প্রতি বইমেলায় আশির দশকের কবি মারুফ রায়হান একটি অসামান্য কাজ করেন। মেলার প্রথম দিন থেকেই তিনি খোঁজ রাখতে থাকেন মেলায় কী কী বই এলো। তা কত প্রকার, কত হরেক কিছিমের বই-ই তো মেলায় আসে, সব বইয়ের খোঁজ নিয়ে কী লাভ? মারুফ রায়হান আসলে সব বইয়ের ব্যাপারে আগ্রহী নন, তিনি আগ্রহী দিনের সেরা বইটির প্রতি। আসলে গুরুত্বপূর্ণ ও ভালো বইয়ের প্রতি তার আগ্রহ। প্রতি বইমেলায় তিনি সেরা ৫০টি বই নিয়ে বইমেলার 'নির্বাচিত ৫০ বই' নামের একটি তালিকা প্রকাশ করেন। যে মেলায় বই প্রকাশিত হয় পাঁচ হাজারের বেশি, সেখান থেকে ৫০টি বই নির্বাচন করা কঠিন। এই পঞ্চাশের ভেতর, মারুফ রায়হান চান, সাহিত্যের সব শাখাই থাকুক। ফলে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, গবেষণা, ভ্রমণ- সব প্রকার বই নির্বাচনে থাকে। সুদীর্ঘ ১৮ বছর ধরে বিরতিহীনভাবে এই কাজটি করার ফলে এবং যতদূর সম্ভব নির্মোহ থাকার কারণে তার এই তালিকাটি বইমেলার আইকনিক তালিকা হয়ে উঠেছে। সেরা পঞ্চাশে থাকতে আগ্রহী সেরা লেখকরাও, নবীনদের জন্য এ যেন জাতে ওঠা। আমার বই মাঝে মাঝে এ তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে, যেমন গত বছর পঞ্চাশতম বইটি ছিল 'মহাদেশের মতো এক দেশে।' এবছর 'সিমলা মানালির পথে' যে তালিকায় ওঠেনি তার অন্যতম কারণ হতে পারে বইটির দেরিতে প্রকাশ। মারুফ রায়হান তার পত্রিকাটি প্রকাশ করার জন্য বেছে নিয়েছেন ফেব্রুয়ারির স্মরণীয়তম দিন - একুশে ফেব্রুয়ারি, এর নামও 'একুশের সংকলন'। বইমেলায় বই তো প্রকাশিত হতে থাকে শেষ দিনটির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, এমনকি তার পরেও বই আসতে থাকে। সেরা পঞ্চাশে থাকতে হলে ফেব্রুয়ারির প্রথম ১৭/১৮ দিনের মধ্যে থাকাই বাঞ্ছনীয়।
এবছর তার তালিকায় থাকিনি, কিন্তু তিনি বইমেলা নিয়ে আমি যে কড়চা লিখি, তার কয়েকটি পর্ব ছেপে দিয়েছেন। আমি তো রীতিমতো অবাক! সেরা পঞ্চাশের ভেতরে শুধু নির্বাচিত পঞ্চাশটি বইয়ের রঙীন প্রচ্ছদ আর সংক্ষিপ্ত বিবরণী নয়, কিছু সাহিত্য তিনি ছাপেন, সেখানেই ওই গদ্য ঠাঁই পেয়েছে। ফলে আমি স্পেস পেয়েছি অনেকগুলো বই যে স্পেস পায়নি (হাসি)। যাহোক, যাদের বই তালিকায় ওঠে, তারা খুশি হন, যাদের বই তালিকায় ওঠে না, তারা হন বেজার। এখন মারুফ রায়হানের অবস্থা হয় "শ্যাম রাখি না কূল রাখি'। আর একটি জিজ্ঞাসা হলো একুশের পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত (বস্তুত দিনের সংখ্যার বিচারে এই সময়েই বেশি বই প্রকাশিত হয়) বই নিয়ে তিনি কী করেন? এগুলো তো বাদই পড়ে যায়, নাকি?
২.
বইমেলায় গেলাম ষষ্ঠদিনে। সেখানে যাবার আগে এবারের বইমেলার নবতর রূপের প্রশংসা শুনেছি সকলের মুখে। গিয়ে দেখলাম সত্যি তাই, ভালোলাগার শুধু নয়, ভালোবাসার মতো বইমেলা। এত বড় পরিসরের, এত সুসজ্জিত বইমেলা আগে কখনোই হয়নি। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ও মুদ্রাপাচারের মতো বেড়েই চলেছে বইমেলার পরিসর। এবার সবচেয়ে বেশি টানলো লিটল ম্যাগাজিন চত্বরকে বর্ধমান হাউজের পেছন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসার ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বাধীনতা স্তম্ভ ও তার জলাধারকে মেলার ভেতর টেনে এনে কেবল দিগন্তকেই প্রসারিত করা হয়নি, এক অতুলনীয় নান্দনিকতাও আনায়ন করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমীর মধ্যবর্তী সড়কে, যে সড়কে মনে পড়ে, নব্বই দশকের বইমেলায় দুপাশে প্রচুর দোকানপাট বসতো, সেখানে মেট্রোরেলের খোঁড়াখুঁড়ি। মাটি খুঁড়লে যা হয়, বেরিয়ে আসে ধুলো। ঐ সড়কে, গোটা বইমেলায়, প্রধান হুমকি মনে হয় ধূলো। আর সদ্যনির্বাচিত নগরপিতাগণ মশককুলকে সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত তারাও কানের কাছে সঙ্গীত সাধনা করে যাবে। করোনা নামক দৈত্য আসার পরে মশারা এমনিতেই কৌলিন্য হারিয়েছে, আর বইমেলায় লোক বেশি না মশা বেশি সেই পরিসংখ্যানে গেলে এটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। বাকি রইলো কেবল ধূলি- যা পুরো হয়ে বসছে বইমেলার তাবৎ খাবারে। এখানে আসার পথেই ডালিয়ার ফোন পেয়েছিলাম, ‘ভাই, মেলায় কি যাবেন আজ?’ ‘আজ? আমি কি প্রতিদিন যাই নাকি?’ আজই প্রথম যাচ্ছি। মেলায় পৌঁছে ডালিয়াকে ফোন করে জানতে পারি সে মেলার অনুষ্ঠানমালা হয় যে শামিয়ানা টাঙানো উঁচুমঞ্চে সেই প্যান্ডেল ছেড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে অপেক্ষা করছে। আমি মেলার সৌন্দর্যে বিহ্বলিত বালক স্থির বিশ্বাস নিয়ে ঘুরি আর ভাবি নামে লিটল হলেও তাদের মিলিত শক্তি তো আর লিটল নয়, চোখে পড়বেই। কিন্তু ভূতের আড্ডা যার মাথা থেকে বেরিয়েছিল সেই স্থপতি নির্ঝর যখন থেকে এই মেলার নকশা করার মহৎ দায়িত্বটুকু তার প্রতিভাবান স্কন্ধে তুলে নিয়েছেন, তিনি যে সৌন্দর্যের পাশেই রহস্যময়তা সাজিয়ে রাখবেন, আলোর পাশে ঝুলিয়ে রাখেন মায়াময় অন্ধকার, তিনি যে গোলকধাঁধা তৈরি করবেন- সেটা আর আশ্চর্য কী! আমি ঘুরে ঘুরে হয়রান, খুঁজে পাই না। যেখানে লেখক-পাঠক মুক্তমঞ্চ ছিল, সেখানে ফুড জোন, নাট্যমঞ্চের পেছনে বইপ্রকাশ মঞ্চ। এর সমুখেই যে লিটল ম্যাগাজিন চত্বর দেখতে পাইনি। আমি যে নগরে এসে পথ হারিয়ে ফেলা বালক বুঝতে পেরে ডালিয়া দূত পাঠালেন আমাকে উদ্ধারের জন্য। দূত আর কেউ নন, চিরচেনা সুহৃদ মাহমুদ হাফিজ। ডালিয়া বসেছিল ‘ভ্রমণগদ্য’-এর স্টলের সমুখেই, যে পত্রিকার সম্পাদক কবি ও ভ্রামণিক মাহমুদ হাফিজ। গোলকধাঁধার বইমেলায় বাতিঘরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ, দূর থেকে আমি ভেবেছিলাম মুজিবশতবর্ষে গোটা বইমেলা বুঝি মুজিবময়, তা কিছুটা বটেই, তবু এখনো বিস্মৃত নন কথাসাহিত্যের ‘জাদুকর’। অন্যপ্রকাশের আলোকিত প্যাভিলিয়নের কাছ থেকে দূরে নয় লিটল ম্যাগাজিন চত্বর। কেন আমি প্রথম পাঁচদিন আসিনি, তার দ- দিতে ডালিয়া ও মাহমুদ হাফিজকে নিয়ে যাই উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চের পেছনে ‘বিসমিল্লাহ রেস্তোরাঁয় আর ধূলির প্রলেপে ঢাকা খাদ্যের দুনিয়ায় ‘বিসমিল্লাহ বলে বসে পড়ি। ভেবেছিলাম পুরির সাথে সবজি খাবো, ডালিয়ার সেটাই ইচ্ছা, কিন্তু মাংস আছে, সবজি নেই। তখন মুরগিকুলের দারস্থ হই, গরুকুলের চেয়ে তারা যে অধিকতর নিরীহ তা কে না জানে? চিকেন চাপের সাইজ দেখে পেটে মৃদু চাপ অনুভব করি, তারা যে মানিব্যাগেও চাপ সৃষ্টি করবে বুঝতে পারি। যাহোক, খাবার মন্দ নয়, জগতের সকল ক্ষতিকর খাবারের মতোই সুস্বাদু! ফিরে আসি লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে। বেশিরভাগ স্টল ফাঁকা। তিন প্রান্ত দেয়াল ঘেষে সারিসারি, মাঝে কতিপয় বৃত্তাকার স্টল, সবমিলিয়ে চত্বরটি বর্ধমান হাউজের চত্বর থেকে বড় পরিসরের, তবু একটা ঘিঞ্জি ভাব আছে। প্রবেশমুখেই আমাকে ডাক দিলেন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। তার মাথায় হ্যাট, গায়ে শীতের পুলওভার। আমাকে আলিঙ্গনে বাঁধলেন। বলি, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে শীত এখনো জাঁকিয়ে বসে আছে। রহস্যটি খোলাশা করলেন। ‘যমুনা’ ও ‘সময়’- দুটো টিভি তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সাক্ষাৎকার দিতে। প্রথমটিতে পরিধান করে ছিলেন শার্ট, পরেরটিতে পোষাকে বৈচিত্র্য আনতে শার্টের উপর ওই পুলওভার চাপিয়েছেন পোষাক-আষাকে উদাসীন ও অনভিজ্ঞ মানুষটি। ভ্রমণগদ্যের স্টলে আমাদের সাথে যোগ দিলেন কবি মারুফ রায়হান, যাকে আমি সম্প্রতি এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে ‘ছোটপর্দার রাজপুত্র’ বলেছি। ওই অভিধায় আনন্দিত হয়ে আমাকে বিস্কিট খাওয়াতে চাইলেন বহকাল ধরে টেলিভিশনের চেনামুখ মারুফ রায়হান। প্রকা- সাইজের মুরগির চাপ খেয়ে আসা আমাদের কারুর পেটেই বিস্কিট ঢুকল না। আমরা চাইছিলাম চা খেতে। চা আনালেন মাহমুদ হাফিজ। তিনটি দুধহীন, একটি দুধসহ। এমনি সময়ে সেখানে আসেন শূন্য দশকের কবি তিথি আফরোজ। ফলে চা অর্ডার দিতে হয় আরো এককাপ। আমার দুধ চায়ের শুভ্ররঙ মারুফ রায়হানকে টানে, তিনি কৃষ্ণকায় লিকার চা তিথি আফরোজকে গছিয়ে দিয়ে দুধ চায়ের অর্ডার পাঠান। মারুফ রায়হান জানালেন, তার ‘নির্বাচিত কবিতা’ যাতে কবিতা আছে ২০১টি, প্রকাশ করেছে ‘ধ্রুবপদ’। দেখা হলো কবি মাসুদ হাসানের সাথে, সস্ত্রীক মেলায় এসেছেন। সস্ত্রীক এসেছেন কবি নির্লিপ্ত নয়ন। তার নয়ন অন্যদিকে ফিরে থাকায় আমরাও নির্লিপ্ততা অবলম্বন করি। কথা বলি তার হাস্যোজ্জ্বল সহধর্মিণীর সাথে। মেলায় মাঝে মাঝে ক্লান্ত ও আড্ডাপ্রিয় দর্শকদের জন্য বেঞ্চ পেতে রাখা হয়েছে। এমনি এক জায়গায় দেখা হলো কবি সঙ্গীতা ইমামের সাথে। তার উজ্জ্বল গাত্রবর্ণের দ্যুতি ঐ চারিপাশে আলো কিন্তু তবু স্থানে স্থানে অন্ধকার বইমেলার ওই স্থানে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছিল। মারুফ রায়হান এসেই বললেন, ‘আমি সঙ্গীতার সাথে ছবি তুলব।’ পাঞ্জেরী সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত শাম্মী ইসলাম নীলার বই ‘ধীরে এলো বসন্ত’ নিয়ে আলোচনা চলছিল, সেখানে ধীরে এসে দাঁড়ালেন আরেক নবীন কবি (বয়সে নন, বইপ্রকাশে) রুখসাত তানজিম। তার প্রথম কাব্য ‘নৈঃশব্দ্যের চরণ’ প্রকাশ করেছে শিখা প্রকাশনী। তারাও চাইলেন সঙ্গীতা ইমামের, যার ‘স্পর্শের রকমফের’ বইটির নামের প্রশংসা করছিলেন সকলে, সাথে ছবি তুলতে। এর আগে দেখা হয়েছিল কবি আশরাফ জুয়েলের সাথে। দীর্ঘদেহী ও সুপুরুষ কবি হাঁটছিলেন একদল পুরুষের সাথেই। জানালেন কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের প্রধান সংগঠক কবি বিসমা উপ্রেতি বাংলাদেশে আসছেন। তাকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আমি ও তিথি আফরোজ একটি স্টলের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে সেখানে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে পড়ি। এটি নিমফিয়া পাবলিকেসন্স। দোকানের যুবকটি জানাল নিমফিয়া নবীন প্রকাশনা, এর মালিক করুনাংশ বড়ুয়া একজন ট্যুর অপারেটর, এ পর্যন্ত একজন লেখকের বই প্রকাশ করেছেন। সেই সৌভাগ্যবান লেখক হলেন মুহাম্মদ জামির, যিনি একজন পেশাদার রাষ্ট্রদূত, এবং মূলত ইংরেজিতে লেখেন। ওই ইংরেজি বই দোকানটিতে আমাদের নোঙর করার আরেকটি কারণ। কেননা, এবছর তিথি আফরোজের নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হবে। মুহাম্মদ জামির মূলত রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বৈদেশিক সম্পর্ক, বিশ্ব রাজনীতি ও কূটনীতি নিয়ে লিখেন। পেপারব্যাকে মুদ্রিত ইংরেজি বইগুলোর ছাপার মান বেশ ভালো। কথা ছিল বাংলাপ্রকাশ স্টলে কবি ও ছড়াকার রহীম শাহের সাথে দেখা করবো। স্বাধীনতা স্তম্ভের জলাধারের পশ্চিম পার্শ্বে বাংলাপ্রকাশের প্যাভিলিয়নটি প্রথম আলো প্যাভিলিয়নের অনুরূপ, ঝলমলে আলোকিত ও চারপাশ খোলা। রহীম শাহকে পাই না, সুমাইয়া ও জুঁই নামের দুজন তরুণীর সাথে দেখা হয়। ‘মহাদেশের মতো এক দেশে’ বইটির প্রকাশনার মান ও ঢাউস সাইজ দেখে তিথি আফরোজ বেশ অবাক! সুমাইয়া ও জুঁই ভেবেছিল আমি বইটি কিনবো, যখন জানল আমিই বইটির লেখক, তখন অবাক হলো। তাদের মানস সরোবরে পাঠক থেকে দ্রুত লেখকে উন্নীত হয়ে আমি সমীহ পাই খানিক, যদিও জানি লেখক মানেই পাঠক। আর আমার নিজের বইয়ের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এখনো আমি নিজেই। কিনি আর বিতরণ করি। সরকারের পুস্তক ক্রয় কমিটি এগিয়ে না আসা পর্যন্ত এটা বোধহয় চলতেই থাকবে। ২ কাল বইমেলায় এসেছি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে না ঢুকে আমি যাই বর্ধমান হাউজের মূল চত্বরে। মাইকে ঘোষণা শুনি, মূলমঞ্চে গান পরিবেশন করবে সত্যেন সাহা শিল্পী গোষ্ঠী। পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়ে এই মঞ্চে বিকেল থেকে রাত অবধি অনুষ্ঠানমালা চলে, প্রথম অর্ধে চলে গম্ভীর প্রবন্ধ পাঠ, দ্বিতীয় অর্ধে সুরেলা সঙ্গীত ও চপলা নৃত্য। এখন বইমেলায় এলে এখানে, বিশেষ করে লিটল ম্যাগাজিন চত্বর চলে যাওয়ার পরে, বিশেষ আসা হয় না। আমি গানের টানে ম-পের দিকে এগিয়ে যাই। বিপ্লবী নেতা সত্যেন সেনের নামটিও আমাকে টানে। সাত নারী আর চার পুরুষের দলটিতে যিনি হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন তার পোষাক মুসলিম লীগারের মতো আর যিনি কিবোর্ড বাজাচ্ছেন তার পোষাক আওয়ামী লীগারের মতো। পাশে এক তবলাবাদক আছেন, যিনি মনে হয় আপামর জনতার প্রতীক। দলটিতে বাদ্যযন্ত্র বলতে ওই তিন, তারা গান গাইলেন খুব আবেগ ঢেলে। সবগুলো গানই বিপ্লবী, একুশের চেতনা সম্পৃক্ত। গানের পরে নাচ। কী করে উঠি? দৃষ্টিনন্দন নাচ পরিবেশন করলো বেনুকা ললিতকলা কেন্দ্র। প্রথম নাচ ‘আইলো রে পরমা পরম বসন্ত, সখি কোকিলা ডাকিল রে/এমন সময় প্রিয় সখা বিদেশে রইল রে’ গানের সুরে নাঁচল নায়িকা ও চার সখী। নায়ক বিদেশে নয়, ছিল দেশেই, তার সাথেই নাচল। এরপরে গোল গোল প্রিন্টের সাদা শাড়ি পরা তিন অপরূপ লাস্যময়ী নৃত্যশিল্পী ‘এই জীবন ছিল নদীর মতো দিশেহারা’ অপূর্ব মাধুর্যময় গানটির সাথে হৃদয় দিশেহারা করা নাচ নেচে মুগ্ধ করলো সবাইকে। লাল শাড়ি আর কালো ব্লাউজ পরিহিতা তিন নবীন নাচিয়ে শিল্পী একুশে ফেব্রুয়ারির উপর রচিত বেশ কিছু প্রচলিত গানের সাথে নাচল অনেকটা কোলাজের মতো, কোনটিই সম্পূর্ণ নয়, সব মিলিয়ে একটি নৃত্যগীতরচনা। বইমেলায় প্রবেশের শেষ সময় সাড়ে আটটা, আমি নৃত্যগীতের আসর ছেড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করি আটটা কুড়িতে। সোজা চলে যাই লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে যেখানে জমজমাট আড্ডা চলছিল কবি কাজল চক্রবর্তীকে ঘিরে। কলকাতা বইমেলা শেষ করেই তিনি চলে এসেছেন ঢাকায়। বাংলাদেশের সাথে তার আত্মার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কথা যা কিছু হলো তা স্বাস্থ্য বিষয়ক, সাহিত্য বিষয়ক নয়। সেখানে ছিলেন কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু, কবি মাহমুদ হাফিজ ও কবি আবম ছালাউদ্দিন। শেষবেলায় মাহমুদ হাফিজের সাথে যাই পাঠক সমাবেশ প্যাভিলিয়নে। সেখানে মাসরুর আরেফিন এসেছেন সস্ত্রীক। মাসরুর গিন্নি ফারহানা আমার দিকে অচেনা চোখে তাকিয়ে ছিলেন, আমি চেনা ভাব আনতে বলি, আমি আজফারের বন্ধু; তাতে অপরিচয়ের ঝাপসা ভাবটি স্বচ্ছ হয় না। আমি তো অবাক মাসরুর গিন্নি আজফারকে চেনে না, আমি বলি আজফার হলো মাসরুরের একসময়ের গুরু, আর আপনি তাকে চেনেন না, তার নাম শোনেননি, এটা তো অবাক ব্যাপার। মাসরুর কি তবে আজফারের কথা ফারহানাকে বলে নি? মাসরুর বেশ বিব্রত, স্ত্রীকে বলে, তুমি তো তাকে চেনো। যা হোক আমি মাসরুরকে স্মরণ করিয়ে দেই যে তাজমহল রোডে সে প্রায়শই আজফারের বাসায় আসতো, রাত বিরেতে, ঘড়ির কাঁটা মেনে নয়, অনেকটা সক্রেটিসের শিষ্যের মতো আর আমরা তো আজফারকে সক্রেটিস বলেই জানি, মাসরুরও তা জানে, ঋণ স্বীকারে তার কোন কুণ্ঠা নেই, স্ত্রীর ওই স্মৃতি বিস্মত হওয়াটাই তার কাছে বিব্রতকর। সেটা হালকা করতেই বলে, অনেকবছর কেটে গেছে, ত্রিশ বছর কম কথা নয়, কামরুল ভাই। ফারহানাকে দেখিয়ে সে বলে, কামরুল ভাই আমার অনেক বছরের পরিচিত, ত্রিশ বছর তো হবেই, আমি মাথা নাড়ি, বলি, মনে আছে মাসরুর চট্টগ্রামে আমরা প্রতিবেশী ছিলাম, আপনি থাকতেন পাহাড়ের, যদি তাকে পাহাড় বলা যায়, পাদদেশে আর আমি থাকতাম পাহাড়ের চূড়ায়, ওই মিমি সুপার মার্কেটের পেছনে, জায়গাটির নাম হিল ভিউ। মাসরুরের সব মনে আছে। সে মাথা ঝাঁকায়। ফারহানার দিকে তাকিয়ে বলি, তখনো আপনি মাসরুরের জীবনে আসেননি। সে তখন কৌতূহলী হয়ে আমাকে দেখে। বোঝে লোকটি একেবারে অনাহূত কেউ নয়। অনাহুত যে নই তা তো বিজুই বুঝিয়ে দিল, তার লোকেরা এক বাটি চানাচুর মেশানো মুড়ি এনে তুলে ধরলো মুখের সমুখে। তিনদিকে ডাবল সোফা, এমন তাদের ঢাল যে বসলে সহজে ওঠা যায় না, যারা বসেছিলেন তারা সকলেই বিদ্বজ্জন, সহজে উঠবার পাত্র নন। আমার পাশেই বসেছিল মাসরুর আরেফিন, গত বছর ‘আগস্ট আবছায়া’ লিখে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিলেন, এবছর বেরুলো ‘আলথুসার’। তার কলমে সোনা ফলছে, উপন্যাসের পাশাপাশি ফল্গুধারার মতো কবিতা লিখছেন, তাতে উপন্যাসের মতোই পঠন পাঠন, উপলব্ধি, ও জীবন অভিজ্ঞতার এক সুমধুর ও প্রাজ্ঞ কোলাজ তৈরি হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। আলথুসার আজই এসেছে বইমেলায়, চারটায় এসেছিল, এক ঘণ্টার মাঝে একশ কপি শেষ, বেচাকেনার যে কোন মানদ-ে অভাবনীয় সাফল্য। চমকে গেছেন লেখক নিজেই, আনন্দিত তো বটেই, কিছুটা উত্তেজিত আছেন, প্রকাশক বিজু বেজায় খুশি। খুশি হয়ে মুড়ি খাওয়াচ্ছে। মাসরুরের কবিতার বই ‘পাঠক সমাবেশ’ থেকে বেরিয়েছে, আর আলথুসার ‘প্রথমা’ থেকে। আলথাসুরের কপি শেষ বলে মাহমুদ হাফিজ নিয়েছেন কবিতার বইটি। ‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’ এক কপি বাগিয়ে ধরেছেন মাসরুরের সমুখে অটোগ্রাফ নিতে। দেখাদেখি আমিও। আমার ঠিক বরাবর বসে আছেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক আহমাদ মাযহার। আমার লেখালেখি প্রসঙ্গে বললেন, কামরুল তো কলম ধরলেই লেখা তরতর করে বেরিয়ে আসে। মাসরুর বল্ল হ্যাঁ, কামরুল ভাই আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে অনেক কমেন্ট করেন। মাযহার ভাই বোঝাতে চেয়েছেন আমার ফেসবুকে নানা প্রকার লেখালেখি, মাসরুর বুঝল, তার পোস্টে আমার কমেন্ট। খুব কি কমেন্ট করি আমি? মনে হয় না, তার দরকারও হয় না, কারণ মাসরুরের লেখার ভক্তকূলের অভাব নেই। ওরাই তো এক ঘণ্টায় উজাড় করে নিয়ে গেল একশ কপি ‘আলথুসার’। মাসরুর দেখায় আলথুসারের প্রচ্ছদে জীবনানন্দ দাশের ছবি দুবার ব্যবহৃত হয়েছে, আর বাকিদের একবার। আলথুসারের প্রচ্ছদ দেখিয়ে বলে, সুন্দর না? আমি ভোট দেই কাব্যটিকে, বলি, ‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’ বেশি সুন্দর। মাসরুরের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। শুনে ওপাশে বসে থাকা কবি জাহিদ হায়দার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে জানালেন, যিনি বলেছেন, কবিতা বহুপ্রকার সেই জীবনানন্দ দাশের কবিতা কিন্তু একপ্রকার। তিনি অনেক মহৎ কবিতা লিখেছেন সত্যি, কিন্তু পাঠ করলে একটা একঘেয়েমি আসে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই মন্তব্যের সাথে জাহিদ হায়দার যোগ করলেন তাঁর (জীবনানন্দ দাশ) মতো ‘মতো’ শব্দটি আর কেউ ব্যবহার করেননি। এটি একটি দুর্বলতা। আমি শুনি, কিছু বলি না। জানি সকল শক্তিমানের দুর্বল দিক আছে। রবিঠাকুরেরও অনেক দুর্বল কবিতা আছে। কবি জাহিদ হায়দারের পাশে বসে আছেন ড. মাসুদুজ্জামান। তিনি বোধকরি প্রতিদিন মেলায় আসেন। কারণ আমি যে কয়েকটি দিন এসেছি তাকে দেখতে পেয়েছি। তার পাশে নব্বই ডিগ্রি কোণে যিনি বসে আছেন তাকে প্রথমটায় চিনতে পারিনি, পরে দেখি কবি কামরুজ্জামান কামু। একে দেখলেই মনে পড়ে আলবেয়ার কামুর কথা। ওই মহান ফরাসী লেখকের নামটি, যেহেতু কামরুজ্জামান থেকে কামু উৎপাদন সম্ভব, তাই কামু যুক্ত করে নিয়েছেন। এখন সবাই তাকে কামু নামেই ডাকে। কে যেন বল্ল সে আলবেয়ার কামুকে আলবার্ট কামু বলতো। ড. মাসুদুজ্জামান বললেন, তাতে কোন ক্ষতি নেই। এই সুযোগে আরেকজন বললেন, ফুকো উচ্চারণ করতাম ফুকোল্ট। ড. মাসুদুজ্জামান অনুমোদন দিয়ে বললেন, তাতেও ক্ষতি নেই। গোলাপ যে নামেই ডাকো। কবি ব্রাত্য রাইসুকে আজ কেমন যেন কর্পোরেট কর্পোরেট লাগছিল, তার সৌন্দর্য তাতে বেড়ে গেছে। কামরুজ্জামান কামু নাকি কর্পোরেট হয়েই গেছে। পোষাকের সেই প্রাচীন মালিন্য নেই, ক্লিন শেভ মুখ। রাইসুও তাই, তার দীপ্তি অধিকতর। শেষবেলায় ভারি আনন্দ হলো পাঠক সমাবেশে। একপাশে ওই বিদগ্ধজন, অন্যপাশে তিন রূপসী রমণী, আলো নিভে যেতে পারে যে কোন মুহূর্তেই, মেধা ও রূপের মিলিত আলোয় স্টলটি উজ্জ্বল। ওদিকে চলছে বই বিক্রির হিসাব মেলানো। বাতি অবশেষে নিভে যায়, আমরা বাড়ির পথ ধরি। তাড়াহুড়োয় তিথি আফরোজের ইংরেজি কবিতার বই ঞযব ইষরহফ এড়ফ য়ের পেজমেকআপ করা পা-ুলিপি বিজুর দোকানে ফেলে আসি। গেটের বাইরে এসে মনে পড়ে। তখন তো আর প্রবেশ করতে দিবে না পুলিশ, বিজুকে ফোন করলে সে এক যুবকের হাতে প্যাকেটটি পাঠিয়ে দেয়। পথ না মিললেও মাহমুদ হাফিজ আমাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবেনই। আমিও গাড়ির আরাম ত্যাগ করতে পারি না। দোয়েল চত্বর থেকে আমরা গাড়িতে চাপি, কবি কাজল চক্রবর্তী নেমে যান তোপখানা রোডে, সেখানকার এক হোটেলে উঠেছেন তিনি। সেটা ভালো নির্বাচন কেননা বইমেলা থেকে পায়েহাঁটা দূরত্বে সেগুনবাগিচা। কাজল চক্রবর্তী নেমে যেতেই সেস্থান দখলে নেন ‘এবং মানুষ’য়ের আনোয়ার কামাল। যেতে যেতে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয় তার অন্যতম হলো বড়ো হয়ে উঠলে মানুষের অহঙ্কার ও উন্নাসিকতার বৃদ্ধি। সেও নাহয় মেনে নেওয়া যায়, যা মেনে নেওয়া যায়না তা হলো অকৃতজ্ঞতা। মাহমুদ হাফিজ বললেন, কেবল অকৃতজ্ঞতাই নয়, কৃতঘœতা। আমরা এই ঐক্যমতে পৌঁছাই একটি মহৎ মানবিক গুণ হলো উপকারীর উপকার স্বীকার করা। আমি নেমে যাই পুলিশ প্লাজায়। আবদ্ধ গাড়ি থেকে নামতেই বসন্তের শীতমোড়ানো বাতাস আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর চাদরে। মনে মনে বলি, ভরা ভাদর হলে তো এমন মুক্ত আকাশের নিচে নামতেই পারতাম না।