অশ্রুধারিণী
আমাদের চোখগুলি
যেন এক একটি স্বচ্ছ স্ফটিক!
বিন্দুবিন্দু অশ্রুকণায় কী ভীষণ প্লাবণ!
প্রতিবিন্দু নোনাজলে ধরে রাখা
এক বুদ্ধিদীপ্ত শক্তিমত্তার মহিমান্বিত সৃষ্টিশীলতা !
যার জোড়ে তাতালো ইস্পাতে জেগে ওঠে
মৃত সব নগর, সভ্যতার কবর!
আমাদের কান্নারা স্বচ্ছ অশ্রুধারায়
নিশ্চিত গিয়ে মেশে অনন্ত সাগরে,
কখনো লুকিয়ে থাকে টুকরো বরফের মাঝে,
কিংবা ফুটন্ত কড়াইয়ের জলে
দৃষ্টির আড়ালে।
অনন্য সৃজনশীল অশ্রুধারিণী সব চোখ!
চোখের কোলে কাজলের ভাঁজে
যেন এক নান্দনিক মায়ার খেলা!
উদ্গীরণেই দৃশ্যমান বিরামহীন পূনর্ভবা -
যেন ‘গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল’!
ছিটকে পড়া দৃষ্টির ক্ষয়িষ্ণু শক্তিমত্তায়
স্ফটিক-স্বচ্ছ চোখের শুদ্ধ-প্রবাহে অশ্রুর বন্যা!
তাতেও প্লাবিত হয় না আর নিঃসীম মহাসাগর।
এমনকি তড়িৎচুম্বকীয় বিজ্ঞান বলয়ের যাদুকরী চমকেও
তখন আর কোনোই কল্যাণীশক্তির নির্নিমেষ উন্মেষ ঘটে না!
নিথর পাথুরে পর্বতমালাও আর নড়ে ওঠে না
জলে ভাসা ফাঁপা কাষ্ঠদ-ের মতন!
এক অনন্য সৃজনশীল অশ্রুধারিণী এইসব চোখমালা,
কাজলের ভাঁজে ভাঁজে
এক নান্দনিক মায়ার অবিরাম পূর্ণোদ্গীরণ
আমাদের সম্মিলিত প্রসব বেদনায়
তেতে ওঠা ইস্পাত
জেগে ওঠা মৃত নগর,
সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ!
পুলসিরাত!বেঁচে থাকাটা চাট্টিখানি কোনো কথা নয়।
সমস্ত অস্তিত্বের জানান দিয়ে
তবেই বেঁচে থাকতে হয়।
বেঁচে থাকতে হয় অনেকটাই
কাঠবেড়ালীর ক্ষিপ্রতা আর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে,
অদম্য-চঞ্চল, ব্যাকুল সে বেঁচে থাকা!
বেঁচে থাকতে হয় নিজস্ব ঘড়ি আর ঘুড়ির সীমানাতেই -
যা কিছু স্পর্শ আর সাধ্যের অতীত ও প্রতিকূল-
তাকে মাড়িয়েই সার্থক বেঁচে থাকা!
যেন সমস্ত অস্তিত্বের আঙ্গিনা জুড়েই
জীবন ও জীবিকার পূর্ণ লেহন।
বেঁচে থাকাটা কি আর চাট্টিখানি কথা?
একে অবজ্ঞা করতে নেই।
যতটা সম্ভব, যতখানি সম্ভব
পেন্ডুলামের শেষ সীমান্তটুকু ছুঁয়েই বাঁচতে হয়।
যদিও তোমার হাত বাঁধা থাকে আড়মোড়া পেছনসমেত,
আর পিঠ ঠেকে আছে দেয়ালের গায়ে,
কিংবা লাশকাটা ঘরে
সফেদ এপ্রোন আর নিরাপত্তা গগলসের আড়ালে
মৃত্যুর পরিসংখ্যান গুণে গুণে স্বাস্থ্যকর্মীর বেশে!
জীবন-মৃত্যুর তোয়াক্কাহীন তোমার নিরন্তর পদচারণায়
অবশেষে তাহাদের পায়ের নিচে,
মাস্কে ঢাকা অচেনা সব মুখম-লের খুব কাছে
তুমিও অমর হলে!
তোমাকে কে কী মাল্য দেবে বলো?
অথচ তুমি তো জানতেই,
বেঁচে থাকাটা কতটা প্রয়োজন, কতটাই না আরাধ্য,
কতটাই না শুচিশুভ্রসৌন্দর্যের পরিচায়ক!
চঞ্চুর একাগ্রতায় কী ভীষণরকম প্রবলভাবে
বেঁচে থাকাটাই যেন আসল!
আর সব মিছে।
তখন সত্তরে এসেও মানুষ বীজ বোনে
জলপাই চারায় দিনরাত পানি ঢালে!
বেঁচে থাকাটা তখন আর শুধু সন্তানের বুকে বুক ঘষার
স্বপ্ন-কল্প-আনন্দ-অপেক্ষা নয়,
বেঁচে থাকার মূল কারণ হলো মরণ!
মরণ- যাতে তোমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাসই নেই
আর তাকেই তুমি ভয় পাও সবচেয়ে বেশী!
কারণ, বেঁচে থাকাটা নিশ্চিতভাবেই মৃত্যুর চেয়ে উত্তম
অধিক গুরুত্ব বহনযোগ্য এক অমোঘ অভিলাষ।
* নাজিম হিকমাতের জন্ম ১৯০২ সালে অটোমান সাম্রাজ্যে যেটা আজকের গ্রীস। তিনি মূলতঃ তুর্কী ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। নাজিম ছিলেন প্রচণ্ড আবেগী একজন লেখক, রোমান্টিক বিপ্লবী কমরেড হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তাঁকে বহুবার কারাভোগ করতে হয়েছিল বা নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী পঞ্চাশটিরও বেশী ভাষায় তাঁর কবিতা অনুদিত হয়েছে। ১৯৬৩ সালে মস্কোতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।