সাহিত্যিক যে-ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন, সেটির প্রতি তার দায় থাকে। জননীকে অস্বীকার করে কেবল কুলাঙ্গার, মনুষ্যসন্তান নয়। যদি গর্ভধারিণী জননী, জননীতুল্য মাতৃভূমি এবং মায়ের ভাষাকে মূল্য দিই, তাহলে অবশ্যই দায়িত্ব থাকে দেশমাতৃকার প্রতি। প্রতিটি নতুন বছরের শুরুর দিকেই আমরা মুখোমুখি হই ভাষার মাসের, ফেব্রুয়ারির। যারা কিছুটা উদাসীনতার মেজাজে উপেক্ষার নির্বাসনে পাঠাতে চান সাহিত্যিকের কর্তব্যবোধ, তারাও একপ্রকার বাধ্য হয়েই বছরের সবচেয়ে হ্রস্ব মাস ফেব্রুয়ারিতে ভাষামুখী, সমাজমুখী হয়ে ওঠেন। তা ছাড়া, বিশ্বে অনন্য ও একক বিষয় তো রয়েছেই আমাদের, মাসব্যাপী একুশের বইমেলা। সাংস্কৃতিক এক মহা আয়োজন। সাংস্কৃতিক নবায়নেরও বটে। ফেব্রুয়ারি শেষ হতেই নিজেদের আবিষ্কার করি মার্চের মঞ্জিলে। বাপ-দাদাদের কেউ স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিলেও তার উত্তর প্রজন্মের প্রতিনিধির সাধ্যি কি মার্চকে অস্বীকার করা! আর মাত্র দুই দশকের মধ্যেই সব রাজাকারের আক্ষরিক তিরোধান ঘটবে পৃথিবী থেকে। তাদের বংশধরেরাও কি পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার প্রবাহিত রাখতে বাংলার বিরোধিতা করে যাবে? কৌশলের তো কমতি নেই। অহেতুক বিতর্ক চলবে, চালানো হবে। মার্চজুড়েই থাকবে ফোঁসফোঁস। যদিও প্রগতির গর্জনে তা চাপা পড়ে যাবে নিশ্চিত। যে-স্বাধীন দেশে সাহিত্যচর্চার সুযোগ পাওয়া গেল; সম্মাননা ও পুরস্কারের এত আয়োজন মিলল, সেই দেশের প্রতি কুর্নিশ করবে না কলম! এমনটা কি হতে পারে? স্বাধীনতার মাসের প্রথম দিনই এমন ভাবনায় আন্দোলিত হই।
সাহিত্যের বিন্দুমাত্র দায় নেই মাটি বা আকাশের প্রতি, মানুষ বা বৃক্ষসমাজের প্রতি- এমন ভাবেন কেবল নেশাগ্রস্ত কবিরাই। ‘নেশা’ মানে মাদক বোঝাচ্ছি না। মদিরা বা কঠিন পদার্থও নয়। কবিতার নেশার কথাই বলছি। অল্প নেশা জটিল, অধিক নেশা ভয়ংকর। যথাযথ নেশাই প্রত্যাশিত; তাতে নিজের তো নয়ই, অন্যের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না। আপনি যদি হন বাংলাদেশের মানুষ, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে আপনার কাছের বা দূরের কোনো আত্মীয় বর্বর পাকিস্তানি সৈনিকদের আঘাতে মারা পড়ে থাকেন, তাহলে আপনি যাই করুন না কেন, কবিতা লিখুন বা গল্প, কৃষিকাজ করুন বা হন চর্মকার, ঠিকাদার বা জমিদার- আপনার চিন্তাজগৎ ভিন্ন হতে বাধ্য। আপনি আত্মপ্রেম ছাপিয়ে পারিপার্শ্বের প্রেমে পড়বেন, ভালোবাসবেন এবং দায়িত্ব বোধ করবেন।
আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখছি, খুব সচেতনভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ ক’জন কবি লেখায়-আলোচনায়-প্রচারণায় এমন একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসী যে মাতৃভূমি ও সমকাল নিয়ে রচিত কবিতা কোনো কবিতাই নয়। নতুন পাঠক নিশ্চয়ই এতে বিভ্রান্ত হন। কবিতায় রাজনীতির বিষয়-আশয় উঠে এলে তাকে এককথায় স্লোগান বলে খারিজ করার প্রবণতাও দেখা যায়। নবীন পাঠক এতে প্রভাবিত হন। জীবনানন্দ দাশকে বুঝলে আগে অবশ্যই মানব যে কবিতা অনেক রকম। বিষয় বা প্রকাশভঙ্গি যেমনই হোক না কেন, একটি লেখা কবিতা হলো কি না, সেটাই আসল।
কবির কি কোনো নির্দিষ্ট দেশ থাকে? যে-ভাষায় তিনি লেখেন সে-ভাষাভাষী মানুষের প্রতি আলাদাভাবে তাঁর কি কোনো দায়িত্ব থাকে? মাতৃভূমির জন্য তাঁর কী কর্তব্য থাকে? এখানে উৎকীর্ণ তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের বহুমুখী জবাব মনে আসে, নতুন জিজ্ঞাসাও তৈরি হয়। সেই পর্যায়ক্রমিক প্রশ্নের আগমন, আর ক্রমাগত উত্তর অন্বেষণের জটিলতা আমরা এড়াতে পারি না। কবির নিজস্ব দেশ অবশ্যই থাকে, যদিও তিনি হতে পারেন বিশ্বনাগরিক, সেটাই কাম্য। একজন বড় মাপের কবি নিশ্চিতভাবেই হন সব দেশের, অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের কণ্ঠস্বর। যদিও একান্ত স্বদেশের আকাশমাটির স্বাদ ও অভিজ্ঞতা প্রচ্ছন্ন থাকে তাঁর রচনায়; দেশকে পাওয়া যায় তাঁর উপমা, চিত্রকল্পের প্রয়োগ-সংকেতে, আবেগের আঙ্গিকে, উচ্চারণ-ভঙ্গিতে। শুধু দৈশিক পরিচয় নয়, একজন প্রধান কবির লেখায় স্পন্দমান থাকে নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্যও। স্বদেশের সীমানার বাইরের কোনো ক্রিয়ায় শৈল্পিক সাড়া দিতে গিয়ে তিনি যখন সেই অঞ্চলের মানুষের অনুভূতির অংশীদার হয়ে ওঠেন তখনো শব্দে-ছবিতে তিনি ইশারা রেখে চলেন আপন বংশের, আপন ভূমির। কবি তুলে ধরেন সত্যের স্বরূপ, শেকড়ের বিবৃতি, নীলিমার বেদনা। অনুভূতির বৈচিত্র্যে ভরিয়ে তোলেন পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি। সত্য অন্বেষণ এবং অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার শিল্পিত প্রকাশ- প্রধানত এ দুটি তার আরাধ্য। প্রকৃত প্রতিভা তাই পরিণত হন দ্রষ্টায়, কল্যাণময় স্বাপ্নিকে এবং দ্রোহীর প্রতীকে। অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপিত করেন স্বগোত্রের মানুষকে। আর সজ্ঞানে বা অসচেতনভাবে সমৃদ্ধ করে চলেন মাতৃভাষাকে। সমাজ প্রায়ই কবির মর্ম বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়, উপেক্ষা করে তাঁর অনিবার্য প্রয়োজন। যদিও প্রকৃত কবি নিবেদিত থাকেন স্বকাল ও সমাজেরই কাজে। বাংলার কবির রচনায় যদি বাংলাদেশই না থাকে, বাঙালির স্বপ্ন ও সংকট না বিম্বিত হয়, তাহলে বাংলায় লেখা বলেই কি ওই কবিতাকে বাংলা কবিতা বলে মেনে নেয়া যায়? কবিকে বুকে টেনে বলা যেতে পারে- আমাদের কবি, বাঙালি কবি!
মাতৃভূমির জন্য কবির নিশ্চয়ই কর্তব্য থাকে। মাতৃভূমি বিপর্যস্ত নিষ্পিষ্ট বিদীর্ণ হতে থাকলে, এবসার্ড নাটকের উপাদানে উপহাসিত হতে থাকলে কবি নীরবতা পালন করতে পারেন না। কবি নিজে সংবেদনশীল শিল্পী, সংবেদনশীলতা জাগানোও তাঁর একটি প্রধান কর্তব্য।
শাহবাগের গণজাগরণ প্রত্যক্ষ করেছিল বাংলাদেশ এবং শাহবাগকে বিতর্কিত করে তোলার বা শাহবাগ বিতর্কিত হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত এমন একটি স্বপ্ন-প্রতিজ্ঞায় আন্দোলিত হয়েছিল দেশের সব শ্রেণির সব পেশার মানুষ, যা স্বাধীনতার পর আর দেখা যায়নি। একাত্তরের বাংলাদেশের হৃদয়ের আলোকশিখার সঙ্গে কিছুটা তুলনা দেয়া যায় ২০১৩ সালের শাহবাগের নবজাগরণকে। গজদন্তমিনারবাসী কবিও আন্দোলিত হয়েছিলেন শাহবাগ-শিহরণে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে জরুরি হলো যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায্য শাস্তি দেয়া। সেখানে সামান্যতম আপস কাম্য হতে পারে না। শাহবাগ, স্পষ্ট করে বললে বাংলাদেশ, জ্বলে উঠেছিল রাজাকারদের ছাড় দেয়ার আশঙ্কায়। পরিণতি সবার জানা। বদল হয়েছিল বিচারকের রায়। কিন্তু শাহবাগের গূঢ় গহন গভীর শক্তিকে আমরা কাক্সিক্ষত স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে পরিচালিত করতে পারিনি। প্রতিটি ফেব্রুয়ারি ও মার্চ এসে আমাদের আপন মুকুরে মুখ দেখার আহ্বান জানায়। যদি সাহিত্যিক হয়ে থাকি, তবে সাহিত্যের দায় বুঝে উঠতে প্রেরণা জোগায়।
সাহিত্যের জন্য সাহিত্য নয়, মানুষের জন্য সাহিত্য- এই মন্ত্র যদি অস্বীকার না করি তাহলে মানুষের সার্বিক মুক্তির উদ্যোগে সাহিত্যকেও যুক্ত করতে হবে। সত্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে কলমের ভূমিকা কখনো হতে পারে মশাল, কখনো লাঙল; যে-লাঙলের ফলায় স্বদেশভূমির সুপ্ত রত্নরাজি উঠে আসবে আলোয়। কালজয়ী সব বাঙালি সাহিত্যিকই ছিলেন মানবমুক্তির পক্ষে। তাঁরা সাহিত্যের দায় সম্মন্ধে সজ্ঞান ছিলেন। তাহলে আজকের প্রজন্মের সাহিত্যনিষ্ঠদের কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশিত সম্পদ লাভে কেন বঞ্চিত থাকব।
একাত্তরে দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের সপক্ষে অবস্থান নিয়ে। অস্ত্র হাতে লড়া মুক্তিসেনার তুলনায় বহুগুণ মানুষ হাতে অস্ত্র বিনা অন্তরে ধারণ করেছিলেন সেই চিরকালীন সম্পদ, যা যুদ্ধকালে হয়ে উঠেছিল পরম অস্ত্র, যার বিশুদ্ধ নাম দেশপ্রেম। তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল শত্রুমুক্ত করে দেশকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা। করোনাকালে আরেকটি মার্চ এসে আমাদের সেসব গৌরবদীপ্ত অধ্যায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। সেইসঙ্গে প্রত্যাশা করছে সাহিত্যসৃজনেও সঞ্চারিত হোক দেশপ্রেমের সাহস, শক্তি, সৌন্দর্য এবং মহিমা।