যামিনী রায়কে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ছবি কি .. এই প্রশ্নের উত্তর এই যে- সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের স্বাক্ষী’।
অস্তিত্বের সাথে সংলাপের মাধ্যম হিসেবে কেবলমাত্র ছবি তথা চিত্রকলাকে বেছে নেবার পেছনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অজস্র যুক্তি ছিলো। তার পরম্পরায় চিত্রকলায় পূর্ণতার পরিপূরক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসত্তার সামগ্রিক অবয়বকে ঝাপসা করে তোলবার সুযোগ কোথায়? অর্থাৎ ‘জীবন ছবির দেবতা’ হিসেবে কোন এক মাধ্যমই দেবত্ব’র মহিমা উচ্চকিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট নয়Ñ এই যুক্তিটিও আর উহ্য থাকে না। শব্দ ও ছবির রূপকল্পে কোন না কোনভাবে তা বাধা পড়তে বাধ্য। একজন শিল্পীকে যে সাহিত্যঙ্গনে সফল হতেই হবে কিংবা একজন লেখককে রং তুলি’র মুন্সিয়ানা রপ্ত করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা অবশ্যই অস্তিত্বের স্বাধীনতা পরিপন্থী। সেইভাবে দেখতে গেলে শিল্পী বনাম সাহিত্যিকের সংঘাত অনিবার্য। দুটো দুই ধারায় আপন আপন সৌকর্যমণ্ডিত সৃষ্টিতে মূলধারার এপিঠ ওপিঠ। ছবি ও লেখা দুটোই মানব হৃদয়ের সহজাত অনুুভূতির অনুপুঙ্খ অভিব্যক্তিকে রং ও অক্ষরের বিভাষে ফুটিয়ে তোলে। অন্যভাবে বলা যায়, যিনি লেখেন তিনি আঁচড়ও কাটেন, আর যিনি তুলি চালান তিনি লিখতেও পারেন। তবে সবাই একযোগে চেষ্টা চালাননি তাই রক্ষা। নইলে আলাদা আলাদা বিশেষত্ব নিয়ে শিল্প সমালোচকÑসাহিত্য আলোচকদের পরিশ্রম আরো দীর্ঘায়িত হতো। এই পাঁচালীর অবতারণা রবীন্দ্রনাথকে উপলক্ষ করে নয়।
সবার আগোচরে বাংলা সাহিত্যের আরেক ক্ষণজন্মা কথাসাহিত্যিক রেখা ও কালির মিতালীতে এমন সব বিষয় সৃষ্টি করে গেছেন যা নজরে আসবার পর আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি কমলকুমার মজুমদার। এতদিন যিনি আমাদের কাছে অতি পরিচিত ছিলেন ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘সুহাসিনীর পমেটম, ‘খেলার প্রতিভা’ ইত্যাদি উপন্যাসের ঔপন্যাসিক হিসেবে। কিংবা ‘তাহাদের কথা’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’, ‘মতিলাল পাদরী’, ‘লুপ্ত পূজাবিধি’ গল্পগুলোর গল্পকার হিসেবে। অথবা ‘বঙ্গীয় শিল্পধারা’, ‘মার্শেল প্রুস্ত বিষয়ে’, ‘ঢোকরা কামার,’ ‘কলকাতার গঙ্গা’, ‘নাতুরালিসম’ প্রভৃতি মূল্যবান প্রবন্ধের প্রবন্ধকার হিসেবে। ‘দানসা ফকির’ এবং ’সুলতানা রিজিয়া’ নাটক দুটোও সেই সাথে উল্লেখযোগ্য। প্রচুর লেখেননি সেই অর্থে। যতটুকু দিয়ে গেছেন এমন অন্তর্ভেদী রচনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। কমলকুমার মজুমদারের সাহিত্য আলোচকগণ তাঁর গদ্যময় সংবেদনশীলতার অপূর্বতায় বহুবার মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্র“য়ারী মৃত্যুবরণের পরপরই যখন প্রথম তার একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলো, এরপর হতে যেন কমলকুমার মজুমদারের পরিচিতির বলয় ভিন্নমাত্রায় আকৃতি পাল্টালো।
সাহিত্য অবয়বের চিরচেনা কমলকুমার শিল্পবোদ্ধাদের এক নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করালেন। বেশীরভাগ ছবিই তিনি এঁকেছিলেন ফেলে দেয়া পরিত্যক্ত কাগজে, কার্ডের উল্টোপিঠে, বাসÑট্রামের টিকিটে। আকারে ছোট এই আঁকাগুলোতে মাধ্যম হিসেবে এসেছে রেখাচিত্র, জলরং কিংবা কাঠ খোদাই। উজ্জ্বল কড়া তেল রং বা অ্যাক্রেলিকের পেলবতা ছিল অনুপস্থিত। পুরো প্রদর্শনী জুড়ে সার বেঁধে ঝোলানো স্কেচ-ড্রইং-জলরং এর নিজস্বতায় আঁকা কমলকুমারের স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পসত্তাটি অনুধাবন করতে কারো বিন্দুমাত্র সংশয় থাকেনি। লেখালেখিতে যেমনটি নিরাভরণ অথচ আলংকরিক বিয়য়ে মাহাতেœ্যর সন্ধান মেলে, ঠিক আঁকাআঁকিতেও তেমনি দেখি অনায়াস প্রতিফলন। সেই প্রদর্শনীর পর কমলকুমার মজুমদারের বহুমুখী প্রতিভা-বিশেষণে এরপর যুক্ত হলো ‘চিত্রকর’ উপাধিটি। উল্লেখ্য, শিল্পচর্চায় সমসাময়িক প্রতিভাবান সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছিলেন কমলকুমার মজুমদারের অমিত সম্ভাবনাকে। অনেকে অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন কেন জীবদ্দশায় তিনি এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেননি। মৃত্যুর পর এ’পর্যস্ত মোট তিনটি একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদারের সহযোগিতায়। এর অনেক পরে দয়াময়ী মজুমদার এবং সন্দীপন ভট্টাচার্য সম্পাদন করেন কমলকুমারের বাছাই করা ছবির প্রিন্ট নিয়ে ‘বাংলার মনোলোক ও অন্যান্য লোকচিত্র শীর্ষক গ্রন্থটি। মূলতঃ এর মাধ্যমেই কমলকুমারের বৃহত্তর পাঠককুল সরাসরি জানতে পারেন তাদের প্রিয় লেখকের তীব্র শিল্পীসত্তার ভেতর বাহির। এর আগে তাঁর আঁকার হাতের পটুত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্মেছিল বিভিন্ন গ্রন্থচিত্রণের সুবাদে। বিশেষ করে কাঠ খোদাই শিল্পে তিনি যে অনন্য প্রতিভা তা জানতে কারো বাকী ছিল না। পাশাপাশি এমন একাগ্রতায় সাহিত্যরচনার ফাঁকে তিনি যে নিরবধি এঁকে চলছিলেন তা কেবলমাত্র তাঁর ঘনিষ্টজনদের জানা ছিল। দয়াময়ী মজুমদারের মাধ্যমে পরবর্তীকালে সবাই জানতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মন্দিরের কারুকাজ, বিশেষতঃ টেরাকোটা নিদর্শনে কোথায় কোথায় লোকশিল্পের অথবা দক্ষিণী বা বাংলার নিজস্ব ভাবের প্রকাশ রয়েছে তা জানবার জন্য কমলকুমার বহু শ্রমবাধ্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। আর এই অর্জন পরম মমতায় বিলিয়ে দিয়েছেন কমল এবং তুলির স্পর্শে।
যারা কমলকুমারের লেখালেখির সাথে বিশদভাবে পরিচিত নন তারা লেখকের কাহিনী নিয়ে নির্মিত ’অন্তর্জলী যাত্রা’ এবং ‘তাহাদের কথা’ চলচ্চিত্র দুটির সাথে নিশ্চয় পরিচিত। লেখালেখির মতোই মাটিÑমানুষের অন্তঃস্থ বয়ান তিনি তাঁর আঁকার কাগজেও সমান দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। বরাবর সর্বভারতীয় শিল্পরীতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন তিনি। সেই সাথে প্রচণ্ড পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতার মিশেলে লৌকিক রীতিকে আধুনিক ক্লাসিকাল ছন্দে রেখাবদ্ধ করা ছিল তাঁর আঁকার সহজাত বৈশিষ্ট্য। হালকা রঙ এবং ঋজু রেখার টান কিংবা গাঢ় রেখার বুনোটের ফাঁকে ফাঁকে সূক্ষ্ম ডিটেলস তাঁর ছবির বিশেষত্বকে দিয়েছে আলাদা পরিচিতি। নন্দলাল, যামিনী, অবনীন্দ্র কিংবা সোমনাথ হোড়, বিকাশ, গণেশ পাইন প্রমুখেরা যেমন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পরীতিকে স্বকীয়তা দান করেছেন সেই নিরিখে তাঁদের সাথে একই দেয়ালে কমলকুমারের ড্রইং বা মনোক্রোমকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হচ্ছেন হালের বোদ্ধা সমালোচকরা। যদিও কমলকুমারের জন্য এটি বাড়তি পাওয়া নয়। কারণ সাহিত্যের মতো সহিষ্ণুতা ও নিষ্ঠার পূর্ণ প্রভাব সঞ্চারিত হয়েছিল তাঁর শিল্পচার্চার অভিজ্ঞতায়। সেই সাথে কমলকুমার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বাংলার আবহমান কৃষ্টি, মাটির মানুষের একান্ত বিশ্বাসকে। পাশাপাশি পটের পুতুল, কাঁথায় কারুকাজ এবং কামারদের পিতলের কাজও ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয়। এর প্রতিফলন দেখি তাঁর বড় মাপের আঁকা ছাড়াও মিনিয়েচার কাজের রেখায় অপূর্ব সূক্ষ্মতায়। চিত্রকলার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর ছিল না। সাহিত্যসত্তার সংকেত অনুসরণ করে আঁকাতেই তিনি তৃপ্ত ছিলেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল অতীন্দ্রিয় বোধের প্রতি তাঁর বিশ্বাস। যার রূপকল্প ফুটিয়ে তুলতে তিনি মা ও শিশুর যুথবন্ধ øিগ্ধতার আশ্রয় নিতেন বারবার। যেমনটি দেখি রেঁনেসা আমলের শিল্পীদের ‘ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড’ বিষয়ভিত্তিক অজস্্র মাস্টারপিসে। একই বোধে জারিত হয়েও কমলকুমার দেশীয় দর্শনকে আঁকড়ে ধরে এঁকে গেছেন। রঙের এবড়োথেবড়ো পোঁচ এবং সাবলীল ড্রইং এর যুগলমিলকে বন্দনা করেছেন নানা ওজনের শিল্পসম্ভার। অনুসন্ধানে জানা যায়, অযতেœ অবহেলায় কমলকুমারের বহু ছবি নষ্ট হয়ে গেছে। তদুপরি যতগুলো রক্ষা করে গেছে দেশজ শিল্পনীতির গবেষণায় এর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক গুরুত্ব যথেষ্ট। উল্লেখযোগ্য বিষয়, কমলকুমার মজুমদারের ছবিগুলো কোন বিশেষ দশকের বক্তব্যকে উপস্থাপিত করে না। এর রূপÑরসÑগন্ধ সবই সর্বদেশীয়। হয়তো দশক নির্বাচনে কমলকুমারের সাহিত্য প্রতিভার স্পষ্ট অবয়ব পাওয়া যেতে পারে। যেহেতু তাঁর রচনাগুলো ছিল এক বিশষ প্রেক্ষাপটের সময়কে আবর্তিত করে। অথচ তাঁর ছবির ক্ষেত্রে জোর গলায় একই কথায় পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। সমকালীন প্রেক্ষাপটে তাঁর ছবি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সামগ্রিক সর্বভারতীয় বিশ্লেষণেও কমলকুমারের কাজ বিশেষ আলোচনার দাবিদার। আশার কথা চিত্রকলায় কমলকুমার মজুমদার তাঁর বিশিষ্টতার কারণে ইদানীং ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষিত হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে সন্দীপন ভট্টার্চাযের একটি প্রস্তাবনা ভেবে দেখবার মতো। সন্দীপন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে যাঁরা শিল্পকলার ঐতিহাসিক ও সমালোচক বলে নিজেদের দাবি করেন, তাঁর সচরাচর তাঁদের লেখায় কমলকুমারের নামোল্লেখ করার সাহস দেখান না। সম্ভবত তাঁদের বন্ধ চিন্তাÑসংস্কারের পক্ষে কমলকুমারের মৌলিক শুদ্ধতা ও তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব একটু বেশী গুরুভার। কিন্তু লেখক হিসেবে আজ আর যেমন তাঁকে এড়িয়ে যাওয়া সাহিত্যের কোন ঐহিতাসিকের পক্ষেই সম্ভব নয়, তেমনই আধুনিকতম এক প্রাকৃত ঘরানার পথিকৃৎ শিল্পী হিসেবেও ক্রমে তাঁর প্রতিষ্ঠা শিল্প-ইতিহাসে স্থায়ী হবে বলে আমাদের বিশ্বাস’। সন্দীপনের এই ধারণার সাথে একাত্ম হতে হলে অবশ্যই কমলকুমারের ছবিগুলোর প্রতি গভীর দৃষ্টি ফেলতে হবে। তবে সন্দীপন বাংলাদেশে বলতে বাংলাভাষীদের বুঝিয়েছেন নিশ্চিত। নির্দিষ্ট কোন দেশ কাল পাত্রের বিষয় বোঝাননি। কেননা পশ্চিম বাংলা ছাড়া বাংলাদেশের খুব কম সাহিত্যবোদ্ধাই কমলকুমারের আঁকাআঁকি সম্পর্ক অবগত রয়েছেন। তবে এটি সত্য, আবহমান বাংলার লোকায়ত সরলতার যে বিভাস আমরা কমলকুমারের ছবিতে খুঁজে পাই তাকে যথাযথ সংরক্ষণ করা সবার দায়িত্ব। লোকচক্ষুর আড়ালের এই সম্ভাবনাকে আলোয় আনতে ব্যর্থ হলে আমরা আত্মপরিচয়ের এক মহার্ঘ্য প্রামাণ্য দলিলকে হারিয়ে ফেলতে পারি।
কমলকুমার যেমন তাঁর লেখায় উচ্চারণ করেছিলেন,
‘আলো ক্রমে আসিতেছে, নভোমন্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ... ক্রমে আলো আসিতেছে’।
এই বির্মূত চিত্রসংজ্ঞাটি সার্থকভাবে রং ও রেখায় কমলকুমার তাঁর চিত্রকলায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। এই অনিবার্য রূপকল্পকে স্পর্শ করবার এইতো সুযোগ। চিত্রকর কমলকুমারের আধা বিমূর্ত স্বরূপ উন্মোচন করার এই উদ্যোগ নির্ভর করছে একটি ছোট্ট জিজ্ঞাসার ওপর । প্রশ্নটি হচ্ছে আমরা কতটা সুনিশ্চিত এবং প্রস্তুত আমাদের অস্তিত্বের সংকেতকে উপলদ্ধি করবার জন্য? কমলকুমার মজুমদারের চিত্রকলায় সে প্রশ্নের উত্তর অনেকাংশে দেয়া আছে। কেবল খুঁজে নেয়া বাকী।