“উপমাই কবিত্ব”, এই উচ্চারণ যে কবি করতে পারেন, তাঁর রচনায় যে চিত্রকল্পের বিশদ ও বিচিত্র ব্যবহার থাকবে সে আর অসধারণ কি। এক কালে জীবনানন্দর চিত্রকল্প অনেকের জন্য হোঁচট-স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো- তাঁদের অভ্যাসজাত এবং সেকালের বাংলা কবিতার অতিব্যবহৃত উপমার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যতা হেতু। বাংলা কবিতার একালের পাঠকদের জন্য জীবনানান্দীয় চিত্রকল্প বড়ো একটা বিপত্তি নয়। বরং তাঁর রচনার মাধ্যমেই বাঙালী পাঠক উপমা-চিত্রকল্পের ইংগিতবহতা, অর্থঘনতা, অর্থ-সম্প্রসারণত্ব- সর্বোপরি ব্যাঞ্জনা বৃদ্ধির সার্থকতা উপলদ্ধি করেছেন। এক অর্থে বাংলা কবিতা এবং বাঙালী পাঠক তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ তাঁর চিত্রকল্পের একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা এবং অনন্যতার জন্য। এসবের প্রতি আমাদের সকলের দৃষ্টি বৃদ্ধদেব বসু আকর্ষণ করিয়েছিলেন। তারপর আরো অনেকের দৃকপাতে আমরা সে-সব প্রকাশের অনুভূতিকে আরো গভীরভাবে বুঝতে পেরেছি।
সারকথায় বলা যায় যে তাঁর উপমা-চিত্রকল্পে আমরা এই সব চরিত্র পাই:
১. দৃশ্যের, গন্ধের, স্পর্শের, স্বাদের এমনকি ধ্বনিরও ইন্দ্রিয়স্বরূপের উদ্ভাসন
২. বিপ্রতীপ ও বিবাদী দুই বস্তুকে উপমান ও উপমেয় করে তোলা। শুধু দুই
বস্তুই নয়, জড়ের সঙ্গে বোধের, রঙের, ধ্বনির, স্বপ্নের; বর্তমানের সঙ্গে অতীতের, অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের সন্নিপাত এবং সেই ধরণের আকস্মিকতার সঙ্গে, যাতে আমাদের উপলব্ধি সম্প্রসারিত হয়ে যায়।
৩. কখনো-কখনো চিত্রকল্পকে এমন ধ্বনি-চরিত্রের সঙ্গে পেশ করেছেন যাতে শ্রুতিকল্প ও চিত্রকল্প অঙ্গাঙ্গী হয়ে গভীরতর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে।
বলতে হবে যে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, বিশেষণ, চিত্ররূপ এগুলোর সমন্বিত রূপকেই আমি চিত্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করছি। ব্যাপকতর অর্থে, তা-ই চিত্রকল্প যা চিত্রের অনুষঙ্গ নিয়ে আসে এবং কবিতার পাঠকের বোধকে বিস্তৃততর করে। এই অর্থে নিচের সকল উদাহরণ অথবা তাদের একত্রিত প্রয়োগ (যদি সম্ভব হয়) সবই চিত্রকল্প -- আমার সংজ্ঞায়:
১. পাখির নীড়ের মতো চোখ
২. উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা
৩. হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমোবে সে
৪. সিন্ধুশব্দ বায়ুশব্দ রৌদ্রশব্দ রক্তশব্দ মৃত্যুশব্দ এসে ভয়াবহ ডাইনীর মতো নাচে-
৫. রোগা শালিখের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো
জীবনানন্দের উপমার প্রচুর ব্যাখা-বিশ্লেষণ হয়েছে। সে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য তাঁর দুটো কবিতা,‘হাজার বছর শুধু খেলা করে (বনলতা সেন)’ এবং ‘যেই সব শিয়ালেরা (সাতটি তারার তিমির)’ এদের উপস্থাপন এবং অবলোকন যে এ দুটো কবিতার প্রতোকটিই আশলে একটি চিত্রকল্প, ব্যাপকতর চিত্রকল্প যেখানে বৃহত্তর চিত্রকল্পের মধ্যে ছোট-ছোট চিত্রকল্প অর্ন্তবিন্যস্ত হয়ে আছে। অন্যভাবে দেখলে জীবনানন্দ কি ভাবে কবিতা নির্মাণ করতেন তারও হয়তো কিছুটা অর্ন্তদৃষ্টি লাভ করা সম্ভব। কবিতা উদ্ধৃত ধরা যাক:
হাজার বছর শুধু খেলা করে
হাজার বছর শুধূ খেলা করে অন্ধকারে জোনাকীর মতো:
চারিদিকে চিরদিন রাত্রি নিধান:
বালির উপরে জ্যো॥স্না-দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো: দ্বারকার;-দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত ম্লান।
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের-ঘুচে গেছে জীবনের সব লেন-দেন;
‘মনে আছে?’ শুধালো সে-শুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন?’
মাত্র পাঁচ লাইনের কবিতা, বিলম্বিত অক্ষরবৃত্তের-মুক্তক, সমিল। চারটি ‘কোলন’, চারটি ‘ড্যাশ’ এবং দুটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন-সম্বলিত হয়ে ধ্বনিপ্রবাহে এলানো যাকে গানের ভাষায় ‘ঢিমে লয়ের’ গঠন বলা যেতে পারে-অথচ শেষ বাক্যে প্রশ্নে-প্রশ্নোত্তরে নাটকীয় মৃদু সংঘাত-তাড়িত। কবিতাটিতে ‘মতো’ সম্বলিত দুটি উপমা স্পষ্ট। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ লাইন পুরোটিই একটি দৃশ্যচিত্র: ‘চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান: বালির উপরে জ্যোৎস্না-দেবদারু;-দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত ম্লান’। কবিতাটির প্রচ্ছন্ন পটভূমি হচ্ছে কাল। কিন্তু জীবনানন্দ এমনভাবে চিত্রিত করেছেন যাতে এক-হাজার, দু-হাজার বছরের কালপ্রবাহ যেন থমকে গেছে চলমান স্্েরাতসহ। একটি ক্ষণিকচিত্র এ নয়, এ যেন মানুষের জীবনের বিলম্বিত প্রবাহের ক্রমকালিক সামগ্রিক স্বরূপ যেখানে হয়তো মিশরীয়, হয়তো আসিরিয়, হয়তো ‘বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতের’ থেকে আজ পর্য্যন্তর ধূসর অনুভূতি ও প্রজ্ঞার অর্জন একটি ক্রমস্টিললাইফ-এ পরিণত হয়েছে। ‘বালির উপরে জ্যোৎস্না’, ‘দেবদারু ছায়া’, ‘বিচূর্ণ থাম’ চিত্ররূপময় করে তোলে ঐ সব প্রাচীন জগতের, নগরের, জীবনের চলমানতা সঙ্গে-সঙ্গে তার অবসানতার পরাবাস্তবিক রূপ। পরাবাস্তবিক এই জন্য যে ঐ জগতের মানবিক জীবনের, ব্যক্তিগত জীবনের স্মৃতি আছে কিন্তু সেই জীবন্ত বর্তমান তো নেই।
কবিতার দুটি চরিত্র, তারাও তো অশরীরি কেননা-‘শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের-ঘুচে গেছে জীবনের সব লেন দেন’। ‘দ্বারকার; -দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত ম্লান’। দুটো অর্থ হতে পারে, (১) দেবদারু ছায়াগুলো ‘দ্বারকা’ নামের পৌরাণিক স্থানের (যেখানে কৃষ্ণ গিয়েছিলেন) বিচূর্ণ থামের মতো অথবা ‘দ্বারকার’-কে ‘দ্বারিক’ অর্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন জীবনানন্দ। দ্বিতীয় অর্থে প্রহরীরা ‘মৃত ম্লান’। এই ”ঃবসঢ়ড়ৎধৎু ংঁংঢ়বহংরড়হ ড়ভ ফরংনবষরবভ” এর পটভূমিকায় দুজন অশরীরির মধ্যে জিজ্ঞাসা এবং প্রত্যুৎত্তর কুয়াশার মতো থমকে থাকে। হাজার বছর আগেকার সান্নিধ্য, সম্পর্ক, ভালোবাসা ঐ বিশাল কালবিস্তৃতিতে থমকে ছিলো, থাকে প্রবহমান এবং ভবিষ্যতে হারিয়ে যায়। এই দুই চরিত্র যেন সাল্ভাতোর দালির ছবির পারসপেকটিভে দিগন্তের ভাঙা শহরের আস্তরে দুটি ছায়া-শরীরির মধ্যে নিস্তব্ধ বাক্যালাপ, যার শব্দ হারিয়ে যায় না কিন্তু অনুরণিত হতে থাকে। পুরো কবিতাটিই তার অন্তর্গত উপমা, দৃশ্যগুলো নিয়ে আরো বড়ো একটি চিত্রকল্পে স্পন্দমান হয়ে ওঠে।
যেই সব শেয়ালেরা
যেই সব শেয়ালেরা জন্ম-জন্ম শিকারের তরে,
দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ের বনের ভিতরে
নীরবে প্রবেশ করে,- বার হয় -চেয়ে দেখে বরফের রাশি
জ্যোৎস্নায় প’ড়ে আছে; -উঠিতে পারিত যদি সহসা প্রকাশি
সেই সব হৃদযন্ত্র মানবের মতো আত্মায়:
তা’হলে তাদের মনে যেই এক বিদীর্ণ বিস্ময়
জন্ম নিতো; -সহসা তোমাকে দেখে জীবনের পারে
আমারও নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে।
একটি মাত্র বাক্যে সমাপ্ত এটি একটি অসাধারণ কবিতা-কবিতার বিস্ময়। এবং একটিই উপমা যার অন্তর্ভূত হয়ে চক্রাকারে ঘুরে-ঘুরে কথা বলেছে, অন্যান্য চিত্রকল্প-দৃশ্য, উপমা, চিত্র। উপমার সাধারণ প্রয়োগ হচ্ছে, “ক”-র মতো “খ”। কিন্তু এখানে জীবনানন্দ দুই, তিন বা ততোধিক সিঁড়ি ভেঙ্গে প্রায় অঙ্কে শাস্ত্রের ধরনে-‘৩ৎফ ড়ৎফবৎ’ উপমা তৈরী করেছেন: যদি সেই সব শিয়ালের ‘হৃদযন্ত্র, মানবের মতো আত্মায়’ ‘সহসা প্রকাশি’ ‘উঠিতে পারিত’ তাহলে তাদের মনে যেমন ‘বিস্ময় জন্ম নিতো’ ‘আমারও’ তেমন ‘নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে’। এই ‘যদি’-‘তাহলে’-তেমন (মূল কবিতায় উহ্য কিন্তু আরোপিত , এই উপমা-চিত্রকল্পের প্রয়োগ জীবনাননন্দের সমগ্র কবিতা-রচনায় জটিলতম, বিস্ময়াবহ, অদ্ভূত-আশ্চর্যজনকভাবে সফল। অথচ বাক্য মাত্র একটিই, কবিতার পংক্তি আট। এ তো গ্যালো কবিতার নির্মাণের, চিত্রকল্পের প্রকৌশলের কথা। কিন্তু কবিতার সারবত্তা, বোধ অধিকতর গূঢ়, গভীর, রহস্যময়। জীবনানন্দ আমাদের মনের এক বিদীর্ণ বিস্ময়কে বিশেষণ-উপমা-চিত্রকল্পের বিস্তৃীর্ণ উপস্থাপনে চিহ্নিত, অর্ন্তদীপ্ত করেছেন-‘তাহলে’ শব্দের পূর্ববতী পাঁচ পক্তিই এই চারিত্র সৃষ্টির কাজে ব্যবহৃত। অত:পর ‘তোমাকে দেখে’, -এই ‘তোমাকে’ নিশ্চয়ই কোন নারী। প্রমাণ করা যায় না, কিন্তুু ইংগিতে তা-ই। এই নারীকে দেখে জীবনানন্দের অথবা কবিতার বর্ণনাকারী পুরুষের ‘স্নায়ুর আধারে’ ‘নিরভিসন্ধি’ কেঁপে ওঠে’। এটি একটি তাৎক্ষণিক মানসিক উদ্ভাসনের চিত্রায়নের কবিতা। এই চিত্রায়ণ ‘বিদীর্ণ বিস্ময়ের’ মতো বিস্ময়কর। কিন্তু আরো বিস্ময়কর বোধ হয় ‘নিরভিসন্ধি’। অভিসন্ধি আমরা বুঝি, দূরভিসন্ধিও বুঝি। কিন্তু ‘নিরভিসন্ধি’-এর সঠিক মানে আমাদের কাছে অস্পষ্ট থেকে যায়। এটা কি প্রাপ্তির এমনকি নেহাৎ বাসনার অথবা শুধু অবলোকনের, তার নিশ্চিত সদুত্তর এখানে নেই --আবার এই অভিসন্ধি কি কোন কূট বুদ্ধির কিংবা নেহাৎ নেতিবোধের তাও উহ্য থেকে যায়। হয়তো আনন্দের বিস্ময়েরই কেননা জোৎস্নায় বরফের রাশি তো তেমনি অনুভবের উদ্রেকের ক্ষমতা রাখে। তবু ‘স্নায়ুর আঁধার’ শব্দের মধ্যে এক ধরনের ফ্রয়েডীয়-ডস্টয়েভস্কীয় গোধূলি জেগে ওঠে, যা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের জগতে ছিলো না এবং পরবর্তীকালের বিষ্ণু দে -বুদ্ধদেব বসুর পৃথিবীতেও নেই। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পৃথিবীতে যদিও নাস্তি এবং নশ্বর প্রেমের সাক্ষাৎ রয়েছে, নিরভিসন্ধির মানসিক অন্ধকার সেখানে অনুপস্থিত। আবারও বলছি, ‘সেই সব শিয়ালেরা’ জীবননান্দের একটি অসাধারণ কবিতা, একাধিক উপমা-চিত্রকল্পকে অর্ন্তভূত করে বৃহত্তর একটি চিত্রকল্পের মধ্যে সারা কবিতার বক্তব্য ও ব্যঞ্জনা রহস্যাশ্রিত হয়ে উঠেছে। এ কবিতা আমরা সম্পূর্ণ কখনো বুঝি না, কিন্তু কবিতাটি ফুরোয় না-পাঠককে বারবার তার কাছে ফিরে যেতে হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, ‘যেই সব শিয়ালেরা’ কবিতাটি সমন্ধে একটি চমৎকার নিবন্ধ রয়েছে অশোক মিত্রের। এবং প্রথম কবিতাটি, ‘হাজার বছর শুধূ খেলা করে’ সম্পর্কে কবিতা পরিচয় পত্রিকায় লিখেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, যা পরে একই নামের প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
রাবীন্দ্রিক যুগের এবং পূর্ববর্তী কালের বাংলা কবিতার উপমা-চিত্রকল্পের ধারনাকে জীবনানন্দ বহুতর বিস্তৃত এবং সমৃদ্ধ করেছিলেন তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা, যুগচেতনা, প্রজ্ঞা এবং কল্পনা-প্রতিভা দিয়ে। তাঁর সৃষ্ট সমৃদ্ধি পরের কালের কবিতা-শ্রমিকদের জন্য প্রেরণা এবং শিখবার বিষয়। ভাবতে অবাক লাগে, এক যুগে শনিবারের চিঠি পত্রিকার কর্মকর্তারা তাঁর উপমা-চিত্রকল্প নিয়ে অকথ্য বিদ্রƒপ করেছিলো। সেই সব ‘হাঁদার মতো’রা আজ কোথায়?
গ্রন্থপঞ্জী ও টিকা
১. ক. বুদ্ধদেব বসু, প্রকৃতির কবি, কবিতা, চৈত্র ১৩৪৩
খ. বুদ্ধদেব বসু, ‘বনলতা সেন, জীবনানন্দ দাশ,’ কবিতা, চৈত্র ১৩৪৯
২. অশোক মিত্র, ‘সেই কবিতাটির প্রসঙ্গে’, প্রবন্ধ সংকলন, দে’জ পাবলিশিং ১৯৯৭
৩. অলোক রঞ্জন দাশগুপ্ত, হাজার বছর শুধু খেলা করে: জীবনানন্দ দাশ’, কবিতা-পরিচয়, দে’জ পাবলিশিং১৯৮১
৪. সজনীকান্ত দাশ জীবনানন্দের একটি কবিতায় অনেকগুলো উপমা ও ‘মতো’-র ব্যবহার সমালোচনা করে ব্যাঙ্গ করেছিলেন: ‘হাঁদার মতো, এই উপমাটি কিন্তু নাই’।