রক্ষণশীল অনুদার একটি কূপম-ূক সমাজের জেগে উঠবার দিনগুলোয় অনেকটা ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন শিল্পের রাঙা এই রাজকন্যা। এ সমাজে তাঁর উপস্থিতি ছিল স্বল্পকালীন; তবু এরই মধ্যে যে অনপনেয় শিল্প-স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাতেই পরিণত হয়েছেন মিথে। যদিও সেটা ছিল তাঁর নিজেরও তৈরি হওয়ার সময়, যাচাই-বাছাই গ্রহণ বর্জন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে শিল্পযাত্রার সূচনাকাল। নভেরা আহমেদের শিল্পচর্চায় সে সময় পাশ্চাত্যের শিল্পশিক্ষা আত্মশক্তি যুগিয়েছে; বিশ্বখ্যাত ভাস্কর হেনরি মুর প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এর আগে শিল্পের জন্য এমন একরোখা ও শতভাগ নিবেদিত শিল্পীকে পায়নি এ সমাজ। শিল্পসুখ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নভেরার কাছে তখন বেঁচে থাকার মানেই হলো শিল্প সৃষ্টি করে যাওয়া এবং সে জন্য ‘সুদূর চীন’ পর্যন্ত সফরের সেই বহুকথিত নীতিটিকে শিরোধার্য করা। তা না হলে বুদ্ধ মূর্তির দর্শনে তিনি মিয়ানমার যাবেন কেন? আর ভাস্কর্যের ফিগারের দেহভঙ্গি সৃষ্টিতে প্রয়োজন হবে বলে উদয়শঙ্করের কাছে ভরতনাট্যম শেখার জন্য ভারতেই বা যাবেন কেন! তবে বড় অভিমানিনী ওই শিল্পীসত্তা বার বার আহত হয়েছে। ছেনি-বাটালি-হাতুড়ি দিয়ে যে-ভাস্কর প্রেমেশ্রমে সৃষ্টি করে চলেছিলেন একের পর এক আধুনিক শিল্পকর্ম, অপরদিকে তাঁর নিজের অবয়বের ওপরেই চলছিল অদৃশ্য ছেনি-বাটালি-হাতুড়ির অশিল্প অসুর অপঘাত। কী নিদারুণ ট্র্যাজেডি। স্বদেশ হারিয়ে ফেলল সেই অসামান্যা ভাস্কর্যশিল্পীকে। ক্রমান্বয়ে তাঁর স্মৃতির ওপর ধুলো জমতে শুরু করল, সিমেন্ট ও পাথরে তা সমাহিত হতেও সময় লাগল না! কিন্তু নভেরা মানে যে নবজন্ম! তপ্ত বাতাস আর আলোর ভেতর তীব্র উজ্জ্বল ফুল ফোটানো মে মাসের এক সন্ধ্যায় তাঁর প্রস্থানের সংবাদটি তাঁরই সৃজনভূমি এই বাংলাদেশে এসে পৌঁছানোর পর প্রতিদিনই যেন তাঁর নবজন্ম ঘটে চলেছে।
গত এক সপ্তাহ যেন আমাদের আচ্ছন্নতার ভেতর দিন যাচ্ছে। এমন এমন সব সত্য তথ্য আমাদের সামনে এসে আছড়ে পড়ছে যে আমাদের অপরাধবোধ কাটছে না। বুধবার এ সামান্য লেখাটি লিখবার সময় একেবারে নতুন দুটি তথ্য পেলাম যা থেকে আরও নিশ্চিত হওয়া চলে যে নভেরা শিল্পকলাকেই তাঁর সংসার হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মুক্ত মানুষ ছিলেন বলেই পরাধীনতার প্রসারিত শেকলকে শক্ত হাতে সরাতে সময় লাগেনি। একেবারে প্রথম জীবনে পিতার পীড়াপিড়িতে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও যখন শাশুড়ি এসে বললেন মাথায় কাপড় দিয়ে চলতে হবে, সে মুহূর্তে বিয়ে ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলেন। ষাটের দশকের শুরুর দিকে ফ্রান্সে যাওয়ার আগে করাচিতে মামার বাসায় অবস্থানকালে পাণিপ্রার্থীদের ভিড় লেগেছিল। নভেরার মামাতো ভাই জাহিদ সারওয়ার নিজাম জানাচ্ছেন কীভাবে নভেরা পাত্রপক্ষদের এড়াতেন। পঞ্চাশের দশকের একেবারে শেষের দিকে ঢাকার ইন্দিরা রোডে বসবাসকারী রক্ষণশীল পরিবারের এক মধ্যবয়সী অনাত্মীয় ভদ্রমহিলা নভেরাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। নিজের কাছে তিনি নভেরাকে এনে রেখেছিলেন, পরে তাঁর বাসা ভাড়া নিয়েও কিছুকাল বাস করেন নভেরা। ভদ্রমহিলা তাঁর মেজ ছেলের জন্য পাত্রী হিসেবে নভেরাকে চেয়েছিলেন। নিজের একটি শারীরিক সীমাবদ্ধতার কথা বলে নভেরা জানিয়েছিলেন ঘরসংসার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের অনুমান করতে এতটুকু অসুবিধে হয় না যে নিজের প্রতি সৎ নভেরা স্পষ্ট করে জেনে গিয়েছিলেন শিল্পের সঙ্গেই তাঁর বিবাহ হয়ে গেছে, শিল্পযাপনই তাঁর সংসার যাপন।
১৯৫৬ সালের মধ্যভাগ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত নভেরা দেশে ছিলেন এবং এই পাঁচ-ছয় বছরে তিনি যে কাজ করেছেন তা একজন শিল্পীর প্রস্তুতি পর্বের কাজ হিসেবেই ধরা যায়। একজন শিল্পীকে শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য এ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু নভেরা তাঁর প্রথম জীবনের কাজ দিয়েই আমাদের কাছে পরিচিত। ইউরোপের আধুনিক ভাবধারার সঙ্গে তিনি দেশীয় বিষয় ও টেকনিকের সাহায্য মিলিয়ে কাজ করেছিলেন। ইউরোপে ব্রোঞ্জ ও অন্যান্য ধাতু দিয়ে যে কাজ হচ্ছিল আমাদের দেশে তখন তা সম্ভব ছিল না। নভেরা লোহার রডের আরমেকার বা খাঁচা তৈরি করে তার ওপর সুড়কি ও সিমেন্ট ব্যবহার করেছেন আর কাঠের কাজও কিছু করেছেন।
২.
ঢাকায় নভেরার যে ভাস্কর্যগুলো সহজেই দর্শনযোগ্য তার ভেতরে রয়েছে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনের প্রাঙ্গণে মানুষ ও গরুর সহাবস্থান। তৎকালীন গ্রামীণ সমাজের একটি অতিচেনা দৃশ্য। এই একটি ভাস্কর্যের টেকনিক দেখেই বিবেচনা করা যায় ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগে অনগ্রসর একটি শিল্পপরিসরে নভেরা কী আধুনিক ভাস্কর্য-ভাষাই না প্রয়োগ করে গেছেন। নভেরার জীবন ও শিল্পকর্ম সম্পর্কে গুটিকতক নিরন্তর সন্ধানীদের ভেতর আছেন শিল্প সমালোচক মেহবুব আহমেদ। তাঁর কাছ থেকে নভেরার এই আধুনিকতার চমৎকার ভাষ্য মেলে। তিনি বলছেন, ‘এ কাজটিতে মানুষ ও গরুর পা এবং শরীর একীভূত হয়ে গেছে। এভাবেই গরুর ও মানুষ উভয়ের ওপর উভয়ের নির্ভরশীলতা বোঝানো হয়েছে। ভাস্কর্যটির কিছু কিছু অংশ বৃত্তাকারে কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। ক্লোজড ফর্মের কিছু কিছু অংশ বিভিন্ন আকারে কেটে বাদ দেয়ার কাজটি বারবারা হেপওয়ার্থ প্রথম করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই হেনরি মুর এই রীতি গ্রহণ করেছেন এবং পরবর্তী বহু ভাস্কর্যেই এর ব্যবহার দেখা গেছে। হেপওয়ার্থ বলেছেন, কাজটি প্রথম করার পর গভীর এক আনন্দ অনুভূত হয়েছিল তাঁর। একটি ক্লোজড ফর্ম পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে জায়গা দখল করে রাখে, আলাদা হয়ে থাকে এর উপস্থিতি। গ্রিক কলামগুলো যদি দেখিÑ স্পেস খালি রেখেই সেগুলো নির্মাণ করা হয়েছে এবং সৌন্দর্যটা ওখানেই। কলামগুলো বা ফর্মগুলো ঠিক খোলা স্পেসের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কলাম ও তার মধ্যেকার খোলা স্পেস বিরতিহীন ফর্ম তৈরি করেছেÑ দুয়ে মিলে সম্পূর্ণ। এই বিষয়টি নভেরাকে নিশ্চয়ই নাড়া দিয়েছিল। কারণ অনেক কাজেই তিনি হোল তৈরি করেছেন।’
জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে উঠতে পারেন কয়জন? তাঁকে নিয়ে জীবনী উপন্যাস রচিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র। শিল্পীজীবনের উন্মেষপর্বে, ১৯৬১ সালে, ভাস্কর হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি; পরে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। নভেরার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৬০ সালে, কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে। ‘ইনার গেজ’ শিরোনামের ওই প্রদর্শনীটি কেবল নভেরারই নয়, তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানেই ছিল কোন ভাস্করের প্রথম একক প্রদর্শনী। শিল্পস্রষ্টা হিসেবে নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের থেকে অগ্রবর্তী। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের বাংলাদেশে একজন নারীর শিল্পী হয়ে ওঠা ছিল কঠিন ও বিরুদ্ধ এক যাত্রা। সে সময়টায় নভেরা বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় এনে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মান। একে বিপ্লব বলাই সঙ্গত হবে। ভাস্কর্যশিল্পে তাঁর শিক্ষাটা ছিল আন্তর্জাতিক। আধুনিক শিল্পকলার তীর্থস্থান লন্ডন, ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে ভাস্কর্য বিষয়ে শিক্ষা নেন নভেরা। শুধু বাংলাদেশেই প্রথম ভাস্কর্য প্রদর্শনীটি হয়েছিল তাঁর সৃজিত ভাস্কর্য দিয়ে এমন নয়, ১৯৭০ সালের অক্টোবরে নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যের প্রদর্শনীটি ছিল ব্যাংককে ধাতব ভাস্কর্যের প্রথম মুক্তাঙ্গন প্রদর্শনী। তাঁর তৃতীয় একক প্রদর্শনী হয় প্যারিসে, ১৯৭৩ সালে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে প্যারিসে তাঁর পূর্বাপর কাজের একশ’ দিনব্যাপী একটি প্রদর্শনী হয়। প্রায় চার দশক তাঁর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হয়নি। এ থেকে বোঝা যায় নিঃসঙ্গ নির্জন বাস তাঁর জন্য ছিল শিল্প-খরার কাল। স্বদেশ ও স্বজাতির সঙ্গে সম্পর্ক ও সংযোগ ছাড়া কেবল অভিমান ভরা একাকিত্ব শিল্পসৃষ্টির জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। একইভাবে উপেক্ষায় অনাদরে শিল্পীকে দূরে ঠেলে দিলে তাও সুখকর হয় না। নভেরার জীবন বাস্তবতা থেকে তাই স্বাধীনচেতা শিল্পীদের নিশ্চয়ই কিছু শেখার আছে।
উপসংহারে একটি কবিতার কয়েকটি চরণ তুলে দিতে চাই। এটি কবি সাইয়িদ আতীকুল্লাহর লেখা। দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। নভেরার প্রতি মমতা ঝরে পড়েছে এ কয়টি পঙ্ক্তিতে:
কী অভিমানিনী সে আসে না কোনদিন শহীদ মিনারে-
শহীদ মিনার কী করুণ ডাকে সেই নভেরাকে
কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বার বার কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বার বার...
শহীদ মিনারের সাথে নভেরার কী সম্পর্ক, কেন সে মিনার কিংবা বলতে পারি দেশমাতৃকা আপন কোলে ডাকে বার বার তাঁর এই অভিমানী সন্তানকে, কী সে অভিমান- একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করে যায় এই কবিতা। শহীদ মিনার এখন বাঙালীর চিরন্তন শিল্পরূপ হয়ে বিরাজমান ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে। এক অর্থে বলতে পারি নভেরারই শিল্প-অস্তিত্বের গভীর এক নমুনা সহস্রধারায় প্রাণবন্ত হয়ে আছে সমগ্র বাংলায়।
আরেকটি কথা, অবশ্যই নভেরার জীবনসঙ্গী গ্রেগোয়া দ্য ব্রন্সের প্রতি আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। তাঁর কাছেই আমাদের অভিমানী রাজকন্যা পেয়েছিল পরম নির্ভরতা। পরিণত পর্যায়ে নভেরার শিল্পসাধনা নিয়ে তাঁর চেয়ে আর ভালো কেউ তো জানে না! আমাদের জাতীয় স্বার্থেই এই মানুষটির কাছ থেকে বহু কিছু জানার আছে। যে নভেরাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম সেই অন্তরালবাসিনী নিবিষ্ট শিল্পসাধকের প্রায় অর্ধেক জীবনের পার্শ্ববর্তী স্বজন হিসেবে এই মানুষটি নিশ্চয়ই নভেরার এমন আরও ভাস্বর ভাস্কর্যের সন্ধান দিতে পারবেন যেগুলো তাঁর নিজের দেশ সংগ্রহ ও সংরক্ষণে সমর্থ হবে। আগামী দিনের ভাস্করদের কাছে যা হয়ে উঠবে প্রেমময় প্রেরণার।
-মারুফ রায়হান
কৃতজ্ঞতা : মেহবুব আহমেদ ও রেজাউল করিম সুমন