আমার প্রথম বই একটি প্রবন্ধ সংকলন, নাম তার ‘অন্বেষণ’, প্রকাশ ১৯৬৪- তে। ওই বছরই, কয়েক মাস আগে, অন্য একটি বই বের হয়েছিল বটে, নাম ছিল ‘ছোটদের শেকসপীয়র’, কিন্তু সেটি আয়তেন এতটা ছোট ছিল যে তাকে বই না বলে পুস্তিকা বলা ভালো। ওটিরও একটি ইতিহাস আছে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সুপারভাইজার ছিলেন প্রয়াত আবু যোহা নূর আহমদ, তিনি নিজে লিখতেন এবং কারা লেখে তার খোঁজ খবর রাখতেন। তাঁর সঙ্গে প্রায় রোজই দেখা হতো আমার গ্রন্থাগারে, কিম্বা তার বাইরে; তিনি বললেন, ‘একটা বই লিখে দিতে হবে ছোটদের জন্য, জীবনী সিরিজে বের হবে, আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে।’ মাপটাও বলে দিয়েছিলেন, আটচল্লিশ পৃষ্ঠা, তিন ফর্মা , তার ছোট বড় হলে চলবে না। সে-বই পরে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে জানি, কিন্তু এত ছোট যে তাকে পুস্তিকা বলি আমি, বই না বলে।
‘অন্বেষণ’ই তাই প্রথম। প্রকাশ করেছিলেন প্রিমিয়ার বুক, যার মালিক ছিলেন আমার বন্ধু গোলাম রহমান, যিনি নিজে লিখতেন, এবং নিউ মার্কেটে তাঁর বইয়ের দোকানটিকে মুখরিত রাখতেন নানান গল্পে। গোলাম রহমান আজ নেই, কিন্তু তিনি তাঁর লেখায় আছেন, অনেকের স্মৃতিতে আছেন, আছেন আমার ওই প্রথম বইতে।
বইতে প্রবন্ধ ছিল চৌদ্দটি। সব ক’টিই সাহিত্য-বিষয়ে। আমার প্রথম বই যে প্রবন্ধের হবে সেটা কি ছিল পূর্বনির্ধারিত এবং অবধারিত? না, তা ছিল না। আমি কখনো কবিতা লিখেছি বলে মনে পড়ে না, লিখলেও ছাপাই নি কোথাও, হাতে-লেখা পত্রিকাতেও নয়, কিন্তু আমি গল্প লিখতাম। গল্পই লিখতাম। ‘মুকুলের মহফিল’, ‘খেলাঘর’, কলেজ বার্ষিকী, নিজেদের উদ্যোগে প্রকাশিত হাতে লেখা পত্রিকা, ছাপানো লিটল ম্যাগাজিন, ‘মাহে নও’, ‘সওগাত’, দৈনিক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা এসব জায়গায় ছাত্রাবস্থায় আমি গল্পই লিখেছি, প্রবন্ধ নয়।
কিন্তু ছিলাম আমি সাহিত্যের ছাত্র, পরে হয়ে গেলাম সাহিত্যেরই শিক্ষক, যার ফলে আমার ভেতরে একটা অসন্তোষ গড়ে উঠলো নিজের লেখার ওপরে; মনে হতো ঠিক যেমন হওয়া উচিৎ ছিল তেমন হচ্ছে না, অন্য রকম হওয়া উচিৎ, অন্যধারার এবং উন্নত মানের। ওদিকে এই জ্ঞানও জন্মালো আমার ভেতর যে গল্প লেখার জন্য পর্যাপ্ত মূলধন আমার নেই। আরো অভিজ্ঞতা দরকার, দরকার আরো সঞ্চয়। আপাতত স্থগিত থাক এই লেখা, অভিজ্ঞতা জমুক, লেখার একটা নিজের মতো রীতি গড়ে উঠুক, তার পর আসা যাবে ফিরে, গল্প লেখা যাবে, উপন্যাসও। সেই সঙ্গে সাহিত্য যত পড়েছি ততই বুঝেছি সাহিত্যকে বিষয় করে অনেক কিছু রয়েছে লেখবার। এভাবে নেতিতে ইতিতে মিলে প্রবন্ধ লেখায় পেলো আমাকে। আমার বন্ধু মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ ‘পূবালী’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন, তাঁর সঙ্গে তখন আমার নিত্য যোগাযোগ, যার ফলে মূলতঃ সাহিত্য নিয়ে ‘ঢাকায় থাকি’ নামে একটি কলাম লেখা শুরু করলাম আমি ওই পত্রিকায়, ‘নাগরিক’ ছদ্মনামে। এরই মধ্যে বৃটিশ কাউন্সিলের দেওয়া একটি বৃত্তি পেয়ে দশ মাসের এক কোর্স করার সুযোগ হলো আমার, ইংল্যান্ডের লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে উইলসন নাইট ও আর্নল্ড কেটেলের বক্তৃতা শুনে নতুন করে নিশ্চিত হওয়া গেলো যে, সাহিত্যকে বিষয় করে প্রবন্ধ লেখার ব্যাপারটা নিতান্ত ফেলনা নয়। আমি প্রবন্ধই লিখতে থাকলাম, এবং লেখা প্রবন্ধের কয়েকটি বাছাই করে বের হলো আমার প্রথম বই ‘অন্বেষণ’।
বইয়ের নাম ‘অন্বেষণ’ কেন দিলাম? পেছনে তাকিয়ে দেখি ব্যাপারটা এখন আমার কাছে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে স্পষ্ট। সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ে কতগুলো মূল্যমান খুঁজছি, ভাবটা ছিল এই রকমের। কিন্তু আরো একটি অন্বেষণ ছিল ভেতরে ভেতরে। সেটা ছিল নিজের জন্য লেখার একটি রীতি। এই নিজস্বতাটা তখন খুবই জরুরী মনে হতো আমার কাছে, এখনো হয়। আবার এও অসত্য নয় যে, নিজেকেই খুঁজছিলাম আমি ওই পর্যায়ে। নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতে চাইছিলাম, লেখার জন্য রীতির অন্বেষণ এবং নিজের জন্য রুচি ও আগ্রহগুলোকে নির্দিষ্ট করাএকই ঘটনার এপিঠ-ওপিঠ বটে। বইয়ের একেবারে প্রথম প্রবন্ধটিই ছিল নিজস্বতার বিষয়ে। নাম ছিল তার ‘স্বাতন্ত্র্যের দায়’। বক্তব্য ছিল এই যে লেখক মাত্রেরই দায় রয়েছে স্বতন্ত্র হবার। তাঁর একটা নিজস্বতা থাকবে, যেটি দিয়ে তাঁকে যাবে চেনা, জানা যাবে যে ভিড়ের মধ্যে আরেকজন নন তিনি, একেবারেই আলাদা একজন।
কেন জরুরী মনে হয়েছিল বিষয়টি তার একটা কারণ বলি। আমি দেখছিলাম আমাদের আগের লেখক যাঁরা তাঁদের অনেকেরই লেখায়, বিশেষ করে গদ্যে, ব্যক্তি মনীষার স্বাতন্ত্র্যটা তেমন ধরা পড়ে না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে আমি নাগরিকতার লক্ষণ মনে করতাম। (আমার ‘নাগরিক’ ছদ্মনাম নেয়ার সেটিই হয়তো বড় কারণ।) ‘অন্বেষণে’র সবক’টি প্রবন্ধের মধ্যেই অন্তর্গত একটি সুর আছে, সেটি এই যে সাহিত্যকে নাগরিক হতে হবে। নাগরিকতার আরো দুটি গুণের কথা বলা আছে লেখাগুলোতে: একটি কৌতুকবোধ, অপরটি চলমানতা। সাহিত্যে চাই স্মিত হাসি, এমনকি সেই সব রচনাতেও যেগুলো বিষয়বস্তুতে যথেষ্ট গম্ভীর। রচনা কাছে টেনে নেবে পাঠককে, দূরে ঠেলে দেবে না। স্মিত হাসি ওই জন্যই প্রয়োজন, সে একটা প্রসন্নতা সৃষ্টি করবেই করবেএকেবারে ভেতর থেকে। আর চাই চলমানতা। সাহিত্য ভারি হবে না অনর্থক, গ্রাম্য হবে না বাহুল্যে। বক্তব্য ছিল এই রকমের।
স্বাতন্ত্র্যের শত্রু কে? একটি শত্রু সামন্তবাদ, অপরটি পুঁজিবাদ, যদিও এরা উভয়ে আবার জাত শত্রু একে অপরের। সামন্তবাদকে তখনো আমি তেমন ভাবে চিনি নি, এখন যেমন চিনি। কিন্তু সামন্ত সংস্কৃতি যে স্বাতন্ত্র্য সহ্য করে না, না-বোঝার কোনো কারণ ছিল না। সামন্তবাদ গদ্যেরও বিরোধী কেননা গদ্য হচ্ছে যোগাযোগের ভাষা, আর সামন্তবাদ তো তার নিজের গ-ির বাইরে যোগাযোগ পছন্দই করে না, এবং সম্পর্কগুলোকে একটি স্থবির বন্ধনে আবদ্ধ রাখে। কিন্তু পুঁজিবাদও যে স্বাতন্ত্র্য পছন্দ করে না সেও বুঝেছিলাম সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা থেকে যেমন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও তেমনি।
সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার কথাটাই আগে বলি। এক সময়ে উৎসাহের সঙ্গে আমি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘প্রেফেস টু দি লিরিক্যাল ব্যালাডস’ প্রবন্ধটি পড়েছিলাম। সেই লেখাতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ যিনি বিপ্লবের সূচনাকালেই এই আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছিলেন যে, গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে মানুষ যে শহরে আসছে তাতে একটি সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে যাতে ব্যক্তি আর ব্যক্তি থাকবে না, একটি স্থূল জনপি-ের অংশ হয়ে যাবে। শিল্প বিপ্লব কি কি করবে তখনো তো তা স্পষ্ট হয় নি, কিন্তু ওয়ার্ডসওয়ার্থ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন কি ঘটতে যাচ্ছে। তারপরে নিজে আমি ওয়ার্ডসওয়ার্থের দেশে গেছি যখন তখন বুঝতে বিলম্ব হয় নি যে, কতো সত্য ছিল ওই কবির আশঙ্কা। মানুষ ছুটছে, হাঁপাচ্ছে, পাগলের মতো আনন্দ খুঁজছে, কিন্তু একজন যে আরেকজন থেকে আলাদা তা বোঝা যাচ্ছে না। বরঞ্চ যতই চেষ্টা করছে আলাদা হবার ততই ধরা পড়ছে সত্যটা যে আসলে তারা একই রকমের।
আমার সহপাঠী ও বন্ধু আব্দুল বারি অনার্স পাশ করেই পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল পররাষ্ট্র দপ্তরে, ফলে অল্প বয়সেই আমেরিকা যেতে হয়েছিল তাকে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনে। আমেরিকা সম্পর্কে তখন অনেকেই অনেক কথা লিখেছেন ও বলেছেন, শুনেছি আমরা, কিন্তু বারি তার একটি চিঠিতে বলেছিল আমাকে নতুন কথা। বলেছিল, আমেরিকাতে তার ভয় লাগে। বিশেষ করে নিউইয়র্কের মতো শহরে গেলে। সেখানে সব কিছুই মস্ত মস্ত; দালানগুলো কতো উঁচু, ভিড় কতো প্রকা-, কিন্তু মানুষকে মনে হয় খুবই ছোট। চতুর্দিক থেকে মানুষের উচ্চতা খর্ব করার ষড়যন্ত্র চলছে যেন। আব্দুল বারি জীবিত নেই, ওর ওই একটি চিঠি যে আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল সেটা তাকে বলা হয় নি। নাড়া-খাওয়াটা বিলক্ষণ কাজ করেছিল আমার সেই ‘স্বাতন্ত্র্যের দায়’ প্রবন্ধটি লেখার পেছনে।
ওই প্রবন্ধে, এবং নানাভাবে বইয়ের অন্যত্র, বলবার বিষয়টা দাঁড়িয়েছিল এই যে, সাহিত্য মানুষকে স্বতন্ত্র করবে, কিন্তু কেবল স্বতন্ত্রই করবে না, সেই সঙ্গে আবার একও করবে, কাছে নিয়ে আসবে একজনকে অপরজনের, বন্ধন গড়ে তুলবে অনুভবের।
‘অন্বেষণে’ ‘সাহিত্য ও জাতীয়তাবাদ’এই নামেও প্রবন্ধ ছিল। এ প্রবন্ধ তখন লেখা। এখন কি ওই প্রবন্ধ লিখতে পারবো আমি? উত্তর হবে হ্যাঁ এবং না। পারবো, এবং পারবোও না। প্রবন্ধের নাম অবশ্যই হবে ভিন্ন, কিন্তু বক্তব্য থাকবে একই। সাহিত্যে আঙ্গিক থাকবে, রীতি রইবে, স্মিত হাসি থাকা জরুরী, চলমানতাও, কিন্তু সাহিত্যের অঙ্গীকার থাকবে মানুষের প্রতি। সেটাই প্রথম সত্য, অন্যসব সত্যের আগে। কেবল অঙ্গীকারে সাহিত্য নয় না, কিন্তু অঙ্গীকার না থাকলে কিছুই হয় না, যতই কেননা অন্য গুণগুলো থাকুক। ওই বক্তব্যে রদবদল হয়নি। কেবল ওটি নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি প্রবন্ধগুলো আবার পড়ে যে বদল হয়েছে কোথাও কোথাও, অর্থাৎ আরো স্পষ্ট হয়েছে বোধ আমার, কিন্তু রদ হয়নি প্রায় কিছুই। কেবল একটি ক্ষেত্র ছাড়া। সেও খুব বড় ব্যাপার নয়। এটি হচ্ছে ডন কুইকজটের মূল্যায়ন। খুবই সাধারণ ছিল বেচারা সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন। একেবারে প্রচলিত। পরে বুঝেছি আরও একটি দিক ছিল ওই মানুষটির চরিত্রে। সেটাই আসল। সেটি হচ্ছে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো। অন্যায়কে চিহ্নিত করতে গিয়ে ভুল করেছে সে বারম্বার; সেটা সত্য; কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যাপারে তার কোনো ভুল ছিল না। আপোষ করে নি, ছুটে গেছে লড়াই করতে। ক্ষ্যাপা এক ধরনের, এবং হাস্যকর অবশ্যই। কিন্তু ওই ক্ষ্যাপা মানুষরাই তো নানা পরিবর্তন এনেছে পৃথিবীতে। ডন কুইকজটের বিপরীত মানুষ হ্যামলেট। ন্যায়-অন্যায় বোধ দ্বারা সেও সর্বক্ষণ পীড়িত; তারও দায়িত্ব ন্যায়ের পক্ষে লড়বার। কিন্তু বড় বিষণœ সে, একাকী, বিচ্ছিন্ন। ডন কুইকজট ও হ্যামলেট দুই বিপরীত প্রান্তের মানুষ; কিন্তু কেউই অগ্রাহ্য নয়। এখন তো মনে হয় আমার পক্ষপাত বরঞ্চ ডন কুইকজটের দিকেই।
একটি সাহিত্যিক রচনার প্রাণ থাকে কোথায়? থাকে দ্বন্দ্বে। নানা রকমের উপাদানের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে, যার দরুন রচনাটি জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই ধারণাটি দেখছি তখনও ছিল আমার এখন যেমন রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কথাটা বলেছিলাম আমি। তবে ‘দ্বন্দ্ব’ শব্দটি ব্যবহার করি নি, দেখতে পাচ্ছি শব্দটি ছিল ‘সংঘাত’। বোঝা যায় ভা-ার তখন প্রশস্ত ছিল না।
সাহিত্যপাঠের নিত্য নতুন চাঞ্চল্যে তখন আমার মধ্যে প্রবণতা ছিল লেখকে লেখকে সমান্তরালবর্তিতা লক্ষ্য করার। এখন অতটা নেই, বুঝতে পারি যে এখন বয়স হয়েছে। সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে আমি এখন যতটা আগ্রহী, আগে ততটা ছিলাম না, সেটা বোঝা যায়; কিন্তু তখনও সাহিত্যকে আমি আলাদা করে দেখি নি সংস্কৃতি থেকে, যার খবর সব কয়টি প্রবন্ধ রয়েছে। আর ওই সমান্তরাল খোঁজা, সেটা ঘটেছিল বিশেষভাবে নজরুল ইসলাম সম্পর্কে আমার প্রবন্ধে। আমি একটা নিকটবর্তিতা লক্ষ্য করেছিলাম সুইনবর্নের সঙ্গে নজরুল ইসলামের। খুব ঘটা করে লিখেছিলাম সেটা, আমার আগে অন্য কেউ সেটি লক্ষ্য করেন নি। অনন্ত তখন আমার চোখে পড়ে নি। সুইনবর্নেও বিদ্রোহ ছিল, আর ছিল ছন্দাসক্তি, সুইনবর্নকেও লোকে অল্পবয়স্ক মনে করতো তাঁর চাঞ্চল্যের কারণে। এসব ছিল নজরুল ইসলামেও। আমি লিখেছি দেখছি নজরুল ইসলামের সম্পর্কে মিল্টনের সমান্তরালবর্তিতার কথাও। মিল্টন অনেক বড় কবি নিশ্চয়ই, কিন্তু নজরুল ইসলামের মতোই বিদ্রোহী এবং অঙ্গীকারবদ্ধ। কবিতা সম্পর্কে একবার তিনি বলেছিলেন তার হওয়া দরকার সরল, ইন্দ্রিয়ঘন ও আবেগপ্রবণ, যে বর্ণনা হুবহু মিলে যায় নজরুল ইসলামের কবিতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে। মিল্টনকে অষ্টাদশ শতাব্দী চিনতে ভুল করেছিল, কেননা তারা তাঁর বিদ্রোহটা দেখে নি, নজরুল ইসলামকেও চেনা যাবে না তাঁর বিদ্রোহকে বাদ দিয়ে।
ওই যে দ্বন্দ্বে আমার আগ্রহ তা শাহাদাৎ হোসেনের কবিতা সম্পর্কে লেখা আমার প্রবন্ধটিতে রয়েছে, দেখতে পাচ্ছি। যেমন এই অংশটিতে, “সাহসী কল্পনার ঐ বড় জগতে শাহাদাৎ হোসেন অনায়াসে চলে আসেন অনুপ্রেরণার ছোট সিঁড়ি বেয়ে। সে রাজ্যে তাঁর প্রবেশ অধীশ্বরের আভিজাত্যে। বিপরীতের সঙ্গে বিরোধের ভেতর দিয়ে টিকে থাকতে হয় নি বলে এ রাজ্যের শক্তি কখনো পরীক্ষিত হয় নিমন্দের সঙ্গে, কুৎসিতের মোকাবিলায় এই মহৎ ও সুন্দর কখনো সংঘর্ষে নামে নি বলে আমরা নিশ্চিন্ত জানি না এর ক্ষমতা কতটুকু। সে একটা দুর্বলতা সন্দেহ নেই।”
‘অন্বেষণে’র কালে আমার একটা আগ্রহ ছিল ধারণার সঙ্গে ধারণার পার্থক্য দাঁড় করানোতে। এতে প্রভাব যদি কারো পড়ে থাকে তবে কোলরিজের কবির নয়, সমালোচকের। খুবই মৌলিক সমালোচক মনে হতো আমার কোলরিজকে, এখনো হয়, যার মৌলিকত্বের বিশেষ প্রকাশ ঘটেছে ধারণার পৃথকীকরণে। যেমন তিনি ইমাজিনেশনকে আলাদা করেছেন ফ্যান্সি থেকে, জিনিয়াসকে ট্যালেন্ট থেকে, আমিও তেমনি চেষ্টা করেছিলাম ঐতিহ্যকে স্বতন্ত্র করতে উত্তরাধিকার থেকে। সে-চেষ্টায় ‘আমাদের সাহিত্যিক ঐতিহ্য ও নজরুল’ নামের প্রবন্ধটিতে আমি লিখেছিলাম, “ঐতিহ্যের সঙ্গে উত্তরাধিকারের একটা তফাৎ আছে। বাড়ীতে পিত্রার্জিত বই থাকাটা আমার উত্তরাধিকার, কিন্তু বই কেনা ও পড়ার অভ্যাসটা আমাদের বাড়ির ঐতিহ্য।’ দেখছি মতটা এখনও বদলায় নি। সাহিত্যের জন্য আমি বৈদগ্ধে বিশ্বাসী ছিলাম, কিন্তু হৃদয়কে বাদ নিয়ে নয়। কখনোই না। তবে হৃদয় বড় বিপজ্জনক প্রাণী, সে আবার ভাবালুও হয়ে পড়তে পারেসহজে। ওই ভয়ের কথাটাও আছে লেখাগুলোতে। খুব কম করে নেই।
শাহাদাৎ হোসেন বড় লেখক ছিলেন না। তবু তাঁকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে, যেমন মনে হয়েছে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলিকে, তাঁর সম্পর্কে প্রবন্ধ আছে বইতে। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর লেখায় স্ববিরোধিতা রয়েছে এই অভিযোগের জবাবে আমি বলেছি যে, যারা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল তাঁদের বক্তব্য অনেক সময়ে বদলায়, কেননা অভিজ্ঞতা নিজেই যায় বদলে, যেমনটি ঘটেছিল ইংরেজী সাহিত্যে এডম- বার্গের ক্ষেত্রে। আমার ওই বইয়ের শেষ লেখাটি মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে নিয়ে। তাঁকে আমি বুদ্ধিজীবী হিসাবে দেখেছি, যে অর্থে অলডাস হাক্সলি একজন বুদ্ধিজীবী। অর্থাৎ নানা বিষয়কে যিনি দেখেন প্রসন্ন বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে, এবং যা দেখেন অন্যকে জানান স্মিত হাস্যে।
‘অন্বেষণ’ যে আমার বই তা চিনবার আরো একটি উপায় আছে। সেটি মুদ্রণপ্রমাদ। আমার কোনো বই-ই মুদ্রণপ্রমাদমুক্ত নয়। এই বই-ও তাই। কারণটা আমি নিজেই। প্রুফ দেখতে চাই, এবং দেখতে গিয়ে আবার বদলাতে থাকি, ফলে গোলযোগ ঘটে যায়। বন্ধু গোলাম রহমানের দোকানে প্রুফ দিয়ে আসতাম, কখনো কখনো পৌঁছে দিতাম ছাপাখানাতেও। ছাপাখানার মালিকের নাম ছিল মীর হাসান আলী, তাঁর আইডিয়াল প্রিন্টিং ওয়ার্কস ছিল লক্ষ্মীবাজারের শেষ মাথায়; আমার স্ত্রী ছিলেন গে-ারিয়ার মেয়ে, স্ত্রীর সঙ্গে তার পিত্রালয়ে যাবার পথে ছাপাখানটি পড়তো, সেখানে থেমে প্রুফ দিতে পারতাম, ছাপা ফর্মার কপিও সংগ্রহ করা যেতো। মনে আছে প্রচ্ছদটি যেদিন ছাপা হয় সেদিন আমরা প্রেসে থেমেছিলাম, থেমে ছাপা প্রবন্ধটি দেখেছিলাম। প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, খুব পছন্দ হয়েছিল আমাদের সকলের, সবুজ ও গোলাপী মিলে বিন্যস্ত, দু’রঙ এক সঙ্গে মিলে আবার একটি তৃতীয় রঙেরও তৈরী করেছে। তা কয়েক বছর হবে, একদিন কাগজে দেখেছি মীর হাসান আলী মারা গেছেন। বড় দুঃখ পেয়েছিলাম। ভদ্রলোক ঠিক ব্যবসায়ী ছিলেন না, তাঁরও আগ্রহ ছিল সাহিত্যে। সেকালে ছাপাখানার এমন মালিক পাওয়া যেতো। পাইকা টাইপে ছাপা হয়েছিল বই। সেই সময়ে প্রবন্ধের বইয়ের জন্য ওই টাইপ খুব ব্যবহার করা হতো, এবং ভালো লাগতো, এখনো লাগে, তখনকার বই যখন দেখি।
বইটি উৎসর্গ করেছিলাম আমার পিতা ও মাতাকে। আমার পিতা ওই বইটি দেখে যেতে পেরেছিলেন এ আমার জন্য একটা সান্ত¦না কেননা পরের বছরই তিনি মারা যান, তখন আমি বিদেশে, আবার গেছি তথাকথিত উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখার তিন মাসের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন। ছেলে আর্টিকেল লিখে সময় নষ্ট করে দেখে তিনি সুখী ছিলেন না; কিন্তু আমার প্রথম বইটি হাতে পেয়ে খুশি হয়েছিলেন, এটা মনে আছে। সব কিছুকেই তিনি আর্টিকেল মনে করতেন, গল্পকেও।