চিকিৎসকের তথ্য অনুযায়ী জেনেছি, বেলাল চৌধুরীর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। না চাইলেও বুঝতে পারি তাঁর পার্থিব জীবনের অবশ্যম্ভাবী অবসান আসন্ন। তাঁর সৃষ্টিশীল হাত মৃত্যুর মুঠোর মধ্যে ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ছে। তাঁর নির্বাক মুখে নেমে এসেছে ছায়া- মুছে যাচ্ছে অবয়বের দীপ্তি। আর ভুবনডাঙ্গা চষে বেড়ানো পাজোড়া নিষ্পন্দ। তারপর ২৪ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল হাসপাতালে ‘এসেছি ঢের দূর, আর নয়’ জীবনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক চূড়ান্তভাবে ছিঁড়ে যায়। সাহিত্যের স্বপ্নতাড়িত এক চরিত্রের জীবনাবসান হলো।
জীবৎকালের আশি বছরের সিংহভাগ সময়ে তিনি ছিলেন খেয়াল খুশিমতো পরিব্রাজক। তাঁর বোহেমিয়ান জীবনের চমকপ্রদ ঘটনা সাহিত্যের বিভিন্ন আড্ডায় আলোচিত এবং ছাপার অক্ষরেও বহুল পঠিত। তিনি ছিলেন উড়ন্ত, কিন্তু উড়নচ-ে না। বাংলাদেশের আধুনিক কবিদের মধ্যে উভয় বাংলায় তিনিই একমাত্র জীবনকে দুলকি চালে এখান থেকে সেখানে, স্থল, আকাশ ও জলপথে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন। দিনযাপনে ভাসমান জাহাজ, পরিত্যক্ত কবরের খোড়ল থেকে ঝাঁঝরা ছাউনি, দোচালা-চৌচালা থেকে ফ্ল্যাটে দিন গুজরান করেছেন তিনি। কৈশোত্তর যুবা বয়স ও যৌবনের অধিকাংশ কাল কখনও একাকী, কখনও তাঁর সোদরপ্রতিমদের সঙ্গে সৃষ্টি ও অদ্ভুতকা- দুই-ই করেছেন। জীবনের মধ্যপর্যায়ে সংসারী হয়েও বাইরের পৃথিবীর আহ্বান পুরোপুরি তিনি খারিজ করতে পারেননি। কাউকে না-বলতে পারার স্বভাব থেকে মানুষের একান্ত প্রয়োজনে সাধ্যমতো কাজ করে দিতে নিজের লেখার টেবিলে বসার তাগিদ তিনি স্থগিত রেখেছেন। সময় খরচের মতো সময় তাঁর না- থাকলেও মানুষকে সঙ্গ দিতে দেশ থেকে দেশে, জনপদে, কখনও অবলীলায় মানুষের অন্দরে প্রবেশ করেছেন। শেষাবধি ঠিকই তাঁর নিজস্ব সাধন জাগতিক ভজন সিদ্ধির স্তরে পৌঁছেছে। সৃজনীশক্তির সিম্ফনি তাঁর মধ্যে ব্যাপ্ত ছিল। এ জন্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ওপার বাংলার ষাটের দশকের আলোড়ন তোলা সুনীল শাসিত সাহিত্য পত্রিকা ‘কৃত্তিবাস’ সম্পাদনা করেছেন তিনি। আমরা অনেকে জানি না, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পত্রিকা ‘দেশ’- এ কবিতা ছাপা হতো পাদপূরণ হিসেবে। এ দেশেও পত্রপত্রিকায় কবিতার যোগ্য স্থান ছিল না। স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে বেলাল চৌধুরী কার্যনির্বাহী সম্পাদক থাকাকালে কবিতাচর্চায় পত্রিকাটি কবিদের অন্তরঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য বান্ধব হয়ে ওঠে। গদ্য ও কবিতা, স্মৃতিকথা তিনি কম লেখেননি। স্মৃতিকথা ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’, নিবন্ধ ‘কাগজে কলমে’, ভ্রমণকাহিনী ‘সূর্য করোজ্জ্বল বনভূমি’, শিশুতোষ ‘সপ্তরতেœর কা-কারখানা’ ‘সবুজ ভাষার ছড়া’ ‘বত্রিশ দাঁত’, অনুবাদ ‘মৃত্যুর কড়ানাড়া’ উল্লেখযোগ্য। আরও আয়ুষ্মান শিল্প-সাহিত্য বেলাল চৌধুরী থেকে পাওয়া যেত। কিন্তু তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল হৃষ্টচিত্তে দশদিগন্তের প্রজ্ঞা-সন্ধানী আড্ডা দিয়ে সময় খরচ। তাঁর বাক্যালাপে যে উইট-হিউমার তার সাক্ষ্য পাওয়া গেছে রাজধানী বিষয়ে মিতায়তনের লেখা ঢাকা ডায়রিতে। কথোপকথনে হাস্যোদ্দীপক উদাহরণের যোগান দিতে ছিলেন পারঙ্গম। নিজস্ব ভাঁড়ার রসে যেন পূর্ণ করে রাখতেন স্বীয় মনোজগত ক্রমাগত খনন করে।
অনেকে জানেন না, বেলাল চৌধুরী গল্প লিখেছেন। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা ‘অপরাহ্নহ্ণ’ গল্পটি সচিত্র সন্ধানীতে ছাপা হলে বোদ্ধা পাঠক মহলে আলোড়ন পড়েছিল। শুরুতেই লিখলেন: ‘ইদানীং লতাগুল্ম, উদ্ভিদ, তৃণদাম, গাছপালা, পত্রপল্লব, পুষ্পিত কানন, শীতল জল, শৈবাল-এ সবের গন্ধ কি নির্মম আর অসহ্য মনে হয়।’ কার্তিকের ঘোরলাগা অপরাহ্ন যে ভাবে বেলাল চৌধুরী বর্ণনা করেছেন তা পড়ে মনে হয়েছিল আমরা গল্পে আরেকজন কমল মজুমদারকে পেয়েছি। কিন্তু গল্পের মতো অস্পষ্ট আলোছায়ার কাটাকুটিতে, কুয়াশার নরম আস্তরণে সব লীন হয়ে গেল। বেলাল চৌধুরী গল্প রচনায় সক্রিয় থাকেন নি।
তাঁর অন্তর্প্রদেশে ছিল উপর্যুপরি মন্থন। তাঁর বাউ-ুলিপনা অনুমোদন করে দেশের চালচিত্র, রীতি-প্রথা, প্রকৃতি অন্তর্লীন ধ্যানে সরবরাহ করেছে অনুকূল গুণময় ভাব। সব কবি’র মতো কাব্যশক্তি বেলাল চৌধুরী পেয়েছেন বাংলার জলহাওয়া, জাগ্রত জীবন, প্রাত্যহিক বাস্তবতা, বাঙালী সত্তা, দেশচিন্তা ও বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে। স্বদেশ যথেচ্ছভাবে অনুরণিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। আবার বেলাল চৌধুরীরও ছিল নিজস্ব বোধ, অন্তর্মুখী প্রতিক্রিয়া, মানস ক্ষতাক্ত শূন্যতা, প্রাক্তন আশাবাদে অনাস্থা, পরিত্রাণের উপায় খোঁজার উদ্দেশে কালের কেশর জাপটে ধরার আগ্রহ, কখনো কখনো বেদনার দৃষ্টিমাখা অবলোকন। চূড়ান্তভাবে মানুষ ও দেশের দুর্দশা থেকে বেলাল চৌধুরী কবিজনোচিত নিরাসক্তি বজায় রাখেন নি। শুধু ব্যক্তি নন তিনি-সমষ্টির অংশ হয়ে সরাসরি দ্রোহের দিকে পাশ ফিরেছেন। বেলাল চৌধুরী জানতেন, কবি যদি হ’ন জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর তবে সামাজিক দায় থেকে তাঁর পরিত্রাণ নেই। তাঁর সমূহ অনুভব, একান্তচিন্তা ও প্রতীতি, অভিনিবেশের প্রকাশ: নিষাদ প্রদেশে, আত্মপ্রতিকৃতি, স্থিরজীবন ও নিসর্গ, স্বপ্নবন্দী, সেলাই করা ছায়া, কবিতার কমলবনে, যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে, বত্রিশ নম্বর কাব্যগ্রন্থে ছড়িয়ে আছে। ‘আপনি কবিতা লেখেন কেন?’-এই প্রশ্নে বেলাল চৌধুরী একই শিরোনামে প্রত্যুত্তর দিয়েছেন, ‘বৃশ্চিক রাশির অসুখী, না-কি সুখী বেলাল চৌধুরী কবিতা লিখি, গদ্যও লিখি-লিখতে হয় জীবিকার জন্যে, আলসেমির জন্য তা-ও ঠিক হ’য়ে ওঠে না সব সময়, কতো লেখা যে অর্ধপথে থমকে আছে, বাঁকা চাঁদের এলোমেলো শব্দরাশি, আবোল-তাবোল। কেবল তখনই বাঁক নিয়ে চ’লে গেছি কবিতার পক্ষপুটে। বলা যায় মজেছি। কতোটা?-প্রায় ডুবজল, ডুবুডুবু। ডুবুরী হওয়ার স্বপ্ন ছিলো যে একদা। ..... দেশ-কাল-সমাজ-সংসার যুদ্ধ-বিগ্রহ পরমাণু আবর্জনা, যোনি, ব্যাঙের ছত্রাক, শ্যাওলা-গুল্ম, ঘাস-লতাপাতা-ফুল, সৌর-পল্লীর যাবতীয় সব কিছুই কবিতার ভোজ্য। আমি কেবল ক্রমাগত ঠুকরে চলেছি।’
তন্নিষ্ঠ পাঠকও জানেন না বেলাল চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের কবিতা নামে আলাদা একটি গ্রন্থ আছে। অবগত না-থাকার কারণে আলোচকরাও তালিকায় এই গ্রন্থটির নাম অন্তর্ভুক্ত করেননি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির বই মেলায় বেলাল চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের কাব্যগ্রন্থটি সন্ধানী প্রকাশনী থেকে বের হয়। গ্রন্থভুক্ত হয়েছে বেয়াল্লিশটি কবিতা। প্রচ্ছদ এঁেকছেন বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। উৎসর্গপত্রে বেলাল চৌধুরী লিখেছেন: ‘মুক্তিযুদ্ধের অমর বীর সেনানী যাঁরা জয়বাংলা ধ্বনি তুলে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য আত্মদান করে শহীদ হয়েছেন তাঁদের পিতা-মাতা, ভাই-বোন, বধূ-সন্তানদের প্রতি সর্বাধিক শ্রদ্ধা সম্ভাষণ।’ বাঙালী জাতির সশস্ত্র যুদ্ধ এক গৌরবময় শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তখন প্রতি মুহূর্তের মৃত্যু বিভীষিকা, বেয়নেটবিদ্ধ দুঃসময়ের নয় মাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন মৃত্যুতাড়িত ও সংগ্রামশীল পঙ্ক্তিগুচ্ছ। স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশে জায়মান ছিল মুক্তিযুদ্ধের অনি:শেষ চেতনা। এই সংজ্ঞাই জাতিকে দিয়েছে প্রেরণা। জাতির পিতার হত্যাকা-ের নিন্দা, সামরিক শাসন, সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ- স্বৈরাচার বিরোধিতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে বাঙালী বার বার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃত দীপ্ত চেতনার সারাৎসার নিয়ে বেলাল চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের কাব্যগ্রন্থটি। সচরাচর দেশে বইয়ের বহিরাবরণে লেখকরাই বইটি সম্পর্কে বিবৃতি রচনা করেন। বেলাল চৌধুরী নিজে লিখতে সম্মত হননি। প্রকাশক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ আমাকে দায়িত্ব প্রদান করলে লিখিত সংক্ষিপ্ত সার প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে এখানে পেশ করছি।
মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কবি বেলাল চৌধুরীর কবিতায় সমার্থক উচ্চারণ। তাঁর কবিতা আপাত-সুবোধ মনে হলেও বিষয়ান্তরে রয়েছে ভাব-উদ্দীপক ব্যঞ্জনা। কবির আত্মোপলব্ধির অন্তরঙ্গ উৎসারণের সঙ্গে অনায়াসে অংশীদার হয়ে ওঠেন পাঠক।
মুক্তিযুদ্ধ জাতির সর্বোচ্চ ত্যাগ, সর্বাত্মক লড়াই আজ ইতিহাসের অংশ। এই ইতিহাস চেতনা কবিতায় ধারণ করেছেন বেলাল চৌধুরী। কখনও প্রত্যক্ষভাবে, কখনও প্রতীকের আশ্রয়ে সেদিনের উজাড় করে দেয়া জীবন কবির অন্তর্লীন ধ্যানানুভূতিকে খনন করেছে; আর তা পাঠক-হৃদয়ে প্রবেশ করে রেখে যায় বিবিধ আলোড়ন। আমরা বেলাল চৌধুরীর কবিতা পাঠে স্মরণ করতে পারি-সেই সব রক্তপাত-মৃত্যু-সন্ত্রাসকবলিত দিনগুলোর স্মৃতি যা জন্মযন্ত্রণার এক শক্তিশালী অনুবাদ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব জাতির মানসিক আবহাওয়া পরিব্যাপ্ত করেছিল। নাড়া দিয়েছিল সত্তার ভিত্তিমূলে। কবি দেখেন সাধারণের ক্ষান্তিহীন সংগ্রাম ও অন্তহীন যন্ত্রণা। এর পশ্চাতে রয়েছে সঞ্জীবনী প্রাণপ্রবাহ। চিত্রধর্মী, কবিতায় গদ্যের প্রভাব বা মননের কাঠিন্য দান-কোন পথেই যাননি কবি বেলাল চৌধুরী। তাঁর মার্জিত কবি-মন ও বিদগ্ধ রুচি সৃষ্টি করেছে দেশ-কালের আধারে এক গীতল হিল্লোল।
কবিতার হৃদয়-সংবাদী পাঠক মাত্রই জানেন, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ, অতি ব্যবহারে জীর্ণ কবিপ্রসিদ্ধি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। বেলাল চৌধুরী তাই দেশজ ঐতিহ্যের সাহায্যে পুনর্র্নিমাণ করেছেন স্বকীয় কাব্যাদর্শ। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এ কারণেই স্থাপিত হয়েছে তাঁর কবিতায় নিবিড় সম্বন্ধ।
সুখের সন্ধান করে ফেরা বেলাল চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন কন্যা মৌরী ও পুত্র পাবলোর সান্নিধ্যে দিনযাপন করতে। ২০১৪ সালে একুশে পদকপ্রাপ্তির পর এবং তা গ্রহণে তিনি দেশে ফেরেন। এই বছরের ৯ মে কলকাতা সাহিত্য আকাদেমির অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কলকাতার চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে তিনি চলে আসেন দেশে। ঢাকার কমিউনিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ইনফেকশনে তিনি আক্রান্ত হন। তখন চিকিৎসার জন্য তাঁকে নেয়া হয় ধানম-ির হাসপাতালে। এ সময় তাঁকে কাইয়ুম চৌধুরী, গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সঙ্গে দেখতে গিয়েছিলাম। শয্যাশায়ী অবস্থায় তাঁকে তাঁর দুই পরম সুহৃদ কাইয়ুম চৌধুরী ও গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের মৃত্যু সংবাদ আমাকে দিতে হয়েছে। এখন আশি বছর বয়সে বেলাল চৌধুরী ‘আসি’ বলে স্থায়ীভাবে আমাদের ছেড়ে গেলেন। এই ঢাকা শহরে আমার মতো দুর্ভাগাদের একজন আত্মার আত্মীয় ও অভিভাবক ছিলেন তিনি।