গাছে পাখি- শাখে ফুল, কলমের নির্যাসে প্রসূত বকুল।
আমাদের কবিতা হচ্ছে সাধারণ কথাবার্তার চেয়ে প্রয়াস সাধ্য, উচ্চমাত্রার সচেতন চিন্তার দাবিদার একটি লিখিত শিল্প। অথবা কাব্য হচ্ছে এক ধরনের স্বপ্নজগত।
প্রাচীন মধ্যযুগে, এমনকি আজকের দিনেও কৃষকদের মধ্যে, কবি তার শ্রোতাদের কাছ থেকে সাক্ষরতার বাধার কারণে বিচ্ছিন্ন নন। তার ভাষা সাধারণ কথাবার্তা থেকে ভিন্নতর, কিন্তু তা একটি কথ্য ভাষা, যা কবি এবং তার রসগ্রহিতাদের মধ্যকার একটি অভিন্ন ব্যাপার। তাদের চেয়ে এ বিষয়ে কবি আরো সাবলীল তবে এর একমাত্র কারণ, কবি হলেন অধিকতর অনুশীলনকারী।
কাব্যে আমরা দেখি উন্নততর স্তরে একই প্রক্রিয়া। সভ্য মানুষ অনেকাংশে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছে। কিন্তু এটা সম্ভব হয়েছে তার সামাজিক সম্পর্কটি জটিল করে। আদিম সমাজ ছিল সরল, শ্রেণিহীন, প্রকৃতির বিরুদ্ধে দুর্বল হলেও এটি একটি সম্মিলিত ঐক্যমোর্চা। সভ্য সমাজ হচ্ছে অধিকতর জটিল, উন্নততর, অধিকতর শক্তিশালী। কিন্তু এসবের আবশ্যিক শর্ত হিসেবেই সমাজ আজও অবধি-এর নিজের বিরুদ্ধেই বিভক্ত। সুতরাং সমাজ এবং প্রকৃতির দ্বন্দ্ব যা হচ্ছে যাদুর ভিত্তি তা চাপা পড়েছে ব্যক্তি এবং সমাজে দ্বন্দ্বে, যা হচ্ছে কবিতার ভিত্তি।
অতীতের লিখিত সাহিত্যের বিশ্লেষণ দ্বারা আদিম কবিতার অনুশীলন সম্ভব নয়। কারণ প্রকৃতিগতভাবেই এগুলো অলিখিত, প্রাক-সাহিত্য যুগের। কেবলমাত্র কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতেই এগুলো লিপিবদ্ধ হয়েছিল। আজকের দিনের অসভ্য মানুষদের মুখে মুখে এখনও সে অবস্থায় এইসব কবিতা বেঁচে আছে অবশ্যই সেই অবস্থাতেই এগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। কিন্তু এইসব লোকের সমাজ সম্পর্কে কিছু না জানলে তাদের কবিতা আমরা বুঝতে সক্ষম হব না। তাছাড়া কবিতা হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের বাক-প্রণালী। কবিতার উৎস বিচার করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই সন্ধান নিতে হবে বাক-প্রণালীর উৎস বিষয়ে এবং এ কথার অর্থ হলো মানুষের নিজের উৎস সন্ধান, কারণ বাক-প্রণালী হচ্ছে মানুষের একটি স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য।
কবিতাকে যারা শুধুমাত্র কবিতা হিসেবেই উপভোগ করে তুষ্ট তাদের কাছে এই পরিকল্পনা অনাকর্ষণীয় মনে হতে পারে। কবিতাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে আলোচনা করলে তা বরং কম না হয়ে আরো বেশি উপভোগ্য হয়। একে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই বোঝা প্রয়োজন কবিতা কী এবং কবিতা কী বুঝতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই অনুসন্ধান করতে হবে এর জন্ম এবং বিকাশের কথা।
প্রাচীন গ্রিসের কবিতা সঙ্গীতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। বিশুদ্ধ যন্ত্রসঙ্গীত তথা বাক-বিবর্জিত সঙ্গীত বলতে কিছুই ছিল না এবং প্রচুর সংখ্যক প্রকৃষ্ট কবিতা রচিত হয়েছিল যন্ত্র-সঙ্গীতের অনুসঙ্গী হিসেবেই। আইরিশ কবিতাতেও আছে কাব্য ও সঙ্গীতের ঘনিষ্ঠ মিলন এবং এটা শুধুমাত্র অনুসন্ধান নয়। এটা এখনো একটি বাস্তব সত্য।
অধিকাংশ ইংরেজদের কাছে ইংরেজি কবিতা হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ অপঠিত বই, তারা এ সম্পর্কে জানেনও না, গ্রাহ্য করেন না এবং কিছুসংখ্যক নগণ্য আগ্রহীর মধ্যে এমন লোকও খুব বেশি নেই যাদের সম্পর্কে বলা চলে যে-কবিতা তাদের দৈনন্দিন জীবনে খুব ব্যাপকভাবে প্রকাশ করে। আইরিশ কৃষকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্নতর। তাদের কাছে কবিতার সাথে বইয়ের কোন সম্পর্ক নেই। তাদের অধিকাংশই নিরক্ষর। কবিতা তাদের মুখে মুখে বেঁচে থাকে এটা তাদের সাধারণ সম্পত্তি। সকলেই এটা জানে। সকলেই ভালোবাসে। কবিতা তাদের প্রাত্যহিক কথোপকথনে অহরহ ফুটে ওঠে বুদবুদের মতো এবং এতদসত্ত্বেও তা সৃজনশীল। অনেক আইরিশ গ্রামে অধুনাতম সময়ও এমন অনেক দক্ষ ঐতিহ্যবাহী কবি ছিলেন যাদের ছিল কবিতা সৃষ্টির সহজাত ক্ষমতা। যে কবিতা প্রায়ই হতো বিস্তৃত আকারের - মুহূর্তের প্রেরণায় সৃষ্ট।
নৃত্য, গীত এবং কাব্য নামীয় তিন শিল্প আদিতে একই ছিল। তাদের উৎস ছিল যৌথ শ্রমে নিয়োজিত শরীরের ছন্দায়িত স্খালন। এই স্খালনের ছিল দুটি উপাদানমূলক অংশ, শারীরিক এবং বাচনিক। প্রথমটি ছিল নৃত্যের উৎস, দ্বিতীয়টি ভাষার।
কবিতা বলতে সঠিকভাবে যা বোঝায় তার প্রথম স্তর হলো নৃত্য পরিহার। এটা থেকে আমরা পেলাম গান। গানে সঙ্গীতের বিষয়বস্তু হচ্ছে কবিতা এবং সঙ্গীত হচ্ছে কবিতার আকার। তারপর দুটো হলো আলাদা। কবিতার আকার হলো এর ছন্দময় কাঠামো, যা সে ঐতিহ্যগতভাবে পেয়েছে গান থেকে। কবিতা একটি গল্প বলে, যাতে আছে এর ছন্দময় কাঠামোর বাইরে একটি নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সঙ্গতি।
সর্বত্র আদিম লোকদের কাছে কবি হচ্ছেন ঐশ্বরিক বার্তা-ঘোষণাকারী, যিনি কোনো দেবতা দ্বারা অনুপ্রাণিত বা আবিষ্ট হয়ে দেবতার কন্ঠেই কথা বলেন। প্রাচীন গ্রিকদের কাছে দৈববার্তা ঘোষণা এবং পাগলামোর মধ্যেকার যোগ শব্দ দুটোর মধ্যেই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান ছিল। তাদের কাছে কবিতা এবং দৈববার্তার যাদুকরী উৎস ছিল স্বতঃসিদ্ধ। কারণ, উভয়ের লক্ষণসমূহ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিত উপাসনামূলক নৃত্যের কথা, যা বেঁচে ছিল ডায়োনিসীয় পূজা-পদ্ধতির অবশেষ হিসেবে। প্লেটো বলেছেন,
‘সবভালো কবিই রচনায় সক্ষম তাদের শল্প সৃষ্টির দক্ষতার কারণে নয়, বরং তারা ঐশ্বরিকভাবে অনুপ্রাণিত বা আবিষ্ট বলে। রচনাকালে তারা নৃত্যরত কোরিবান্টদের (কড়ৎুনধহঃবং) চেয়ে বেশি প্রকৃতিস্থ থাকেন না। ছন্দ এবং মিলের কাজে মগ্ন হওয়ার সাথে সাথেই তারা উম্মত্ত অবস্থায় ফোয়ারা থেকে দুধ এবং মধু সংগ্রহরত ব্যাকান্টদের (ইধপপযধহঃং) মতো বিহ্বল এবং আবিষ্ট হয়ে পড়েন।’
আধুনিক ইউরোপীয় কবিতার প্রধান তিনটি রূপ গীতি কবিতা, মহাকাব্য এবং নাটক। সবই বিকশিত হয়েছে গ্রিক প্রভাবে। বিকাশকালে তাদের আদিম বৈশিষ্ট্যে কিছু ছাঁট পড়েছে। গ্রিক লিরিক নামে এবং বাস্তবে ছিল গান। গ্রিক মহাকাব্য আবৃত্তি করা হতো প্রকাশ্য জনসমক্ষে। গ্রিক নাটকে থাকতো বৃন্দগান ও বৃন্দনাচ। গ্রিক মহাকাব্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হচ্ছে ইলিয়াড ও অডিসি। ওগুলো রচিত হয়েছে মহাকাব্যিক ষড়মাত্রিক ছন্দে, যাতে থাকে একটি চরণের ধারাবাহিক পৌণঃপুণিকতা, আমাদের অমিত্রাক্ষর ছন্দের মতো। ইলিয়াডে- আছে প্রায় ১৫,০০০ চরণ, অডিসিতে ১২,০০০-এর কিছু উপরে। ইলিয়াডে বর্ণিত হয়েছে ট্রয়-যুদ্ধে আগামেমনন এবং একিলিসের বিরোধের গল্প। অডিসিতে আছে অডিসিউস নামীয় আরেক নায়কের যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরার কাহিনী।
অডিসিতে চারটি চারণ- অনুষ্ঠানের বর্ণনা আছে। একটি হলো লায়ারের সহযোগে গীত সাদামাটা একটি গানের ধুয়া। আরেকটিও তাই। তবে তার পূর্বে অনুষ্ঠিত হয় একটি নাচ, যাতে চারণ সহযোগিতা করছে লায়ার বাদন দ্বারা। অন্য দুটিতে চারণের গানের সাথে নাচছে একটি কোরাস দল। এই গানগুলো এক সময় নাচ ছিল। মহাকাব্যের ষড়মাত্রা ব্যাখ্যা করলে এর সমর্থন মেলে, যা সম্ভবত একই ধরণের দুটো চরণ নির্ভর, যেমনটি-আমরা পাই আদি গ্রিক ঐকতানিক কবিতায়।
চারণ সঙ্গীতের বির্বতনটি এখন অতি পরিস্কার। এটা শুরু হয়েছিল আদিম গানের দলপতি এবং কোরাস, একক এবং দোহারদের মিলনে। দলপতি এবং একক গানের সুর জেগে ওঠে এবং কোরাস এবং ধুয়া ধীরে ধীরে হয় বিলীন। এরপর একক শিল্পী ত্যাগ করলেন তার যন্ত্র, অতঃপর গান হয়ে গেল কবিতা। এই হলো মহাকাব্যের জন্মকথা।
মহাকাব্য অনুপ্রাণিত হয়েছিল যুদ্ধ বিগ্রহের দ্বারা। নাটকের বিকাশের প্রেরণা এসেছিল কৃষ্টির উন্নতি থেকে। আদিম সমাজে যুদ্ধ ছিল পুরুষের কাজ। অপরদিকে, যা আদিতে ছিল বাগান রচনার স্তরে নির্দিষ্ট হয়েছিল নারীদের বিশেষ কেন্দ্র হিসেবে। উপরন্তু, খাদ্য সংগ্রহ, শিকার অথবা পশু পালনের তুলনায় কৃষি কাজ হচ্ছে একটি অত্যন্ত জটিল প্রযুক্তি। তাই শিশু জন্মের সঙ্গে যুক্ত আচারের আদর্শের সাথে জড়িত ছিল ভূমি উর্বরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রণীত নতুন যাদু-প্রক্রিয়ার বিস্তৃত রীতি-নীতি।
এ্যারিস্টটল জানিয়েছেন যে, ‘গ্রিক ট্রাজেডি বর্ণনা শুরু হয়েছিল একজন অভিনেতা দিয়ে এবং তিনি বলেছেন যে, আদিতে এই অংশটি অভিনীত হতো স্বয়ং কবির দ্বারাই। এই মতবাদ আমাদের ধারাবাহিকতার ক্রমটি পূর্ণ করে: পুরোহিত-কবি-অভিনেতা। পুরোহিত ছিলেন ভূতাবিষ্ট, কবি প্রেরণাদীপ্ত; এবং গ্রিক নাটকের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত অভিনয় পেশার সাথে জড়িত সদস্যদের ওপর আরোপিত হতো এক ধরনের পবিত্রতা। কেন? তাদের পবিত্রতা এসেছে তাদের উৎস থেকে। এক সময় যা দেবতার কন্ঠ বলে বিবেচিত হতো তারা ছিলেন সেটা প্রকাশের মাধ্যম। অভিনেতা যিনি অলঙ্কারপূর্ণ ভাষায় সেই অংশটি আবৃত্তি করেছেন যা কবি তার জন্য রচনা করেছিলেন, এসেছেন কবি-অভিনেতা থেকে এবং কবি-অভিনেতা, যিনি তার নিজের রচনা নিজে আবৃত্তি করেছেন- তাৎক্ষণিক রচনায় সিদ্ধ, অনুপ্রাণিত- এসেছিলেন ডায়োনুসাসের পুরোহিত থেকে কবি দলপতি রূপ গ্রহণ করে।
ধনবাদে এসে কবির সামাজিক মর্যাদা পরিবর্তিত হয়েছে। শেক্সপীয়র যুক্ত ছিলেন লিসেস্টারের আর্ল-এর সাথে। তাঁর পেশাগত অবস্থান ছিল আংশিকভাবে সামন্তবাদী। অপরদিকে মিল্টন অনেকদিন ধরে ছিলেন কমনওয়েলথ কর্মচারী এবং ক্রমওয়েলের বৈদেশিক সচিব। তাঁর মর্যাদা ছিল ধনতান্ত্রিক। কি তাঁর রাজনীতি এবং কবিতার মধ্যে ছিল নিবিড়ভাবে সম্পর্ক। তাঁর কাছে রাজনীতি, কাব্য ও ধর্ম ছিল এক এবং অবিভাজ্য। রেস্টোরেশনের পরে আধা-সামন্তবাদী পৃষ্ঠপোষকতার দিকে একটি আংশিক প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল। পোপ এবং গ্রে’র মতো কবিরা ভোগ করেছিলেন ভূমি অভিজাতদের আতিথেয়তা, যারা ছিলেন তাদের কবিতার গ্রাহক এবং তাদেরকে তারা নিয়োগ করেছিলেন সচিব হিসেবে।
কিন্তু শিল্প-বিপ্লবের সাথে সাথে সমস্ত সামন্তবাদী অবশেষগুলো চুড়ান্তভাবে অপসৃত হলো। কবিতা হলো পণ্য। কবি হলেন খোলা বাজারের জন্য উৎপাদনকারী, তার পণ্যের চাহিদার ক্রমশ নিম্নগামিতাসহ। বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে ধনবাদ আর কোন প্রগতিশীল শক্তি নয়, বুর্জোয়াও নয় প্রগতিশীল শ্রেণি; এবং তাই বুর্জোয়া সংস্কৃতি, কবিতাসহ হারিয়ে ফেলেছে তার প্রাণশক্তি। আমাদের সমকালীন কবিতা শাসক শ্রেণির সৃষ্ট নয়- বড় বড় ব্যবসায়ের কবিতা দিয়ে কী আসে যায়? ওগুলো সমাজের মধ্যবিত্ত বৃদ্ধিজীবী নামে পরিচিত ক্ষুদ্র এবং বিচ্ছিন্ন একটি শ্রেণির দ্বারা সৃষ্ট, যারা শাসক শ্রেণির দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েও একচেটিয়া ধনবাদের লৌহবেড়ি ভাঙবার একমাত্র শক্তি সর্বহারা জনতার সাথে হাত মেলাতে দ্বিধাগ্রস্ত এবং তাই বুর্জোয়া কবিতা সামাজিক পরিবর্তনের অন্তঃশীল শক্তির সাথে হারিয়েছে যোগ। বুর্জোয়া কবি যদি তার শিল্পকে পুনর্বিন্যাস করতে না শেখে, তাহলে শীঘ্রই সে তার কথা শোনাবার জন্য নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই পাবে না।
কবিতা আদিতে ছিল একটি সামাজিক কর্ম, যাতে কবি এবং জনসাধারণ পরস্পর সম্মিলিত হয়। আমাদের কবিতা এমন মাত্রায় ব্যক্তিক হয়েছে যে, এটা এর উৎসের সাথে হারিয়ে ফেলেছে যোগ। এর শিকড় গেছে শুকিয়ে।
হোমারের অবস্থান ছিল শ্রেণি বিভক্ত সমাজের উদ্ভবের কাছাকাছি। আমরা আছি শ্রেণি সমাজের কাছাকাছি। হোমারের সময়ও কবিতা ছিল প্রচন্ডভাবে জনপ্রিয় এবং কোনো কোনো দিক দিয়ে তখনো অপরিণত। পরবর্তীকালে গ্রিসে এবং পুনরায় এলিজাবেথীয় ইংল্যান্ডে কবিতা তার পূর্ণ অবয়ব পেলো এবং তখনো তাতে রক্ষিত ছিল প্রচুর পরিমাণে গণআন্দোলন।
বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিতার উদয়ের আগে রবীন্দ্র-কাব্যের আওতার থেকে বেরিয়ে পড়বার দু-একটা প্রয়াস দেখা দিয়েছিল। সে ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি হয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার আঙ্গিকের অনুশীলনের জন্যেই বিখ্যাত। তিনি শব্দ ও ছন্দকেই ভালোবেসে গেছেন। তাঁর কবিতায় মননধর্মের অভাব অত্যন্ত শোকাবহভাবে আমাদের আঘাত করে। কিন্তু আঙ্গিকের দিকেও সত্যেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে যেতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। বাংলা ভাষায় যুক্ত অক্ষরের পূর্বস্বরকে যে আমরা গুরু বা দুমাত্রায় উচ্চারণ করি, রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছন্দেই তার প্রথম পরিস্কার নমুনা দেখতে পাওয়া যায় সত্যেন্দ্রনাথের আবির্ভাবের অনেক আগে। সত্যেন্দ্রনাথ এই প্রবর্তনকে প্রয়োগ করে গেছেন তাঁর নানা ছন্দে।
কোনো কোনো সমালোচকের ধারণা যে, একালের কাব্যেও রবীন্দ্রনাথের অবসান হয়নি বরং বিশেষ করে তাঁরই অনুভাবে একটা উল্লেখ্য আধুনিক কাব্যযুগ দাঁড়াতে পেরেছে। এরকম মন্তব্যে অনেকখানি অর্ধসত্যতা রয়েছে। অবশ্য আধুনিককালে দু’একজন বিশিষ্ট কবির প্রধান কবিতাগুলোও বার বার রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়িয়ে দেয়। আরো দু-একজন ভালো কবি তাঁরই জিনিস নিয়ে সাধক হয়েছেন বলেন মনে হয়; কিন্তু জিনিস যারই হোক তাকে উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করে যদি রচনায় পৃথক সিদ্ধি পাওয়া যায় তাহলে শিল্পীর উপায় নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো মূল্য নেই। অন্যদিকে দু-একজন কবি রবীন্দ্রনাথের ব্যাপ্তি সম্বন্ধে অবহিত থেকেও নতুন দীক্ষা ও রীতি-নীতির ভিতর দিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কাব্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন। নিজের দেশের কবিতার দীর্ঘকালের ঐতিহ্যের ভিতর স্থিত হয়েও আজকের মুখ্য কবি পৃথিবীর, বিশেষত পশ্চিমের, শ্রেষ্ঠ কাব্য উপলব্ধি করতে পেরে বাংলা কবিতাকে এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করাতে পেরেছেন যে তার ভবিষ্যৎ পরিণতির প্রশ্ন বৈষ্ণব পদাবলী মঙ্গলকাব্য এদেশের গীতিকা বা মধুসূদন বা রবীন্দ্রনাথের সত্যের ভিতরেই শুধু আটকে নেই- সেখানেই মানুষ তার স্বতন্ত্র আধুনিক চেতনাকে মহান কবিতায় প্রকাশ করতে পেরেছে সে সবের সঙ্গেও যুক্ত। এ জিনিস মধুসূদন বুঝেছিলেন- রবীন্দ্রনাথ আরো গভীরভাবে; আধুনিককালের আরো জটিল বিন্যাস কবির কাছ থেকে এ বিষয়ে অপার সতর্কতা ও তেমনই অধ্যবসায় ও মননের ক্ষমতা দাবি করছে। সে দাবি মেটাবার শক্তি কবিদের যত বেশি- বর্তমানের কবিতা অর্থশীল হয়ে উঠবার বেশি সুযোগ পেতে পারে।
এ- কাব্যযুগ এখনো চলছে, যাঁদের হাতে সমাপ্তির ভার খুব সম্ভব তাঁদের কারো লেখাই এখনো শেষ হয়নি। দশ-বিশ-ত্রিশ বছর পরে এ-কালের বাংলা কবিতার আরো সঙ্গত পরিচয় পাওয়া যাবে।