করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





মার্চের এক অধ্যায়
সুশান্ত মজুমদার
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সারাদেশের মতো দক্ষিণের বাগেরহাট মহকুমা ছিল কর্মসূচী, আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজনৈতিক তৎপরতায় অন্যতম অগ্রগণ্য অঞ্চল। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে যথেষ্ট সক্রিয়। ১৯৬২ সালের চিন্তা-ভাবনায় বিভেদাত্মক, প্রগতিবিমুখ, বাঙালী বিদ্বেষী সরকারী শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবা আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয় দফার সংগ্রামের প্রারম্ভ, ৬৭ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চায় সরকারী নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেও বাগেরহাট ছিল সরব। ৬৮ সালে শেখ মুজিবসহ বিভিন্ন পেশার বাঙালী বরেণ্যজনদের নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচী এখানে যথাযথ পলিত হয়। ৬৯-এর দেশ ও জনমানস মথিত ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে বাগেরহাট ছিল গণঅভ্যুত্থানের শহর। সামরিক শাসক আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্র এলাকার সচেতন মানুষ প্রত্যাখ্যান করেন। এর প্রভাবে মুসলিম লীগ ক্রমাগত গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি ও আগ্রহ ছিল না। অনেক আগে থেকে বাগেরহাটের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল কৃষক সংগ্রাম। কৃষক সমিতির শ্রেণী সচেতন সাংগঠনিক কার্যকলাপে মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি স্থায়ী স্থান পায়নি। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির গোপন রাজনীতি শুরুর পর তা নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে একাধিক উপদলে বিভক্ত হলে কৃষক সংগঠন চলে আসে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’র হাতে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নবম সেক্টরের বাগেরহাট সাব-সেক্টরে এরাই মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহত্তম ঘাঁটি ও দল গড়ে তোলে।

ক্ষমতাসীন নতুন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। বাগেরহাট মহকুমায় পাঁচটি প্রাদেশিক সংসদীয় আসন। সাতটি থানার মধ্যে একটি থানা রামপাল খুলনার আসনের সঙ্গে যোগ হলে বাকি ছয়টি থানা নিয়ে দুটি জাতীয় সংসদের আসন। নির্বাচনে সব আসনে ভোটে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী। সারাদেশবাসীর মতো বাগেরহাটবাসীও দারুণ উল্লসিত- এই প্রথম বাঙালীরা পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আসীন হচ্ছে। ষাটের দশকে সংঘটিত আন্দোলনের প্রাণবন্ত সজীব ভাব বুঝি অনিঃশেষ। তারই প্রভাবে গোটা অঞ্চলজুড়ে বিরাজ করে আনন্দ উৎসব। হাটে-ঘাটে-মাঠে-ব্যবসা কেন্দ্রে এক আলোচনা- আওয়ামী লীগ পাকিস্তানকে শাসন করবে। বাঙালীরা বহুকাল উপেক্ষিত, নিপীড়িত, শোষিত- এবার অবশ্যই উন্নয়নের আশা করা যায়।

একাত্তরের ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত সংসদ সদ্যসরাও এখানে আসবেন। দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণজনের মধ্যে উদ্বেল প্রতীক্ষা। পহেলা মার্চ দুপুরের মধ্যে মুখ থেকে মুখে জানাজানি হলো- প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুর একটায় বেতার ভাষণ দেবেন। ঢাকা থেকে সব খবর দ্রুতই যেন চারপাশে ছড়িয়ে যেত। এক্সচেঞ্জ সিস্টেমের টেলিফোনের মাধ্যমে খবরাখবর রাজনৈতিক কর্মসূচী-তথ্য-ঢাকার ঘটনা প্রবাহের সংবাদ বাগেরহাটে পৌঁছাত। শহরের মধ্যখানে ডাকবাংলো, তার পাশে উকিলবার। সামনে ভিড় করে মানুষ কথাবার্তা শুনছে, আলোচনাও করছে। আইনজীবীদের অনেকে রাজনীতি করেন, দলের নেতা, এরাই বিশ্লেষণ করে রাজনীতির অবস্থা ভাল ব্যাখ্যা করতে পারেন। সবার এক কথা- ইয়াহিয়া খান ভাষণে নতুন কী বলেন? বাজারে, রেস্টুরেন্টে, রাস্তার দু’পাশের দোকানের রেডিওতে বক্তৃতা শুনতে মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে। শহরজুড়ে নীরবতা। রেডিও’র ঘোষণায় বলা হলো- প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এখন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। না, এ তো প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ নয়। অপরিচিত একজনের স্বর দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে জানিয়ে দেয়- ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। শুনে ক্ষুব্ধ মানুষ হৈচৈ উঁচু আওয়াজ রচনা করে। পরক্ষণে স্তম্ভিত হয়ে তারা যেন বঞ্চিত হওয়ার বোধে নীরবতার মধ্যে জমে গেল। সহসা শহরের চার রাস্তার মোড়ের জটলা শ্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে- ‘ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা ঢাকা’, ‘ইয়াহিয়া-ভুট্টোর গদিতে আগুন জ¦ালো একসাথে’, ‘জয় বাংলা’। দাবি আদায়ে একসঙ্গে মানুষের ধ্বনি ক্রোধী মানুষের মনে আগুন ধরিয়ে দিলে সবাই দলবদ্ধ হয়। তুমুল ধ্বনি বুঝি বাগেরহাটের সব চরাচরে ছড়িয়ে ভৈরবের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বাতাসে উড়ে দিক-দিগন্ত ধরে ফেলে। ডাকবাংলোর সামনে রাস্তার ওপাশের রেস্টুরেন্ট থেকে একটা চেয়ার নিয়ে তার ওপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ নেতা অজিয়র রহমান দৈনিক সংবাদের পুরনো একটা কপি হাতে ধরে যথাসম্ভব কণ্ঠে জোর দিয়ে বলেন, এবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু মশালের আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে ঠিকই বলেছিলেন। এবার তিনি সংবাদ থেকে পড়ে শোনান- ‘এই বাংলার স্বাধিকার-বাংলার ন্যায্য দাবিকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু বাংলার সাত কোটি মানুষ আর বঞ্চিত হতে রাজি নয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজনে আরও রক্ত দেব। বাংলার ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।’ অজিয়র রহমান আরেকটি খবরের কাগজ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বিবৃতি পড়ে শোনান : ‘জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া বানচালের চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জাগ্রত জনতা, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও জনগণকে বিজয় বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হচ্ছে।’ কাগজে ছাপা কয়েকদিন আগের বঙ্গবন্ধুর বিবৃতির অংশবিশেষ শুনে মানুষ উপলব্ধি করতে পারেন, বাঙালীর নির্ভরযোগ্য এই নেতা একজন দূরদর্শী রাজনীতিক। কিন্তু বাঙালীদের হাতে শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙালী সামরিক শাসকদের অনীহার শেষ কোথায়! কী হতে পারে এর পরিণতি? ইয়াহিয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলে বাঙালীরা অবশ্য ফুঁসে উঠবেই।

বাগেরহাটসহ বিস্তীর্ণ দক্ষিণাঞ্চলের বড় একটা এলাকার নেতা শেখ আবদুল আজিজ খুলনা-২ আসন থেকে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ঢাকা-খুলনা-বাগেরহাট নিয়ে তার রাজনৈতিক কার্যক্রম। কেন্দ্রের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, ঢাকার যাবতীয় আন্দোলনের ঘটনা তার মাধ্যমে গোটা দক্ষিণের স্থানীয় নেতারা পেয়ে থাকেন। কখনও ঢাকাবাসী তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী ফোনের মাধ্যমে কর্মসূচীর খবরাখবর সরবরাহ করেন। ঢাকা থেকে সার্কুলারের মাধ্যমে এলাকার বামপন্থীরা দ্রুত পরিবর্তিত রাজনীতির বিশ্লেষণ ও পরিকল্পিত কার্যপ্রণালীসমূহের বাস্তবায়নের নির্দেশ নিয়ত পেয়ে থাকে। তারা লিফলেট ছড়িয়ে জানিয়ে দেয়- দ্বন্দ্ব চরম স্তরে পৌঁছেছে, একটা গুণগত পরিবর্তন অর্থাৎ জনযুদ্ধ ছাড়া ক্ষমতা গ্রহণের অন্য কোন সহজ ফর্মুলা নেই।

নদীর ওপার থেকে লাল ঝা-া নিয়ে কৃষক সমিতির সদস্যদের বিশাল এক মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। তাদের স্লোগানে শোনা গেল : ‘কৃষক-শ্রমিক-জনতা, গড়ে তোল একতা’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর’। ফুরিয়ে আসা বিকেলে ঠিক সন্ধ্যার আগে শহরের সর্বসাধারণ জেনে যায়- সংসদ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণায় ঢাকা গর্জে উঠেছে। ঢাকা স্টেডিয়ামে কমনওয়েলথ একাদশের সঙ্গে পাকিস্তানের চতুর্থ দিনের ক্রিকেট খেলা চলছিল। জাতীয় পরিষদের বৈঠক হবে না শুনে ক্ষুব্ধ দর্শক স্টেডিয়ামের খেলা ভেঙ্গে তাঁবুতে আগুন দিয়ে রাজপথে বেরিয়ে এসেছে। হাইকোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা স্টেট বাস ক্ষোভের আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। ঢাকা বিমানবন্দরের, মতিঝিলের বিমান অফিসের কর্মীরা কাজ ছেড়ে বেরিয়ে আসায় বন্ধ হয়ে গেছে প্রদেশের ও আন্তঃদেশীয় রুটে প্লেন চলাচল। বিকাল ৪টায় হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক শেষে জমায়েত জনসমুদ্রের সামনে তিনি বলেন : ‘জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করা খুবই দুঃখজনক। বাংলার জনগণ ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করছে।’ সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায়, ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। পূর্বাণীর সামনের মানুষকে বঙ্গবন্ধু আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন : ‘আমি মর্মাহত। ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রামের মাধ্যমে এদেশের মানুষের মুক্তি আনব।’ ১ মার্চের রাতের দু’টি ঘটনা দক্ষিণের মানুষ পরদিন জানলো। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলার গভর্নর ভাইস্ এডমিরাল আহসানকে পদচ্যুত করেছেন। তিনি ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসনকর্তা লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে অসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব দিয়েছেন। শেখ মুজিবের আহ্বানে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তার খবর ও ছবি ১১০নং সামরিক আইনের নির্দেশে সংবাদে ছাপা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাগেরহাটের মানুষ সকালে ঘুম ভেঙ্গে নিষিদ্ধের সংবাদ শুনে স্লোগানে স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। এ তো দাবি আদায়ের সংগ্রামকে নস্যাৎ করে দেয়া। ঘটনার প্রেক্ষাপটে অবস্থা ক্রমশ পাল্টে যাওয়ায় এলাকাবাসী হয়ে ওঠে মারমুখী।

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী ২ মার্চ ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয় হরতাল। মিছিলের নগরী রাজধানী। সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, যানবাহন, ট্রেন, বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। সরকারী, বেসরকারী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীর উপস্থিতি ছিল না। এই হরতাল তখন খুলনা-বাগেরহাটে পালিত হওয়ার কথা না। হরতাল কেন্দ্র করে উত্তাল খুলনায় ২, ৩ ও ৪ মার্চ পুলিশের গুলিতে ১০ জন শহীদ হলে ডাকা হরতালের প্রভাবে খুলনার সঙ্গে অচল হয়ে যায় বাগেরহাট। ৬ মার্চ পর্যন্ত একটানা হরতাল চলে। শেষের দিকে কেবল ব্যবসাকেন্দ্র বাগেরহাটে বেলা ২টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। এমন অব্যাহত হরতালের মধ্যে মফস্বলে খবর এলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

চারপাশে শুরু হয়েছে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো। বাগেরহাটের ছাত্র-জনতা পতাকা দেখেনি, পতাকার রং সম্পর্কে আদৌ কোন তথ্য তারা জানে না। পতাকা উত্তোলনের খবর জানার পর রোমাঞ্চিত বিভিন্ন জন অনুমানে পতাকার রং-আকার নিয়ে তুমুল কথা চালাচালি শুরু করে। স্থানীয়রা মুখে মুখে তৈরি করে ফেলে বাংলাদেশের পতাকার কল্পিত নকশা। পাকিস্তানের অন্যায় নিষ্পেষন থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে পতাকা এক নতুন উপলব্ধি, স্বাধিকারের প্রতীক। পরদিন জানা গেল ঢাকার আরও ভয়াবহ খবর। লাঠি ও রড হাতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সামরিক সরকার বেতার মারফত ঢাকা শহরে রাত ৯টা থেকে ৩ মার্চ সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে। গভীর রাতেও ছাত্র-জনতা-শ্রমিকদের অব্যাহত থাকে কারফিউর বিরুদ্ধে মিছিল। বহু বিক্ষোভকারী বুলেটবিদ্ধ হয়েছে। ঢাকার নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলিবর্ষণের কঠোর নিন্দা করে বঙ্গবন্ধু বিবৃতি দিয়েছেন : ‘বাংলাদেশে আগুন জ¦ালাবেন না। যদি জ¦ালান তবে সেই দাবানল থেকে আপনারাও রেহাই পাবেন না।’ রাজনীতি সচেতন বোদ্ধাজনরা বোঝেন, বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশ উচ্চারণ করেছেন। এই ভূখ- এখন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু আরও বলেছেন : ‘বাংলার মাটিতে যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সবার প্রতি আকুল আহ্বান বাংলার মাটিতে যেন বাঙালী-অবাঙালী, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না বাধে। আমি বুকে ব্যথা পাব। বাংলার মাটিতে বসবাসকারী বাঙালী-অবাঙালী, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সবাই সমান। বাংলার মাটিতে বসবাসকারী সবাই আমাদের ভাই।’ কারফিউ ভঙ্গকারীদের ওপর সরকারী বাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনা শুনে মফস্বলের মানুষ মিছিল বের করে প্রতিবাদ জানায়। মনে হলো, বাগেরহাট বুঝি ঢাকার অংশ; আর ঢাকার রাতের নিস্তব্ধতা এখানকার প্রবল বিরুদ্ধচারী লড়াকু মানুষরাই চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছে বলে গুলিতে জখম হয়েছে। অতএব গুলি খেয়েছে আমার ভাই ইয়াহিয়া তোমার রক্ষা নাই। সাবেকি আমল থেকে বাগেরহাটে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাস। ’৪৭-এর দেশভাগজনিত সাম্প্রদায়িকতার শিকার হলে এদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসে। ষাটের দশকে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রীয়দের বেশিরভাগ ওপার বাংলায় চলে গেলেও তখনও শহরে সিংহভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য, বড় বড় ভবনের অধিকারী তারাই। পাকিস্তানের শাসনাধীনে ধর্মীয় কারণে অপবাদ অপমানে নির্যাতিত হয়ে আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির কারণে সনাতনধর্মীরা মানসিক জোর ফিরে পায়। বঙ্গবন্ধুর হিন্দু-মুসলমান সবাই সমান, ভাই ভাই এমন ঘোষণার পর তারা মার্চের সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে স্ব-স্ব অবস্থানে অনড় থাকে। শিক্ষিত হিন্দুদের অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ, ছাত্র-যুবাদের দেখা গেল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে। সভা-মিছিলে অংশগ্রহণে তারা আগুয়ান। কুবের চন্দ্র বিশ্বাস প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জয়লাভ করলে মাটি সংলগ্ন নিম্নবর্ণের হিন্দুরা স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকে।

শুরু হলো সর্বাত্মক হরতাল। ঢাকাসহ সারা বাংলা অচল। ৪ ও ৫ মার্চের হরতালের মধ্য দিয়ে বাঙালী আরও ঐক্যবদ্ধ হলে পাকিস্তানী শাসন থেকে তাদের কাছে চূড়ান্ত মুক্তি কাম্য হয়ে ওঠে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন এলাকার আন্দোলনের খবর যে কোন সময়ের চেয়ে দক্ষিণাঞ্চলের ছোট ছোট শহরে দ্রুত পৌঁছাতে থাকে। উপর্যুপরি রক্তাক্ত ঘটনার জন্য খুলনা ও রংপুরে কারফিউ বলবৎ থাকে। সরকারী বাহিনীর গুলিতে জেলা শহরে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ে। গুলিতে আহত মুমূর্ষু সংগ্রামীদের জন্য শত শত নারী-পুরুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। রাজারবাগের পুলিশ, ইপিআর ব্যারাকের বাঙালী জওয়ানরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মিছিলকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। বিরাজমান আন্দোলনমুখর পরিবেশ দেখে বঙ্গবন্ধু বলেন : ‘বিশ্ববাসী দেখুক, বাংলাদেশের নিরস্ত্র ছাত্র-শ্রমিক-জনতা বুলেটের মুখেও কি দুর্দান্ত সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে নিজেদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।’ রেডিও পাকিস্তান ও টেলিভিশনের নাম পাল্টে রাখা হয়- ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ ও ‘ঢাকা টেলিভিশন’। এই দুই গণমাধ্যমের নাম পাল্টে দেয়ার পর বিক্ষুব্ধ শিল্পীরা ঘোষণা করেন, যতদিন সংগ্রাম চলবে ততদিন শিল্পীরা বেতার ও টেলিভিশনে অংশ নেবেন না। বাগেরহাটেও সংগ্রামী মানুষের মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য খোলা মাঠে, কখনও মিলনায়তনে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শহরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী হরতালের পর সারাদেশের মতো বাগেরহাটেও অর্থনীতি সচল ও বেতন নেয়ার জন্য বেলা আড়াইটা থেকে চারটা পর্যন্ত ব্যাংক খোলা রাখা হয়। রেশন দোকানগুলো খোলা থাকে। ৫ মার্চ শুক্রবার এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষ পাকিস্তানের নির্যাতন আর সহ্য করবে না বলে শপথ গ্রহণ শেষে কয়েকদিনের আন্দোলনে শহীদদের উদ্দেশে গায়েবানা জানাজা আদায় করেন। জুমা নামাজের পর বাগেরহাটের প্রায় সব মসজিদে শহীদানের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। জানা গেল, ছাত্র লীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে যে বিশাল মিছিল বের হয় সেখানে এগারো দফা আন্দোলনে নেতা তোফায়েল আহমদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান। তোফায়েল আহমদের বক্তৃতা যেন সব বাঙালীর মনের কথা। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঢাকার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার সুযোগ দাবি করে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করে। কেউ কেউ হাঁটতে হাঁটতে জোর কণ্ঠে গেয়ে চলে- ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই চলবে।’

পরদিন ৬ মার্চ দেশের সব বাঙালীদের মতো অবিসংবাদিত নেতার নির্দেশের অপেক্ষায় বাগেরহাটের মানুষও। উত্তেজনা নিয়ে জনগণ সংবাদপত্রে দৃষ্টিনিবদ্ধ ও বেতারে কান পেতে রাখে। এদিকে শহরে মশাল মিছিল বের করার প্রস্তুতি চলে। স্বাধিকারকামী জনতার কণ্ঠে ক্ষুব্ধ গর্জন। গণশক্তির স্লোগানে বারবার উচ্চারিত হতে থাকে- ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে রেডিও পাকিস্তানে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ভাষণ দেন। তার বক্তব্যে ছিল বাঙালীদের স্বাধীনতার স্বাদ চিরতরে মিটিয়ে দিয়ে চরমভাবে শায়েস্তা করার হুমকি। ইয়াহিয়া বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি ততদিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব।’ ইয়াহিয়া খান ভাষণে ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার এবং ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ইয়াহিয়ার ভাষণ আগুনে যেন ঘি ঢালে। পারলে তখুনি মফস্বলের ক্রুদ্ধ মানুষ সরকারের প্রশাসনিক ভবনসমূহ দখল করে নেয়। পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ গণবিরোধী ভূমিকার প্রতিবাদে মিছিলের ভাষা এখন দারুণ গরম। খবর এলো, ইয়াহিয়ার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দিয়েছেন- শহীদের রক্ত মাড়িয়ে তিনি আলোচনায় বসবেন না। বাগেরহাটে কিছু সংখ্যক বাঙালীবিরোধী বিহারির বাস। তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে আন্দোলনকারীরা যেন জড়িয়ে না পড়ে তারজন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও বামপন্থী নেতারা জাতীয় স্বার্থে সবাইকে শান্ত ও ঐক্যবদ্ধ থাকার ডাক দেন। ইয়াহিয়ার বক্তব্যের জবাব দিতে মানুষ চায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের মহাসমাবেশেই যেন বাঙালীর মুক্তির সুস্পষ্ট কর্মসূচী ঘোষণা করেন।

এলাকায় ৭ মার্চ সকাল থেকে মিছিল আর মিছিল। অপ্রশস্ত রাস্তার দু’পাশের দোকানপাট, গাছগাছালি, উঁচু ভবনের ছাদ-কার্নিশ সব কেঁপে গেল। ঝাঁঝালো স্লোগানে একটাই লাইন- ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ কোথায় অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, যুদ্ধের প্রস্তুতি- কোন কিছু না থাকলেও উচ্ছ্বাসময় কণ্ঠনিনাদে মুক্তির আকাক্সক্ষাই ধ্বনিত হতে থাকে। মফস্বলের মানুষ দেখেনি রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক মানুষের অভূতপূর্ব সমাবেশ। শুধু অনুমান করা গিয়েছিল উপস্থিত মানুষের সংখ্যা। শহরের সব বেতারযন্ত্র খোলা- মানুষের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ এখুনি শোনা যাবে। কিন্তু বেতারে কোন শব্দ নেই। মানুষ পরস্পর মুখ চাওয়াচায়ি করে- ব্যাপার কী! দক্ষিণাঞ্চলের বিস্মিত মানুষ তবু বেতারের সামনে অপেক্ষায় থাকে। তাদের মনোবলে চিড় ধরেনি। নিশ্চয় ঢাকায় কোন না কোন গোলযোগ হয়েছে। জানা গেল, ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার না করার প্রতিবাদে কর্মরত বাঙালী কর্মচারীরা কাজ বর্জন করেছেন। ঢাকার অসংখ্য মানুষের জনসমাবেশে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার সৌভাগ্য হলো। কেন্দ্রীয় নেতাদের ফোনে দেশের সব মফস্বলের মতো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষও জেনে গেলেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বক্তব্য। পরদিন জানা গেল, গত গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণ প্রচারের অনুমতি দিয়েছে। আবার বেতার যন্ত্রের সামনে মানুষের ভিড়। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- আপ্তবাক্যে পরিণত হওয়া এই ভাষণের মর্মার্থ গ্রহণ করে শুরু বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভ। ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশ মহকুমা নেতাদের থেকে গ্রামীণ সংগঠনের শাখাসমূহের কাছে পৌঁছে দেয়া শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বাগেরহাটের কোর্ট-কাচারি, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া হিসেবে স্বাধীনতা পক্ষের দলগুলো নিয়ে ৯ মার্চ মঙ্গলবার গঠিত হয় বাগেরহাট সংগ্রাম কামিটি। স্থানীয় নেতারা নিজ নিজ ইউনিয়নে গঠন করেন আলাদা সংগ্রাম কমিটি। একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোর প্রভাবে মানচিত্রসহ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সংগ্রহের প্রয়াস দিয়ে জোরালোভাবে শুরু হলো জাতির জীবনের শ্রেষ্ঠকর্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।