বিস্তারের ব্যাপ্তিতে একটা মানুষকে কেন্দ্র করে বৃত্ত কতোখানি বড় কিংবা আরও বড় হতে পারে ! সেই পরিধির এক নমুনা রেখে গেলেন একটা মানুষ। যাঁর ইহজাগতিক প্রস্থানের পরও মানুষ সেই বৃত্তপরিধির খণ্ড খণ্ড জ্যা আবিষ্কার করে চলেছে। গান লেখায় তার তেমন ইচ্ছে ছিল না, অথচ অগুন্তি নামকরা গীতিকারের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয় বরং সবার অনেক অনেক পছন্দের অনেক গানই লিখে গেছেন এই মানুষটা। সময়ে বুঝিবা সবার জানা হয়নি। প্রয়াণ মাত্রেই শোক ও স্মৃতিকে ঘিরে, শব্দে শ্রদ্ধাপ্রদীপ জ্বালিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যখন সামাজিক মাধ্যমে একে একে তাঁর নানান বিষয় নিয়ে লিখছে; তাদের কেউ কেউ তাঁর গান নিয়ে লিখছেন। বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ছে মানুষের। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক কি লেখেননি। শুধু যে লিখেছেন এক জাদুর কলম দিয়ে তা নয়, তার পাঠেও ছিল মন্ত্রমুগ্ধকর অনন্য এক জাদুমন্ত্র। সত্যিই তাঁকেই বলতে হয় সেই বাজিকর।
... ... ... ... ... তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর
সেই রুমাল যে নাড়ে বেশুমার বুকের ভিতর, তার লাগি নিমিষে হয়া পড়ে সকলে কাতর। অমন অমোঘ কথার বুননে অলৌকিক পুরুষটি বুঝিবা দেখে ফেলেছিলেন নিজেই তাঁর অনাগতটুকুনও। তাই বুঝি নিয়তি তোমারে দিয়াছে ব্যাধি, নিরাময় অসম্ভব যার ? ভাবলেই শোকে ও শ্রদ্ধায় ন্যুব্জ হতে হয়, ভীষণ আর্দ্র হতে হয়।
হৃদগভীরে বিম্বিত শোকধ্বনি
পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি তোমার,
শহর জুড়ে যাচ্ছো তো বেশ
লঘু লয়ে পদব্রজে।
বুকের ভিতর মেঘলা আমার
শোকের ছুরি যাচ্ছে কেটে
রক্তপাতের যন্ত্রণাতে।
বলো দেখি -
তোমার হাতের কলমখানি
যাবে এখন কোন তল্লাটে !
জানো নাকি -
সৃষ্টিনেশায় অপেক্ষমান
কাগজগুলো শব্দ খোঁজে।
তোমার হাতের শব্দ খোঁজে।
জানি এসব কিচ্ছুটি আর
ঘটবে না এই জগতটাতে
শোকমাতমে দুর্ণিবার তাই
বুকের ভিতর বর্ষা নামে।
ভীষণ রকম বর্ষা নামে।
(রচনা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬)
১৯৮৭ থেকে মানুষটাকে বার বার বারাধিবার দেখতাম। জাতীয় কবিতা পরিষদকে ঘিরে দেশের সব বরেণ্য কবিদের উপস্থিতি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল সেই সময়টায়। নেতৃত্বে ঔৎসুক্য ছিল বেশীর ভাগেরই। অল্প কজন যাঁদের দেখিনি ওটা নিয়ে মাতোয়ারা হতে, সৈয়দ হক হাতে গোনা তাঁদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম একজন। তাতে তাঁর উপস্থিতি কখনোই অনাগ্রহে নিমজ্জিত ছিল না, ছিল না কিছুটাও অনীহায় ম্লান। এই কেছে থেকে দেখবার আগে থেকেই মানুষটার ঠাঁই ছিল আমার পরানের গহীন ভিতর। অন্য সবার থেকে বেশ-ভূষায় ভিন্নতর এ মানুষটি আপনা থেকেই চোখে পড়তেন, তাঁকে খুঁজে-পেতে দেখতে হতো না।
তারও অনেক পরে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠানে আমি যেনো নতুন করে আবিষ্কার করেছিলাম সেই প্রিয় সৈয়দ হক-কেই। সেটা ছিল এক সময়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীর অনুবাদ গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের গোরার প্রকাশনা অনুষ্ঠান। তাতে উপস্থিত ছিলেন বেশ কজন প্রথিতযশা, তাঁদের মাঝে কজন ছিলেন নামকরা সাহিত্যিক এবং ইংরেজীর অধ্যাপক। যাঁদের ভিতর দুজনের প্রতি নিজেও ভীষণ অনুরাগী আমি। সেই অনুষ্ঠানটিতে অবাক হয়ে পুনঃ আবিষ্কার করলাম সৈয়দ হক খুব অনায়াসে টপকে গেলেন অন্য সবাইকে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের চৌকশ, তথ্যবহুল ও বিবিধ বিশ্লেষণধর্মী বিশেষত্বে।
আমি খুব ভাল করে বুঝলাম, জীবনের শুরুতে পড়ালেখায় অসমাপ্ত অবস্থায় যতি টেনে সত্যিকারের অর্থবহ সিদ্ধান্তে তিনি অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে শুধুই লিখবেন বলে স্থির করেছিলেন। আর সে ভাবনা ও সিদ্ধান্তের জগতে পড়বার বিষয়টাকে বিন্দুমাত্র কার্পণ্যে দেখেন নি মানুষটা। অগাধ পড়ায় আর অবিরাম লেখায় এক জীবনে তিনি তাই আদৌ যতি টানেননি।
যতি যে টেনেছে সে তার জীবন, মানুষ সৈয়দ হক নয়। অগুন্তি পেয়ে পেয়ে তাঁর কাছ থেকে পাবার তেষ্টাটুকুন যেনো অভ্যাসের দাস হয়ে গেছে। তাই যতই পান করি না কেন, সে তেষ্টা তবু - কেবলি জেগে রয়। জানো কি সব্যসাচী !
সব্যসাচী
এই যে হঠাৎ ব্যস্ত তুমি
যাচ্ছো চলে অলৌকিক এক
আলোর পানে - জেনেছো কি
মুঠোর ভিতর আজো তোমার
রইছে জেগে নৃত্যরত
সাতশ সাতাশ মোমের আলোক,
কিশোর কাব্যে পাখির ঝলক
সৃষ্টিপাগল রাত জোনাকি -
একাই তুমি লিখবে সব
একাই পড়ে আনন্দম,
উচ্ছ্বলতায় দীপ্ত ভীষণ;
শেষমেষ তবে হ্যাংলা হলে !
সেই তুমিও একাই বুঝি
উদ্বেলতা করবে সাবাড়
ভাগ দেবে না নতুন কোনো
উদযাপনের, সব্যসাচী,
বললে না তো
কতো কি আর ছিল বাকী !