর এই চিত্ররসিক সত্তার পরিচয় পাওয়া যাবে। চিত্র প্রদর্শনীর তাৎক্ষণিক আলোচনা যেমন লিখেছেন তেমনি লিখেছেন গভীর পর্যালোচনামূলক লেখাও।
২০২০-এ প্রকাশিত তাঁর আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথা হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে বইটি গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বস্তু ও চৈতন্য অনুষঙ্গের দলিল। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ততার সূত্রে লাবণ্যময় ও স্মৃতিমেদুর গদ্যে মুক্তিযুদ্ধ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন ও শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের নানা প্রগতিশীল কার্যক্রমের বিবরণ দিয়েছেন তিনি এই বইয়ে। এ ছাড়াও ঢাকায় ১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন, ছায়ানটের জন্মকথা ও বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত চর্চার প্রথম দিককার অনেক অনালোচিত দিকও বইটিতে আছে ।
মাহমুদ আল জামান নামে রয়েছে তাঁর কবিতাসংকলন ‘জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক’ (১৯৮৭), ‘কোনো একদিন ভুবনডাঙায়’ (২০১০), ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বিড়াল’ (২০১৪), ‘কবিতাসমগ্র’ (২০২১) এবং আবুল হাসনাত নামে তাঁর প্রকাশিত বই ‘রবীন্দ্রনাথ: চিত্রকর’ (২০১২), ‘জয়নুল সফিউদ্দিন কামরুল ও অন্যান্য’ (২০১৩), ‘রবিশঙ্কর মানিক সতীনাথ ও অন্যান্য’ (২০১৩), ‘প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য’ (২০১৯)।
মূলত সম্পাদক হিসেবেই আবুল হাসনাতের পরিচিতি। সবেচেয়ে বেশি খ্যতি ছিল সম্পাদনায়। তাঁর খ্যাতির শুরু দৈনিক সংবাদ সাময়িকীর সম্পাদকতা সূত্রে সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে। বাম রাজনীতির কর্মী হিসেবে ঐ ধারার সাহিত্যের প্রতি পক্ষপাত থাকলেও সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন উদার দৃষ্টির। ডাকে আসা অপরিচিত লেখকের লেখাও অনেক সময় গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছেন। উপেক্ষিত অনেক লেখক সম্পর্কে তরুণদের উদ্বুদ্ব করেছেন লিখতে। তাঁর সম্পাদকতায় সংবাদ-এর সাহিত্য সাময়িকী খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিল।
লেখালিখি ও তাঁর কর্মজীবনের কথা যা বাহ্যত জানা যায় তার মধ্য দিয়ে তাঁকে ঠিক মতো চেনা যায় না। এমনকি তাঁর সম্পাদকীয় নীতি, যা সর্বত্রই প্রশংসিত, তার আলোকেও পুরোপুরি বোঝা যায় না তাঁর সাহিত্যিক সত্তাকে। তাঁর সমকালে যে সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি (যাকে প্রগতিশীল বলে চিহ্নিত করা হতো) ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর নেতৃত্ব ও বিচরণের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে তাঁকে যেমন আদর্শনির্দিষ্ট মনে করার কথা তিনি ছিলেন তারও ঊর্ধ্বে, তার চেয়ে উদার। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে নিজে যেমন শুভবুদ্ধি ভিত্তিক জীবনের অনুশীলন করতেন তেমনি আস্থাশীল ছিলেন অন্য মানুষের শুভবুদ্ধির ওপরও; এমনকি বহুক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সুখকর না হলেও তিনি শুভবুদ্ধির ওপর থেকে কখনো আস্থা হারাননি।
সাহিত্য সম্পাদনায় তিনি যে রুচির পরিচয় দিয়েছিলেন তা বাংলাদেশের সাহিত্যিক মহলের কাছে দীর্ঘকাল ধরে উৎকর্ষের পরিচায়ক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর সম্পাদনা কর্মের আরো উৎকর্ষের নমুনা ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ (১৯৮৩) ও ‘মুক্তিযুদ্ধের কবিতা’ (১৯৮৪) সংকলন; সংকলনদুটি বাংলাদেশের সাহিত্যে যথার্থ প্রতিনিধিত্বশীল; এই ধারার সৃষ্টিকর্ম বিচারে সংকলন দুটির তাৎপর্য দীর্ঘ কাল ধরে অনুভূত হবে। এ ছাড়াও বেশ কিছু সংকলন তিনি সম্পাদনা করেছেন যেগুলো ইতিহাসের উপকরণ।
মাহমুদ আল জামান নামে তিনি যেমন প্রধানত কবিতা লিখতেন তেমনি লিখতেন ছোটদের জন্যও! আবুল হাসনাত নামটি ছিল তাঁর সাহিত্যিক অভিভাবকত্বের পরিচায়ক; পক্ষান্তরে মাহমুদ আল জামান সৌকুমার্যের! কোভিড উনিশের অতর্কিত হামলায় আমাদের সাহিত্যাঙ্গনের সত্যিকারের এই সজ্জন মানুষটির বিয়োগজনিত শূন্যতা আমাদের বেদনার্ত রাখবে বহুদিন।
ভূঁইয়া ইকবাল
সত্যিকারের বইসুহৃদ (ইরনষরড়ভরষ) ভূঁইয়া ইকবাল সম্পর্কে কৌতূহল জন্মেছিল আশির দশকের গোড়ায় মুহম্মদ জাহাঙ্গীর ও তাঁর যৌথ সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘বক্তব্য'-র (১৯৭৭-৮৪) একটি সংখ্যা দেখে; পরে পশ্চিমবঙ্গের ‘দেশ’ সাহিত্য সংখ্যায় তাঁর লেখা দেখে; আরো কিছু পরে দেখি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র’ (১৯৮৫)! আরো পরে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে খগেন্দ্রনাথ মিত্রের বইয়ে স্কুলপড়ুয়া ভূঁইয়া ইকবালের সম্পাদনায় প্রকাশিত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘টরেটক্কা'-র (১৯৬৫) কথা জেনে সে কৌতূহল আরো বাড়ে। অনেক পরে জনতে পারি গত শতাব্দীর ষাটের দশকের লিটল ম্যাগাজিন প্রবাহে কবিতা পত্রিকা ‘পূর্বলেখ’ (১৯৬৬-৬৭) সম্পাদনা সূত্রে তিনিও ছিলেন এক অভিযাত্রী। এ ছাড়াও তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন গড়ে তুলবেন একটা সৃজনশীল প্রকাশনাসংস্থাও। নির্মলেন্দু গুণের ‘কবিতা, অমীমাংসিত রমণী’ এবং আবুল হাসানের ‘যে তুমি হরণ করো’ যৌথভাবে প্রকাশ করবেন মর্মে বিজ্ঞাপনও বেরিয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনে; প্রকাশনা-সংস্থার নামও ঠিক হয়েছিল! তখন সম্ভব না হলেও পরে সেই নামেই, অর্থাৎ পূর্বলেখ প্রকাশনী আত্মপ্রকাশ করেছিল!
পিএইচডি গবেষণার জন্য কলকাতায় নিয়মিত যাতায়াত সূত্রে সেখানকার সারস্বত সমাজের সঙ্গে তাঁর যে ঘনিষ্ঠতা হয় তা তাঁর গবেষকরুচিকেও সমৃদ্ধতর করে তোলে! তথ্যনিষ্ঠায় ও গবেষক-স্বভাবে তাঁকে পুলিন বিহারী সেনের অনুসারী বলা যেতে পারে। নিজের কাজ সম্পর্কে জাহির করে বেড়ানোর মতো নিম্নরুচি ছিল না তাঁর। ফলে অনেকটা নীরবেই কাজ করে গেছেন। সব মিলিয়ে গবেষণার জন্য তাঁর সংগৃহীত উপকরণও বিপুল। নিঃসন্দেহে তাঁর গবেষণা ও সংগৃহীত তথ্য ভবিষ্যতের গবেষকদের অনেক সহায়ক হয়ে উঠবে। গবেষণাকাজের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও বাংলাদেশ লেখক শিবিরের হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন বটে তবে এইসব পুরস্কার তাঁর কীর্তি ও কর্ম থেকে বড় নয়! তিনি কাজ করে গেছেন কোনো রকম স্বীকৃতি-সম্মানের প্রত্যাশা বা আকাক্সক্ষা না করেই।