আমার ধারণা সমস্যা ছিলো এটাÑ ভ্রান্তি না জেনেই বেড়ে উঠেছিলাম। আমার বাবা ছিলেন খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী। আমার জানামতে তিনি ছিলেন লিবারেশন সাইকোলজির প্রতিষ্ঠাতা; এককভাবেই এটা নিয়েই তিনি কাজ করতেন। ল্যাবরেটরি কোট পরে তিনি বাড়ির চারদিকে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। বাড়িটা পরিচিত ছিলো ‘দ্য স্কিনার বক্স’ নামে। এটা ছিল আমার স্কুলঘর যেখানে আমি তার ল্যাবের ইঁদুরের মত পিয়াগেট-এর জ্ঞান উন্নয়ন তত্ত্বের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। খেতে পেতাম না, কিছুটা ক্ষুধা-উদ্দীপনার তাড়নায় আমাকে রাখা হত। আমাকে শাস্তি দেয়া হত না কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবর্তী ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। আমি ভালোবাসা পাইনি কিন্তু একটা অন্তরংগ আর নিবিড় প্রতিশ্রুতির আবহে বেড়ে উঠেছিলাম।
আমরা থাকতাম ডিকেন্সে, দক্ষিণ লস এঞ্জেলসের একেবারে প্রান্তিক একটা মহল্লায়। শুনতে খারাপ লাগলেও, সত্যি হলো আমি বেড়ে উঠেছিলাম শহরের ভেতর একটা ফার্মে। ডিকেন্সের গোড়াপত্তন হয় ১৮৬৪ সালে। আরভিন বাদ দিলে, এটা ক্যালিকফোর্নিয়ার অন্যান্য শহরের মতইÑ যা কুৎসিত, অপদার্থ, স্থূলকায় সাদা রিপাবলিকানদের সুতিকাগার। চিহুয়াহুয়া আর পুর্ব এশিয়ার উদ্বাস্তুরা যারা তাদের পছন্দ করত তারা এখানে একটা ভূস্বামী সম্প্রদায় গড়ে তুলেছিল। শহরের মূল সনদ অনুযায়ী ডিকেন্স চীনা, স্প্যানিশ, ফরাসী, লালচুলওয়ালা শহুরে লোকেরা কথ্যভাষা আর অদক্ষ ইহুদীমুক্ত থাকবে। যাইহোক, প্রতিষ্ঠাতা লোকজন তাদের সীমিতজ্ঞানের পরিধিতেই আবাসিক কৃষিকাজের জন্য ৫০০ একরব্যাপী খাল তৈরী করে দিয়েছিল। এতে করে আমার আশপাশের ১০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছিল বিশাল খামার।
ফুটপাথ ধরে এগিয়ে খামারে ঢুকলেই বাতাসে ভেসে আসতো গোবর সারের তীব্র কটু গন্ধ। এখানে আপনার গাড়ি, প্রগতিশীল ভোটিং রেকর্ড বা সামাজিক অবস্থান কোনোকিছুরই পাত্তা নেই, সবই বাতাসে উবে যেতে বাধ্য। আর বাতাস আপনার অনুকূলে থাকলে আপনাকে নিয়ে যেতে পারে মারিজুয়ানার মায়াবী জগতে। রাস্তাগুলো বিচিত্র সব পাখিতে ঠাসা। মুরগী থেকে ময়ূরÑ কী নেই এখানে! এর মাঝেই জীর্ণ মলিন সাইকেল নিয়ে লোকজনের যাওয়া আসা চলতো। কেউবা হাত ছেড়ে দিয়েই সাইকেল চালিয়ে যেতো ছোটখাটো কোন প্রাপ্য রসিদের হিসাব করতে করতে কিংবা কেউবা মুখ উঁচিয়ে কারো সাথে কুশল শুধোতে শুধোতে। সামনের উঠোনের গাছ আর বেড়ার সাথে ঝুলিয়ে রাখা মালবাহী গাড়ির চাকাগুলো যেন বিশেষ ঢঙের আবাসন ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে। বাড়িগুলোর জানালা, প্রবেশপথ, প্রহরা আর দরজার বিচিত্র সব খিল আর কুলুপ আপনাকে মনে করিয়ে দেবে কারাগারের কথা। শীর্ণকায় বুড়ো আর বাচ্চাগুলো বারান্দায় সারাক্ষন অলস বসে থাকে কিছু ঘটার অপেক্ষায়।
আমার বাবা, যাকে আমি বিশ বছর ধরে জানি, তিনি ছিলেন একটি কমিউনিটি কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অন্তর্বর্তীকালীন ডীন। জনৈক আস্তাবল রক্ষকের ছেলে হিসেবে বাবা বেড়ে উঠেছিলেন কেন্টাকির লেক্সিংটনের একটা ছোট্ট ঘোড়ার খামারে। তাই কৃষিকাজের ব্যাপারে তিনি ছিলেন কিছুটা নস্টালজিক। শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়ে ওয়েস্ট ছেড়ে আসার পর কালোদের মহল্লায় থাকা আর ঘোড়ার লালনপালন করা তার জন্য ছিল একটা মহা আনন্দের বিষয়। যদিও বন্ধক বা সংরক্ষণ করার মত সামর্থ তার কস্মিনকালেও ছিলো না।
তার হৃদয় জুড়ে ছিলো কালোমানুষের মুক্তির ভাবনা। কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কিংবা পশুপালন নিয়ে মাথা ঘামাতেন তিনি কম। তুলনামূলক মনোবিজ্ঞানী হলে হয়তোবা কিছু ঘোড়া আর গরু ৩ বছর পার করত, হয়তোবা টমেটোগুলোতে আরও কম পোকা ধরত। আর মানসিক স্বাধীনতার সন্ধানে আমি ছিলাম তার আন্না ফ্রয়েড, তার ছোট্ট একটা কেস স্টাডি। আমাকে তিনি ঘোড়ায় চড়া শেখাননি। আসলে এটা ছিল আমার সাথে একটা সামাজিক পরীক্ষণ যেখানে আমিই নিয়ন্ত্রিত দল আবার আমিই পরীক্ষামূলক দল। কালোদের সেকেলে ভাগ্যবান শিশুদের মত শৈশব আমার ছিলো না। আমার বেড়ে ওঠা ছিল বিচ্ছিরি ধরনের, যা কখনোই মুছে ফেলা যাবে না। চলবে...
(অংশবিশেষ)