ছাব্বিশে মার্চ থেকে শুরু হয়েছে সরকার ঘোষিত ১০ দিনের ছুটি। ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে জরুরী কাজে সংযুক্ত আরো অনেকের মতো সংবাদকর্মীদেরও ছুটি নেই। অফিস সিএনজি পাঠাচ্ছে কর্মীদের অফিসে আনা ও বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। ঘর থেকে বেরুনোর আগে ব্যালকনি থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম ময়লা সংগ্রহকারী তরুণটি যথারীতি কাজ করছে তার ভ্যান নিয়ে। তার মুখে মাস্ক নেই, হাতে নেই দস্তানা। একটু পরই সবজিঅলার ভ্যান এলো, হাকডাক শুরু হলো। দু’একজন গৃহিণী দরদাম শুরু করলেন ওই ব্যালকনি থেকেই। সে যাক, বের হলাম অফিসের উদ্দেশে। রাস্তাঘাট একেবারেই সুনসান। কেবল পুলিশ আছে টহলরত। আর্মির একটা গাড়িও দেখা গেল। এই পুলিশ-আর্মি তো কাজে নেমে গেছে কোভিড-১৯-এর ভয় দূরে সরিয়ে রেখে। স্বাস্থ্যকর্মীরাও কি ঘর থেকে বের হননি! গ্যাস, পানি ও বিদ্যুত সরবরাহের সঙ্গে যারা নিয়োজিত, তারাও তো কাজে গেছেন। এদের কথা আমরা কয়জন ভাবি? পিএম অফিসের সামনে প্রায় গোসল হয়ে যাচ্ছিল। মোটা পাইপে ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত পানি ছিটানো হচ্ছে রাস্তায়। জেনেছি বহু জায়গায় গাড়ির মাধ্যমে ছিটানো হচ্ছে এই জীবাণুধ্বংসী তরল।
আমাদের ঢাকাবাসী এখন ঘরে বসে টিভি দেখছেন, ফেসবুকে রাজাউজির মারছেন। তবে গৃহিণীদের কথা আলাদা। তাদের বেশির ভাগই এখন বুয়াহারা, মানে গৃহকর্মী ও পাচিকাহীন। তাই সংসারের প্রতিটি কাজ তাকে করতে হচ্ছে। ছুটির কারণে যে পুরুষটি এখন ঘরবন্দী তিনি মাত্র ৩০ মিনিট তার ঘরনীর দিকে চোখ রাখুন। বুঝে যাবেন সংসারে কতশত ধরনের কাজ রয়েছে। আমি নিজে ঘরে থাকার সময়ে এটাসেটা কাজে গৃহিণীকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তিনি নিরুৎসাহিত করেছেন। বলাবাহুল্য এটি প্রায় সব বাঙালী গৃহিণীরই মনমানসিকতা। তারা স্বামীকে দিয়ে পারতপক্ষে ঘরের কোন কাজ করাতে চান না, এক ধরনের সঙ্কোচ কাজ করে যাতে মেশানো থাকে মমতা ও মা-খালা-নানি-দাদির কাছ থেকে পাওয়া সংস্কার। অথচ বিদেশে গিয়ে দেখেছি বাঙালী নারীদের পরিবর্তন। পুরুষরাও বদলে গেছেন। বিদেশেই কেবল ঘরের কাজের সুষম বণ্টন রয়েছে।
ঢাকার দিনরাত এখন একাকার হয়ে গেছে। সব জায়গার ছবিই এক। তবে মীরপুরের তোলার বাগ, মোহাম্মদপুরের একটি এলাকা এবং আরও দু’এক জায়গার খবর বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। তবে সে কথায় যাবার আগে সংবাদপত্র নিয়েই দু’একটা কথা বলতে চাই। এখন অফিস-আদালত বন্ধ, তাই সেসব স্থানে পত্রিকা বিলি হবে না। কিন্তু আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর পরিস্থিতি কি? আমি যেটায় ভাড়া থাকি সেই বহুতল ভবনে একমাত্র আমিই সংবাদপত্র রেখে আসছিলাম। অন্যরা মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমারটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল হকার দেশের বাড়ি চলে যাওয়ায়। দু’একজন বন্ধুর প্রাসঙ্গিক অনুভব না বললেই নয়। আমার প্রাক্তন সহকর্মী যুগান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান আসিফ রশীদ বললেন- বাসায় বিলি-বণ্টনের ব্যবস্থা নেই, রাস্তায় হকার নেই, স্টলগুলো বন্ধ। তবু আমরা পত্রিকা বের করে চলেছি। এর চেয়ে আহাম্মকি আর কী হতে পারে! আরেক স্নেহভাজন, দৈনিক দেশরূপান্তরের দায়িত্বশীল পদে কর্মরত মাহবুব মোরশেদ লিখলেন, পত্রিকাগুলো হাতে নিয়ে সকাল বেলা মন খারাপ হয়ে গেল। ২৪ পৃষ্ঠার পত্রিকা ১২ পৃষ্ঠা হয়ে গেছে। ২০ পৃষ্ঠার পত্রিকা ১২ কিংবা ১০ পৃষ্ঠা হয়ে গেছে। ১২ পৃষ্ঠার পত্রিকা ৮ পৃষ্ঠা হয়ে গেছে। একটা পত্রিকা প্রিন্ট বন্ধ করে শুধু অনলাইনে চলে গেছে। সামনে হয়ত আরও সঙ্কুচিত হবে পরিসর। সন্দেহ, দূরত্ব, অস্পৃশ্যতা, অবিশ্বাসের নতুন যুগে ঢুকে পড়লাম আমরা। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে কুড়ি বছর পর যে বাস্তবতা দেখার কথা ছিল সে বাস্তবতা হয়ত এ বছরই দেখতে পাব।
যা হোক, ঢাকার ছবি বদলে গেছে। আরেক স্নেহভাজন, নামকরা পত্রিকার উঁচুপদে কর্মরত একজন লিখলেন, ‘পান্থপথে দেখলাম, র্যাবের গাড়ি। সামনে শ’ খানেক মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, ঘটনা কী। কারওয়ান বাজারে ন্যায্যমূল্যের ট্রাক। গায়ে গা লাগিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ কেনাকাটা করছে। আমার ভয় হচ্ছে, এই যুদ্ধ ভয়ঙ্কর রূপ নিতে যাচ্ছে। আমরা সংক্রমণ ঠেকাতে পারব না। কেউ কথা শোনে না। কালকে টিভিতে দেখাল, সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে মানুষ বেরিয়েছে বাসায় থাকতে ভাললাগে না বলে। যাদের বাড়ি নাই, তাদের কথা আলাদা। গ্রামের বাড়িতে সকালে উঠে গরুগুলোকে খাওয়াতে হবে, মুরগিগুলোকে খেতে দিতে হবে, তাদের জীবনপ্রণালি আইসোলেশন, সামাজিক দূরত্ব মানবে না।
মোহাম্মদপুর ও
টোলারবাগে ভবন কোয়ারেন্টাইন
টোলারবাগে একটি ভবনের একজন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর ভবনের বাসিন্দাদের হোম কোয়ারেন্টাইন করা হয়। পরে টোলারবাগের ৪০টি বাড়ি পুলিশি নজরদারিতে আনা হয়। কারণ যে ব্যক্তি মারা গেছেন, তিনি কার কাছ থেকে ভাইরাস বহন করেছিলেন, সেটি চিহ্নিত করা যায়নি। আইইডিসিআর জানিয়েছে, সেখানে আরও আক্রান্ত থাকতে পারেন।
অন্যদিকে মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিংসহ ওই এলাকার ৫৪টি ভবন একইভাবে পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা। মোহাম্মদপুর থানার ওসি গণমাধ্যমেকে বলেন, আইইডিসিআরের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই এলাকায় করোনায় আক্রান্ত রোগী থাকতে পারে কিংবা আছে পুরো মোহাম্মদপুর এলাকার এ রকম ৫৪টি বাসার তালিকা আমরা পেয়েছি। ৫৪টি ভবনে লাল কালিতে মার্ক করেছে পুলিশ।
সুসংবাদ : দুটি নতুন করোনা হাসপাতাল
এই ক্রান্তিকালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য দুটি শিল্পগ্রুপ হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি বাঙালী সমাজের জন্য বিরাট সুসংবাদ। অথচ এর একটি নির্মাণের আগেই বাধার সম্মুখীন হয়। বাঙালী চরিত্র বোঝা দুষ্কর। তেজগাঁওয়ে আকিজ গ্রুপের হাসপাতাল হলে এলাকার লোকের মধ্যে সংক্রমণ হবে এমন একটা ভাবনা থেকে বিরোধিতা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ৩০১ শয্যার হাসপাতাল তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আকিজের নিজস্ব দুই বিঘা জমিতে হাসপাতালটি হচ্ছে। এটি তৈরি হচ্ছে তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোডের শান্তা টাওয়ারের পেছনে। আকিজ সেখানে বিনামূল্যে রোগীদের চিকিৎসা দেবে। বসুন্ধরা গ্রুপের নিজেদের জায়গায় যে হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নেয় রোববারে সেটি কমপক্ষে ৫০০০ শয্যার হবে। এসব উদ্যোগ অন্য শিল্পগ্রুপদেরও অনুপ্রাণিত করুক।
ঘরে বসে মানসিক চাপ
দমবন্ধকর একটা পরিস্থিতি। এর ভেতর সারাক্ষণ ঘরবন্দী। স্বাভাবিক কারণেই মনের ওপর চাপ বাড়বে। খুঁজছিলাম এমন কোন মনোবিদের বক্তব্য যার ওপর ভরসা করতে পারি, পেয়েও গেলাম। জনকণ্ঠে যোগ দেয়ার আগে ডেইলি স্টার ভবনে বসতাম, সাপ্তাহিক ২০০০ অফিসে। সে সময়ে মেখলা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুরোধ করেছিলাম পাঠকের মানসিক সমস্যার উত্তর দিতে। তিনি সানন্দে সম্মত হয়েছিলেন। সেই থেকে গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত সম্পর্ক।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার মনে করেন, করোনাভাইরাস নিয়ে যে বাস্তবতা, সেটা মেনে নিতে হবে। করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমাদের তেমন কোন ধারণা নেই। যে জিনিসটা আমরা আসলে জানি না, সেই জিনিসটা আমাদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করে। অনিশ্চয়তা থেকে আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় হয়। ভয়টা আতঙ্কে রূপ নিতে পারে। যখন মানুষের করার কিছু থাকে না, তখন কিন্তু মানুষের মধ্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব তৈরি করে। অসহায়ত্ব মানুষের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে। ব্যক্তি বিশেষে একেকজনের মানসিক চাপ একেক রকমের। কারও হয়ত বা সামান্য ভয় লাগছে, কেউ হয়ত বা শঙ্কার মধ্যে আছে, অনেকে সাংঘাতিক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছেন। যখনই উদ্বেগ, ভয় মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক বডি (শরীর) থেকে কিছু নিউরো কেমিক্যাল মোবিলাইজড করে। এটা যদি ক্রনিক হয়ে যায়, তখন আমাদের মধ্যে কিছু উপসর্গ তৈরি হয়। আমাদের যে ইন্টারনাল অর্গান সিস্টেম আছে, যেমন- ফুসফুস, লিভার, কিডনি, সেটাকে কিন্তু ইফেক্ট করবে। অনেকের মাথাব্যথা হতে পারে। কারও মাথা ঘোরাচ্ছে। কারও ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ঘুম হচ্ছে না। অনেকের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এই শারীরিক সমস্যাগুলো তাঁদেরই বেশি হবে, যাঁরা আগে থেকে উদ্বেগপ্রবণ। অনেকে খিটখিটে হয়ে যাবে। অল্পতে রেগে যাবে। করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময়টা আমাকে মেনে নিতে হবে। আমি যদি এটা মেনে না নিই, তাহলে কিন্তু আমি এটা ফেস করতে পারব না। এই পরিস্থিতি নতুন ধরনের একটা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ আমাকে মোকাবেলা করতে হবে। জীবনের কোন কিছুই কিন্তু স্থায়ী না। যত দুঃসময় আসুক, এগুলো স্থায়ী না। এই পরিস্থিতি কিন্তু শেষ হবে। আমরা যদি খুব আতঙ্কগ্রস্ত হই, উদ্বিগ্ন হই, তাতে আমাদের কোন লাভ নেই। বরং ক্ষতিই হবে।
করোনাকাল : অনিবার্য বাইরে যাওয়াও
এক অভূতপূর্ব সময় এসেছে জাতির সামনে। স্পষ্ট করে বললে সমগ্র পৃথিবীতেই আজ ক্রান্তিকাল। রানীর মুকুটসদৃশ একটি ভাইরাস রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। মানছে না কোন নিয়ম। মানবদেহই তার আরাধ্য। যে কোন মানবদেহ। আক্রান্ত দেশগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে, তারপরও যেন মনে হচ্ছে আরও কিছু প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার ২৬ মার্চ থেকে দশ দিনের জন্য দেশবাসীকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছে। কেননা ঘরের বাইরে গেলে এই রোগের বিস্তার ঘটতে পারে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তাই ছিল না কোন আনুষ্ঠানিক আয়োজন। মানুষ ঘরে বসেই স্মরণ করেছে একাত্তরে পূর্বপুরুষদের আত্মত্যাগের কথা। নিজেকে বাঁচাতে হলে আমাদেরও কিছু কিছু ত্যাগ করতে হবে, সতর্ক ও সচেতন হতে হবে- এই বার্তা যেন সবার সামনে চলে এসেছে। এ মুহূর্তে গণমাধ্যমের দায়িত্ব বিরাট। একইসঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও করণীয় রয়েছে।
মানুষ ঘরে অবস্থান করছে। কিন্তু ঘরের বাইরেও যেতে হচ্ছে অনেককে জরুরী প্রয়োজনে। সার্বক্ষণিকভাবে ঘরে থাকার জন্য মানুষের ওপর বন্দিত্বের অনুভূতিসহ নানা মনোস্তাত্ত্বিক চাপ আসাটা স্বাভাবিক। এ সময়ে তার করণীয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা চাই। একইসঙ্গে একান্ত জরুরী প্রয়োজনে পরিবারের কাউকে না কাউকে নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে। ঘরের বাইরে বেরুনো ওই ব্যক্তিই যখন আবার ঘরে ফিরে আসছেন তখন তার নিজের ও পরিবারের সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট করণীয় রয়েছে। এসব তথ্য ও বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছানোর জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকাই প্রধান। তবে স্থানীয়ভাবে জনপ্রতিনিধিরও দায়িত্ব রয়েছে। তিনি কি সার্বক্ষণিকভাবে ঘরেই অবস্থান করবেন? এটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। অনলাইনে বার্তা প্রেরণের সুবিধা এনে দিয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। তাই শুধু কম্পিউটার নয়, একইসঙ্গে টেলিভিশনের মাধ্যমে ভিডিও বার্তা দেয়া যায়। টেলিফোনেও তথ্যসহায়তা দেয়া সম্ভব। এসব বিষয়ে মানুষের ভোটে নির্বাচিত মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হিসেবে স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ভূমিকা গ্রহণের বিরাট সুযোগ রয়েছে। এমনকি শুধুমাত্র জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের বিশেষ বিশেষ অংশ বার বার প্রচার করা যেতে পারে।
দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমজীবী মানুষেরই কষ্ট বেশি। তাদের পাশে এসে দাঁড়াানোর আহ্বান জানাচ্ছেন কোন কোন মন্ত্রী। যিনি আহ্বান জানাচ্ছেন, তিনি মন্ত্রী হোন বা যে কোন মানুষ, তার নিজেকেও নিয়োজিত করতে হবে দরিদ্রের প্রত্যক্ষ উপকারে। প্রতিবেলায় খাদ্য নিশ্চিতই সবচেয়ে জরুরী বিষয়। এটি কিভাবে সম্ভব সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা চাই। কেননা এখন ঘরে থাকার সময় এবং ভিড় এড়ানোর সময়। একমাত্র স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরাই জানেন তাদের এলাকায় কোন কোন ঘরে অভাবি মানুুষ রয়েছে। শহরাঞ্চলে বস্তিবাসীরা আছেন। তাদের প্রতিদিনের খাদ্যের যোগান কিভাবে আসবে, এটির সুরাহা যদি আমরা না করতে পারি তাহলে মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করব কিভাবে। তাই চাই উদ্যোগ, সঠিক ব্যবস্থাপনা।
করোনাকাল কেটে যাবে। কিন্তু যে দাগ রেখে যাবে সমাজে অর্থনীতিতে, তার প্রভাব কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি পাবে সেটাই বড় ভাবনা।
২
রবিবার জনকণ্ঠ অফিসে সম্পাদকীয় মিটিং শেষে ‘ঢাকার দিনরাত’ লিখতে বসার আগে অভ্যাসবশত সদ্য ব্রেক করা সংবাদে চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে গেলাম। মিরপুরে দুজন করোনা-আক্রান্ত, ২৫ পরিবার লকডাউনে। রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর ওভারব্রিজের পাশে তানিম গলিতে এক পরিবারের দুজনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) আক্রান্ত দুজনকে সকালেই বাসা থেকে নিয়ে গেছে। এই ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট এলাকার দুটি বহুতল ভবন ও একটি টিনশেড বাড়ি লকডাউন করে দিয়েছে মিরপুর থানা-পুলিশ। সেখানে ২৫ পরিবারের বাস।
করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের শুরুর দিকেই একাধিক ডাক্তারের কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার কথা আমরা জানি। সবচেয়ে ঝুঁকিতে এখন স্বাস্থ্যকর্মীরাই। তবে সংবাদকর্মীরাও যে বিপদে আছেন সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠল একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলের একজন কর্মী কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হলে। ওই টিভির ৪৭ জনকে ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। খোদা না করুক আমাদের অফিসের কেউ আক্রান্ত হলেও তো সরকারী কর্তৃৃপক্ষ কিছু একটা ব্যবস্থা নেবেন। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর এই পত্রিকায় কর্মরত রয়েছি। শুধু ঈদের সময়ে দেখেছি ২০ পাতার নিয়মিত পত্রিকা ১৬ পাতা হতে। আর এখন এই করোনাকালে নিয়মিতভাবে বেরুচ্ছে ১২ পাতা। এটি আমাদের জনকণ্ঠ পরিবারের প্রত্যেকের জন্যই অস্বস্তি ও কষ্টের। তবে শুধু আমাদের কাগজই তো নয়, প্রায় সব পত্রিকাই ১২ থেকে ১৬ পাতা হয়ে গেছে। সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নোয়াব-এর বিজ্ঞপ্তি প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে পত্রিকায় এই মর্মে যে করোনাভাইরাস কাগজে ছড়ায় না। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা বলছে, কাগজের ওপরে ভাইরাসটির বেঁচে থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
রাস্তায় গাড়ি বাড়ছে
পদযাত্রায়ও বহু মানুষ
২৬-২৭ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার প্রথম দুটি দিন রাস্তাঘাট সুনসান দেখেছি যার বিবরণ রয়েছে গত সপ্তাহের কলামে। কিন্তু গত তিন দিন যাবত ঢাকা শহরে প্রচুর মোটরসাইকেল, প্রাইভেট গাড়ি এবং যন্ত্রচালিত রিক্সা দেখছি। আমাদের কর্মীদের বহনকারী সিএনজির সামনের দিকে লাল কাপড়ের ব্যানারে সংবাদপত্র কথাটি লেখা থাকে। এছাড়াও উইন্ডস্ক্রিনের সঙ্গে জনকণ্ঠ/সংবাদপত্র লেখা স্টিকার থাকে। তাও দফায় দফায় ঢাকার পুলিশ আমাদের সিএনজি আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। সংবাদপত্র লেখা ব্যানার দেখেও গাড়ি আটকানোর কারণ হিসেবে এক পুলিশ সদস্য বললেন, অনেকেই এভাবে লিখে রাস্তায় বের হচ্ছেন। বিস্মিত হলাম। সত্যিই কি এটা হচ্ছে? তাছাড়া এত যে গাড়ি দেখছি রাস্তায় তার সবগুলোই কি যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারছে বাইরে বেরুনোর? যদি না দেখাতে পারে তাহলে কি তাদের জরিমানা গুনতে হচ্ছে? সেই জরিমানার রিসিট কি তারা পাচ্ছেন? বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো না হলেই হয় ব্যাপারটা।
অন্যদিকে বহু মানুষ হেঁটে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছেন। বাসস্ট্যান্ডগুলোতেও জটলা দেখছি, কোন না কোন গাড়ি আসবে এমন ভরসাই করছেন অপেক্ষারত মানুষেরা।
ঢাকাবাসীর কড়চা
আমার নিজ এলাকা উত্তরার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাই। ওষুধের দোকান ও সুপারশপ ছাড়া এখানে মোটামুটি ভালভাবেই ‘ছুটি’ চলছে। এখানে-সেখানে রিক্সাওয়ালাদের জটলা থাকে অবশ্য। যদিও খুব বেশি যাত্রী পাওয়া যায় না। কিন্তু মসজিদে বেশ ভিড়। আমাদের সড়কে প্রতিদিনই সবজিওয়ালা আসে ভ্যান নিয়ে, হাঁকডাক পাড়ে। গৃহিণী তিনতলা থেকে দড়ি দিয়ে বাঁধা ব্যাগে টাকা রেখে নিচে পাঠান। যা যা কেনার কেনেন। সবজিওয়ালা ওই ব্যাগে সেসব সদাই ভরে দেন, মূল্য রেখে বাকি টাকা ফেরত দেন। তবে সবজিগুলো আগের তুলনায় বেশি করে ধোয়ার নিয়ম চালু হয়েছে। সেইসঙ্গে আরেক দফা দুই হাত সাবান দিয়ে ভালমতো ধুয়ে নেয়ারও। আমার কন্যা আছে তার সংসারে। স্ত্রী আর পুত্র ২৬ মার্চ ছুটি ঘোষণার কয়েকদিন আগে থেকেই ঘরবন্দী। আমিই কেবল বাইরে বেরুই, মানে অফিসে যাই। আমার বাল্যবন্ধু খুলনা মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর ডাঃ আবদুল আহাদ একটি ভিডিও পাঠিয়েছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে একজন অফিসফেরত ব্যক্তি ঘরে ঢোকার আগে নিজেকে ও তার পরিবারকে কিভাবে সুরক্ষিত করার নিয়ম অনুসরণ করছেন। পেয়ে উপকৃত হলাম। শতভাগ অনুসরণ করছি ভিডিওর নির্দেশনা। কাপড়-চোপড় চালান হয়ে যাচ্ছে ধোয়ার জন্য। ঘড়ি-মোবাইল-চাবি-টাবি সব জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে স্যানিটাইজার দিয়ে। জুতা দরজার বাইরেও রাখা হচ্ছে। দুহাতের দস্তানা খুলে ঢাকনাঅলা বিনে ফেলা হচ্ছে। তারপর সোজা ¯œানঘরে গোসল করা। তবু কি শতভাগ নিশ্চয়তা আছে যে আমি বাইরে থেকে করোনাভাইরাস বহন করে আনছি না?
করোনাকালে
পাতালে হাসপাতালে
পাতালে হাসপাতালে কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের একটি গল্পের নাম। করোনাকালে হাসপাতাল নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনে জাকিয়া আহমেদের প্রতিবেদন পড়তে পড়তে গল্পটার নাম মনে পড়ল। করোনা আসার আগে পর্যন্ত যাদের নানা জটিল রোগ ছিল, কিংবা এখন যারা বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা হাসপাতালের সেবা পাবেন কিভাবে, এমন ভাবনা হচ্ছে প্রতিবেদনটি পড়ে। জাকিয়া লিখেছেন, ‘বেসরকারী হাসপাতালের ফটকে ঝুলছে ‘ক্লোজ’। প্রবেশপথে লেখা ‘ক্লোজ’। ৬৭ বছরের নাজমা বেগম ক্যান্সারে আক্রান্ত। পেটে পানি জমার কারণে চিকিৎসক তাকে আলট্রাসাউন্ড করতে বলেন গত ২৪ মার্চ। সেদিন থেকে অনেক হাসপাতাল ঘুরে পরিচিতজনের সুবাদে অবশেষে তার আলট্রাসাউন্ড হয়েছে গত ২ এপ্রিলে। তার মতো অনেক রোগীই বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারাত্মক সঙ্কটে পড়ছেন। মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন রোগীর স্বজনরা। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, আগের মতো চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে না। সেজন্য অধিকাংশ হাসপাতালই রোগীশূন্য। রোগীদের প্রবেশেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। কোথাও লেখা রয়েছে ‘ক্লোজ’। ঘোষণা না থাকলেও কার্যত বন্ধই রয়েছে এসব হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা।
বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি নিচ্ছে না, চিকিৎসকরা বসছেন না এমন অভিযোগ রোগী এবং স্বজনদের। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ এপ্রিলে রাজধানীর পান্থপথ, গ্রিন রোড ঘুরে দেখা যায়ু যে গ্রিন রোডে পা ফেলার জায়গা থাকে না। ডাক্তারের সিরিয়াল সন্ধ্যা ৭টায় থাকলে মগবাজার থেকে বের হতে হয় সাড়ে ৪টায়। সেই গ্রিন রোডে কোথাও কেউ নেই। হাসপাতালের সামনে নেই নিরাপত্তারক্ষীদের হুইসেল, নেই গাড়ির জটলা।
গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকে তালা মারা। ভেতর থেকে সাইনবোর্ড ঝুলছে ‘ক্লোজ’। ভেতরে তিনটি লিফটের সিরিয়ালে জায়গা পেতে যেখানে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। কয়েকবার লিফট উপর-নিচ করার পর সুযোগ হয় ওঠার। সেই লিফটের কয়েক হাত দূর থেকে লেখা ‘ভিজিটর পাস ছাড়া হসপিটালে প্রবেশ ও অবস্থান নিষেধ।’ রিসেপশনের সামনে যেখানে রোগীদের দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে হয়, সেখানে চেয়ারগুলো শূন্য পড়ে আছে। রিসিপশনের চারপাশে পর্যন্ত আটকে দেয়া হয়েছে। সব ফাঁকা কেন জানতে চাইলে রিসিপশন থেকে বলা হয়, স্যাররা ছুটিতে আছেন।
তালাবদ্ধ এ হাসপাতালের বিপরীত দিকে অবস্থিত সেন্ট্রাল হাসপাতাল। সেখানে গিয়ে দিয়ে যায়, ভেতরের মূল ফটকের তিন-চতুর্থাংশ আটকানো। ওয়েটিং জোনে কেবল খালি চেয়ার। মধ্যবিত্তের আস্থার এ পুরনো হাসপাতালটিতে যেখানে গা ঘেঁষে দিয়ে চলতে হয় রোগীদের সেখানে ২০ মিনিট অপেক্ষা করেও একজন রোগীর দেখা মিলল না।
একটু এগিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতাল। এ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজির ভিড়ে যেখানে রোগী নামাতে একটু দেরি হলেই নিরাপত্তারক্ষীদের লাল চোখ দেখতে হয়, সেই হাসপাতালের সামনে দুটি এ্যাম্বুলেন্স আর দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অলস সময়ে রাস্তার ধারে চা খেতে দেখা যায় নিরাপত্তারক্ষীদের।’
সর্বশেষ
ঢাকায় বহু জায়গায় অভাবি মানুষদের ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। বলতে পারি গত কয়েকদিনে ত্রাণ কার্যক্রম জোরদারও হয়েছে। প্রশাসন সতর্কতার সঙ্গে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনে ত্রাণ বিতরণে অংশ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ভাটারা থানার ত্রাণ প্রদানের ব্যবস্থাপনা বিশেষভাবে নজরে পড়েছে। ছবি দেখুন, এটি পেয়েছি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর ওয়েবসাইটে। পুলিশ ত্রাণপ্রত্যাশীদের স্থানীয় একটি হাই স্কুলের মাঠে নিরাপদ দূরত্বে লাইন ধরে বসিয়ে ত্রাণ দিয়েছে। বিষয়টি অনুসরণীয়।
এই লেখা শেষ করার আগে আরেকটি খবর পিলে চমকে দিল। আইইডিসিআর জানিয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন শনাক্ত ১৮ জনের ১২ জনই ঢাকার। আগের দিন চার এপ্রিলে দুপুর ১২টা পর্যন্ত শুধু ঢাকাতেই ১৫ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ।
এলাকাগুলো মনিপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া, বড়বাগ, মীরপুর ১০ ও ১১, উত্তরা ১ নম্বর ওয়ার্ড, উত্তর খান ( থানা ও ইউনিয়ন), খিলক্ষেত, বারিধারা, বনানী, গুলশান, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, হাজারীবাগ, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, পলাশী নীলক্ষেত ও সেগুনবাগিচার একাংশ, কাকরাইলের একাংশ, মগবাজার, রামপুরা, বাসাবো, শাহজাহানপুরের একাংশ, বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জের একাংশ, যাত্রাবাড়ী, মীরহাজির বাগের একাংশ। তথ্য- আইইডিসিআর।
ঢাকার দিনরাত যে ভাল কাটছে না, তা বলাইবাহুল্য।
৫ এপ্রিল ২০২০
[email protected]