করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
হাসানুল কায়সার
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) কথাসাহিত্যিক। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে পিতার কর্মস্থল বিহারের সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের নিকট মালবদিয়া গ্রামে। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের স্নাতক। তিনি তদানীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব-রেজিস্ট্রার; শেষজীবনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার, মানিক তার ডাকনাম। তার মা নীরদাসুন্দরী দেবী ছিলেন গৃহিণী। ১৪ ভাই-বোনের মধ্যে মানিক ছিলেন অষ্টম। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল ও মেদিনীপুরের নানা স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিতে হয়। শেষপর্যন্ত তিনি মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে ১৯২৬ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। পরে বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ন মিশন কলেজ থেকে আইএসসি (১৯২৮) পাস করে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে বিএসসি-তে ভর্তি (১৯২৮) হন, কিন্তু পাঠ অসমাপ্ত রেখেই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন।

কলেজ ক্যান্টিনে একদিন আড্ডা দেওয়া অবস্থায় এক বন্ধুর সঙ্গে মানিক বাজি ধরেন তিনি তার লেখা গল্প বিচিত্রায় ছাপাবেন। তখন কলকাতায় বিচিত্রা পত্রিকা ছিল অত্যন্ত বিখ্যাত। খ্যাতিমান কবি, লেখকরাই সেখানে লিখতেন। বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরে তিনি লিখে ফেললেন তার প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’। পরে গল্পটি বিচিত্রার সম্পাদক বরাবর পাঠিয়ে দেন। গল্পের শেষে লেখক নাম স্বাক্ষর করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঠানোর চার মাস পর বিচিত্রায় গল্পটি ছাপা হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই গল্পটি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। সমকালীন লেখকদের কাছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি পরিচিত হয়ে ওঠে। এরপর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। আর এই সাহিত্যচর্চার কারণে তিনি একাডেমিক পড়াশোনায় আর এগোতে পারেননি; শেষাবধি শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে সাহিত্য রচনাকেই তিনি তার মূল পেশা হিসেবে বেছে নেন।

১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ‘উদয়াচল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস’ পরিচালনা করেন। একইসঙ্গে তিনি বঙ্গশ্রী (১৯৩৭-৩৯) পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। এ ছাড়া কিছুদিন তিনি ভারত সরকারের ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টের প্রভিনসিয়াল অর্গানাইজার এবং বেঙ্গল দফতরে প্রচার সহকারী পদেও কর্মরত ছিলেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের একজন শক্তিমান লেখক।

১৯৪৩ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক মাস একটি সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৩৮ এ সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে কমলা দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তখন তিনি রীতিমতো খ্যাতিমান লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

১৯৪৪ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ সময় থেকে তার লেখায় কমিউনিজমের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আমৃত্যু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৪৬ সালে প্রগতি লেখক সংঘের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬-এ ভারতের দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গ প্রগতি লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি এর যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন তিনি।

বিশ শতকের তিরিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ-শরত্চন্দ্র ধারার বিরোধিতা করে যে কল্লোল গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে, সেই গোষ্ঠীর লেখক হিসেবে মানিকের স্বতন্ত্র পরিচয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার জীবনের প্রথম পর্বে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড, ইয়ুং, অ্যাডলার প্রমুখের প্রভাব হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি মার্কসবাদে দীক্ষা নেন। সাহিত্যের মাধ্যমে মার্কসের শ্রেণিসংগ্রামতত্ত্বের বিশ্লেষণ এবং মানুষের মনোরহস্যের জটিলতা উন্মোচনে তিনি ছিলেন একজন দক্ষশিল্পী। শহরের পাশাপাশি গ্রামজীবনের পটভূমি অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণিত হয়েছে তার উপন্যাস ও গল্পে।

মাত্র ৪৮ বছরের জীবনে অর্ধশতাধিক উপন্যাস ও ২২৪টি গল্প তিনি রচনা করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ : উপন্যাস জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০-৪১), চিহ্ন (১৯৪৭), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), সার্বজনীন (১৯৫২), আরোগ্য (১৯৫৩) প্রভৃতি; আর ছোটগল্প অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), হলুদ পোড়া (১৯৪৫), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০), ফেরিওয়ালা (১৯৫৩) ইত্যাদি। পদ্মানদীর মাঝি ও পুতুলনাচের ইতিকথা  উপন্যাস দুটি তার বিখ্যাত রচনা। এ দুটির মাধ্যমেই তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পদ্মানদীর মাঝি চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার রচনায় মানুষের অন্তর্জীবন ও মনোলোক বিশ্লেষণে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তার প্রথম দিকের রচনায় নিপুণভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে মানুষের অবচেতন মনের নিগূঢ় রহস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর পরবর্তী রচনায় তার সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্রের মানুষের নাম যা-ই হোক, তারা তো তারই মতো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সামনে অধস্থ মানুষ। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, একটি বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে ধাবিত; ভারতবর্ষে, বিশেষত বাংলায় নরম ও চরমপন্থার রাজনীতির টানাপড়েন, আবার ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণির স্বনির্মিত ‘আধুনিকতা’, আছে রবীন্দ্রনাথকে বুঝে না বুঝে গা ভাসানো ‘রাবীন্দ্রিকতা’, আবার বিরোধিতা, একই সঙ্গে পূর্ব আর পশ্চিম বাংলা ভুখা মানুষেরও মিছিল। ব্রিটিশ রাজশক্তি সেসব মানুষের দিকে যেন কোনো কালে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি; অথবা তাদের জানা ছিল বংশবদ একটি শিক্ষিত শ্রেণি এখানে তৈরি করতে পারলে তারাই এই বেনিয়া শক্তিকে ফুল বেলপাতা চন্দনে প্রায় পুজো করে জিইয়ে রাখবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নাগরিক জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে তার নিখুঁত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার এ পর্যায়ের রচনায়। তিনি নিজে চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়েছেন, তা সত্ত্বেও তিনি সাহিত্যচর্চাকেই পেশা হিসেবে আঁকড়ে ধরেছেন। এক সময় তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার জন্য সাহিত্যিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। তিনি কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে ঐক্য ও মৈত্রী স্থাপনের প্রয়াসে সক্রিয় ছিলেন। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি দেহ ত্যাগ করেন।