চীন দেশের চিত্রকলা প্রভাবিত ধ্রুপদী ধারার নিসর্গ-ভিত্তিক কাব্যধারা ‘শানশুই শি’ নামে পরিচিত। এ ঘরানার কবিতাকে কোন কোন ক্ষেত্রে নদী ও পাহাড় ভিত্তিক কবিতা বলেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। শানশুই শি ট্র্যাডিশনের শুরুয়াত হয় খৃষ্ট পরবর্তী চতুর্থ শতাব্দীতে। সূত্রপাত থেকেই এ শৈলীর কাব্যকলার একটি প্রধান বৈশিষ্ঠ হচ্ছে, নিসর্গের সাথে আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপট থেকে কাব্যকলাকারদের মিথস্ক্রিয়ার পরিমিত বয়ান। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণজাত চিত্রময় বর্ণনায় সচরাচর প্রাধান্য পায় বনানী,পাখি, মেঘ, শিলাপাহাড়, নদী ও পুষ্প। এ সব বিষয় কখনো বিধৃত হয় প্রতীক হিসাবে, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নিসর্গের নির্মোহ বিবরণে প্রতিভাত হয় প্রতিফলন।
ধ্রুপদী জামানায় চীন দেশে কবিতা লেখা হতো খাগের কলম দিয়ে চিত্রকরের নিষ্ঠায় ক্যালিওগ্রাফি করে। কবিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সফল রাজনীতিবিদ ও সমাজ-গুরু। কবিরা স¤্রাটের দরবারে কাজ করাকে সামাজিক কর্তব্য বিবেচনা করতেন। তবে ব্যক্তিগত জীবনে তাঁরা ছিলেন তাও-বাদী ‘চ্যান’ বা ধ্যান মার্গের নিষ্ঠাবান পথিক। কবিরা সন্ন্যাসী কিংবা শ্রমণ ছিলেন না, তবে ভ্রমণ ভালোবাসতেন, এবং সফরে বৌদ্ধ মনেস্টারীর সরাইখানায় বাস করা পছন্দ করতেন। প্রায় সকলেই চ্যান বা ধ্যান-মার্গের শ্রমণ-গুরুদের কাছ থেকে পেতেন ধ্যান অনুশীলনের যথাযথ দীক্ষা। ফলশ্রুতিতে- সংখ্যায় সামান্য কয়েকজন কবি জীবনের অন্তিম লগ্নে গৃহ ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন।
তবে এ ধারার কবিদের সংখ্যাগুরু অংশ- ধ্যান মার্গের অনুশীলনের পাশাপাশি পালন করতেন দারাপুত্র পরিবার নিয়ে সংসার। তাঁদের গৃহের একাংশে ছিলো হাতে লেখা পান্ডুলিপির সামহারে সমৃদ্ধ গ্রš’াগার ও ক্যালিওগ্রফি কিংবা চিত্রদি অংকনের ব্যবস্থা। সমাজের উ”চবর্গের নাগরিক, রাজ দরবারের কূটকৌশলে সুদক্ষ এ ট্র্যাডিশনের কবিরা জীবনের এক পর্যায়ে সমাজ থেকে দূরে প্রকৃতি নিবিড় পরিবেশে বসবাস করে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিফলন করতেন। তখন তাঁদের দিনযাপনে প্রধান হয়ে ওঠতো ধ্যান, বাগিচা ভিত্তিক পুষ্প চর্চা, ওয়াইন পান ও নিসর্গ পর্যবেক্ষণ।
এখানে শানশুই শি ট্র্যাডিশনের তিন জন প্রধান কবির সাতটি কবিতার ভাবানুবাদ সংক্ষিপ্ত বায়োসহ উপস্থাপন করা হচ্ছে। কবিতাগুলো ধ্রুপদী যুগের চীনা কাব্যধারার খ্যাতনামা পন্ডিত ডেভিড হিনটনের ইংরেজীতে অনুদিত ‘মাউন্টেন হোম: দ্য উইল্ডারনেস পোয়েট্রি অব অ্যানসিয়েন্ট চায়না’ নামক গ্রš’ থেকে চয়ন করা হয়েছে। শানশুই শি ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপট সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্য সান নামক একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিক ডেভিড হিনটনের একটি সাক্ষাৎকার থেকে।
তাও শিয়েন
-----
কবি পরিচিতি: কবি তাও শিয়েন (৩৬৫- ৪২৭ খৃষ্টাব্দ) এর জন্ম হাল জামানার জুইঝিয়াং অ লে। পেশাগতভাবে কবি কাজ করতেন চীন দেশের রাজকীয় সরকারে। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে চাকুরী ত্যাগ করে তিনি বেছে নিয়েছিলেন নিজ গ্রামের নিরিবিলিতে সমাজ-বি”িছন্ন জীবন। তাঁর কবিতাগুলো রচিত হয়েছিলো পাড়া-গাঁয়ের নির্জনে বসবাসের সময়।
পান করি ওয়াইন
দিন কয়েক হলো- বাস করছি আমি একটি গ্রামে- নিরিবিলি
দূরে তুষার ছাওয়া পাহাড়,
চূড়ায় রুশনির তবকে মোড়ে যেন তৈরি হয়েছে পানের অলীক খিলি,
ঘোড়ার গাড়ির কোলাহলে পূর্ণ সরণি থেকে বহু দূরে
মাঝেসাজে ভাবি- এটা সম্ভব হলো কীভাবে,
বসে আছি এমন নিস্তব্ধতা ছড়ানো নিঝুম পুরে
তৈরী হয় মৃদু আ”ছন্নতা মহুয়া জারিত মদের প্রভাবে।
মনে তৈরী হলে বি”িছন্নতা- নিজের অজান্তে বাড়ে দূরত্ব
মেঘমালায় ঝলসে ওঠে শেষ বেলাকার সুরুজের শিখা,
সাঁজের আগে-পুব দিকের বেড়ার কাছ থেকে তুলি চন্দ্রমল্লিকা;
আর উত্তর দিকে তাকাতেই ফের ভেসে ওঠে সুদূরের পর্বত
খেলছে চমৎকার দখিনা হাওয়া গোধূলিতে,
দিকচক্রবালে ফাগ ছড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে অরুণ কুমারের রথ
পাখিরা ফিরছে কুলায়- শিহরিত হই মৃদু শীতে।
তাবৎ কিছু ছড়ায় গাঢ় তাৎপর্য- অর্থবহ.. নিবিড়.. নিরংকুশ,
সান্ধ্য-কুসুমের সৌরভ ছড়ানো হাওয়ায় ভরে ওঠে ফুসফুস।
যখনই আমি ব্যাখ্যা করতে যাই
বলতে চাই - এ অভিজ্ঞান দারুণ খাসা,
মদির আবেশে আ”ছন্নতা বাড়ে
আমার মুখে যোগায় না যথাযথ পরিভাষা।
ছড়া নদীর পাড়ে
এবারকার নববর্ষে ভাবি -
খুঁজতে খুঁজতে বিত্ত ও বিক্রমের চাবি,
কীভাবে যেন কেটে গেলো প াশটি বছর,
দিনযাপনের চলিষ্ণু প্রবাহ নিয়ে তর্পণে
মনে হয় - থিতু হওয়া গেলো না
ঠিক মতো বাঁধা হলো না ঘর।
বিষয়টা নিয়ে কেবলই ভাবি
পুরো ভোর-বিহান ধরে,
তাজা হাওয়ায় নেই নিঃশ্বাস
পরি”ছন্ন ঝকঝকে নিঃসীম আকাশ,
জানালা দিয়ে মৃদু হাওয়া ঢুকছে ঘরে।
সুহৃদরাও এসেছে আজ
তাদের নিয়ে বসাই মজলিস
ছড়া নদীর পাড়ে- ঘাটলায়,
অযথা ভাবনা কিছু নেই-নেই কোন কাজ
শ্যাওলা ভাসিয়ে মৃদু স্রােত বয়ে যায়।
বহতা জলে রোদের রেখাচিত্রে ছলকায় ঝিলমিল
উপত্যকার আকাশ জুড়ে চক্রাকারে ভাসে চিল,
তার ধারালো চোখ দুটি কিছু খুঁজছে- দূরের জলধি
দেখি- পাহাড়ের ওপারে পাহাড় ছড়িয়ে আছে
দিগন্ত অবধি।
বুঝিবা সাধকের হৃদয়ে কৈলাশ পর্বতের রূপরেখা
উপমিত হয় না সঠিক,
আমার মানসে এ মুহূর্তে যা দিচ্ছে দেখা
কুহু স্বরে ফুকারে কৃষ্ণাভ পিক;
সোরাহী থেকে আমি ঢেলে দেই পেয়ালায়
কে জানে ঘটবে কী আজ
নদীতীরের এ নিরালায়,
এমন দিন ফিরবে কী আর কখনো
হৃদয় উড়ে দূর অজানায়,
কল্পনা হয়ে ওঠে বন্য।
জানি- সুনির্দ্দিষ্ঠ লক্ষ্যে আমি কখনো ছুড়িনি তীর
হতে চাইনি নিষাদ,
ভেদ করতে পারিনি তিমির,
পান করি- বিস্মৃত হই শত যুগের সহ¯্র বিষাদ।
আগামিকাল হয়তো বিপন্ন হবো অনাগত কোন সন্ত্রাসে,
চিন্তিত হই না-
মেতে ওঠি আজ ভোরে-বিহানের অনাবিল উল্লাসে।
ওয়াং আন-শিহ
-----
কবি পরিচিতি: কবি ওয়াং আন-শিহ (১০২১- ১০৪৬ খৃষ্টাব্দ) এর জন্ম লিনচিয়ানে। পেশাদার রাজনীতিবিদ, স্যাঙ বংশের রাজত্বকালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পালন করেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য কবি ছিলেন ইতিহাস খ্যাত। গ্রামের প্রকৃতি নিবিড় পরিবেশে কবি অবসর জীবন কাটান। তখন নিসর্গ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি নিজেকে নিয়েজিত করেছিলেন কবিতার অনুশীলনে।
মন্ত্র
জানালা গলে কামরাতে ঢুকে পড়ে ভোরের আলো
বই এর পাতা মুড়ে আমি ঢলে পড়ি ঘুমে,
স্বপ্নে দেখি জল বাড়ছে দহে
পাহাড় চূড়ার মন্দিরে বাজছে ঘন্টা ধ্বনি,
মন আমার ভরে ওঠে সংবেদনশীল আবহে,
গুহার গভীরে ঝলসায় রত্নময় খনি;
অসফল উদ্যোগ ও অপমান অঙ্গে ধারন করে
কীভাবে বয়োবৃদ্ধ হও তুমি?
ছেড়ে যাবে একদিন- চিরায়ত নয়
পায়ে নিচে শিশির ভেজা দূর্বাঘাসে সবুজ ভূমি,
দাঁড়াও এসে- শিলাপাহাড় কেটে
ধাপে ধাপে নেমে আসা প্রপাতের সোপানে-
জলছোঁয়া হিমেল হাওয়া এসে জুড়াক তোমার দেহমন,
ভরে উঠুর অন্তর নিসর্গ নীলিমার নিবিড় ধ্যানে।
সর্বশেষ কবিতা
এ রকম বয়োবৃদ্ধ হওয়াতে আমোদ কিছু নেই
নেই কোন আনন্দ,
দিনযাপনের বহতা সুর থেকে যেন কেটে গেছে ছন্দ।
এর চেয়েও খারাপ হচ্ছে-
বিছানায় চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে থাকা,
অদৃশ্য কালিতে ক্রমাগত স্মৃতির ছবি আঁকা;
তাই নদীতীরে আসি আমি - স্পর্শ করি জল
ঘুরে বেড়াই বাগিচায় বিন্যাস করি ফুলদল,
আকাশ..প্রান্তর ও সমুদ্রে খুঁজি বেঁচে থাকার ছল;
পাপড়ির বর্ণে রঞ্জিত হয়ে ওঠে হৃদয়মন
সৌরভ মথিত করে তুলে মুহূর্ত আমার,
যতেœ সিরামিকের ডিশে গড়ে তুলি ফুলবন
আসবে হয়তো দখিনা হাওয়া- খুলে রাখি দুয়ার।
আমার মেয়াদ আর কত দিন
দৃষ্টি ক্রমশ হয়ে আসছে মলিন
তুলেছি ফুল- তৈরী করেছি পাপড়ির বরোজ,
পরষ্পরকে ভুলে যাওয়া হবে কী সহজ?
ইয়াং ওয়ান-লি
-----
কবি পরিচিতি: কবি ইয়াং ওয়ান-লি (১১২৭-১২০৬ খৃষ্টাব্দ) এর জন্ম জিশুই অ লে। পেশাদার রাজনীতিবিদ এ কবি একাধিক স¤্রাট ও প্রধানমন্ত্রীদের পরামর্শক হিসাবে রাজদরবারে কাটান তাঁর জীবনের ব্যাপক সময়। ব্যক্তিগত জীবনে কবি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের চ্যান বা ধ্যান-মার্গের অনুসারী। তাঁর কবিতায় সচরাচর উদ্ভাসিত হয় ধ্যান-লব্দ উপলব্দি।
সরোবরে নৌকা
সরোবরের দূর কিনার ঘেঁষে জেলে
তার নাওখানা বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে,
বয়স্ক চোখ আমার অনুসরণ করে
বৈঠার তাড়নে সৃষ্ট জলরেখা।
আমার দৃষ্টির অস্ব”ছ গিলাফে মাঝি অদৃশ্য সুতোয়
বুনে দিচ্ছে জলজগুল্মে ভরা পথরেখা,
হঠাৎ করে মনে হয়-
নলখাগড়ার ডগায় বসে জলচর পাখি এক
সাবধানে রক্ষা করছে ডানার ভারসাম্য।
রাতের বৃষ্টি
শিলাপাহাড় কেটে বয়ে চলা নদীটির পরি”ছন্ন আকাশ
ভরে ওঠে ঝড়ো বৃষ্টিতে,
মনে হয় শত সহ¯্র মুক্তা যেন ঝরে পড়ছে সিরামিকের খু ায়,
ধারালো টিক-টাক টিক-টাক শব্দপুঞ্জ
কেটে কেটে বসে যায় আমার হাড় ও করোটিতে।
স্বপ্নে মাথা চুলকে আমি জেগে ওঠি
ভোর অব্দি শুনি- কেবলই শুনতে থাকি
বেজে ওঠা শব্দমালার মধ্যবর্তী নীরবতা।
সারা জীবনভর শুনছি আমি বৃষ্টিপাতের শব্দ
চুল আমার হয়ে ওঠেছে ধূসর,
তারপরও পারিনি ভেদ করতে
রাতের নদীজলে ধারাপাতের বিপুল রহস্য।
প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ
ঘাস ধামসানো গরুচরা মেঠোপথের
এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে খরগোশের গাতাগর্ত
আমার সামনে খোলা এক বিশাল তেপান্তর
চারদিকের ধূ ধূ আকাশে ছড়ানো বিপুল শূণ্যতা
জোড়া সারসের উড্ডয়ন উদ্যোত সফেদ ডানায়
আমার ভাবনা মিশে যায়
উড়ে যায় অজ¯্র পাহাড়ের নীলাভ রেখা ধরে
পর্বত সারির চূড়োগুলো পেরিয়ে- ধবল মেঘমালার ওপারে
আরো অফুরন্ত পাহাড়ে-
আমার দৃষ্টি ঘুরে ফেরে
সন্নিকট থেকে চলে যায় সীমাহীন সুদূরে
ভীড় করে কাছাকাছি এসেছে অনেকগুলো গিরিশৃঙ্গ
আবার মেঘমালায় ভাসছে একাকী একটি চূড়ো
চেয়ে থাকি আমি-
কেবলমাত্র একটি পাহাড় কিংবা উপত্যকা
ভাবনা অতিক্রম করে যায় জানার রাজ্যপাট
দিগন্তে তাকিয়ে থেকে থেকে মনে হয়
ছনি-পড়া বয়োবৃদ্ধের চোখ রূপান্তিরিত হচ্ছে
শিশুর বিষ্ময়ভরা দুটি নয়নে।