বহু অপেক্ষার পর বইটা হাতে পেয়ে সাথে নিয়ে ঘুরি আর নীল মলাটে ছাপা কারুকাজ করা পুরনো দরজার দিকে তাকায়ে থাকি। এ রকম একটা দরজা আমি কোথায় দেখছি? মাঝে মাঝে রঙ চটে গেছে। দরজার হুড়কো লাগানো থাকলেও তালা দেয়া নাই, চাইলেই খুলে ঢুকে যাওয়া যায় অথবা কড়া নাড়া। এই দরজা খুললে ওই পাশে কী দেখব? অতীত? অন্য দুনিয়া? মনে হয় আমার ছোটবেলায় নানা বা দাদার বাড়িতে হয়তো এ রকম দরজা ছিল, সেইসব তো সুখের দিন।
তাইলে কি দরজার এই পাশের সময়টা অসুখী? এ রকম আগডুম-বাগডুম ভাবি, মাঝে মাঝে বই খুলে আমাকে দেয়া শাহীন আপার অটোগ্রাফ দেখে আপ্লুত হই- ‘যার এ বইয়ের প্রথম পাঠক হওয়ার কথা...।’ পাতা উল্টায়ে উল্টায়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেই, কিন্তু পড়া শুরু করার মতন অবসর বা নির্জনতা পাওয়া যায় না।
মেলবোর্নে এখন অটাম, গাছের পাতার রঙ বদল শুরু হয়ে গেছে। দিন ছোট হচ্ছে আর রোদের তেজ কমতে শুরু করেছে। কিছুদিন পরে পাতাগুলো খয়েরি হয়ে ঝরে যাবে, এখন যাওয়ার আগে শেষ খেলা দেখায়ে যাচ্ছে। অফিস থেকে ফিরতি পথে রাস্তায় গাছের পাতার আড়ালে বিকালের আলো নরম মনে হয়। কিছু কিছু এমন দিন থাকে, যখন মনে হয় কোথাও যাওয়ার নাই। মনে হয় দুনিয়ায় আমাকে আঁটতেছে না। এমন না যে খুব দুঃখী দুঃখী ভাব, কিন্তু নিজেকে চলমান সবকিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন লাগে। অন্য গাড়ির সাথে সাথে আমার গাড়িও চলছিল, এর বেশি কিছু টের পাচ্ছিলাম না। পাশের সিটে অসুখী দিনের বন্ধ দরজাটা বলতেছে, এইবার খুলে দেখার সময় আসছে।
ওকলি লাইব্রেরির উল্টাদিকে আমার প্রিয় পার্কটায় যখন পৌঁছলাম তখন বিকালটা আরেকটু পুরনো। এখানে বহু আগের কিছু কবর আছে, সেই ১৭০০ সাল থেকে শুরু। একবার ঘুরে ঘুরে এপিটাফগুলি পড়েছিলাম। জায়গাটা অদ্ভুত। একদিকে বাচ্চাদের খেলার জন্য দোলনা, সেইখানে মাঝে মাঝেই ওদের হাসি, দৌড়ঝাঁপের শব্দ পাওয়া যায়, সাথে পাখির ডানার ঝাপটানি আর বাতাসে গাছের পাতার দোল খাওয়ার শব্দ মিশে, প্রাচীন কবরগুলি এর ভেতরেই শুয়ে থাকে, তাদেরকে আলাদা কিছু মনে হয় না, যেন শেষ হওয়ার পরেও এই মানুষগুলির নিঃশ্বাস বাতাস বহন করছে।
গাছের নিচের বেঞ্চে বসে বইটা খুললাম। শুরুতেই জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন-
‘যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ- সবচেয়ে গাঢ় বিষণœতা;
যেখানে শুকায় পদ্ম- বহুদিন বিশালাক্ষী যেখানে নীরব;
যেইখানে একদিন শঙ্খমালা চন্দ্রমালা মানিকমালার
কাঁকন বাজিত, আহা, কোনোদিন বাজিবে কি আর!’
হঠাৎ একঝাঁক সাদা কাকাতুয়া ডানা মেলে ঘাসে নেমে এল ওদের কর্কশ গলায় ডাকতে ডাকতে, ওদের পেছনে বাঁধানো কবর আর গাছের পাতায় বিকালের রোদ। যেন অতীতে পৌঁছলাম...
‘যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ- সবচেয়ে গাঢ় বিষণœতা...’ আমি সাবিনার কথা পড়তে শুরু করলাম। সে তখন ট্রেন ছাড়ার ১০ মিনিট আগে একটা চশমা কিনেছে ১০০ টাকায় আর আরো সস্তা কিছু খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেছে অনিতা সেনের স্মৃতিকথা। সেকেন্ডহ্যান্ড বইয়ে যেমন করে তার প্রথম পাঠকের স্মৃতিও থেকে যায়, এইখানেও আছে, শ্রীহট্টের নীলিমা দাস তার বিয়েতে বইটা উপহার পেয়েছিলেন শিলংয়ের পুলিশবাজারের শংকরলালের কাছ থেকে। চলন্ত ট্রেনের জানালায় দৃশ্য বদলায় আর সাবিনা বইয়ের ভেতরে নীলিমা সেনের হাতের হলুদের ছোপ দেখে তার ছোটবেলায় চলে যায়।
সাবিনার মা নীহার বানুর ছিল বই পড়ার নেশা- ‘পরের বেলার আধা-কষা তরকারিতে একহাতে ছড়ছড়িয়ে পানি ঢালছেন তো আরেক হাত অব্যর্থভাবে চুলার উপরে জলচৌকির ওপর, যেখানে মসলাপাতির ঝাঁঝাঁ গন্ধ মাখা খোলা বই পড়ে রয়েছে।’ পড়তে পড়তে আমার মুখ হাসি হাসি হয়ে যায়, শাহীন আখতারের রসবোধ এ রকম আলতো। অন্য কথার মাঝখানে হঠাৎ দুই একটা শব্দে খেয়াল না করলে টেরই পাওয়া যায় না। এ রকম বেশকিছু ছোট উদাহরণ পেয়েছি পরের পৃষ্ঠাগুলিতে, যেমন কমিউনিস্ট অনিতা সেনের স্মৃতিকথার এক জায়গায় সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে তার তখনকার আবেগপ্রবণ কল্পনার কথা এসেছে এইভাবে- ‘পৃথিবীর একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশটার প্রতি অসম্ভব মায়া তখন আমাদের। কল্পনায় দেখতাম যৌথ খামারে ট্যাক্টর চালাচ্ছি, মাটি খুঁড়ে আলু তুলছি...খড়ের গাদায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে তাকিয়ে আছি কাস্তে আকৃতির ভঙ্গুর চাঁদখানার দিকে। ককেশাসের নির্মেঘ আকাশের দীপ্তিমান চাঁদ, যার ধোঁয়াটে নীল আলোটাও বরফের মতো ঠা-া হিম। কাছাকাছি রাস্পবেরির ঝোপ থেকে ক্রিস্টাল চোখে তাকিয়ে আছে একটি নেকড়ে ছানা। জাতে হিংস্র হলেও স্বভাবে নিরীহ আর মায়াময়, সমাজতান্ত্রিক দেশের জন্তু তো!’
বোঝা যায় সেই অল্প বয়সে রাশিয়ান উপন্যাস পড়ে পড়ে একটা ধারণা করে নিয়েছিলেন অনিতা সেন, আবার ডায়েরিটা যে সময়ে লেখা হয়েছে, ততদিনে তার রাজনৈতিক মতবাদ কি অনেকটাই পরিবর্তিত? নয়তো সমাজতান্ত্রিক মায়াময় নেকড়ে নিয়ে রসিকতাটুকু বোধহয় করতেন না।
বইটার বিন্যাস ভালো লাগছে। কাছের অতীত থেকে দূরের অতীত, সূদূর অতীত ঘুরে বর্তমান ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া। তার মধ্যেই পাজলের টুকরার মতন চরিত্রগুলি জোড়া লাগছে, স্পষ্ট হচ্ছে। পড়ার সময় যতটা অনায়াস মনে হয়, লেখার সময় নিশ্চয়ই সে রকম ছিল না। তার ওপর আছে ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরা। যদিও ইতিহাস আর তা নিয়ে উপন্যাস এক নয়, এ নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্কও আছে। তার পরও বিশ্বাসযোগ্য গল্প বুনে তোলার জন্য প্রেক্ষাপট তো জানতে হয়। আবার শুধু সন-তারিখ, ঘটনা পরম্পরা আমরা ইতিহাসের বই থেকেও জানতে পারি, তা উপন্যাস হয়ে ওঠে যখন যেই সময়ের মানুষগুলি বইয়ের অক্ষরের মাধ্যমে আমাদের চোখের সামনে চলে-ফিরে-বেড়ায়, যখন পাঠক হিসেবে তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অনুভূতিগুলি টের পেতে থাকি।
বইয়ের শুরুতে সাবিনার সিলেট থেকে ঢাকা ট্রেন জার্নিও তার রোমন্থনের অংশ, যেদিন অনিতা সেনের স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে সে তার বাবা মোয়াজ্জেম হকের তরুণ বয়সের কথা ভাবতে থাকে। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতায় ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে চলে গিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিতে। সাবিনা ট্রেনের জানালায় বাতাসে পায় আমের বউল আর শজনে ফুলের গন্ধ আর তার মনে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে তার বাবা শিলচরের এক ভাতের হোটেলে আঁকাড়া চালের ভাত আর শজনে ফুলের বড়া খেয়েছিলেন, যা দুইদিনের অনাহারে তার মনে হয়েছিল অমৃত। সেদিনই তার মেজো ভাইয়ের দেয়া প্রস্তাবটা সম্পর্কে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে রাজি হয়ে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রস্তাব তার মেজো ভাই দিয়েছিল তাদের বাবা মোয়াজ্জেম হকের নব্বই বছরের জন্মদিনে ঘরে সদ্য ঝোলানো ঝাড়বাতির নিচে বসে। ততক্ষণে ক্লান্ত বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন। মেজো ভাইয়ের ইচ্ছা, পরিবারের ‘সোনালি দিন’ নিয়ে সাবিনা একটা বই লিখুক।
ধীরে ধীরে জানা যায় সাবিনা একজন সাংবাদিক এবং উঠতি সাংবাদিকদের প্রশিক্ষক। চার ভাইবোনের ভেতর সে সবচেয়ে ছোট। বড় ভাই বহু বছর আগে লাং ক্যান্সারে মারা গেছে, মেজো ভাই প্রতিপত্তি এবং বিত্তশালী প্রবাসী সার্জন, বড় বোন রোকসানা একজন ডাক্তার, ঢাকায় থাকে, ব্যস্ততার কারণে গ্রামের বাড়িতে তেমন আসতে পারে না, তবুও আশপাশের গ্রামের লোকেরা তার ছোটখাটো উপকার ভোলেন নাই। এদিকে প্রতিবেশীদের কাছে সাবিনার বরং বদনামই আছে ডিভোর্সি বলে, লোকে তার বিয়ে ভাঙাটা মনে রেখেছে, পরের বিয়ের কথা মনে রাখেন নাই।
বই লেখার জন্য সাবিনা চাকরি ছেড়ে দিয়ে বৃদ্ধ মা-বাবার কাছে থাকে। আগের বাড়িটা আর চেনা যায় না। মেজো ভাই প্রচুর খরচ করে ঢালাও সাজিয়েছে। সাবিনার সব অচেনা লাগে, শুধু পুরনো বিবর্ণ ছবিতে ধরা থাকে করোগেটেড টিনের চাল। তার মনে পড়ে ছোটবেলায় উঠানের এক কোনে দাঁড়ানো কাঁঠাল গাছ, যে কাঁঠালের ম-ম গন্ধ আর স্বাদের সুনাম আছে এখনো। ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগে তার মা-বাবার বিয়ের রাতে শনের ঘরের চাল উড়ে গেছিল। নীহার বানুর সেদিন মনে হয়েছিল এই বুঝি রোজ কেয়ামত। আমরা সাবিনার দুনিয়ায় এ রকম করেই ঢুকতে থাকি। জানা যায় নীহার বানুর বাবা যথেষ্ট ধনবান হাজি চান, মোয়াজ্জেম হকের মা সায়মা খাতুন মাঝে মাঝেই তার কাছ থেকে ছেলের পড়াশোনার খরচ আনতেন।
বইটা কোনো একটা বিন্দুতে স্থির থাকছে না, যেভাবে আমাদের মাথার ভেতরের ভাবনাগুলিও অস্থির।
কোনো কোনো অংশ কয়েকবার করে পড়ছি যেন একটু অমনোযোগেই খেই হারাব। এর মধ্যে বিকালটা গড়াচ্ছে, একজন-দুজন করে মানুষ আসছে পার্কে হাঁটতে।
আমি পড়ছি নীহার বানুর পাশের বাড়ির বিধবা সুরবালার কথা, যে দেশভাগের সময় ভারত চলে যাওয়ার সময় তার বইগুলো নীহার বানুকে দিয়ে গিয়েছিল। ফাতেমা আর জোহরাদের বাড়ির কথা, যারা মজুমদারদের সঙ্গে বাড়ি বদল করে রিফিউজি হিসেবে সাবিনাদের গ্রামে এসেছে দাঙ্গার সময়ের বীভৎস স্মৃতি সঙ্গে করে। তাদেরকে গ্রামের লোকেরা মেনে নিতে পারে নাই। আরো পড়ছি সাবিনার শৈশবের কথা, পড়ুয়া মায়ের গল্পে আবিষ্ট হয়ে সে কল্পনা করত তাদের গ্রামের মাঠটার প্রান্তেই বুঝি সেই কুয়া, যেখানে ইউসুফ নবীর ভাইয়েরা তাকে ফেলে দিয়েছিল, অথচ তার ভাগ্যে ছিল রাজসিংহাসন, কে তাকে ঠেকাবে?
কোনো চরিত্রকেই খুব সাজিয়ে গুছিয়ে বাক্সে ভরা যাচ্ছে না। এরা জীবন্ত এবং বিস্ময়কর। তাই পড়ুয়া, স্বামী অন্তঃপ্রাণ, শিল্পমনা নীহার বানু একই সাথে বিদ্বেষ পোষণ করতে পারেন সায়মা খাতুনের প্রতি। শাশুড়ির মৃত্যুর বহু বছর পরেও যখন তিনি তার ৯০ ঊর্ধ্ব স্বামীকে পাহারা দিয়ে মৃত্যুর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন, তখনো শাশুড়ির প্রতি তার মন গলে না, সন্তানের প্রতি সায়েমা বানুর কান্নাকে তাই অনায়াসে মাছের মায়ের কান্না বলতে পারেন। আবার গরিব, অশিক্ষিতা এবং দূরসম্পর্কের আত্মীয় হাজি চানের করুণার পাত্রী সায়মা খাতুনও পক্ষীমাতা সিমুর্গের মতন কোলে তুলে নেন ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় তার উঠানে এসে প্রাণ খোয়ানো হিন্দু বাবার ছেলেকে। নাম দেন কাশেম।
অনিতা সেনের সমাজসেবী এবং উদারমনা মা ছেলে নিরুর মুসলমান বন্ধুর খাওয়ার মাঝখানে মাছের বাটি তুলে নিতে দ্বিধা করেন নাই। বাড়ি থেকে পালিয়ে তার ছেলের সুভাষ বসুর দলে যোগ দেয়ার দায়ও তিনি দিতে চেয়েছেন মোয়াজ্জেম হকের ঘাড়ে। এদিকে মুসলমান বাড়িতে বড় হওয়া কাশেমকে মালাউনের বাচ্চা বলে রগড় করতে ছাড়ে না গ্রামের লোকেরা। এই রকম নীরব বৈষম্য এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের সমাজে, একটু বাতাসেই যা ফুলে-ফেঁপে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
মোয়াজ্জেম হকের সঙ্গে জহর বকশীর অসম বন্ধুত্বের বিবরণ পড়তে পড়তে অসহায় লাগে।
আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিয়েও তার মনের বহিরাগতের অস্বস্তি ঘোচে না। বিশেষ করে জাপানিরা যখন প্রশ্ন করে তিনি হিন্দু কিনা, তখন মাথা নেড়ে সায় দিতে কষ্ট হয়। অন্যদিকে অনিতা সেন নিজে কমিউনিস্ট অথচ তার দাদা পালিয়ে গেছে সুভাষ বসুর দলে যোগ দিতে, এ নিয়ে পার্টির চোখে তার মর্যাদা কমে গেলেও দাদার চিঠিতে সিঙ্গাপুরে ইংরেজদের আত্মসমপর্ণের বিবরণ পড়তে পড়তে শিলংয়ের গভীর শীতরাতে ঠিকই আনন্দে আন্দোলিত হন তিনি।
এই বইয়ের এটা খুব শক্তিশালী জায়গা বলে আমার মনে হয়। কাউকেই কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢালা যাচ্ছে না। বিশেষ করে এখনকার দিনে, যখন যেকোনো দেশের রাজনীতিতেই মূল ঝোঁকটা বাইনারির দিকে। অথচ মানুষ তো বিচ্ছিন্ন সত্তা না, আমাদের সম্পর্ক, আশপাশের মানুষ, ছোটবেলা সবকিছুর সমষ্টি আমরা, কীভাবে একেকটা অস্তিত্বকে শুধু সাদা-কালোতে ভাগ করা সম্ভব?
পার্কের আকাশে হালকা গোলাপি ছোপ দেখা যাচ্ছে। একটু পরে সূর্য ডুবে যাবে। আমি পড়ছি বাহাদুর শাহ জাফরের মাজারের সামনে দাঁড়ানো মোয়াজ্জেম হকের কথা-
‘সামান্য এক বরইগাছের নিচে ঢেউ টিনে ছাওয়া সম্রাটের মাজার ঘিরে অস্থায়ী স্থাপনা। মোয়াজ্জেম হক টুপিটা কপালে টেনে রয়ে রয়ে কাঁদছেন। কেন কাঁদছেন, মাজারে কখন ফুলের স্তবক অর্পিত হলো, সুভাষ বসু ভাষণে কী বলছেন জানেন না। খালি মনে হচ্ছিল দু-আড়াই বছরের অব্যক্ত কান্না যেন নিজের অজান্তেই বরফের মত বুকে চাকা বেঁধে ছিল, দরবেশ-কবি-সম্রাটের অদৃশ্য পরশে বরফের চাকাটা আস্তে আস্তে গলে অশ্রু হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কোথায় যেন মিল মরহুম সম্রাটের সাথে তাঁর বাবা মেহের আলির। বিষণœ চোখ দুটিতে, না দাড়িতে? মেহের আলির ভাঙ্গা গাল, উঁচু কণ্ঠা আর আর মধ্যেখানে হাড় বের হওয়া তীক্ষ্ম নাক আগে থেকেই। এখন মহামন্বন্তরে বেঁচে থাকলেও হয়তো কংকালসার। পরনে ছিন্ন বসন। মহামারীতে আক্রান্ত। বাহাদুর শাহ জাফরের সালংকার তসবিরের দিকে তাকিয়ে মোয়াজ্জেম হকের মনে হয়, মাথায় রত্নখচিত তাজ, বুকে দোলা রক্তবর্ণের রুবি আর অশ্রু ফোঁটার মত অজস্র মুক্তার মালায় সম্রাটের বিষাদ ঢাকা পড়েনি। তা উৎকীর্ণ হয়ে আছে তাঁর কবরগাত্রে-
কিতনা বদনসিব হ্যায় জাফর দাফন কি লিয়ে
দো গজ জমিন মিল না সাকে কুওয়ে ইয়ার মে...’
সন্ধ্যার বাতাস কানের কাছে হু-হু করে বয়ে গেল যেন দীর্ঘশ্বাস। কাকাতুয়ার ঝাঁক সূর্যাস্তের রঙ ডানায় মাখতে মাখতে উড়ে যায়। আমিও বাড়ির পথে রওনা হই। কী অদ্ভুত এই অংশটুকু, যেখানে সম্রাট আর গ্রামের গরিব কৃষক মেহের আলি এক হয়ে গেছেন। শুধু ভালোবেসে দেখতে জানলেই এ রকম দেখা যায়...বইটা শেষ করতে আমার হয়তো বহুদিন লাগবে। আমার আরো কিছু সকাল-দুপুর-সন্ধ্যাজুড়ে বিস্তৃত হবে এর চরিত্ররা। যেভাবে নীহার বানুর হাতের মসলা লাগা বইগুলিকে তার ছেলেমেয়েরা চিনত আম্মার বই হিসেবে। সেভাবেই শাহীন আপার বইও একদিন আমার বই হবে। পেয়ার কা প্যাহলা খত লিখনে মে ওয়াক্ত তো লাগতা হ্যায়..
(সৌজন্যে সিল্করুট)