করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





জন্মশতবর্ষ : শেখ মুজিব
মারুফ রায়হান
টুঙ্গিপাড়ার কিশলয় বেড়ে হবে একদিন হিমালয়, বাংলা মা নিশ্চয়ই জানত। শতাব্দীপ্রবীণ বটবৃক্ষ কিংবা বাংলার বহমান নদীই জানে কার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বছরভর যার নামের পরে সূর্যের চুমু ঝরবে সেই বছরটির প্রথম দিনেই নৈবেদ্য সাজালাম প্রেমে ও শ্রদ্ধায়। আজকের নবীনের কাছে মুজিববার্তা পৌঁছে দেবার গহীন গৌরবময় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে অগ্রজ ও প্রবীণ দেশপ্রেমিকদেরই ওপরে। তাতে যেন বিন্দুসম খাদ না থাকে, না থাকে কুণ্ঠিত কৃপণতা। অসামান্য মান্যজনের ছবি আঁকায় যেন সামান্যতমের রঙতুলিও তার সবটুকু উজাড় করে দেয়। মুজিববর্ষে প্রাণের সবটুকু হর্ষ পল্লবিত হোক শতমাত্রিকতায়। নতুন চিনে নিক স্বজাতির পরম পিতাকে, মাতৃভূমি-বাংলার বিপুল বন্ধুকে।

ভালবাসার দারুণ দৃষ্টান্ত

তাঁর কাছে ছিল না কোন শ্রেণীভেদ, কোন ইতরবিশেষ। সবাই তাঁর স্বজন, স্বদেশের আপনার জন। তাই মিশতেন সবার সঙ্গে, কাছে টেনে নিতেন সব বয়সী সব শ্রেণীর মানুষকে। তাঁর হৃদয়ের উষ্ণতা এভাবেই গভীর মায়ায় স্পর্শ করত তাঁর সান্নিধ্যে আসা শতভাগ মানুষকে। দশকের পর দশক পেরিয়ে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টে অশ্রুসজল হয়ে, কখনওবা জ্বলে উঠে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর নয়নের মণি, অবিসংবাদিত নেতা। সে জন্যই তো ইতিহাসের মহান বিপ্লবী কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের বন্ধু।’

উদার ও স্নেহপরায়ণ একজন মানুষ হিসেবেই তাঁকে চিনতেন গ্রামবাংলার মানুষ। যাঁরা তাঁর ব্যক্তিগত সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরাই তাঁর ভদ্রতা ও যতেœ অভিভূত হয়েছেন। মানুষের চেহারা ও নাম মনে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। এক্ষেত্রে তাঁকে অদ্বিতীয়ই বলতে হবে। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর একবার ঘুরে আসার অনুরোধ জানাই তরুণ বন্ধুদের। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নিজের হাতে মন্তব্য লিখেছেন বহু বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। কেউ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন, কেউবা মুগ্ধ তাঁর ব্যক্তিত্বের কথা জেনে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখে, তাঁর সাদাসিধে জীবনযাপনের কথা জেনে কেউ কেউ রীতিমতো বিস্মিত। অনেকেই আবার বলেছেন, তিনি শুধু বাংলাদেশের নেতাই ছিলেন না, ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাঁকে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত নেতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন কেউ কেউ। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন বিশ্ব নেতারা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান অথবা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বাংলাদেশ সফরে এসে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর দেখার পর তাঁরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নিজের হাতে মন্তব্য লিখেছেন। এসব মন্তব্য হয়ে উঠেছে জাদুঘরের মূল্যবান সম্পদ।

রাষ্ট্রের শোষণ অনন্য জবাব

আজকের প্রজন্মের হাতের মুঠোয় স্মার্ট ফোন, তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে তথ্যভা-ার তার চোখের সামনে। তারা জানে যে, ক্ষুধা দূর করার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে ভাল অবস্থানে এগিয়ে আছে বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য তুলে ধরে পাকিস্তানেরই সংবাদপত্র ডন-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কোন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্বর্গরাজ্য নয়। শূন্য অবস্থান থেকে নিজেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এখন তো কোন কোন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক বাংলাদেশকে এশিয়ার পরবর্তী অর্থনৈতিক পরাশক্তি বলে মনে করেন। গত বছর (২০১৮) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮ ভাগ, যেখানে ভারতের ছিল ৮ ভাগ এবং পাকিস্তানের মাত্র ৫ দশমিক ৮ ভাগ। মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও পাকিস্তানের অর্ধেক। আর বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ পাকিস্তানের চেয়ে চারগুণ বেশি। এই প্রবৃদ্ধির বেশিরভাগই রফতানিনির্ভর যা ১৯৭১ সালে শূন্যের কোঠা থেকে ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। যেখানে পাকিস্তানের বার্ষিক রফতানি আয় আড়াই হাজার কোটি ডলারের কিছু কম। পাকিস্তানের আরেক উল্লেখযোগ্য গণমাধ্যম ট্রিবিউন সরাসরি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে লিখেছে, তুলনামূলক সম্পদশালী পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা আরও বিস্ময়কর! কারণ যুক্তরাষ্ট্র, চীন কিংবা সৌদি আরবের মতো দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ নয়। তাদের নেই রাসায়নিক অস্ত্র, নেই বিশ্বসেরা সেনাবাহিনী এমনকি দক্ষ পেশাজীবীতেও পরিপূর্ণ নয় দেশটি। কিন্তু এখন সেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং উদার পরিবেশ বিরাজমান। বাংলাদেশের এমন এগিয়ে যাওয়া পাকিস্তানের জন্য শিক্ষণীয়।

১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে একটি পোস্টারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। বিষয়টি এমন : রাজস্ব খাতের ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানে ১ হাজার ৫০০ কোটি রুপি, পশ্চিম পাকিস্তানে ৫ হাজার কোটি রুপি। উন্নয়ন খাতে ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানে ৩ হাজার কোটি রুপি, পশ্চিম পাকিস্তানে ৬ হাজার কোটি রুপি। বৈদেশিক সাহায্য পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ২০ ভাগ, পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৮০ ভাগ। বৈদেশিক দ্রব্য আমদানি পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ২৫ ভাগ, পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৭৫ ভাগ। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ১৫ জন, পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৮৫ জন। সামরিক বিভাগে চাকরি পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ১০ জন, পশ্চিম পাকিস্তানে ৯০ জন। চাল (মণ প্রতি) পূর্ব পাকিস্তানে ৫০ রুপি, পশ্চিম পাকিস্তানে ২৫ রুপি। আটা (মণ প্রতি) পূর্ব পাকিস্তানে ৩০ রুপি, পশ্চিম পাকিস্তানে ১৫ রুপি। সরিষার তেল (সের) পূর্ব পাকিস্তানে ৫ রুপি, পশ্চিম পাকিস্তােন ২.৫০ রুপি। স্বর্ণ প্রতি ভরি পূর্ব পাকিস্তানে ১৭০ রুপি, পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৫ রুপি।

এ যেন নিজ দেশে পরবাসীর মতোই জীবন। এ কথার বিপরীত পিঠে রয়েছে অমোঘ সত্য : পাকিস্তানের শাসকবর্গ দেশটির অপর অংশ অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষকে অভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গণ্য করত না। শুধু শুষে নিত তাদের সম্পদ। এই শোষণের অনন্য জবাব দিলেন শেখ মুজিব ঐতিহাসিক ৬ দফার মাধ্যমে।

৬ দফার মূল বক্তব্য ছিল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে। পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধা সামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন।

বলাবাহুল্য বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা দাবির মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ৬ দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়া হবে।

কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?


আরেক মহান বিপ্লবী চে গুয়েভারাকে স্মরণ করি। তাঁর ভাষায় রাজনৈতিক বীরের চরিত্র এ রকম : ‘একজন মানুষের জীবনের চূড়ান্ত সময় তখনই আসে, যখন তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যদি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেন, তাহলে তিনি একজন বীর, তা তিনি সফল হোন বা না হোন। তিনি ভাল বা মন্দ রাজনীতিক হতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি মৃত্যুর মুখোমুখি না হন, তাহলে তিনি একজন রাজনীতিকের চেয়ে বেশি কিছু নন।’ এই দুই সংজ্ঞাই কি খাটে না শেখ মুজিবের বেলায়? তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বড় অংশজুড়েই তিনি কারাভোগ করেছেন। এক্ষেত্রেও তিনি একক ও অদ্বিতীয়। বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ হিসাব করে দেখিয়েছেন যে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারা ভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের ১৪টি বছর কারাগারে ছিলেন। তিনি ১৯৩৮ সালে প্রথম কারাগারে যান। এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাঁচ দিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় তিনি ১৩২ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও কারাগারে গিয়ে ৮০ দিন কারাভোগ করে মুক্তি পান ২৮ জুন। ওই দফায় তিনি ২৭ দিন কারাভোগ করেন। একই বছরের ১৯৪৯ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন এবং ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়। ছয় দফা দেয়ার পর জাতির পিতা যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গ্রেফতার হয়েছেন। ওই সময়ে তিনি ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর পরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। এ দফায় তিনি কারাগারে ছিলেন ২৮৮ দিন।

দেশপ্রেমিক মহান নেতার কারাবাসের এই হিসাব দেখে বিদ্রোহী কবি নজরুলের কবিতার কয়েকটি চরণ আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে : কে মালিক? কে সে রাজা? / কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?

কবিতার ছন্দ
নক্ষত্রের আলো


রাজনীতির কবি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ কবিতারই মতো স্পষ্ট ও সঙ্কেতময়, দ্রোহ ও দেশপ্রেমের রসে সিক্ত। নেতাকে যাঁরা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তাঁদের অবলোকন তরুণ প্রজন্মকে সাহায্য করতে পারে নেতার প্রতিকৃতি নির্মাণে। কর্মসূত্রে, রাজনৈতিক সূত্রে বা কোন না কোনভাবে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসেছিলেন এমন বহু ব্যক্তিই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করেছেন। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত সেই সব স্মৃতিকথা অত্যন্ত মূল্যবান। সৃষ্টিশীল রচনার প্রয়োজনে সেই সব লেখা যে মহামূল্যবান উপাদান হয়ে উঠতে পারে সে কথা বলাবাহুল্য। এ ক্ষেত্রে তাজউদ্দীনের ডায়েরির কথা প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের ‘প্রথম দর্শনে বঙ্গবন্ধু’ বইটির কথা। আরেকজন সচিব মুহাম্মদ সিরাজুদ্দিন টুকরো টুকরো স্মৃতিকথা লিখেছেন। তিনি পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিগ্রন্থ লিখলে বঙ্গবন্ধু আমলের প্রশাসনিক বহু অজানা কথাই মানুষ জানতে পারতেন। অতিরিক্ত নেতিবাচকভাবে প্রচারিত তিয়াত্তর চুয়াত্তরের দিনগুলো প্রকৃত সত্যের তরবারিতে ঝলসিত হয়ে ওঠা জরুরী। কারণ তাতে কাটা পড়বে বহু মিথ্যাচার।

এখানে প্রয়াত কবি আবুল হোসেনের স্মৃতিকথা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করতে চাই কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। এই লেখাটির প্রথম পাঠক এবং প্রথম প্রকাশকারী ছিলাম আমি। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বঙ্গবন্ধুর প্রায় সমবয়সী এই কবির জন্মদিন পনেরোই আগস্ট। কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর আর কখনই তিনি তাঁর নিজের জন্মদিন পালন করেননি। কবি আবুল হোসেন লিখেছেন : ‘প্রতিষ্ঠার দেড়-দু’বছরের মধ্যেই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহভঙ্গ ঘটে পূর্ববঙ্গের। বিরোধীরা আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে সরকারী মুসলিম লীগের বিপরীতে। ভাসানী তার সভাপতি, শেখ মুজিব যুগ্ম সম্পাদক। বিরোধী দলগুলো শেরেবাংলা ফজলুল হক ও শহীদ সোহাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সম্মিলিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ১৯৫৪ সালে। প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। পরিষদের গরিষ্ঠ দল যুক্তফ্রন্টের নেতা ফজলুল হক যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তার কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যে মন্ত্রিসভাকে ১৫ দিনের বেশি টিকতে দেয়নি। দেশদ্রোহের অভিযোগ তুলে তার প্রধান শেরে বাংলাকে বরখাস্ত করে শেখ মুজিবকে পাঠায় জেলে। এর আগেও একাধিকবার তার জেল হয়েছে। পরে যদিও তিনি একবার প্রাদেশিক মন্ত্রী হয়েছেন, বছরখানেকের জন্য, জেল খেটেছেন বহুবার। ষাটের দশকের শুরুতে বিদেশে চাকরি করতে যাওয়ার সময় দেখে যাই তার রাজনৈতিক জীবনের অত্যাশ্চর্য রূপান্তর। জেলের ভাত আর সরকারের তাড়া খেতে খেতে কিভাবে এক তরুণ একগুয়ে ছাত্রনেতা দেড় দশকের মধ্যে তার সমসাময়িক সতীর্থ এবং অনেক সহযাত্রীকে রাজনীতির ময়দানে পেছনে ফেলে, নয়ত মিইয়ে যেতে দিয়ে উঠে এসেছেন এক আপোসহীন চড়াগলার নেতার আসনে। সাড়ে ছ’বছর পরে যখন দেশে ফিরে এলাম তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা। সরকারের বিপক্ষে।’

তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে...

‘এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।’

মুজিববর্ষ পালনের আনন্দ-উৎসবের মাঝখানে বঙ্গবন্ধুর এ অমূল্য উক্তিটি চিরকাল স্মরণে রাখার আন্তর-শপথ নেব আমরা। জাতির পিতাকে দেশের খেটে খাওয়া দুঃখী মানুষের দুঃখের অবসানের জন্য একাগ্রচিত্তে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়নি; স্বাধীনতাবিরোধী সেই পাকিস্তানপ্রেমীরা প্রতিশোধ নিয়েছে তাঁকে হত্যা করে। কিন্তু প্রকৃতিই তা পরিশোধের দায় নিয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যার মাধ্যমে অসমাপ্ত দায়িত্ব পালন ও মানবসেবার। পালে লাগিয়ে তাঁর খোলা হাওয়া শুধু সম্মুখপানে ধেয়ে চলা। বিশ্বকবির ভাষায় : ঝড়কে আমি করব মিতে, / ডরব না তার ভ্রুকুটিতে; বাস্তবিকই সুযোগ্য কন্যাটি ঝড়ঝঞ্ঝায় এতটুকু টলেননি, ভীতি তাঁর রক্তকণিকাতেই নেই, এগিয়ে চলেছেন একনিষ্ঠতায়। তাঁর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখে নিজেদেরও প্রস্তুত করতে হবে বিরুদ্ধতা উজিয়ে দেশসেবার, মানবসেবার।
বলাবাহুল্য, ব্যক্তিগত গুণাবলী, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অসামান্য চরিত্রমাধুর্যের সৌরভে অবিস্মরণীয় নেতাদের কাতারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর সমগ্র জীবন ছিল ইতিহাসের অতুলনীয় এক মহাকাব্যের মতো। এ মহান ব্যক্তিত্বের জীবন নিয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। বঙ্গবন্ধু লিখিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীও প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তির মূল্যায়নের জন্য আত্মজীবনী গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এটিকে ভিত্তি করে বড় মাপের সাহিত্য রচনার সম্ভাবনা থাকে। এই দুঃখিনী বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক শিশু কালে কালে কী বিপুল সঙ্কট ও সংগ্রাম পেরিয়ে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন কোটি মানুষের অন্তরের মণিকোঠায়। হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক। গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো করুণ এক মৃত্যুর শিকার হন অবশেষে। ইতিহাসের এই মহানায়ককে নিয়ে খুব বড় মাপের সাহিত্য রচনার সুযোগটি এখনও রয়ে গেছে। আগেও একটি রচনায় উল্লেখ করেছি- আংশিক বা খ-িত জীবন নয়, বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ জীবন নিয়েই সৃষ্টি হতে পারে অত্যন্ত উন্নত স্তরের সাহিত্য, বিশেষ করে বড় ক্যানভাসের ক্ল্যাসিক উপন্যাস। যা কেবল বাংলাদেশের সাহিত্যেরই অনন্য দৃষ্টান্ত হবে না, হয়ে উঠবে বিশ্বসাহিত্যের ভা-ারে এক কালজয়ী ধ্রুপদী সাহিত্য। এভাবেই আন্তর্জাতিক বিশ্বে নতুন করে আলোচনায় উঠে আসতে পারে বাংলাদেশ। বর্গমাইলের হিসাবে আয়তনে ছোট হলেও এই দেশ যে খুব বড় একটি সম্ভাবনার দেশ এবং যার রয়েছে শ্রদ্ধাজাগানিয়া এক গৌরবময় ইতিহাস সেটি বিশ্ববাসী নতুন করে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। একমাত্র সাহিত্যেরই রয়েছে সেই ব্যাপক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ শক্তি। তরুণ প্রজন্মের ভেতর উল্লেখযোগ্য অংশ এখন কম্পিউটার ব্যবহার করছে। ইন্টারনেট হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের চারণক্ষেত্র। মহান নেতার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বিশদ তথ্য ও রচনা এবং আলোকচিত্রমালা আকর্ষণীয়ভাবে অনলাইনে উপস্থাপনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভবিষ্যত কর্ণধারদের কাছে জাতির পিতাকে পূর্ণাঙ্গ রূপে তুলে ধরা আজ সময়েরই দাবি।

কিরণ-ছটায়
সহস্র সম্ভাবনা


মুজিববর্ষের কিরণ-ছটায় রয়েছে সহস্র সম্ভাবনা যা সহস্র বছর ধরেই আলো দেবে জাতির হৃদয়-মননে। তাই এ সুযোগ কাজে লাগানো চাই সর্বোচ্চ সক্রিয়তায়। মুজিববর্ষ পালনে জাতীয় পর্যায়ে গঠন করা হয়েছে দুটি কমিটি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন এবং জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। মহাকর্মসূচির দুয়েকটি উল্লেখ করি, প্রত্যাশা করি যার কিরণ-ছটা ছড়িয়ে পড়বে বহির্বিশ্বেও। ইউনেস্কোতে বঙ্গবন্ধুর নামে পুরস্কার প্রবর্তন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের আরও ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার স্থাপন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজে বঙ্গবন্ধু সেন্টার স্থাপন, লন্ডনে মাদাম তুসো জাদুঘর ও জাতিসংঘ সদর দফতরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন, উইমেন, পিচ এ্যান্ড সিকিউরিটি শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন, জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তি দিবস উদযাপন, কফি টেবিল বই প্রকাশ; বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ইংরেজী ছাড়াও হিন্দী, উর্দু, ফরাসি, জার্মান, চাইনিজ, আরবি, ফারসি, স্প্যানিশ, রুশ, ইতালীয়, কোরীয় ও জাপানি- এই ১২টি ভাষায় অনুবাদ।
জয়তু মুজিববর্ষ।