এই যে সময়ের অদ্ভুত আনাগোনা, তুলতুলে মেঘের মতো নির্বিকার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে বেড়ানো, মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়া আবার অন্যসময়ে আগুন হয়ে পুড়িয়ে দেয়া- এই সবকিছু আমাকে যতটা না বিস্মিত করে, তার চেয়ে অনেক বেশী করে বিষণœ। কিছু কিছু ইংরেজি চলচ্চিত্রের শুরুতে বা শেষে মেঘের এই আনমনা ছুটে চলাকে বেঁধে ফেলা হয় ক্যামেরার অন্তর্জালে। তখন যতটা না মেঘ দেখি, তার চাইতে বেশী দেখি সময়কে। সময় এক অস্তিত্ববিহীন দ্রুতগামী ঘোড়ার অদ্ভুতুড়ে বিজয়রথ বুঝি! এই যেমন ধরুন মাত্র সাতাশ মাস আগেই এমন এক ক্লান্ত বিকেলে, ফুরফুরে হাওয়া দেয়া সন্ধ্যার আগমনে, কবি মারুফ রায়হানের সঙ্গে পুলিশের বাড়িয়ে দেয়া লাল প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে চিনি ছাড়া চা পান করছিলাম অমর একুশে বইমেলায়। কথা হচ্ছিল সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে, আড্ডা হচ্ছিল বিচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে আসা কবি, গল্পকারদের সাথে। ক্যানাডার মাটিতে বসে কীভাবে বাংলা সাহিত্যের চর্চাকে এগিয়ে নেয়া যায়, তা নিয়েও টুকটাক আলাপ হচ্ছিল ইত্যবসরে। আজকে সাতাশ মাস পরে এক গনগনে বসন্ত দুপুরে প্রায় মাটির বুকে ডুবে যাওয়া সোফায় হেলান দিয়ে সেদিনের কথা ভাবতে ভাবতে চিঠি লিখছি আপনাদের। কেউ কেউ হয়ত বলবেন গত আড়াই বছরে দুনিয়া আমূল বদলে গেছে রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে, সংস্কৃতিতে; আবার কেউ বলবেন সবই একই আছে! সময়ের যে তুলনামূলক চালচিত্র, তারই গুণগান গেয়েছিলেন কি আলবার্ট আইন্সটাইন তার ঞযবড়ৎু ড়ভ ঝঢ়বপরধষ জবষধঃরারঃু-তে? জানি না!
এমন নয় যে এর মাঝে আপনারা আমার চিঠি পাননি। পেয়েছেন তো! ওই যে চেরি ফুলের আড়ালে আবডালে তুষারপাতের গল্প, বরফের কুচিতে আনন্দ মেশানো বেদনায় ঘেরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন কিংবা বাঙালির আজব মেজবান খাওয়ানো কী শেয়ার করিনি আপনাদের সাথে! তবুও মাসঘুরে একই গল্প লেখা হয় ভিন্ন খাতায়। গত পরশুই হুলস্থূল ইফতার মাহফিলে গেলাম বন্ধু-স্বজনদের নিয়ে। ক্যানাডিয়ান বাংলাদেশীদের এক মহা মিলনমেলা বিসিসিবি নামক একটি সংগঠনের আয়োজনে। ইফতারের পর বাইরে পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে দেশের মতোই জমজমাট আড্ডা জমিয়ে তোলার চেষ্টাটা কখনও মিথ্যে হয় না। এদিকে এনডিপি থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানো ডলি বেগম আসলেন দোয়া প্রার্থনা করতে। তরুণ এই মানুষটি জিতে গেলে জিতে যাবে বাংলাদেশ। ডলি বেগম হতে পারেন প্রথম বাংলাদেশী ক্যানাডিয়ান সাংসদ। তবে সমস্যা অন্যখানে। সাংসদ হওয়া তো দূরে থাক, কাউন্সিলরও হননি এর আগে কোন বাঙালি এখানে। কারণটা বড্ড অদ্ভুত। একই আসনে নাকি এমনকি এগারজন বাঙালি দাঁড়িয়ে যান, তারপর সেই পুরনো গল্প। বাঙালির ভোটে হেরে যায় অন্য বাঙালি! আমি খুব চাই ডলি বেগম জিতে যান। তিনি লিবারেল পার্টি থেকে দাঁড়াননি বলে তাকে যাতে হারিয়ে দেয়া না হয়। খুব অদ্ভুত লাগে যখন দেখি একযুগও হয়নি ক্যানাডায় এসেছেন এমন বাঙালিরা ডলি বেগমকে ভোট দিতে চান না এই বলে যে তারা লিবারেল পার্টির সমর্থক! আমার খুব অবাক লাগে। এত এত মানুষ, এখনও শরীর থেকে গুলিস্তানের ঘাম কিংবা কস্তুরীর জিলাপির গন্ধ মুছে যায়নি, অথচ তারাই লিবারেল-ডেমোক্রেটিকের ধোঁয়া তুলে বাংলাদেশী ক্যানাডিয়ান প্রার্থীর পাশে দাঁড়ান না। আমাকে ভুল বুঝবেন না সুধীজন! আমি ডলি বেগমকে তেমন ভাল করে চিনি না, তিনি তো আমাকে চেনেনই না। তবু আমি শুধু দেখতে চাই বাঙালিরা এক হোক, জয়ী হোক। এই যে নীরবে নিভৃতে নিজেরাই নিজেদের হারিয়ে দেয়া, নিজেরাই নিজেদের নিয়ে মশকরা করা, তা থেমে যাক।
তবে শুধু যে হতাশার ডালি সাজিয়ে দেব আপনাদের সামনে এমনটা ভাববেন না। ভাল খবরও আছে বৈকি। ডা. শাফি উল্লাহ ভুঁইয়া, একজন ক্যানাডিয়ান বাংলাদেশী, যিনি কিনা একাধারে ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো এবং রায়ারসন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন, নির্বাচিত হয়েছেন এই বছরের ক্যানাডার অন্যতম সেরা ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে। এর আগে কোন বাংলাদেশী ক্যানাডিয়ান এই তালিকায় এসেছেন বলে আমার জানা নেই। নটর ডেমের জুনিয়র অনুজতুল্য ইশতিয়াক আহমেদ ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোতে যোগদান করেছেন কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে। দারুণ মেধাবী এই মানুষটির অন্তর্ভুক্তি আমাদের জন্য অনেক সম্মানের ব্যাপার এবং সে যে বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু ভাল গবেষণার সুযোগ তৈরী করবে এই বিষয়েও আমার কোন সন্দেহ নেই।
আজকে টরোন্টোর আকাশ বেশ ফকফকে। তাপমাত্রার অনুভূতি প্রায় ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাস কেমন যেন পরিষ্কার নয়। ক্যানাডার আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্কতা জারি করেছে, বিশেষ করে শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের জন্য, কারণ এই ধুলিবালিময় বাতাস নানা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তবে তাতে গা করবার মানুষ বেশী নেই। সারাবছর তুষারপাতে ঢেকে থাকা মানুষগুলো বাহুল্য পোশাকের ভারমুক্ত হয়ে নেমে পড়েছে ডাউনটাউনের রাস্তাঘাটে। হাত ধরাধরি করে তরুণতরুণীদের নির্ভয় পদচারণা জীবনকে অনেক সুন্দর ও কলুষমুক্ত করে তোলে। এক উদাসী ভবঘুরে সামনের মাস থেকে গাঁজার অনুমোদনপ্রাপ্তি নিয়ে আবেগময় বক্তব্য দিচ্ছে মাইক হাতে নিয়ে, বুঝলাম ভাই একটু চড়া আছেন। আমি যেখানে থাকি তার আশেপাশে চড়া মানুষের ছড়াছড়ি। সপ্তাহান্তে মদ্যপ ভাইয়েরা আমার রাস্তার পাশে হড় হড় করে বমি করে জীবনের সব হতাশা-দুঃখ ভুলে থাকে। কেউ কেউ অভিজাত স্ট্রিপ ক্লাব ব্রাস রেইলের দরজা খুলে ঢুকে পড়ে রঙিন জগতে। যে যার মতো, কারও কোন মাথা-ব্যথা নেই অন্যের জীবনে। এই যে ছুটে চলা, নিজের জন্যই নিজের মতো করে।
দু’সপ্তাহ আগেই আড্ডা দিচ্ছিলাম ক্যানাডার উঠতি দুই আইনজীবী সাকিব আলম এবং আশরাফুল করিমের চেম্বার কজমো ল’ অফিসে। কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ বিষয়ে। কী এক ভীষণ উত্তেজনা! এমন ঘটনাগুলো প্রবাসীদের উৎসাহিত করে, উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেশ থেকে যত দূরেই থাকুক না কেন, প্রবাসীদের স্বদেশ চিন্তায় কিন্তু বাধা আসে না। এই যে ১০ লক্ষেরও বেশী বার্মিজ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার এই ঔদার্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। তবে উৎকণ্ঠাও আছে। সদ্য মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া বাংলাদেশের বলতে গেলে একমাত্র আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে শরণার্থীদের অবাধ বিস্তারে কী ভবিষ্যত দাঁড়াবে এই এলাকাটির? একদা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের ‘বসিয়ে’ দিয়ে যে জনমিতিক পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তেমন কিছু কি ঘটবে এই এলাকাতেও? জানা যাবে আগামী দুই দশকে। তখন আর কিছু করার থাকবে না।
যাই হোক! ওই যে বলছিলাম আইনজীবী বন্ধু সাকিব ও রনির সাথে আলাপ করছিলাম টরোন্টোর বাংলা বইমেলা নিয়ে। ভীষণ দুর্বল এই ব্যবস্থাপনা আমাকে নিদারুণভাবে হতাশ করেছে। একটা বড় হলঘরে ৬০ ভাগ জায়গায় দর্শনার্থীদের বসিয়ে মঞ্চে গান-বাজনা আর হলের দেয়াল ঘেঁষে অল্প কিছু বইয়ের স্টল, যেখানে বেশীরভাগ বই স্থানীয় বাংলাদেশী ক্যানাডিয়ানদের নিজেদের প্রকাশনা। মানের কথা বলে দিন দুপুরে আর কিল খেতে চাই না! এখানে নাকি লক্ষাধিক বাঙালি আছেন। তাহলে শিল্প সাহিত্যের এত দীনতা কেন? শুধু শিল্প সাহিত্য কেন, যদি বলি খাবার দাবারের কথা, তাহলেও মুখ বেজার করতে হবে। বিদেশী গবেষক, স্কলার বন্ধুদের নিয়ে যে একটা মানসম্পন্ন দেশী রেস্তোরাঁয় বসে দু’দন্ড আড্ডা দেব, ভাল-মন্দ খাব- এমন জায়গা নেই বললেই চলে। প্রিমিয়াম রেস্তোরাঁ নামে একটি রেস্তোরাঁ হয়েছে বটে, কিন্তু যেখানে শত শত ভারতীয় পাকিস্তানী মানসম্মত রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে, সেখানে বাঙালি রেস্তোরাঁ কেন কেবল দুয়েকটি? এই উত্তর কে দেবেন জানা নেই!
সারা পৃথিবীটাই নাকি দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে। দুনিয়াটা আসলে কি কখনও স্থির ছিল? এই উত্তেজনা, এই আরোপিত হিংসা-বিদ্বেষ, সুখে থাকলে ভূতে কিলায় প্রবাদটিকে সত্য পরিণত করতে আমাদের যে নিত্য চেষ্টা তা থেকে বোধহয় আর মুক্তি নেই। মোটামুটি সাদাসিধে দেশ ক্যানাডাতেও এর আঁচ লেগেছে। রাস্তার উপর ভ্যান তুলে দিয়ে ১৫ জন মানুষ হত্যা কিংবা গত সপ্তাহেই মিসিসাগাতে একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় রোজার মধ্যে দিনে খাবার বিক্রি করায় দুর্বৃত্তদের বোমা হামলায় মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সামনে বাংলাদেশ এবং ক্যানাডা উভয় দেশেই নির্বাচনী মরসুম। কে জেতে কে হারে? তার প্রভাব বাঙালিদের জীবনে নানাভাবে পড়বে সন্দেহ নেই।
মানুষের জীবনটাই কেমন এলোমেলো। হিসাব মেলানো যায় না সহজে। আগামী বইমেলায় জন্য লিখতে থাকা উপন্যাস ‘কোথাও একটা লুকোনো বিষাদ আছে’র পাতা থেকে চোখ তুলে এগারতলার কাঁচের দেয়াল দিয়ে বাইরের রোদেলা বিকেলে ঝলমলে টরোন্টো শহরের দিকে তাকাই। সুউচ্চ অট্টালিকার ফাঁকে দূরে লেক অন্টারিও জলে ঘেরা সৌন্দর্য চোখে পড়ে। মনে হয় গুলশানের বাসা থেকে হাতিরঝিলের দৃশ্য যেন। এখানে সন্ধে হলে রোজার মাসের ঢাকার মতোই যান চলাচল কমে আসে, যদিও কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিজের অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হলেও রোজার মাসটাতে মাগরেবের আযান শোনার জন্য হৃদয়টা হাহাকার করে ওঠে। কোথাও আযানের শব্দ শোনা যায় না। অলৌকিক আযানটাকে নিজের ভেতরে বাজিয়ে নিয়ে একধরনের অদ্ভুত সুফিজমের অনুভূতি হয়। হৃদয়ের গভীরে যে সুর, সেতারের দ্যোতনা, তার তাল-লয়-ছন্দ শুধু উদাসী কবিরে গহীনে বাজতে থাকে, মনে হয় যেন ভালোবাসার এক ‘অদ্ভুত ইঙ্গিত আসে ঈশ্বরের কাছ হতে’...
২৮ মে ২০১৮
ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো
টরোন্টো, ক্যানাডা।
[email protected]