নারীর সৌন্দর্যের রহস্য আত্তীকরণের যোগ্যতা সবার কমবেশী থাকলেও কি উপমহাদেশে কি ল্যাটিন আমেরিকায় সর্বত্র নারীর প্রতি সহিংসতা আমাদের ভাবনায় ফেলে দেয়। যে নারীর গর্ভে আমাদের জন্ম তার প্রতি আমাদের রিপু আর শৃঙ্গার রসের নিয়ন্ত্রণ এতো লাগাম ছাড়া কেন? জ্ঞানের অভাব?
এই অঞ্চলের প্রাচীণ গ্রন্থ মহাভারত, পুরাণ তথা প্রাচীন শাস্ত্র নিয়ে এক আধটু ঘাঁটাঘাটি করে অসাধারণ সব উপমা আর ঘটনাসূত্র খুঁজে পাই। একা হজম করা দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই কিয়দংশ শেয়ার করছি কেবলমাত্র নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি’র পূর্বসূত্র বোঝার স্বার্থে।
শৃঙ্গার শব্দের অন্ত র্গত ‘শৃঙ্গ’ কথাটার মানে হচ্ছে ‘শিঙ’ যা দিয়ে চুলকানো যায়। ইংরেজীতে হর্ন বলে। যা হতে হর্নি বা কামুকতা কথাটি চালু। শৃঙ্গ হলো কামুক তার প্রথম প্রকাশ, রতিভাব বা মৈথুন ইচ্ছে প্রকট হয়ে ওঠে এই পথ ধরেই।
‘শৃঙ্গ হি মন্মথোদ্ভেদস্তদাগমনহেতুকঃ’।
পুরুষের উপভোগের দৃষ্টি এই শৃঙ্গার রসের কোন সুযোগকেই হাতছাড়া করতে চায় নি। দেবীশ্রেষ্ঠা পার্বতীর স্তনের বর্ণনা দিচ্ছেন মহাকবি কালিদাস তাঁর কুমারসম্ভব কাব্যে এভাবে-
‘পার্বতীর পীতাভ শুভ্র দুটি স্তন একটি অপরটির জায়গা আটকে পরষ্পর চাপাচাপি করে বাড়তে লাগল। পাণ্ডু-গৌর স্তনের ওপর দুটি কৃষ্ণাভ চুচুক ও স্তন দুটি এতটাই প্রবৃদ্ধ এবং বর্তুল যে সে-দুটির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম মৃণালতন্তুও প্রবেশ করানো যায় না।’
আজ হতে প্রায় তিন হাজার বছর আগেই বেদশাস্ত্র কথায় শৃঙ্গারের উপমা দেখি। সূর্য উদিত হবার আগে ঊষার সৌন্দর্য যে ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে তাতে শৃঙ্গার রস টইটম্বুর। রস অনুধাবন করতে না পারলে ‘পাপী’ খেতাব অনিবার্য। তাতে বলা হয়েছে- ঊষা তার রূপ প্রকাশ করেছে ঠিক নর্তকীর মতো। গাভি দোহনের সময় তার দুধভাণ্ড ‘উধঃ’ যেমন উন্মুক্ত করে দেয়, ঊষাও তেমনি তার বক্ষ দুটো উন্মুক্ত করেন প্রতি প্রত্যুষে।
‘অধি পেশাংসি বপতে নৃতূরিবাপোর্ণুতে বক্ষ উগ্রেববর্জহ্ম’ (ঋগবেদ, ১.৯২ ৪)
এমন কি পৌরাণিক শ্লোক বলছে,
মাত্রা সগ্রা হুহিত্রা বা ন বিবিক্তাসনো ভবেৎ
বলবান্ ইন্দ্রিয়গ্রামঃ বিদ্বাসমপি কর্যতি।
অর্থাৎ, মা- বোন বা মেয়ের সঙ্গে কখনো নির্জনে বেশীক্ষণ থেকো না, কেননা ইন্দ্রিয়গুলোর স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই বড়ো প্রবল, বুদ্ধিমান লোককেও তা মথিত করে ফেলে।
আমি জগতের কুশিক্ষায় শিক্ষিত ইন্দ্রিয়গ্রস্থ মানুষগুলোর শৃঙ্গার-স্তর দুর্মতিগ্রস্ত হবার সূত্রটি আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম যেন ...।
পৌরাণিক চরিত্রের প্রেম-কাম-বিলাস-মিলন নিয়ে কিছু বলতে গেলে অবধারিত ভাবে রাধা-কৃষ্ণের প্রসঙ্গ চলে আসবে। যদিও রাধা বেগম ছাড়াও কৃষ্ণের অপরূপা রুক্সিণী সহ আরো সাতজন প্রিয়-মহিষী ছিলেন। কেউ বলেন এগারো। (সে যাই হোক। লিস্টটা একটু পরে দিচ্ছি।)
অনেক অনেক কবি-ঋষি এঁদের ভেতর-বাহিরের আদিরূপ নানা আঙ্গিকে বর্ণনা করে গেছেন। বুঝলে ভালো, না বুঝলে তা ‘ভালগারে’ পর্যবসিত হতে বাধ্য।
রূপ গোস্বামী জানাচ্ছেন,
যমুনার তীর ছাড়াও রাধার সাথে কৃষ্ণের একবার মিলন হয়েছিল কুরুক্ষেত্রে। ঐশ্বর্যময় কিন্তু কৃত্রিমতায় পরিপূর্ণ কুরুক্ষেত্রের সাজানো-গোছানো তুলতুলে শয্যায় রাধার মোটেও আনন্দ হয়নি। রাধার মন পড়েছিল সেই প্রেম যমুনার ঘাটে কৃষ্ণের প্রাণ আকুল করা মোহন–মুরুলীর পঞ্চম সুরের তালে মিলন বাসনার স্মৃতিতে। তাই দুঃখ করে সখীকে বলেন – ‘তথাপ্যন্তঃখেলন্ মধুর-মুরলী-পঞ্চমজুষে/মনো মে কালিন্দী-বিপিন-পুলিনায় স্পৃহয়তি।’
জয়দেবের বর্ণনায় তা আরো একটু আদিম। তিনি জানাচ্ছেন,
রাধা যখন প্রথম কৃষ্ণের সান্নিধ্যে এলেন তখন তিনি না পারছেন বলতে, না পারছেন ভুলতে। এতোটাই বিহ্বল তিনি। কৃষ্ণের মুখে রাধা যতই তাঁর রূপগুণের প্রশংসা শুনে লজ্জায় লাল হছেন ততই কৃষ্ণের ‘সাহস’ বেড়ে যাচ্ছে। যেই না রাধা একটু ইতিবাচক হাসি হেসেছেন, অমনি কিনা, দুষ্টুমনি কৃষ্ণ রাধার জঘনমেখলায় হাত রেখে শিথিল করে দিলেন মেখলার বন্ধন –
‘মৃদু-মধুর-স্মিত-ভাষিতয়া শিথিলকৃত-জঘন দুকূলম্।’
বিজ্জকার নামে এক মহিলা কবিও একইভাবে এই কোমরের দড়ি আলগা করার আবেশঘন মুহূর্তের উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর বর্ণনায় নায়িকা সখীদের বলেন, আমার বাপু কী যে হয়! যেই মুহূর্তে আমার কোমরের কশিতে সে একবার হাত দেয়, তারপর সত্যি বলছি, আর কিছু মনে করতে পারি না – সখ্যঃ শপামি যদি কিঞ্চিদপি স্মরামি।’
অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্র রাধাকৃষ্ণের বিষয়ে অতো চটুল ছিলেন না। কৃষ্ণের জীবনে রাধা কেবলই এক প্রেমিকা। তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, ‘রুক্সিণী ভিন্ন কৃষ্ণের আর কোন মহিষী ছিলেন না।’ রাধা’কে মূল লিস্টের বাইরে রেখে পূরাণকার’রা আটজন প্রধানা মহিষীর কথা উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া প্রবাদ আছে এখনকার আসাম বা তৎকালীন প্রাগ্জ্যোতিষপুরের অনার্য রাজা নরকাসুন্দরকে হত্যা করে ষোল হাজার রমণীকে নাকি কৃষ্ণ দ্বারকায় নিয়ে এসেছিলেন। কৃষ্ণ-মহিষীদের নাম গুলো হচ্ছে, রুক্সিণী, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, সত্যা, নাগ্নজিতী, রোহিণী বা ভদ্রা, লক্ষণা ও শৈবা গান্ধারী।
এর মধ্যে কৃষ্ণের বিশেষজন ছিলেন রুক্সিণী। চেদী’র রাজা শিশুপালের সাথে তাঁর বিয়ের কথা প্রায় পাকা ছিল, মধ্যস্থতাকারী ছিলেন মগধের রাজা জরাসন্ধ। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁকে ‘হরণ’ করে নিলেন। কি এমন ছিল রুক্সিনী’র মধ্যে যার রূপ সংবরণ করতে পারলেন না কৃষ্ণ?
কবির উপমায় –
অনন্য প্রমদা লোকে রূপেণ যশসা শ্রিয়া/ বৃহতী চারুসর্বাঙ্গী তন্বী/ পীনোরুজঘনস্তনী ... যেমন ফরসা গায়ের রং, তেমনই তাঁর দেহের সৌষ্ঠব, লম্বা চেহারা, স্থুলতা যদি কোথাও থাকে তবে শুধু তা স্তনে, জঘনে, নিতম্বে, চুল কালো ও কোঁকড়ানো, তীক্ষ্ণ সাদা ঝকঝকে দাঁত, যেন চাঁদের কিরণ জমাট বেঁধেছে রুক্সিণীর নারী শরীরের আনাচে-কানাচে ... মায়াং ভূমিগতামিব।
২
প্রাচীন কালে ব্রাহ্মণ স্ত্রীদের অতৃপ্তি ছিল সাংঘাতিক। বুড়ো বা সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণরাও ঠিক মতো স্ত্রী সম্ভোগ করতে পারতেন না নানাবিধ আচার ও ‘লিমিটেশনের’ জন্য। আবার ক্ষেত্রবিশেষে ব্রাহ্মণী তাদের বয়স্ক পতিদের মনোবাসনা তৃপ্ত করতে পারতেন না। এই অন্তস্থঃ গোপন দাম্পত্য সমস্যা মেটাবার জন্য তিন ব্রাহ্মণ মহর্ষি ‘বৃহদারণ্যক’ উপনিষদের বিবাগী পর্বে একটি ‘ফতোয়া’ দেন। সেই তিন মহর্ষি হচ্ছেন, উদ্দালক, মৌদগল্য ও কুমারহরিত। তাঁরা জানালেন, ‘ময়ি তেজঃ ইন্দ্রিয়ম’ (দেবরাজ ইন্দ্রের মতো তাঁদের তেজ) উচ্চারণ করে ব্রাহ্মণ যখন ঋতুস্নাতা হওয়া ব্রাহ্মণী’র প্রতি উপগত হবেন তখন অবশ্যই তাকে ‘প্রস্তুত’ থাকতে হবে। যদি ব্রাহ্মণী প্রস্তুত না থাকেন, তবে?
যাজ্ঞাবল্ক্য জানাচ্ছেন, ‘সা চেদ্ অস্মৈ ন দদ্যাৎ কামম্’ – সেই স্ত্রী পুরুষকে দেহদান না করলে তাকে সোনা-দানা গয়নার লোভ দেখাতে হবে। তাতেও যদি ব্রাহ্মণীর তনু- মন সায় না দেয় – ‘সা চেদ্ অস্মৈ নৈব দদ্যাৎ কামম্’ – তাহলে হাতে নয়তো লাঠিপেটা করতে হবে সঙ্গম করতে ... ‘এনাং যষ্ট্যা বা পাণিনা বা উপহত্য।’
এই ঔপনিষদিক নির্দেশ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আবার একে একটু রোমান্টিক করে তুলতে ঋষিগণ কিছুটা ‘কবিতা’ মিশিয়েছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, স্ত্রীর জননেন্দ্রিয়কে বাজপেয় যজ্ঞের বেদী বলিয়া চিন্তা করিবে। লোম সমূহকে কুশ বলিয়া ভাবিবে। চর্ম ও জননেন্দ্রিয়ের পার্শ্বস্থিত স্থূল মাংসখণ্ড দুটিকে সোমপল্লী পেষণের দুইটি পাষাণখণ্ড বলিয়া চিন্তা করিবে। যিনি এইরূপ চিন্তা করেন তিনি বাজপেয় যজ্ঞের স মান ফল লাভ করেন –
‘তস্যা বেদিরুপস্থো লোমানি বর্হিশ্চার্মাধিষবণে সমিদ্ধো মধ্যতস্তৌ মুষ্কো স যাবান্ হ বৈ বাজপেয়েন লোকো ভবতি তাবান স্য লোকো ভবতি।’
তবে পাশাপাশি এটাও বলা আছে পুরুষেরও এই ফল লাভে ‘স্পন্দমান পাষাণতুল্য শ্রীমন্থদণ্ড’ থাকাটা জরুরী।
পুষ্করিণীর চাইর পারে রে ফুটল চাম্পা ফুল।
ছাইরা দেরে চেংরা বন্ধু ঝাইরা বানতাম চুল।।
হস্ত ছাড় পরাণের বন্ধু চইলা যাইতাম ঘরে।
কি জানি কক্ষের কলসী ভাসাইয়া নেয় সুতে।।
দূরে বাজে মনের বাঁশী ঐ না কলা বনে।
তোমার সঙ্গে অইব দেখা রাত্রি নিশাকালে।।
লুকিয়ে-চুরিয়ে সমাজ-বিরুদ্ধ প্রেম যিনি করছেন, তিনি কে?
শত বছর আগের এক কবিতায় জানতে পারি এক বিবাহিতা রমণী অদ্ভুত কথা বলছেন। তিনি বলছেন – ‘আমার স্বামীর রূপের সীমা নাই। যে কোন রমণীর জন্যই তিনি আকাঙ্ক্ষার পাত্র। তাঁর এমন গুণ পৃথিবীর সমস্ত রমণীরাই তাঁর বশীভূত হবেন। কিন্তু তাঁর দোষ শুধু একটাই। একমাত্র দোষ – তিনি আমার স্বামী। আহা! তিনি যদি অন্যের স্বামী হতেন।’
এইসব কাল্পনিক চরিত্রের মাঝে কেবল একজন চরিত্রেরই সমিল মনে পড়ে। কৃষ্ণের প্রিয়তমা রাধা। বৃন্দাবনের শত কোটি গোপ রমণীর প্রেমাস্পদ কৃষ্ণ, অথচ রাধা বা রাধিকা ছাড়া তিনি অসম্পূর্ণ। ভাবে-রসে-শরীরে-শাস্ত্রে- দর্শনে। রাধা’র আরেক নাম হ্লাদিনী। যিনি কৃষ্ণের এক আনন্দময়ী শক্তি। আকাশে ঘুড়ি ওড়ে। ঘুড়ির একপাশে মানে স্বয়ং ঘুড়ি হলেন কৃষ্ণ, আর তার সুতো হলেন হ্লাদিনী। অপরপাশে তাদের রসিকজন। কবির ভাষায় –
হ্লাদিনী করায় কৃষ্ণে আনন্দাস্বাদন।
হ্লাদিনী দ্বারায় করে ভক্তের পোষণ।।
আমজনতা তাঁদের ভেতরের মিথস্ক্রিয়া বোঝে কি বোঝে না। কেউ কেউ না বুঝে চটুল তুড়ি বাজায়। এক কথায় যদি তাঁদের প্রেমলীলার উপসংহার টানতে হয় তবে বৈষ্ণব দার্শনিক জীব গোস্বামীর শেষ কথাটাই আগে বলে দেয়া ভালো। তিনি রাধার মায়া, পূর্ভ রাগ, অভিসার ইত্যাদির ইতর জাতীয় ব্যবচ্ছেদে যারা তৃপ্তি পায় তাদের উদ্দেশ্যে বললেন – রাধা ইত্যাদি ব্রজ- রমণীরা কৃষ্ণের একান্ত স্বকিয়া কান্তা হওয়া সত্ত্বেও নরলীলার প্রেম-মাধুর্য বাড়িয়ে তোলার জন্য পরকীয়ার মতো ভাব দেখান – ‘পরমস্বীয়াঃ অপি পরকীয়ায়মানা ব্রজদেব্যঃ।’
রাধাকৃষ্ণের উপাখ্যান আমাদের পরম্পরাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে – প্রেমের নাম বেদনা, প্রেমের মরা জলে ডুবে না, প্রেম কোন ধর্ম-জাত-পাত মানে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এক জায়গায় কৃষ্ণ বলছেন, কুল-শীলের বাঁধ ভেঙে যেভাবে তোমরা আমাকে ভালবেসেছো, তার প্রতিদান দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, এমনকী দেবতাদের মতো অমর আয়ু পেলেও এই প্রেমের ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না –
‘ন পারয়ে’হ নিরবদ্যসংযুজাং / স্বসাধুকৃত্যং বিবুধায়ুষাপি বঃ।’
আর চিরবিরহী রাধা কৃষ্ণের সান্নিধ্যে কখনো তৃপ্ত হন না। অতি সুখের দিনে সখীরা মজা করে রাধা’কে জিজ্ঞাসা করে – কাল যে এত চন্দন-কুমকুমের চিত্তির করেছিলি বুকে, সে সব কে ধুয়ে মুছে দিল? চোখের কাজল মুছে দিল কে? ঠোঁটের লালিমা কে শুষে নিল? রাধা পরম সুখে উত্তর দেন, ‘নীল পদ্মের রঙে সব উঠে গেছে। সে কৃষ্ণ নয়, নীল যমুনার জল তা। সখী’রা মাথা ঝাঁকায় – বুঝেছি, কালো রংই তোমার পছন্দ।
তাই বলি, শত গোপীদের মাঝে আসল রাধা’কে চেনা অত সহজ নয়। আমরা সবাই না বুঝেই ভেতর ভেতর অপেক্ষায় থাকি মর্ত্যের রাধা উদ্ভটভাবে চুম্বন করে বলছেন – ‘সাধু তদ্বদনং সুধাময়মিতি।’ কৃষ্ণ এর অর্থ বুঝেছিলেন।
৩
উত্তর ভারতের তুলসীদাস রামায়ণ বর্ণনা করেছেন নির্মোহ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হতে। সীতাকে তিনি মা’-এর স্থান হতে সাধারণ ইন্দ্রিয়তাড়িত নারীতে চিত্রিত করেন নি। রামের সাথে তাঁর প্রেম গার্হস্থ্য সুখের বিজ্ঞাপন। রাবণের সাথে সীতার সম্পর্ক ‘আদর্শ সতী নারীর রূপক’ হিসেবে সর্বজনবিদিত।
কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’ সে দিক হতে আলাদা। সাধারণ মানুষের ধারণ উপযোগী করে তার চরিত্র চিত্রণ। মানুষ মাত্রই ইন্দ্রিয়প্রবণ। রাবণ কি সীতা কি স্বর্গের অপ্সরা রম্ভা। সবাই কুপিত হন। কেউ আচরণে, কেউ আনমনে ...।
আমি কৃত্তিবাসকে বেছে নিলাম -
... নির্জন অরণ্যে সতী-সাধ্বী সীতা’কে দেখে ব্রাহ্মণতপস্বীর ছদ্মবেশী রাবণ বলতে শুরু করলেন, তুমি কি স্বর্গের লক্ষ্মী, না স্বর্গসুন্দরী অপ্সরা? তোমার নাক-চোখ-মুখ এমনকি দাঁতগুলোও কি সুন্দর, সমান। তোমার জঘন দুটি স্থূল ও বিস্তৃত, ঊরু দুটি করিশুণ্ডের মতো, স্তনদ্বয় তাল ফলের মতো, যেমন গোল, তেমনই সমুন্নত, তেমনই পরষ্পর ঘন সন্নিবিষ্ট, জড়িয়ে ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে –
এতাবুপচিতৌ বৃত্তৌ সংহতৌ সংপ্রগল্ভিনৌ।’
স্বাভাবিকভাবে সীতার পছন্দ হয় নি রাবণের এমন ভাষা। কিন্তু কৃত্তিবাস ইঙ্গিত দিচ্ছেন, আসলেই কি তাই?
মাইকেল মধুসূদন রাবণের প্রশস্তি এমনি এমনি গান নি। রাবণ ‘ভিলেন’ হলেও মানুষের যাবতীয় গভীর ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটিয়ে গেছে তার দর্শনে। দেবতাদের কৃপার তোয়াক্কা করে নি। স্বর্গের অপ্সরী রম্ভা’র সাথে তার প্রেম-লীলা কৃত্তিবাস ‘অসাধারণ’ ছন্দে বর্ণনা করেছিলেন। ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটলে একটু তুলে ধরি।
কৃত্তিবাসের ছন্দে রম্ভা’কে আয়ত্ত্বে আনার জন্য রাবণের আকুতি –
‘দৈবের ঘটনে আজি গেছ হাতে পড়ি
হেনজন কেবা আছে স্ত্রী পাইলে ছাড়ে।
পৃথিবীর নারী যদি হয়ত ঘটনা
পাইলে না ছাড়ি আমি তার এক জনা।‘
স্বর্গসুন্দরীশ্রেষ্ঠা রম্ভা’র বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। তিনি নিরুপায় নিশ্চুপ হয়ে থাকলেন। সেটাকে ‘ মৌন সম্মতিলক্ষণ্ম’ ভেবে – ‘রম্ভাকে চাপিয়া তবে রাবণ ধরিল।’ ... এই পর্যায়ে কৃত্তিবাস আর স্থির থাকতে পারলেন না। শৃঙ্গার রসের বিকৃত-সুকৃত সব ধরণের প্রকাশই তিনি রাবণ-রম্ভা’র মাঝে ঘটাতে থাকলেন –
‘অনুমানে রাবণ বুঝিল তার মন
ধরিয়া শৃঙ্গার করে রাজা দশানন।
একে তো রাবণ তাহে রম্ভার ইঙ্গিত
ইঙ্গিতে শৃঙ্গার করে রাজা বিপরীত।
একে দশানন তাহে শৃঙ্গারে প্রবীণ
একাসনে শৃঙ্গার করয়ে সপ্তদিন।
হাত পা আছাড়ে রম্ভা রাবণের কোলে
রাবণ শৃঙ্গার করে ধরি তার চুলে।
রহ রহ বলি রম্ভা বলে রাবণেরে
মুখেতে তর্জন করে হরিষ অন্তরে।‘
সাধারণ বাংগালী’র পক্ষে এই এইরূপ ভাবাবেগের রস আস্বাদন যে গুরুপাক হবে তা মুনি-ঋষিরা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই একই সাথে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে গিয়ে প্রার্থনা করতে বলেছেন,
‘সংজাম্পত্যং সুষম মাকৃণুষ্ব ...’
অর্থাৎ, ‘আমাদের দাম্পত্য জীবন সুষম ও সমঞ্জস্য করে দাও।’
আত্মঘাতী বাঙ্গালী যুগ যুগ ধরে তাই করে যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে ...।
৪
“আমার সাধ না মিটিলো
আশা না পু্রেিলা
সকলি ফুরায়ে যায় মা ...”
কোনো কালেই নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান পুরুষরা দেয় নি। এটা নিয়ে আপনি রাগ করতে পারেন, প্রতিবাদ করতে পারেন কিন্তু অস্বীকার করতে পারেন না। বিস্তর কিতাব-কাহিনী-ইতিহাস-পেপার কাটিং ইত্যাদি ঘেঁটে গম্ভীর কথার লম্বা কথায় না গিয়ে যদি স্বাদু ভাষায় বলি তার অনেক কারণের একটা কারণ হচ্ছে, নারী’র সৌন্দর্যের প্রতি পুরুষের সনাতন লোভ। স্বয়ং দেবতারা যেখানে রতি দমন করতে পারেন নি, মর্ত্যের দুর্বল মানুষ কোন ছার! তার ছায়া দেখতে পাই প্রাচীন কবি-সাহিত্যিকদের রচনায়-বর্ণনায়।
যে দেবীর আরাধনা করে শাশ্বত বাংলায় পূজা-পার্বণ হয়ে আসছে সেই মাতৃরূপী দেবীদের শারীরিক উপমা-বর্ণনায় নেই কোন ‘সেন্সরশীপ’। দেবীগণ সব্বাই ‘নবযৌবনসম্পন্না’। যেমন – দুর্গা’র রূপ-আরতি শুরু হয় ‘অতসীপুষ্পবর্ণাভং’ দিয়ে আর শেষ হয় ‘পীনোন্নতপয়োধরাম্’ বলে। বিদ্যাদেবী সরস্বতী’র কাছে বিদ্যার ধ্যান চাইতে গেলে ভক্তিভরে স্মরণ করতে হয় তিনি ‘কুচভর-নমিতাঙ্গী’। আঁটোসাটো শাড়ী পড়িয়ে লক্ষ্মী দেবী’র দেহলালিত্য প্রকাশ করে মন্ত্রকার উচ্চারণ করেন ‘ক্ষৌমাবদ্ধনিতম্বভাগললিতাম্’।
শুধু তাই নয়, ভাগবত পূরাণে কৃষ্ণের মাতা যশোদা’র মাতৃমূর্তি মূর্ত করা হয়েছে যৌনতাকে প্রাধান্য দিয়ে। কুৎসিত রুচির পাঠকরা যুগে যুগে এতে সোমরস খুঁজে ফিরেছে, কিন্তু ধর্মভাব বৃথা যায় নি এতে এতোকাল পরেও। যৎসামান্য উদহারণ দেয়া যাক।
চিরকালের মমতাময়ী মা যশোদা। পুত্রের কথা স্মরণ হওয়া মাত্রই তাঁর স্তন্য ক্ষরিত হয় – পুত্রস্নেহ স্নুত-কুচযুগম্।’ একই সাথে পালাকার জানাচ্ছেন – ক্ষৌমংবাসঃ পৃথুকটিতটে, যশোদা পৃথুলা নিতম্ববতী। দুষ্ট বালক কৃষ্ণের পেছন পেছন যখন ‘সুমধ্যমা’ দৌড়াচ্ছেন মহর্ষি ব্যাস ঠিকই লক্ষ্য করছেন সবকিছু। কৃষ্ণের পেছনে ছোটাছুটির জন্য যশোদার গুরু নিতম্ব কেমন ওঠানামা করছিলো তা দেখে ব্যাস লিখলেন,
‘অন্যঞ্চমানা জননী বৃহচ্চল / চ্ছ্রেণীভরাক্রান্ত গতিঃ সুমধ্যমা ...
’ সাথে খসে পড়ছে খোঁপায় বাঁধা ফুল – ‘জবেন বিগ্রংসিত কেশবন্ধন-চ্যূতপ্রসূনা।’
সব কিছুর পরে আপন চিন্তা, ইন্দ্রিয়-ভাবনাকে জয় করার লক্ষ্যে সেই কৃষ্ণের মাধ্যমে উপদেশ দেয়া হয় - ‘তেজী লোকেরা যা আচরণ করছেন সেটি করো না, তাঁরা যেটি উপদেশ দিয়েছেন বুদ্ধিমানদের সেইটি পালন করো।’
তেষাং যৎ স্ববচোযুক্তং বুদ্ধিমাংস্তৎ সমাচেরৎ।
প্রাচীন কালের ঋষিরা কুমারী নারীদের সাথে সঙ্গমও করতেন, সন্তানসহ শাপও বর দিতেন (যেমন - পরাশর মুনি ও সত্যবতী)।
আর এ’যুগে সকল ক্ষমতাবান পুরুষ ঋষিদের স্থান দখল করে নিয়েছেন। তাদের ‘কামার্ত শ্লোক’ হচ্ছে ‘বিবৃতি’, আর এতে অভিশপ্ত হচ্ছে ‘রাষ্ট্র’।