ইমতিয়ার শামীম আশির দশকের একজন জরুরি এবং শক্তিশালী কথাশিল্পী। উপন্যাস এবং গল্পে তার সমান বিচরণের কারণে তিনি প্রশংসিত হয়ে আসছেন অনেক দিন ধরেই। ‘শীতের জ্যোৎস্নাজ্বলা বৃষ্টিরাতে’ তার সপ্তম গল্পগ্রন্থ। এই সংকলনে স্থান পেয়েছে ছয়টা গল্প যে গল্পগুলোতে বরাবরের মতোই উঠে এসেছে যমুনাপারের প্রান্তিক মানুষদের ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং বেঁচে থাকার অপূর্ব স্পৃহা।
প্রথম গল্প ‘মঙ্গামনস্ক শরীরীমিুদ্রা’-য় উত্তরবঙ্গের কোনও এক গ্রামের রাশেদা নামের জনৈক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তার প্রেমিক রফিক ঘরে খিল দেয়। সে বলে: দরোজা ভাইঙ্গে কোনো লাভ হবার নয়, মু ঘরত থন বারাবার নয়। এ ঘরত মোর মিত্যু হবে। সত্যি রফিক তার ঘরের অন্ধকারে থেকে যায় খেয়ে না-খেয়ে। তারপর সেই জনপদে মঙ্গা আসে যা রফিক জানে না। এদিকে সামরিকজান্তা পৃথিবীকে দেখাতে চায় যে সেখানে মঙ্গা আঘাত করলেও আসলে কেউ না-খেয়ে নেই। কাজেই সামরিক বাহিনীর সৈন্যরা সেই জনপদের বাড়ি-বাড়ি হামলা করে ক্ষুধার্ত মানুষজনকে তুলে নিয়ে যায়। ঘরে খিল দিয়ে থাকা রফিককেও তারা পাঁজাকোলা করে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে। স্বেচ্ছানির্বাসন এভাবে শেষ হলে রফিক অনুধাবন করে যে সেই গ্রামে কোনও মানুষ আর বাস করে না। তারপর হয়ত ‘হাড় বেরুনো মানুষগুলো তাদের হাড় নিয়ে তাড়া করবে দূর-শহর থেকে গাড়িবিস্কুট নিয়ে আসা মানুষগুলোকে।’
সত্তর দশকের মধ্যভাগের ‘লালচে ক্ষুধা’-র গল্প ‘কৃষক হত্যার সম্ভাব্য প্রাক-পুরাতনী’ যেখানে প্রান্তিক চাষী ইউসুফ, তার স্ত্রী রাবেয়া এবং তার কিশোরী-কন্যা কুমকুমসহ গ্রামের সকলেই ক্রমশ নিঃস্বতার দিকে ধাবিত হয়। টান টান ক্ষুধায় তাদের পাঁজর ছিঁড়ে আসে। চোখ জুড়ে তাদের লালচে ক্ষুধা। এমনকি সবুজ বিপ্লবও তাদের অর্থনৈতিক পতন আটকাতে পারে না। তারপর গোপন অস্ত্রের সন্ধানে প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফের বাড়িত হামলা চালায় সৈন্যদের দল এবং কোনও অস্ত্র না-পেয়ে তারা ইউসুফকে তুলে নিয়ে যায়। তখন ইউসুফের কিশোরী-কন্যা কুমকুম তার মা’কে জিজ্ঞাসা করে: অনীলবাবুর ভিটায় (তার মা’র মতো করেই) গ্যালে অহনও কি আমার খারাপ বাতাস লাইগবো মা?’
তারপর আমি দেখি যে ‘লোকনাথ ও মোহাম্মদী পঞ্জিনামা’ গল্পে আফতাব খলিফার পিতা সকল সময়ে দু’টো পঞ্জিকা কেনেÑ একটা লোকনাথ পঞ্জিকা, আরেকটা মোহাম্মদী পঞ্জিকা। আফতাব খলিফা কিছুতেই বুঝতে পারে না যে মোহাম্মদী পঞ্জিকাই যেখানে যথেষ্ট, সেখানে কেন তার পিতা বছর-বছর লোকনাথ পঞ্জিকা কিনতে যাবে। গল্পের শেষে ফুটে ওঠে বন্ধুবিচ্ছেদের কাহিনী যে গল্পটা আফতাব খলিফা জানতে পারে না। তবে লেখক আমাদেরকে জানান যে আফতাব খলিফার পিতার বাল্যকালে তার বন্ধু অতীন আর অতীনের বোন দেশান্তরী হয়েছিল যাদের সাথে আফতাব খলিফার পিতার আর দেখা হয়নি। অতীনদের বাসাতেই একদা সে একটা লোকনাথ পঞ্জিকা পড়ে পেয়েছিল। সেই থেকে লোকনাথ পঞ্জিকা প্রতি জেগে থাকে আফতাব খলিফার পিতার মনোযোগ কেননা ‘কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেটা দেখতে দেখতে সে জানতে পারত, আজ অতীনরা পূজা করছে, আজ অতীনের বোন নিশ্চয়ই উপবাস করবে, আজ তো দেখি ভাইফোঁটার দিন।’
‘গ্রামীণ নিরাপত্তা দু-একটি খসড়া’ নামের গল্পে বিধৃত হয়েছে ভ্যানচালক সবর আলি, সবর আলির স্ত্রী জোনাকি এবং রোস্তম খোনকারের বিবাহিতা কন্যা বেহুলার গল্প। সবর আলির স্ত্রী জোনাকি বহুচারিনী ছিল। সন্তানসম্ভবা হওয়ার কারণে জোনাকি তড়িঘড়ি করে ভ্যানচালক সবর আলিকে বিয়ে করে। জোনাকি মারাও যায়, সম্ভবত গর্ভ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে। জোনাকির মৃত্যুর পরে সবর আলি অনেক কাঁদে। অন্যদিকে জোনাকির বন্ধু নিঃসন্তান বেহুলা বন্ধুবিয়োগের কারণে আঘাত পায় বেহুলা। তবে জোনাকির মৃত্যু হলেও সবর আলি তার জীবনকে অস্বীকার করে না। বেহুলার সাথে তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় কাকতালীয়ভাবেই এবং সে কারণে গভর্বতী হয় বেহুলা। তখন সবর আলি ‘টের পায় কোনও কোনও সময় পিতা হওয়ার পরও পিতা হিসেবে পরিচিতি না পাওয়ার মধ্যে কী ভীষণ আনন্দ লুকিয়ে থাকেÑ যা কোনও দিন কোনও ময়ের পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।’
নগরায়ন এবং ভূমিদস্যুতার গল্প ‘৩২ দিনের আষাঢ়’ যেখানে ভূমিদস্যুরা নদী পর্যন্ত ভরাট করে ফেলে বানাতে থাকে ‘পবনধারা হাউজিং এস্টেট’-র মতো উপনগর। সেখানে হারিয়ে যায় বাদশা মিয়ার জমি, তালুকদারদের জমি। আর কাদেরালি তখন ভাবে, বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষে কখনও এভাবে নদী নিহত হতে দেখেনি; তারা এও দেখেনি যে দুর্বৃত্তায়ন নদীর দু’পাশ গ্রাস করে নিঃশ্বেষ করে ফেলতে পারে আবাদি ধানীজমি এবং সেখানে তুলতে পারে অট্টলিকা! ভূমিদস্যুতার ফলাফল হ’ল এই যে গ্রামে আর নদী থাকবে না, নদীতে বর্ষার জল আসবে না। তাই কাদেরালির মনে হয়, আষাঢ়মাস অথবা শ্রাবণমাস আসলে পঞ্জিকাতে থাকার কোনও প্রয়োজনই নেই!
‘মন তুমি কৃষিকাজ’ গল্পে দেখা যায় যে গ্রামে এবং শহরতলীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যোগযোগ-প্রযুক্তি—মোবাইল ফোন হয়ে উঠছে গ্রামীণ এবং আধাশহুরে মানুষদের পারস্পরিক যোগযোগের মাধ্যম, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমও বটে। মানুষজন তাজ্জব হয়ে দেখছে যে ‘ওইটুকু এক যন্ত্র’-র মধ্যে কত কিছুই না থাকতে পারে! মোবাইল ফোন কেনার সামর্থ্য নেই বলে সেখানে বিস্তৃত হচ্ছে ‘সুইট ওয়াইফ টেলিকম সার্ভিস’-এর মতো দোকান যেখানে মোবাইল ফোন মেরামত করা যায়, আবার পয়সার বিনিময়ে কথাও বলা যায় মানুষের সঙ্গে। এমন এক গ্রামের বর্ষিয়ান সোবহান ভূঁইয়াও মোবাইল ফোন প্রযুক্তির প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সে ভাবতে থাকে, তার সিকিউরিটি গার্ড ছেলেক বিয়ে দিয়ে সে (অন্যান্য জিনিসের সাথে) যৌতুক হিসেবে একটা মোবাইল ফোন কব্জা করবে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করাটা যখন গ্রামে প্রতিপত্তির আইকন হয়ে উঠেছে তখন সেইবা পিছিয়ে থাকবে কেন? সোবহান ভূঁইয়ার এমন ভাবনার ভেতর দিয়ে শেষ হয় গল্পটা।
এর আগে আমি লিখেছি যে ইমতিয়ার শামীমের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল তার ডিটেইলিং। কাহিনীর কেন্দ্রের আশপাশ দিয়ে তিনি বিভিন্ন ডিটেইলিংয়ের ঘুর্ণি তোলেন সবর্দাই। সেই ডিটেইলিংয়ের ভেতর দিয়ে যমুনাপারের প্রকৃতি এবং প্রান্তিক মানুষদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা তাই আবারও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উঠে এসেছে। বিশাল এক ক্যানভাসের উপস্থিতি তার এবারকার গল্পগুলোতেও আমরা লক্ষ করি। বিশাল ক্যানভাসের ভেতরে তিনি তার মূল এবং পার্শ্বচরিত্রগুলোকে প্রবিষ্ট করেছেন। এবং তা’তে করে চরিত্রগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছে এবং চরিত্রগুলো ক্ষুধা ও দারিদ্রপীড়িত এবং আর্থ-সামাজিকভাবে পরিবর্তনশীল বাংলাদেশের প্রতিভু হয়ে উঠেছে সহজেই। বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি শব্দ এবং বাক্যগুলোকে এমন মুন্সিয়ানা এবং মমতার সাথে গেঁথেছেন যে তা’তে করে মনে হয়, তিনি আসলে যমুনাপারের প্রান্তিক মানুষদের মহাকাব্যের একটা অংশমাত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তার নিজস্ব কাব্যিক ভাষা সেই কর্মযজ্ঞে আবারও তাকে যথার্থই সাহায্য করেছে।
ইমতিয়ার শামীমের এই গল্পগ্রন্থ ক্ষুধা ও দারিদ্রপীড়িত বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার একটা বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনা বলে বিবেচিত হবে বলে মনে করি। আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার চিত্রণ প্রায় অনুপস্থিত। চৌকস ভাষা ব্যবহার করে আমরা কথামালা সাজাই এবং সযতনে আমরা এই ভূখণ্ডের বাস্তবতার চিত্রণ এড়িয়ে যাই। বস্তুতপক্ষে, একটা দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ধরতে পারাটা কঠিন কাজ এবং কথাসাহিত্যে তার প্রয়োগ তো আরও কঠিন। শ্রদ্ধেয় হাসান আজিজুল হক, জুলফিকার মতিন এবং সনৎ কুমার সাহা একদা আমাদেরকে হাতে-কলমে এসব সূত্র শিখিয়েছিলেন।
এবং আমি বলব, এই গল্পগ্রন্থে ইমতিয়ার তার নিজের সৃষ্টিকে নিজেই অতিক্রম করেছেন। এই গল্পগ্রন্থ প্রমাণ করে যে তিনি নিজেকে বারবার ভাঙতে ভাঙতে ধাবিত হয়েছেন নতুন সৃষ্টির দিকে। বস্তুতপক্ষে, একজন লেখকের কাছ থেকে আমরা নিজেকে অতিক্রম করার স্পৃহা, সাহস এবং ক্ষমতা দেখতে চাই। সেই বৈশিষ্ট সব লেখকের ভেতরে থাকে না। একই কারণেই আমি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদুল জহির, ওয়াসি আহমেদ, মামুন হুসাইন, প্রশান্ত মৃধা প্রমুখ লেখকদের প্রণাম করি। আমার দৃষ্টিতে তাই ইমতিয়ার শামীম বাংলা কথাসাহিত্যের একজন জরুরি লেখক। ‘শীতের জ্যোৎস্নাজ্বলা বৃষ্টিরাতে’ নামক তার সপ্তম গল্পগ্রন্থে ইমতিয়ার শামীম আবারও তার অন্যন্য প্রতিভার ছাপ রাখলেন।
‘শীতের জ্যোৎস্নাজ্বলা বৃষ্টিরাতে’ প্রকাশ করেছেন কথাপ্রকাশ। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০১৫। এই গল্পগ্রন্থের জন্য ইমতিয়ার শামীম প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার ১৪২১ পেয়েছেন। আপনারা জানেন যে বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ইমতিয়ার শামীম ইতোমধ্যে বিভিন্ন সাহিত্য-পুরস্কারে (আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথাসাহিত্য পুরস্কার, লোক সাহিত্য পুরস্কার এবং জীবনানন্দ পুরস্কার) ভূষিত হয়েছেন। আশা করি, বাংলাভাষার মানসম্পন্ন সাহিত্যে তার অবদান অব্যাহত থাকবে। ইমতিয়ার শামীমকে অজস্র ধন্যবাদ।
০৭ অক্টোবর ২০১৬