করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





রুবেন দারিও-র গুচ্ছ কবিতা
ভাবানুবাদ: মঈনুস সুলতান
কবি রুবেন দারিও-র জন্ম ১৮৬৭ সালের ১৮ জানুয়ারী নিকারাগুয়ার মেটাপা শহরে। পেশাগতভাবে কবি কিছুকাল যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সাথে। কূটনৈতিক হিসাবেও কাজ করেছেন কিছুদিন। হিস্পানিক আমেরিকার কাব্যসাহিত্যে উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ‘মর্ডানিজমো বা আধুনিকায়ন’ আন্দোলনের তিনি ছিলেন পুরোধা পুরুষ। কবিতায় ছন্দ, মাত্রা ও বাকপ্রতিমার আধুনিকায়নে তাঁকে পথিকৃৎ বিবেচনা করা হয়ে থাকে। হিস্পানিক কাব্যকলায় তিনি সৃজন করেছেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রীতি, যা আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর নিরিখে তৈরী করেছে নতুন এক ট্র্যাডিশন।

চৌদ্ধ বছর বয়সে রুবেন দারিও কবিতা লিখতে শুরু করেন, এবং ‘বালক কবি’ অভিধায় পরিচিত হয়ে ওঠেন। বিষয়বস্তু হিসাবে তাঁর কবিতায় জীবনভর ফিরে ফিরে আসে ভালোবাসা, বিষণœতা,বীরত্ব ও অভিযান-প্রিয়তা। শুরু থেকেই কবিতায় তাঁর কন্ঠস্বর ছিলো আন্তরিক, শৈলীর দিক থেকে নিজস্ব এবং কল্পনার চিত্রময় সম্পদে ভরপুর।

১৮৮৬ সালে ভ্রমণপ্রয়াসী কবি নিকারাগুয়া ত্যাগ করে সফর করেন এল সালভেদর ও কোস্টারিকা প্রভৃতি দেশ। অতঃপর চিলিতে কিছ ুদিনের জন্য থিতু হলে প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতা ও স্কেচের সমবায়ে নির্মিত গ্রন্থ আজুল বা নীল। হিস্পানিক কবিতার ভাষ্যকাররা পুস্তকটিকে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে নবতর বার্তা বহনকারী হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন। ইউরোপীয় কাব্য-নির্মাণের চলমান ধারায়ও বইটি প্রভাব ফেলে।

১৮৯৩ সালে কবি কলম্বিয়া সরকারের তরফে কূটনৈতিক হিসাবে কর্মরত হন আর্জেন্টিনায়। তাঁর পরবর্তী উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে- ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত প্রোসাস প্রোফানাস ই অতরাস পোয়েমাস বা আশালীন গাথা ও অন্যান্য কবিতাবলী। এ গ্রন্থের অভিব্যক্তিতে তিনি ফরাসী কেতার প্রতীকবাদের সংযোজন করে সাহিত্য সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেন। ১৮৯৮ সালে কবি রুবেন দারিও আর্জেন্টিনার সংবাদপত্র লা নাসিওন এর প্রতিনিধি হিসাবে ইউরোপ যান, এবং থিতু হন মূলত প্যারিসে। তাঁর কবিতার যে সংকলনকে মাস্টারপীস বিবেচনা করা হয়, তা হচ্ছে ১৯০৫ সালে প্রকাশিত কানতস দে ভিদা ই এসপারানজা বা জীবন ও আশার সঙ্গীত।

১৯১৪ সালে- প্রথম মহাযুদ্ধের প্রক্কালে কবি অসুস্থ ও দারুণভাবে দরিদ্রাবস্থায় চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। পরবর্তীকালে তিনি সম্মানীর বিনিময়ে বক্তৃতা দানের উদ্যোগ নেন। অতঃপর কবি নিউইয়র্ক শহরে নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে অসুস্থ দেহে ফিরে যান জন্মভূমি নিকারাগুয়ায়। ওখানকার লেওন শহরে ১৯১৬ সালে ৬ ফেব্রুয়ারী তাঁর মৃত্যু হয়।

এখানে কবির চারটি কবিতার ভাবানুবাদ উপস্থাপন করা হলো। স্প্যানিশ থেকে কবিতাগুলো ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন স্টুয়ার্ট কুক। তথ্যসূত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে- ‘করডাইট পোয়েট্রি রিভিউ’তে প্রকাশিত ‘ফোর মিলানকোলিক সঙস্ বাই রুবেন দারিও’ নিবন্ধটি।



নিশিরাতে বিষন্ন সেরেনাদ
মারিয়ানো ডে লাভিয়াকে

তুমি তো শুনতে পেয়েছো নিশিরাতে আত্মার নীরব সিম্ফনি
দূরারোগ্য অনিদ্রা- শব্দ হয় সজোরে বন্ধ হাওয়া কপাটের
তুমি তো শুনতে পেয়েছো দূরাগত গাড়ির বিলীয়মান ধ্বনি
অস্পষ্ট প্রতিধ্বনির মৃদু আওয়াজে কাঁপে গভীর রাত ফের।

নিশিরাতের আঁধারে মোড়া রহস্যময় নীরবতার অন্তপুরে
যখন জনপদে যে জন বিস্মৃত জাগ্রত হয় সে কারাগারে
রজনী মধ্যযাম মৃতদের- এ প্রহর বাঁধা নিদ্রার বাহুডোরে
পাঠ করো পংক্তি, ভিজে আছে অপ্রাপ্তির অশ্রুময় ক্ষারে।

এ যেন শূন্যপাত্র যাতে আমি ঢেলেছি আমার গাঢ় বেদনা
সুদূরের স্মৃতির কষাঘাত- দুর্ভাগ্যের অপমানে জর্জরিত
আমার আত্মা অতীত তর্পনের পুষ্প নির্যাসে নেশাগ্রস্ত উন্মনা
অন্তরের নিবিড় বিষাদ- বন্ধুদের মাইফেলে হয়েছি নিগৃহীত।

আমি যা হতে পারতাম এ নিয়ে নেই কোন খেদ
যে রাজ্য ছিল আমার নিজস্ব- তা অগোচরে হরিয়ে ফেলা
আমি না জন্মালেও হতো না তেমন কোন প্রভেদ
স্বপ্নের সোপানে জমেছে শ্যাওলা ছুঁয়েছে আমাকে অবহেলা।

নীরবতা থেকে জেগে ওঠে যে রূপমর্মর আমার অভ্যন্তরে
যেখানে রাত্রির খাম মুড়ে ফেলে পৃথিবীর মরীচিকা
ভুবনের আত্মার প্রতিধ্বনি বাজে আমার নিভৃত কন্দরে
ভেতরে তুলে শব্দঝড়-তুষের আগুনে পোড়ে মৃদু শিখা।


দুঃখজনক, অত্যন্ত দুঃখজনক

বিষাদে ভারাক্রান্ত আমি একদিন
অবলোকন করেছিলাম একটি জলপ্রপাত
কীভাবে ডিঙিয়ে পাথর ঝরে পড়ে জল
সুমিষ্ট আঘ্রাণে ভরা ছিলো সে নিশিরাত
নক্ষত্রের রূপালি রোশনিতে
আকাশ ছিলো নিখাদ নির্মল।

রাত্রি যেন কাঁদছিলো অঝোরে
কাঁদছিলো ফুঁপিয়ে
মথিত হচ্ছিলো চরাচর
দীর্ঘশ^াসের ব্যথিত সুরে
রহস্যময় এক শিল্পীর অশ্রুজল
মিশে যাচ্ছিলো গোধূলির বেগুনি আভায়
বয়েছিলো দখিনা হাওয়া সে রাতে প্রবল।

আমি ছিলাম বিষাদে বিপন্ন সে শিল্পী রহস্যময়
মিশিয়ে ছিলাম আমার আত্মা প্রপাতের ধারাস্রােতে
ছুড়েছিলাম বহতা জলে নুড়িপাথর কতিপয়।


বিষন্নতা
ডমিংগো বলিভারকে

বাতি হাতে হাঁটছো তুমি
আমাকে দাও আমার নিজস্ব আলো
অন্ধের মতো হাতড়াচ্ছি চারদিকে দারুণ অন্ধকারে
বিজুলি যে চমকালো
আটকা পড়েছি ঝড়ে- কালবশেখি করাঘাত হানে দ্বারে।
অন্ধ হয়েছি আমি স্বপ্নের তীব্র ঝলকানিতে
সমন্বিত সঙ্গতির সন্ধানে হয়েছি উন্মাদ
পারি না বেরুতে স্বপ্নের বেড়াজাল থেকে
কেবলই তৈরী হয় বাস্তবের সাথে বিবাদ।

পথ চলি আমি-বয়ে বেড়াই স্বপ্নের অভিশাপ
পদাবলীর শরশয্যায় শুয়ে
গুমরে মরে আমার আত্মার সন্তাপ।
শব্দের সাথে দৃশ্যের প্রতিমা জুড়ে তৈরী করি কথা
আহত আমি
রক্তাক্ত মেরুদন্ড থেকে নিয়ত ঝরে বিষণœতা।

এভাবেই ঘুরিফিরি বৈরী এ বিশে^
আলোরিক্ততায় হই আমি অন্ধ
¯œায়ুবিক দুর্বিপাকে উন্মাদ
চারদিকের সড়কাদি দুর্ঘটনায় হয়েছে বন্ধ
কখনো মনে হয় সীমাহীন এ পথপরিক্রমা
আহরণ করেছি যে স্বর্ণ তাতে মেশে খাদ।

উদ্দীপনা ও উদ্বেগের দোলাচলে আমি বিপন্ন
টানতে পারি না সংসারের জোয়াল আর
ভুগি হামেশা পুষ্টিহীনতায়- জোটে না অন্ন
আমার বিষাদ কী একবার
আলতো করেও স্পর্শ করতে পারে না তোমাকে
পথ চলতে গিয়ে পিছলে পড়েছি আমি
পা আমার ডুবেছে নিদারুণ পাঁকে।


পথ চল এবং বিস্মৃত হও
(স্বপ্ন দেখাই হচ্ছে আমার অভিশাপ)

ঘুরে বিভ্রান্ত হয় তীর্থযাত্রী অযথা
সুগম্য সড়কের সন্ধানে
ব্যবহার করছি আমরা একই ধরনের মানচিত্র
তবু কেন তুমি প্রত্যাশা করো আমার সহায়তা
কেন চিড় ধরাও আমার একনিষ্ঠ ধ্যানে।

কীটের মতো তুমি বহন করছো মৃত্যু
যে খাচ্ছে কুরে কুরে
তোমার যা কিছু দিব্য সুষমায় মোড়া মানবিক
কী পেতে চাও রাজপথে ঘুরে ঘুরে
অভিষ্ঠ তোমার ভ্রমণের অধিক
ব্যর্থ হবে জেনো নিশানা
গন্তব্যে কখনো তুমি পারবে না পৌঁছতে
হাঁটতে হাঁটতে ছুঁয়েছো তুমি সীমানা।

অন্তরে শান্তির সিগ্ধতা নিয়ে
হাঁটো হে পথিক
অজানা দিগন্ত থেকে আছো তুমি এখনো অনেক দূরে
ভেসে উঠছে স্বপ্নে ছাওয়া এক রাজ্যের প্রতীক
মথিত হচ্ছো পথ চলার সুদূর প্রয়াসী সুরে।

পথ চলো- হেঁটে যাও- আর হও বিস্মৃত
এবং এ স্বপ্নই হচ্ছে জেনো তোমার অভিশাপ
স্বপ্নবৃক্ষের গোড়ায় যদি ঢালো জল
ইন্ধনে জ¦লবে চুল্লি বাড়বে তোমার মনস্তাপ।

(স্টুয়ার্ট কুকের ইংরেজী অনুবাদ থেকে)