করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





যুদ্ধকাল ৭১
এনায়েত কবীর

মস্তিস্কের নির্জনে প্রাচীন এক চিত্রকলা আমাদের ভস্মীভূত গৃহ !
আকস্মিক নির্গমনে আমাদের ভাঁড়ার সঞ্চয় , যা কিছু নির্মোহ -
পুড়ে ছাই, ভস্মের গাদায় আমাদের জন্মস্মৃতি ডুবে রয় !
অসতর্ক প্রতিটি সৌন্দর্য ঝরে যায়, আমাদের বলাকারা তবু
নিরালম্বে সজাগ প্রহরী দাবানল বিপরীতে আর আমরা বিস্ময়ে
ঝরে পড়া পলেস্তারায় চুম্বকে খুঁজে নেই অতীত কিঞ্চিৎ ।
*

আমাদের ইঁদারার জলে তবু ঝরা পাতা ভাসে
পাতার গভীরে শুয়ে থাকে সুষমা শেকড় , ঝরা পাতা
অসংখ্য কঙ্কালে পরিণত জীবাশ্মের সূচনায় । আমাদের ভীতি
মৃত্যুকে অভয় দিয়ে আমাদের ভীতি ডুবে রয় ইঁদারায় !
উড়ে চলে আমাদের বলাকারা উড়ে চলে
অসতর্ক প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের অভয় জীবনে !
*
মৃত কেউ, কেউ জীবন্মৃত , কেউ বিজয়ী জননী এক সন্তানহারা মাতম
আমাদের সব ভস্মীভূত , আমাদের গৃহ , আমাদের প্রাণ
যা কিছু সঞ্চয় । কিন্তু সেই ভস্মের গভীরে উঁকি দেয় সামান্য জীবন
আর অসামান্য এক সম্মানে উন্নত আমাদের মস্তিস্ক অধীর !
*
কেননা, আমরা হতভম্বÑ সচকিত -সম্বিত আর আমাদের বলাকারা উড়ে চলে উড়ে ,
আমাদের মস্তিকে যুদ্ধের চিত্রকলা রয় স্মৃতি হয়ে !

*

কেউ যোদ্ধা নই, মারণের মন্ত্রে কেউ ভাসিনি আমরা -
তবু আক্রান্ত আমরা বারুদের গন্ধে সন্ত্রস্ত প্রতিটি
অনভ্যস্ত পদক্ষেপে বয়ে নিয়ে যাই লাভা স্রোত ,
এক একটি আগ্নেয় গিরি আমরা ঝাঁপ দেই আগুনে উন্মুক্ত !
*
কেউ যোদ্ধা নইথ কেউ ফলিয়েছি শস্য, কেউ ভাসিয়েছি
মাটির ভেলায় ডুবুরী কলস আর আমাদের মেয়েরা প্রত্যেকে
জন্ম দিয়ে গেছে কবি ও সাধক, আমাদের বিদ্যালয়ে
অবনত বৃক্ষ ফল ও ফুলের প্রাকৃত বনের ভেতরে
লুকোচুরি খেলে এঁকে গেছি চিত্রকলা মস্তিস্কের নিওরনে !
*
কিন্তু যুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে যোদ্ধা হতে ।
লাভার ভেতর থেকে উত্তপ্ত পাথর ছুঁড়ে
আমরা দিয়েছি ভোঁতা করে তাহাদের লকলকে জিব !
প্রথমে মেরেছি ভাতে, তারপর পানিতে উল্লাসরত
মাছ হয়ে ডুবিয়েছি তাহাদের কাদার কর্পূরে !!
*
কেননা আমরা জীবন্ত এক একটি আগ্নেয়গিরি সহসাই নিতে পারি
মানুষের রূপ, হতে পারি বীর , মেয়েরা এখানে বীরগর্ভে নেচেছে ময়ূর !
কেউ যোদ্ধা নই, ক্রমশ আক্রান্ত হতে হতে শিখে গেছি যোদ্ধা হতে
তবু কেউ মারণাস্ত্র হাতে আগুনের ফণা হয়ে খুঁজিনি মানুষ !

*

পথের বিনাশ নেই জেনে আমাদের রক্তপথে
ছুটে গিয়েছিলো মৃত্যুর ইশারা আর পরিযায়ী
পাখী হয়ে ডানা ঝাপটে আমরা নিস্ক্রিয় করেছিলাম
প্রতিটি গুলির শব্দ আর নিষ্ক্রিয় বোমার নীচে
নৈশব্দের খেলায় জীবিত মৃতদেহ আমাদের !
*
আমাদের মেয়েরা ছিলো সমুদ্রের ঢেউ -
উত্তাল বীর প্রসবা , প্রত্যেকে বীরের
উত্তাপ ছড়িয়ে ধ্বংস শিখেছিলো দুষ্কৃতির !
তারপর ঢেউয়ের বিনুনী ভাসিয়ে নিয়েছিলো
দস্যুমুখ বালির ক্ষিপ্রতা থ অনিবার্য অভয় খেয়ালে !
*
বাস্তুর বিনাশে নয়, অবিনাশী হিংসার অশেষ
অলিখিত আয়োজনে আমাদের নামগুলো সব
এপিটাফে এক একটি অতীত- তবু আমরাই
আবার সমস্ত বিপর্যয়ে দাঁড়ালাম যোদ্ধা হয়ে!
*
অপমৃত্যু শিখিয়েছে আমাদের যোদ্ধা হতে ।

*

যুদ্ধ আমাদের পেশা নয় , কিন্তু বিরল সাহসে
আমরাই টাঙ্গিয়েছি সূর্যকে সবুজ শস্যের মাঝে আর
পুরো মানচিত্রে আগুনে হলুদ সঁপে দিয়ে হয়তোবা
অনাহারে ঘুরেছি বাদাড়ে চেতনার উপাসনা শেষে !
যুদ্ধাস্ত্রই তবে জীবনে মৌলিক এই ভেবে দুর্গমে পেতেছি
ক্ষণবাস প্রান্তরের উন্মুক্ত অচেনা আবাহনে ।
*
কোনও বিলাসী যুদ্ধবাজ হরণ করেছে তাবু
কিন্তু উন্মুক্ত নীলিমা দিয়েছে আশ্রয় ,
নিরাশ্রিত প্রতিটি প্রাণের মাঝে উল্লসিত
বিজয়ের ধ্বনি লক্ষ কণ্ঠের সঙ্গীত হয়ে উঠেছিলো তবে
আর উড়ন্ত ডানায় বলাকারা ভস্ম উড়িয়ে উড়িয়ে
অচেনা বাস্তুকে চিনেছিলো নিরন্তর অন্বেষণে ।
*
নিদ্রাহীনতায় নিরন্ন সন্ত্রাস আমাদের নিয়ে গেছে
বিপন্ন সময়ে নির্লিপ্ত নিঃশব্দ অথচ গভীর বিজয়ের কাছেথ
তাই বারূদের ঘনত্বের ভেতরে আমরা সাজাই শান্তির সমাচার !

*

যুদ্ধের প্রতিটি গল্প বিজয়ের তাই
আমাদের নিহত কঙ্কাল অস্থি মজ্জা
মিশে থাকে মৃত্তিকার গভীর উর্বরে
শস্যের উজ্জলতা মাঝে আর আমরাই খুঁজে নেই
বিজয় কাহিনী আর প্রতিটি মৃতের গল্প বীরত্ববহুল
হাতিয়ার হয়ে ওঠে নিধনে নিধনে যোদ্ধা , যোদ্ধা হাতিয়ার।
যুদ্ধবাজ পেশাদার নই, বীরের সন্তান হয়ে তবু
যুদ্ধ শিখে অনিবার্য যোদ্ধা হয়ে উঠি !
*
যোদ্ধারা বিজয়ী আর যুদ্ধবাজ পরাজিত !
তবু বারে বারে পরাজিত মানবতা- মানুষের অধিক বিপন্ন
কোনও মানুষ খুঁজে চলে মানবিক জিজ্ঞাসায় !
প্রতিটি যুদ্ধের জয়ে পরাজিত মানবতা
প্রতিটি যুদ্ধের পরাজয়ে বিপন্ন সৌখিন মানবতা !
*
আমরা বিরহীÑ আমাদের প্রেমে শুধু মানুষের জয়
যে মানুষ জানে না মারণ , মারণের পেশা যার
মানুষের দলে তার নেই অধিকার -প্রেমে তার নেই অধিকার !
*
মানুষের পেশা তাই মানুষকে বাঁচাবার -
মারণের নেই তার সামান্য, সামান্য অধিকার !

*

জীবিত প্রতিটি প্রাণে অসমাপ্ত জীবনের ছায়া -
ধ্বংসস্তূপের গভীরে প্রারম্ভিক স্মৃতিকথা তবু
হৃত পরিজনের নিহত অবয়বে লিখে যায়
এক একটি উন্মত্ত অধ্যায়ের প্রণোদনা ।
*
আহত একটি দেহ কাঁধে চলমান শিশু
মাতৃ-জঠরে আরেক জীবনের খোঁজে
পার হয়ে যায় ভাঙ্গা সেতু- পার হয়ে
ভাঙ্গা সেতু নদী বয়ে যায় রক্তের কিনারে।
মারণকলের অব্যাক্ত করাতে প্রমত্ত
উদ্বেগের সংবিধানে কেউ শুধু রয়
কেউ শুধু রয় কেউ শুধু রয় দেহহীন ছদ্মবেশে।
*
নিহত প্রতিটি নাম বয়ে যায় আমাদের রক্তে
বয়ে যায় কেউ বীর প্রাক্কলনে খুঁজে নেয়
রক্ত খুঁজে নেয় আর আমাদের প্রতিটি নদীর
স্রোতে মৃতদেহগুলো পতাকা নাচায় ।
অথবা এখানে কেউ নয় মৃত , কেউ নয় ।
*
অসমাপ্ত বহুবিধ জীবনের ভার বয়ে যায় আমাদের পথ।

*

আমাদের সন্তানহারা জননী দিশেহারা
গৌরবের অনন্ত সম্ভারে নিজেকেই খোঁজে
নিজেরই পুস্পহারা ধামে নিরন্তর ভেসে
পাড়ি দিয়ে যায় জীবনের অসমাপ্ত পথ।
*


আমাদের জননীরা সম্পন্ন সময়ে
উল্কাপাতে খোঁজে সন্তানের অপহৃত মুখ !
তরুণী কন্যার জননাঙ্গে বিষের ছোবলে
শিশু, শত শত অভিশপ্ত যুদ্ধশিশু মানুষের
শিশু হয়ে যায় মিশে, মিশে যায় কালান্তরে
জাতিভেদে আর নাই ভেদাভেদ নাই নাই
নাই রক্তপাত নাই ,আমাদের শিশু কারা
আমরাই খুঁজে যাই আমাদের জাতীয় সত্ত্বায় ।
*


শোক নাই , আমাদের কোনও শোকের দিশা
মঙ্গলে অমিত তেজে খুঁজে যায় পিতৃ হন্তা মাতৃ হন্তা তবু
আমরা মানুষ থেকে যাই আর আমাদের সন্তানেরা
বেড়ে ওঠে যুদ্ধ ও যুদ্ধ কথার মাঝে বেড়ে ওঠে।
পেশাদার অযুত সৈনিক পরাজয়ে কাঁপে
আমাদের তারামন বিবি হাঁটে বীররেখা পার হয়ে
এক একটি গ্রামের ভস্মাধারে রেখে যায় বিজয় কাহিনী।

*

মৃতদের ভার কাঁধে বিজয় উল্লাস চলে ,
নৌকায় গুলির গোঙানি নিস্তব্ধ খুঁজে চলে
অব্যয় প্রবাহে খুঁজে চলে নিহত সঙ্গীর ঝোলা ।
যুদ্ধক্ষেত্রে মারণ কলের নীচে কেউ একদিন
লিখেছে সঙ্গীত গেয়ে গেছে সুরে সুরে
'জয় বাংলা, জয় বাংলার অশেষ জয়ে '
লিখে গেছে সাধ্যের সীমানা পেরিয়ে অবাক
চলে গেছে তারপর অবাক কবিতা লিখে রেখে।
*
নিহত সঙ্গীর ঝোলা বয়ে যায় শ্রুতিলিপি
বাঘা সিদ্দিকীর নৌকা বিক্রমে অপার
বিস্ময়ে অবাধে পার হতে থাকে জলন্ত সেতুর নীচে
ধ্বংসাবশেষ অবাধে পার হতে হতে খুঁজে ফেরে ।
সঙ্গীত মুখর যে তরুণ এক হাতে পতাকা ওড়ায়
আরেক হাতের নীচে স্নেহশীল আরেক হাতে লাশ
বয়ে যায় পিতার নিহত মুখ বয়ে যায় অব্যর্থ গুলির
প্রমত্ত সন্দর্ভ বয়ে যায় অব্যর্থ কবিতা হয়ে
নিজেরই সুরে সুরে মুগ্ধ হতে থাকে মুগ্ধ ।
*
গোলা গুলি সব পাখীর পালকে বিঁধে যায় উড়ে
উলমনে উড়ে যায় বজ্র উল্লম্ফনে যখন কেউবা
বারে বারে হেঁকে ওঠে ‘জয়বাংলা’ বিজয় উল্লাসে ।

*

প্রতিদিন যুদ্ধবাজ যায় মরে , তবু হত্যা হয় গণহত্যা
বিধ্বস্ত নগরে লাশ ভাসে , তরুণীর ক্ষত বিক্ষত স্তনের
নীচে ঘুমন্ত জীবিত শিশু সারমেয় স্তনে খুঁজে পায় জীবনের নাম।
আর বাজীকর জিতে নেয় জননাঙ্গ বিকারের
অদম্য কৌশলে বাজীকর মাতৃহন্তা বাজিকর
শুধু চিনেছে যৌনাঙ্গ অজৈব জন্মের পথে যার
মাতৃসুখে মাতৃস্তনে কখনো হয়নি পরিচয় !
*
আমাদের ধ্বংস শহরের শহরগুলো বিধ্বস্ত !
আগুনের ধ্বনি গেছে ভেসে রণসুরে সুরে
রণ ধ্বনি যায় বয়ে ‘একটি মজিবরের কণ্ঠে
লক্ষ মজিবরের কণ্ঠ ’ বয়ে যায় বিজয়ের সুর !
*

আমাদের বীর পুত্র , বীর কন্যা খুঁজে গেছে নদী তীরে
নিখোঁজ পিতার মৃতদেহ , সেই দেহ কারো পিতা নয়
নয় কারো ভ্রাতা , নয় মৃত নয় দেহ নয় নিখোঁজের খোঁজে
এসেছে যে, সেও তবে কি নিখোঁজ উল-প্রান্তরের মাঝে !
গোলাঘরে ধানের গভীর গন্ধে মাতোয়ারা মাতালগে
শিশুটির শ্বাস কবে রোধ হলো কবে মৃত নাম
জননীকে উন্মাদিনী রূপে রেখে চলে যায় অসমাপ্ত পথে ।

*

আমাদের উদ্বাস্তু ডানায় আতঙ্ক উড়ে চলে ;
নক্ষত্রের অন্ধকারে উদাস আলোর অপরূপে
সাধারণ্ কেউ যোদ্ধা হয়ে ওঠে বীরের সম্মানে।
পরিযায়ী সময়ের নীচে উন্মুক্ত বাস্তুর দেখা মেলে,
দেখা দিয়ে যায় রণে ও নিরাশ্রিতের নিঃসঙ্গ সঙ্গীতে ।
*
পরান্নের অভিমুখী সমস্ত প্রাণের নিরাভরণ উৎসের সন্ধানে
বঞ্চিতের জাগতিক এক একটি সংলাপে রণনীতি ভুলে
ফিরে যায় বাস্তুভুমে যায় ফিরে যায় রণাঙ্গনে দেহ রেখে !
শিশুটিকে আর কেউ দেখে নাই,পিতার মৃত্যুর পরে
মাতার মৃত্যুর পরে , শিশুটিকে কেউ দেখে নাই !
তবু শিশু এক নিজের স্বজন খুঁজে নেয় পরজনে !
পরজনে পরম বন্ধনে শিশুটি কখন যুবক কেউ জেনে যায় ।

*
উন্মত্ত বাতাস শিস দিয়ে বলে যায় হাবীবের চূড়ান্ত বিক্রম গাঁথা ,
তার গোঁফের সৌখিনে খেলা করে যায় বন্য এক বিজয় প্রতীক !
আর উড়ন্ত উদ্বাস্তু ডানা তাড়া করে যুদ্ধবাজ ভূত , তাড়া করে
নিয়ে যায় গভীর দীক্ষায় আর বোতলের বন্দী ভূত যায় মরে যায় ।