করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





শাহাবুদ্দিনের ছবি : মানুষের আকাশ আলিঙ্গন
মইনুদ্দীন খালেদ
বাংলাদেশের শিল্পাকাশে শাহাবুদ্দিনের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো। শিল্পীর চিত্রপটে দৃষ্টিপাতমাত্র দর্শকের শিহরিত সত্তা তা অপার বিস্ময়ে অনুভব করে। এক অভূতপূর্ব গতিময় ইমেজ যেন আকাশের অনন্ততার পরিমাপ নিতে চায়। ওই ইমেজ উড়ে-চলা মানুষের। বিশাল ডানার পাখির মতো মানুষ শাহাবুদ্দিনের চিত্র পরিধির মধ্যে স্পেস-ক্রাফট হয়ে গেল কেন ? কেন তার ছবির মানুষ ভূমি থেকে উৎক্ষেপিত রকেটের মতো, কিন্তু পরিণামে মহাকাশের শূন্যতায় স্বচ্ছলতা পায় ? মানুষী শক্তি কোন তুরীয় অবস্থায় গেলে বস্তু থেকে রূপান্তরিত হয়ে অগ্নিগোলক হয়ে যায় ? এসব প্রশ্নের উত্তর পদার্থবিদ্যার গতিসূত্রের আলোকে ব্যাখ্যা করা চলে। কিন্তু আমরা তাতে সন্তুষ্ট হতে পারি না। কারণ নিরপেক্ষ গতিসূত্র নয় শুধু, আমরা এ শিল্পীর ছবি নিরীক্ষণ করে শিল্পসত্য ও ইতিহাসের সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে চাই।
মানুষী ইমেজের ওই উড্ডীন রূপ বাংলাদেশের মানুষের। এর আগে কোনো শিল্পীর কাজে আমরা এই ভূখ-ের মানুষকে শক্তির চরম প্রকাশে ডানাঅলা পাখির মতো হয়ে সাহসে, সাধে, সংকল্পে ও স্বপ্নে স্পেসের তৃষ্ণায় এমন অধীর ও অস্থির হতে দেখি নি। হাজার বছরের বঞ্চনা ও পীড়নে সংক্ষুব্ধ এদেশের মানুষের অবরুদ্ধ মুক্তির স্পৃহা অকস্মাৎ যেন আকাশচুম্বী হয়ে প্রকাশ পেল। শাহাবুদ্দিনের ছবির সারবস্তু সেই অবরুদ্ধ আত্মার মুক্তি। রাগে, ক্ষোভে, হিংসায়, প্রতিহিংসায় যুদ্ধের তেজে প্রজ্জ্বলিত হয়ে মানুষ তার ছবিতে স্বাধীনতার নিরঙ্কুশ স্বাদ নিতে চায়।
শাহাবুদ্দিন কালদগ্ধ শিল্পী। কালের আগুনে পুড়ে যে মানুষ বিপ্লবী হয়ে ওঠে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়ে রাজপথে নেমে দুষ্ট শাসককে শাসায় এ শিল্পী সেই কালের সারথি। ১৯৫০-এ জন্ম নেওয়া এ শিল্পী ষাটের গণঅভ্যুত্থানের প্রথম সারির এক প্রতিবাদী তরুণ। গণ-মানুষের মুক্তির মিছিলে অংশ নেওয়ায় তার মধ্যে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা প্রখরতা পেতে শুরু করে। পরিণামে তিনি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ অনিবার্য মনে করেন। যদিও তিনি তখন চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তবুও সুকুমার ভাবনাকে ঘুম পাড়িয়ে তিনি অস্ত্র হাতে রণাঙ্গণে চলে এলেন। মানুষের সৃজনশীলতার বুঝি কোনো অবিনাশী জাদুকরী গুণ আছে; তাই রাজপথের মিছিলে অগ্রগামী চারুশিল্পের সেই তরুণ বিদ্যার্থীই আবার হয়ে উঠলেন দলনেতা, প্লাটুন কমান্ডার। একথা সত্য, জীবন বাজি রেখে গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে জীবন-মৃত্যুর ভয়ংকর পথ পাড়ি দিয়ে শক্তি-সংকল্প, জেদ-রাগের অভিঘাতে মানুষের দেহ যে কত বিচিত্র মুদ্রায় ঝলকায় তা-ই শাহাবুদ্দিনের ছবির বেগবান মানুষের বৈচিত্র্যের প্রধান উৎস। এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমাদের চেতনার আমূল পরিবর্তন হয়। যুদ্ধোত্তর দেশে শিল্প যে নতুন জন্ম লাভ করে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ শাহাবুদ্দিনের চিত্ররাশি। প্রতিনিয়ত আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। চেতনা চোখে দেখা যায় কি ? তা তো অনুভবের বিষয়। কিন্তু শাহাবুদ্দিনের তুলি নিরন্তর শিল্পময় করে তা প্রকাশ করছে। চেতনা বিমূর্ত—বস্তুগত হয়েও তা বস্তু-উত্তীর্ণ শক্তি, তাপ ও আলো। শাহাবুদ্দিনের চিত্রতলের শুভ্র পরিধির মধ্যে অনির্বাণ জ্বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামক সেই তপ্ত আলো।
গতির দুরন্ত প্রকাশ আমরা দেখেছি বিদ্রোহী কাজী নজরুলে। আবেগের বিচিত্র বেগ দেখেছি বলাকা কাব্যের রবীন্দ্রনাথে। চিত্রশিল্পীর তুলিও যে গতির ঝরনাধারা হতে পারে তার প্রমাণ শাহাবুদ্দিনের ছবি। আমার কাছে এ শিল্পীর ছবি শুধু চোখের আলোয় মাপার বিষয় নয়। কেননা তাঁর ছবিতে মানুষের রূপের বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আংশিক প্রকাশের পর বিস্তৃত শূন্য স্পেসে যে সামান্য তুলির ছোপ উঁকি দেয় তাতে আমরা শব্দময় এক ইশারা কানে শুনতে পাই। মারণাস্ত্রের শব্দে প্রকম্পিত যুদ্ধক্ষেত্রে তড়াক করে গেরিলাযোদ্ধার লাফিয়ে ওঠা এবং আবার দ্রুত অপসৃত হওয়ার শত শত শিল্পমুদ্রা যে শাহাবুদ্দিন প্রায় চার দশক ধরে প্রদর্শন করে চলেছেন তাতে শব্দের দ্যোতনা আছে, ধ্বনির ব্যঞ্জনা আছে। আমার বলার বিষয় এই যে, এই শিল্পীর ছবিতে হুঙ্কার আছে, আর্তনাদ আছে, গোলার শব্দ আছে এবং সর্বোপরি যুদ্ধের বিভীষিকা আছে। শাহাবুদ্দিনের ছবিতে সাদার বিপরীতে উষ্ণ হলুদ, তপ্ত লাল যেভাবে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে অথবা দগদগে হয়ে লেপ্টে থাকে তাতে এসব ছবি একইসঙ্গে চোখে দেখার, কানে শোনার এবং ত্বক দিয়ে অনুভব করার বিষয় হয়ে উঠেছে। শাহাবুদ্দিনের ছবি যেহেতু গতির উন্মেষ ও উত্থান, তাই বিশেষ বিবেচনায় তা বিমূর্ত শিল্পরীতির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। একাধিক ইন্দ্রিয় সজাগ করে বুঝতে হয় এ শিল্পীর ছবি।
শাহাবুদ্দিনের শিল্পসাধনায় শক্তির ধ্যান এতটা জাগর হলো কেন ? এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা শুধু তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার ঘটনায় সীমায়িত থাকতে চাই না। যে-কোনো সৃজনশীল মানুষের শিল্পের অভিব্যক্তির পেছনে অন্তত তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। প্রথমটি জন্ম-জন্মান্তর ধরে যে ভৌগোলিক পরিবেশের জীবন প্রণালির মধ্যে তাঁর জন্মলাভ ও বেড়ে ওঠা, দ্বিতীয়টি তাঁর নিজস্ব কাল ও ঘটমান বর্তমান এবং তৃতীয়টি তাঁর রক্তবীজ অর্থাৎ বংশের স্বভাব-প্রকৃতি।
শাহাবুদ্দিনরা মেঘনা পাড়ের মানুষ। মেঘনা নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রশস্ততম নদী। হাজার নদীর এই দেশের দক্ষিণে সাগর। তাই জল এদেশে স্থলের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙনের দেশে মানুষ অনাদিকাল থেকে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে, সচল রেখেছে জীবনের প্রবাহ। আদিম কৃষিজীবন, জেলেজীবনের রূপ আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে খুব স্বাভাবিক ছিল। গ্রীষ্মম-লীয় দেশে নিরন্তর সংগ্রামশীল জীবন পোশাক চাপানোর অবসর পায় না, প্রয়োজনও বোধ করে না। পুরুষ মালকোচা দেওয়া লুঙ্গিপরা নগ্নপ্রায় আর নারীর পরনে লজ্জানিবারণের জন্য অপরিসর শাড়ি। শ্রমনিষ্ঠ জীবনে আব্রু ও আভরণের বালাই নেই। কৃষক, জেলে, মাঝি-মাল্লার নগ্ন দেহ শাহাবুদ্দিনের অ্যানাটমি অনুশীলনের এক আদি উৎস। বাংলার মানুষের দেহপাঠ জয়নুল জেনেছেন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের জীবন দেখে, সুলতানের প্রেরণা চিত্রা নদী, শাহাবুদ্দিনের মেঘনা। নদীপাড়ের চিরন্তনী বাংলা দেখার পাশাপাশি রাজনীতি সচল নিজের সময়কে দেখেছেন শিল্পী ঢাকার রাজপথে। শাশ্বত বাংলা আর সমকালের অগ্নিঝরা ষাটের দশক একই সঙ্গে শাহাবুদ্দিনকে উদ্দীপিত করেছে। কালের তাপে মানুষের দেহ কীভাবে প্রলম্বিত হয় এবং চেতনা তার বিশেষ প্রখরতা পায় তা তিনি মিছিলের পুরোভাগে স্লোগানে হাত উত্তোলিত করে নিজেই অনুভব করেছেন। অগ্রগামী থাকার, নেতৃত্ব দেওয়ার, বিজয়ী হওয়ার বাসনা তার মধ্যে জন্মগতভাবেই প্রবল। তাই তিনি শিশুবয়সে ছবি এঁকে পুরস্কার লাভ করেছেন, প্লাটুন কমান্ডার হয়েছেন এবং চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিনের প্রিয় শব্দ বিজয়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তাঁর শক্তি সঞ্চয়ের ধ্যানমন্ত্র। আর সমষ্টিগত মানুষের সঙ্গে মিতালি তাঁর বেঁচে থাকার স্বস্তি। জনতার সংগ্রামে রাজপথে, মুক্তিযুদ্ধে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আর ঘরোয়া আড্ডায়ও প্রচুর জনের সঙ্গে কথা বিনিময় করে শাহাবুদ্দিন আনন্দ অনুভব করেন। নিভৃতচারী শিল্পী স্বভাবের একবিন্দু লক্ষণও তাঁর মধ্যে নেই। বরং মানুষের কলরব তাঁকে সৃজনের গতি দেয়।


শাহাবুদ্দিন রাজনীতিনিষ্ঠ পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। শিল্পীর রাজনীতিক পিতা এক শিশুপুত্র ছাড়া তাঁর ছয় সন্তানকেই যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। ছেলেরা তাঁর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছেন। সব সন্তানই তাঁর যুদ্ধে নিহত হতে পারতেন। কিন্তু দেশমাতৃকার জন্য মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার চেয়ে সন্তানদের বেঁচে থাকার ভাবনা এই মহৎ পিতার কাছে অধিকতর তাৎপর্য হয়ে ওঠে নি। দেশপ্রেমের এই দৃষ্টান্ত বিরল। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম থেকেই মানুষ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। ভিয়েতনাম ছাড়া এরকম আর কোনো দেশ নেই। আমাদের বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কৃষিবাংলার খেটে খাওয়া মানুষের সন্তান। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ও কল্যাণবোধ তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এ শক্তির ভিতে আছে ধর্মনিরপেক্ষ লোকায়তিক দর্শন। এই দর্শনের জোরেই স্বদেশ-স্বজন শত্রুর আক্রমণের শিকার হলে তারা সংঘবদ্ধ শক্তিতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। কোনো কালেই এদেশের মানুষ তার কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার স্বাদ পায় নি। তাকে প্রান্তেই অবস্থান করতে হয়েছে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিক মানুষ বাদশাহি আমলে মহাসড়কে দাঁড়াবার অধিকার পায় নি। নিচু জমিনে দাঁড়িয়ে বাদশাকে কুর্নিশ করেছে। দাস খেটেছে। ফসল ফলিয়ে ফসলের অধিকার পায় নি। ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলেও এদেশের সেই নিম্নবর্গের মানুষকে নতমস্তকে থাকতে হয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর যখন পীড়ন ও বঞ্চনা আরও প্রত্যক্ষ হলো তখন সেই দুঃশাসন পিষ্ট মানুষ প্রতিবাদের রাগে ফুঁসে উঠল। তাদের নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে মুক্ত স্বদেশ রচনার অঙ্গীকারে ব্রত নিয়ে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই প্রথম এই ভূখ-ের মানুষের সমষ্টিগতভাবে দুঃশাসকের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই এবং পরিণামে মুক্ত স্বদেশ রচনা। এই গণযুদ্ধে অংশ নিয়েই শাহাবুদ্দিন তাঁর শিল্পের রসদ লাভ করেছেন। দেখেছেন কত ক্ষুদিরাম অকাতরে প্রাণ দিল স্বদেশ মুক্তির জন্য। যুদ্ধের তাপেই তাঁর জীবনীশক্তির পুঞ্জীভূত বারুদ বহ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠল। শাহাবুদ্দিনের তুলির ছোপ আগুনের মতো দপদপিয়ে জ্বলে উঠে তাকে পরিণত করল এক বিস্ময়কর শিল্পীতে।
শাহাবুদ্দিনের একক ইমেজের ছবি প্রায়শ স্পেসকে দ্বিখ-িত করে নানারকম জ্যামিতিক হিসেব প্রদর্শন করে। তীর্যক গতি প্রদর্শন শিল্পীর প্রধান প্রবণতা। তবে ইমেজ আকাশ থেকে ছত্রীসেনার মতো নামে, আবার ভূমি থেকে দ্রুত আকাশের দিকেও পক্ষ বিস্তার করে। কখনো ডানে বা বাঁয়ে প্রসারিত সেই মানুষ বুক চিতিয়ে আগুয়ান থাকার তীব্র আকাক্সক্ষা জানান দেয়। এইসব ছবি দেখে আমরা বুঝি লড়াই চলছে। ছবির স্পেস জুড়ে আতঙ্কের অনুরণন। ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলছে কিংবা ঘটে গেছে। শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য লাফিয়ে উঠে লক্ষ্য ভেদ করছে সেই বলশালী মানুষের রূপ। কিংবা আত্মরক্ষার জন্য বাতাসের বেগে দ্রুত অপসৃত হতে যাচ্ছে যোদ্ধা। এসবই গেরিলা যোদ্ধা শাহাবুদ্দিনের রণাঙ্গণের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত। তাঁর ছবির মনোযোগী দর্শকেরা নিশ্চয়ই জানেন যুদ্ধের মধ্যে দেখা মানুষের শক্তির তুমুল প্রকাশ, জয়, পরাজয়, হত্যা, রক্তপাত বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ এই শিল্পী শুধু নিজেকে একাত্তরের যুদ্ধের ঘটনায় সীমায়িত করে রাখেন নি। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর আরও অনেক কাল অতিবাহিত হয়েছে। শক্তির স্বরূপ অšে¦ষণ করে শিল্পী যে অভিসন্দর্ভ রচনা করে চলেছেন তাতে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক নতুন চিন্তা।
শক্তির অšে¦ষায় গিয়ে শাহাবুদ্দিন ইতিহাসের মহানায়কদের স্বরূপ বুঝতে চেয়েছেন। একই মানুষের ইমেজ নানা জ্যামিতির হিসেবে তিনি এঁকেছেন। সবচেয়ে বেশি রূপায়িত করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দ্বিতীয়ত যে মানুষ তাঁর চর্চার প্রেরণা হয়েছে তিনি মহাত্মা গান্ধী। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাদার তেরেসা, নেলসন ম্যান্ডেলা, এমনই শত শত কল্যাণকামী সংগ্রামী মানুষের অবয়বের মুখোমুখি হয়ে শিল্পী বুঝতে চেয়েছেন কোন শক্তির বলে তাঁরা কীর্তিমান হলেন, মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী মুদ্রা হিসেবে বিরাজ করছেন এবং তাঁরা মহাকালের গর্ভে তলিয়ে গেলেন না। তাঁরা পূজনীয় প্রাণপ্রতিমা (রপড়হ) হয়ে অনেক মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তির চিরস্থায়ী তীর্থে পরিণত হলেন।
শাহাবুদ্দিন নানামুখি পর্যবেক্ষণ থেকে বঙ্গবন্ধুকে এঁকেছেন। তাঁর মুজিব চিত্রমালাই শুধু আলাদাভাবে গভীর অভিনিবেশে গবেষণা করার বিষয়। শিল্পী যুদ্ধ চলাকালে ভারতের মেলাঘরে যোদ্ধাদের রিক্রুমেন্ট সেন্টারে বসে সাতই মার্চে ভাষণরত বঙ্গবন্ধুকে এঁকেছিলেন। একথা আমরা শিল্পীর মুখে এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে শুনেছি। তারপর আমরা উদাত্ত বাহুর মুজিব ইমেজ দেখি তার সত্তরের দশকের শেষে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শাহাবুদ্দিনের তুলি বিশেষ বেগ পায়। ১৯৭৫-এ ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকা- তাঁকে প্রথমত হতাশায় নিমজ্জিত করে রাখে। তখন তিনি প্যারিসে। ওই হত্যাকা- শেখ মুজিবুরের আশীর্বাদধন্য যোদ্ধাশিল্পী শাহাবুদ্দিনকে মুহ্যমান করে রাখে। তারপর ধীরে ধীরে তিনি তুলি হাতে যুদ্ধংদেহী মনোভঙ্গি নিয়ে আবার আঁকেন মুক্তিযোদ্ধাদের এবং প্রিয় নেতা অবিনাশী প্রেরণা বঙ্গবন্ধুকে। দু’পায়ে ভর করে থাকা মানুষেরা ক্রমে গতির দ্যোতনা পেতে থাকে। যখন আরও বাড়ে তখন সেই মানুষগুলো বাতাসের বেগকে পরাজিত করে শূন্যে উঠে যায়। যেন তাকে বন্দি করার ক্ষমতা নেই কোনো শক্তির। সেই শূন্যে ভাসমান যোদ্ধারা আরও দূর আকাশের ঠিকানা খুঁজতে থাকে। তাদের দেহে তখন গতির ঝড়োবেগ এমনই তীব্র যে তারা আরও বাধাহীন পরিসর চায়; তাদের মধ্যে তখন স্পেসের তৃষ্ণা—তারা যেন মহাকাশকে আলিঙ্গন করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। এইভাবে দুঃখকাতর শাহাবুদ্দিন তাঁর ছবির চরিত্রের মতো আবারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ও অপরাজেয় বেগকে শিল্পরূপ দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নবায়িত করে। যে কথা শিল্পের ইতিহাসে প্রায়শ বলা হয়ে থাকে যে গভীর শিল্প শিল্পীর মানসিক অবস্থারই প্রতিফলন। শক্তিপূজারী মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ক্ষেত্রে এ কথা শতভাগ খাঁটি।
হুঙ্কার-প্রকম্পিত ভাষণরত সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধু, বেদনামথিত বঙ্গবন্ধু, চিন্তাক্লিষ্ট বঙ্গবন্ধু, হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু, সংক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু, গুলিবিদ্ধ বঙ্গবন্ধু—কত রকম বোধেই না শাহাবুদ্দিন চলচ্চিত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই মহানায়ককে এঁকেছেন। বিশালদেহী বঙ্গবন্ধু যখন ভূমিতে লুটিয়ে পড়ছেন এ দৃশ্য বিশাল বৃত্তচাপের পরিধি রচনা করে শাহাবুদ্দিন যেভাবে এঁকেছেন তাতে আমরা এক ট্র্যাজিক মহিমা প্রত্যক্ষ করি। মহানায়কের পতন নেই, তাঁকে মেরে ফেলা যায়, কিন্তু তার মৃত্যুদৃশ্য আমাদের বলে দেয় ট্র্যাজেডির নায়কের নশ্বর দেহ মৃত্যুতে লুটিয়ে পড়েও অবিনাশী ইমেজ হয়ে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই নিয়েছে;—তিনি চিরঞ্জীব প্রাণপ্রতিমা বা আইকন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করেছেন।
শাহাবুদ্দিন শান্তিকামী গান্ধীকে এঁকেছেন। বিশাল ক্যানভাসে বেশির ভাগ অঞ্চলে অপার শান্তির নীলের আবহ অথবা শুভ্রতার চাদরের অন্তহীন বিস্তার আর এক প্রান্তে গান্ধী। প্রথমত শান্তিতে হিল্লোলিত হয় আমাদের অন্তর। কিন্তু গান্ধীর মুখের দিকে তাকালে সেই শান্তরস শুকিয়ে যায়। চশমার ফ্রেম ভেঙে যেন তাঁর চোখের মণি বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। ফ্রেমবিদীর্ণ গান্ধীর চোখই শাহাবুদ্দিনের গান্ধী বিষয়ক অধিকাংশ ছবির ভরকেন্দ্র। তাঁর রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলেও ওই একই শৈল্পিক পরিচর্যা রয়েছে। শাহাবুদ্দিনের হৃদয়ের উথালি-পাথালি বেগ খরবেগে তুলি চালায়। আবেগের এই রুদ্ররূপ এ শিল্পীর রক্তবীজে বিরাজ করে। তার ছাত্রজীবনের কাজের পাঠ নিয়ে আমি দেখেছি তিনি তেরছা করে তুলি চালান। রূপের চোখচেনা ইমেজকে ভেঙে দিতে চান। এক্সপ্রেশনিস্ট প্রকাশভঙ্গির প্রতি প্রবল পক্ষপাত রয়েছে। তাঁর প্রথম চারুশিক্ষার পাঠে ছিল রিয়ালিজম ও ইম্প্রেশনিজম তত্ত্ব অনুধাবনের অনুশীলন। তিনি তাতে মকসো করেছিলেন। কিন্তু তা তাঁর মন ভোলাতে পারে নি।
এমনকি প্যারিসের ‘অ্যাকোল দে বোজার্ত’-এ তিনি যে পাঠ নিয়েছিলেন তা-ও তিনি খুব দ্রুতই শিল্পচর্চার জন্য আর প্রয়োজনীয় মনে করেন নি। তেলরঙের পুরু ক্বাথে চ্যাপ্টা তুলি নিয়ে যোদ্ধার তেজে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের মনোমুদ্রাকে সবেগে প্রকাশ দেওয়ার শৈল্পিক কৌশল যখন তিনি আয়ত্ত করে ফেলেছেন তখন আর তাঁর কোনো শিল্পীর কাছ থেকে অনুদান নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে নি। যদিও এ ভাষা অর্জন করতে তাঁর প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর লেগেছে। কিছুকাল তিনি ফ্রান্সিস বেকনের প্রভাব বলয়ে আটকে ছিলেন। প্যারিসের কোনো কোনো সমালোচক তখন তাকে ‘পাতি বাঁকো’ অর্থাৎ ক্ষুদে বেকন বা পাতি বেকন বলে আখ্যায়িত করেছেন। ‘আর্ত আকতুয়েল’ পত্রিকায় একটি লেখা পড়ে আমি এ বিষয়টি জানতে পারি। পরবর্তী সময়ে প্যারিসের মাসিক পত্রিকা ‘সিমেজ’ যখন শাহাবুদ্দিনকে বেকন বিষয়ে ও বেলিকোভিচ বলে আরও এক শিল্পীর সঙ্গে তার সাদৃশ্যের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন তখন তার উত্তরে শিল্পী ব্যাখ্যা করে বলেন যে তিনি তাঁর ছবিতে আশাবাদ ব্যক্ত করে চলেছেন আর অপরপক্ষে বেকন ও বেলিকোভিচ ইউরোপের নৈরাশ্য ও একাকীত্বের সংবেদ প্রকাশ করেছেন তাঁদের শিল্পে। ইমেজের বিচূর্ণীকরণ, অতি আশা এবং অতি দুঃখ, দুভাবেই হতে পারে। শাহাবুদ্দিনের চিত্রসাধনায় নৈরাশ্য নেই। দুঃখ তো অবশ্যই আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু, সহযোদ্ধাদের মৃত্যু, মর্মবিদারি দুঃখের কথাই তো জানান দিচ্ছে। কিন্তু এসব মৃত্যু ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করে, কোনো একা মানুষের মৃত্যু নয়। চ্যাপ্টা তুলি হাতে সশস্ত্র যোদ্ধার মতো ক্যানভাসে ঝাঁপ দেন শাহাবুদ্দিন। তাই তাঁর নিজের দেহের ভার, বেগ ও মনোবেগ আছে তাঁর তুলির আঁচড়ে। সাদা ও লালের সংঘর্ষে তাঁর ছবিতে আতঙ্কের আবহ তৈরি হয়। অনেক সমালোচক, এমনকি দর্শকও, আমাকে বলেছেন যে শাহাবুদ্দিনের ছবি দেখলে তাদের কেমন যেন ভয় লাগে। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পুষ্ট কোনো হৃদয় যখন রুদ্র তেজে মানুষের শক্তির চরম প্রকাশ দেখাতে চান তা তো ভয়ের দ্যোতনা সৃষ্টি করেই। তার ড্রিপিং পরিচর্যা তো আমাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
এই যে মহামানবদের ইমেজ আর তীরবেগে ধাবমান মানুষ আর মানুষের সঙ্গে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জট পাকানো প্রকাশ এসব দেখে মনে হয় শিল্পী যেন কোনো পৌরাণিক বিষয় এঁকেছেন। এ দেশের মানুষেরা শাহাবুদ্দিনের ছবি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে বুঝতে পারে। কিন্তু তা যখন বিশ্বের অন্য কোনো দেশের মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয় তখন তারা ভাবে এগুলো বুঝি পৌরাণিক বিষয়ের ছবি। মহামানবেরা তো আধুনিক আইকন বা মূর্তি। তাঁদের তো মানুষ পূজনীয় মনে করে। তাঁরা তো লোকান্তরিত হয়েও মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ পাচ্ছেন প্রতিদিন। আর শাহাবুদ্দিনের অন্য যেসব ছবিতে পৌরাণিক ভাবনার ইশারা রয়েছে তা-ও নবপুরাণ বা নতুন মিথ বলে আখ্যায়িত হওয়ার যৌক্তিক কারণ আছে। তাঁর ছবি পশ্চিমের মানুষের কাছে মিথ হয়ে যায় এইজন্য যে ওই দুরন্ত-উড়ন্ত বলশালী নগ্নপ্রায় মানুষের মধ্যে তারা প্রমিথিয়ুসের ছায়া দেখতে পেয়েছে। শাহাবুদ্দিনের ছবিতে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরস্পরিত হয়ে যে অভূতপূর্ব ন্যারেশান বা আখ্যান রচিত হয় তা গ্রীক ও রোমান মিথ পাঠে অভিজ্ঞ পশ্চিমের চোখ মিথের আলোকে পাঠ করে। যুদ্ধংদেহী মানুষের মেলবন্ধন তো বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। যত সময় যাবে তাতে ক্রমে সঞ্চিত হবে মিথের শক্তি। শাহাবুদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্ররাশি যেন এক নবপুরাণ। কেননা একমাত্র এই শিল্পীর ছবিতেই মানুষী অভিব্যক্তি শিল্পীর আবেগের তোড়ে মিথের অদ্ভুতদর্শন শক্তিমত্ত চরিত্রের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।