করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





রাতকাহিনী
হামিদ কায়সার
আমাদের কানে খবরটা যে-কোন ভাবে হোক চলে আসে। আমরা, মানে লরার মা, ওর ভাই, ভাবী এবং আমি; আমি লরার কে সে পরিচয়টা না হয় পরেই দেওয়া যাবে, তবে এটুকু বলে রাখি আমি ওর রক্ত-সম্পর্কের কেউ না হলেও, ওর সবচেয়ে আপন এবং সবচেয়ে কাছেরÑ যে ওকে বুঝি বা ওর মনের অনেক গভীরে পৌঁছাতে পেরেছি! তো আমরা অবাক হয়ে শুনি যে লরা না-কি লন্ডন থেকে স্বামী-সংসার বাচ্চা সব ফেলে এক কাপড়ে এখন ঢাকায়। সেটা আসতেই পারে। বিদেশবিভূই অনেকেরই ভালো লাগে না। হোমসিক কাজ করে। হয়তো ঢাকার রোদ ঝলমলে দুনিয়ার বদলে লন্ডনের প্যানপ্যানানি মার্কা বৃষ্টিভেজা প্রকৃতিই কাল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আমাদের জন্য ব্যাপারটি রীতিমতো অস্বস্তিকর এই কারণে, লরা চলে এসেছে এক উঠতি শিল্পপতির হাত ধরে। শিল্পপতির পরিচয় যদি শুধু সেটাই হতো মেনে নেওয়া যেত, কিন্তু ছেলেটা তারচেয়ে বহুগুণে খ্যাতিমান একজন প্লেবয় হিসেবে। যেমন হ্যান্ডসাম তেমনই স্মার্ট- অর্থের প্রভাবতো রয়েছেই- কোনো মেয়েকে চোখে ধরলে, বাগে আনতে সময় লাগে না। ছুঁড়ে ফেলতে সময় লাগে আরো কম, শরীরের মোহ কেটে গেলেই হলো!  
আমরা স্বাভাবিকভাবেই আতংকিত বোধ করি, লরার জীবনটা শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে? লন্ডনে স্বামীর কাছে কখনো কি ও ফিরে যেতে পারবে? না, ফেরার মুখ আছে ওর? আর ঢাকাকে ঘিরেই যদি নতুনভাবে জীবন শুরু করতে চায়- এই ঘটনার প্রভাবটা ও ঠিক কিভাবে সামলে উঠবে? আমরা ওর জন্য ভেতরে ভেতরে এসব ভাবনায় বিহ্বল হই, আবার পাত্তাও দিতে চাই না ব্যাপারটাকে। পোড়ারমুখী নিজের জীবন নিয়ে ট্রিটমেন্ট করছে, সেখানে আমরা কোন ছার! বিশেষ করে, আমি তো ওর আপন বা রক্তের সম্পর্কের কেউ নই। নেহাৎ পাতানো ভাই। আমার এত মাথাব্যাথা কেনো ওর জন্য? নিজের মায়ের পেটের বোন হলে না হয়, যেখানেই থাক না কেনো, যে চুলোয়, টেনে এনে বের করে বুড়িগঙ্গার জলে টুকরো করে ভাসিয়ে দিতাম!
কিন্তু নিস্পৃৃহ থাকতে চাইলেই কি আর থাকা যায়। আমি যে লরার জীবনের সঙ্গে এক সময় ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম। শিল্পকলা একাডেমিতে আমি বাজাতাম তবলা আর ও নাচতো দেশের নাচ! এইভাবে একসঙ্গে তালসঙ্গত করতে করতে কবে যে একজনের প্রতি আরেকজন গভীরভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম, তা নিজেরাই বলতে পারবো না। অবশ্য আমাদের এই সম্পর্ক বাস্তবতার কাছে হার মেনেছিল, কারণ লরা মুসলমান হলেও আমি যে জাতে কায়স্থ। কোনো পরিবারই আমাদের দুজনের সম্পর্ককে সহজভাবে মেনে নিতো না, আবার সবার মতামত অগ্রাহ্য করে আমরা যে নিজেদের মতো জীবনের বন্ধনে আবদ্ধ হবো তেমন শক্তি বা সাহস কোনটাই আমাদের ছিল না। অথচ একজন আরেকজনকে ছেড়েও থাকতে পারছিলাম না। অগত্যা, আমরা জ্ঞানতই ভাইবোনের সম্পর্ক গড়ে তুলি এবং সে-সম্পর্ক যে কবে কখন গভীরতা ছাড়িয়ে আরো কোন্ গভীরে পৌঁছে গিয়েছিল, আমরা নিজেরাও বলতে পারব না। এবং কবে কখন যে আমিই হয়ে উঠেছিলাম ওর সবচেয়ে বড় অভিভাবক, সেটাও জানা নেই। সম্পূর্ণ লোভলালসা কামনাবাসনার উর্ধ্বে সে সম্পর্ক! সঙ্গত কারণেই আমার কাঁধেই যে সব ঝামেলা এসে চেপে বসবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এক গভীর রাতে বাসার কলিং বেলটা একটু অস্বাভাবিকভাবেই বেজে উঠল। দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি বাক্সপেটরা হাতে দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লরার স্বামী ইরফান। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে এসে সোজা আমার বাসায় উঠেছে। ওর চেহারা দেখেই যা বোঝার বুঝে গেলাম। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চোখজোড়া লাল। চোখ-গাল বসে গেছে নিচে। একটু থিতু হয়েই প্রায় আমার পায়ে ধরার অবস্থা, ‘ভাইয়া! যে করেই হোক আমার লরাকে আপনি আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। ওকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তও বাঁচব না।’
ভারী অবাক হলাম ওর দিকে তাকিয়ে। এ কি বিংশ শতাব্দীর কোনো যুবা? তাও আবার লন্ডনের মতো জায়গায় থাকে? যে স্ত্রী ওকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে এলো- না বলে না কয়ে কোন এক লাফাঙা পুরুষের হাত ধরে, সেই স্ত্রীকে ফিরে পেতে কেনো ওর এত ব্যাকুলতা? কাপুরুষতা ছাড়া একে আর কি বলবো? ধমকে ওঠলাম, ‘অমন মেয়ের মুখে ঝাটা মারো মিয়া! ভালো মেয়ের অভাব আছে? তোমার একটা ছয় বছরের বাচ্চা আছে না! ওর জন্য একটা মা খুঁজো!’
জিভ কাটল ইরফান। ‘ভাইয়া! ও ভুল করেছে বলে কি আমিও ভুল করব? আমার মেয়েটা ওকে ঠিকই ভুলতে পেরেছে। কিন্তু আমি পারছি না। কেমন করে পারবো ভাইয়া, আপনি তো সবই জানেন! আপনার জন্যই তো আমি ওকে পেয়েছিলাম।’ ‘আমি একটা পাপ করেছিলাম ইরফান। তোমার মতো ভালো ছেলের কাছে ওকে বিয়ে দিয়ে!’ ‘এ-কথা বলবেন না ভাইয়া! আই অ্যাম ভেরি গ্রেটফুল টু ইউ! লরাকে বিয়ে করে আমি ঠকিনি। বিশ্বাস করুন ভাইয়া, ও আমাকে অনেক দিয়েছে। শুধু এ-ভুলটা যে কেন করল? বাট, আমি ওকে কোনভাবেই হারাতে চাই না। আপনার জন্যই ওকে একদিন পেয়েছিলাম, আপনার কাছেই তাই আজ এতদূর থেকে ছুটে এসেছি। ভাইয়া আমার বিশ্বাস আপনিই ওকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন! আপনার কথা ও কখনোই ফেলে না!’
আমি ইরফানের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। ছেলেটা কোন গ্রহের মানুষ? ওর মনে কি রাগ ঘেন্না কিছুই নেই? সম্ভবত নেই। আমি ওর চোখের ভঙ্গির মাঝে আট-নয় বছর আগে লরার জন্য যে গভীর ভালোবাসা দেখেছিলাম, অবিকল সে বোধটাই দেখলাম জেগে রয়েছে, সঙ্গে ভাংচুরের আভাসও। সেখানে সামান্য ক্রোধ কিংবা প্রতিহিংসা বা শঠতার ছায়া পর্যন্ত নেই। ‘এই যে পরপুরুষের সঙ্গে চলে এসেছে। রাতের পর রাত এক বিছানায় কাটাচ্ছে। তারপরও তুমি কি ফিরিয়ে নেবে? মানিয়ে নিতে পারবে?’ বড় দৃঢ়চেতা মনে হলো ইরফানকে, ‘ও আমার পাশে শুধু থাকলেই হলো ভাইয়া। আমি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারব। ও কি করেছে না করেছে- এসব নিয়ে কোনদিন ওকে কোনো প্রশ্ন পর্যন্ত করব না। আপনি শিওর থাকতে পারেন।’
মনে মনে একটু ক্ষুন্নই হই। এ-তোমার কি ধরনের অন্ধপ্রেম হে যুবক? এ-বিষয়ে তুমি তোমার বউকে কোনদিন কোন প্রশ্ন পর্যন্ত করবে না! আমি হলে কি কখনো মেনে নিতে পারতাম? কখনোই না। তা সত্ত্বেও ওর এই অন্ধ-ভালোবাসা দেখে আমার মনের সুক্ষè কোণে কোথায় যেন ছিটেফোটা লুকিয়ে থাকা মমতাটুকু জেগে ওঠলো। মনে মনে বললাম, তুমি যেহেতু সত্যিই ওকে ভালোবাসো। দেখি তোমার জন্য কী করা যায়। আমি ওকে আপাতত রেস্ট নিতে বলি। বলি যে, ‘ভালো করে ঘুম দাও।’ ও অসহায়ের মতো বলল, ‘লরা চলে আসার পর থেকে ঘুম কী জিনিস ভাইয়া, আমি জানি না। আপনি যদি সত্যিই আমার চোখে ঘুম দেখতে চান, লরাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এনে দিন। আমি ওকে লন্ডনে ফিরিয়ে নিতে চাই।’ আমি ওর আকুতির কাছে হার মানলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই লরার কাছে যাব। দরকার হলে কালই দেখা করব। ছুটিয়ে দেব ওর রাধাগিরি। আপাতত ইরফানের দেখভালের দায়িত্ব দিলাম ওর বৌদীকে। বেচারা আমার সাত বছরের বাচ্চার স্কুল লেখাপড়া নিয়ে ত্রিশংকু অবস্থায় থাকে, এরমধ্যে আবার জুটলো নতুন আপদ!

২.
আমরাÑ না, আমরা বললে ভুল হবে, লরার মা-ভাই সবাই ওর প্রতি তীব্র ঘৃণায় এ ব্যাপারে নাক গলাতে সামান্যও আগ্রহ দেখালো না, ওদের এক কথা, এমন মেয়ের পরিচয় দিতেও ওদের রুচিতে বাঁধছে! কিন্তু ইরফানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। কীভাবে সেই উঠতি প্রভাবশালী শিল্পপতির কাছ থেকে লরাকে উদ্ধার করে ইরফানের কাছে ফিরিয়ে আনবো! সারাক্ষণ সেই ভাবনাতেই ভেতরে ভেতরে পুড়তে লাগলাম। এই অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পেছনেও হয়তো সূক্ষè কোনো কারণ থাকলেও থাকতে পারে। কারণ, আমি আমার যৌবনকে ঠকিয়ে বঞ্চিত রেখে লরার সঙ্গে ভাইবোনের পবিত্র সম্পর্ক রক্ষা করেছি! কখনো ওর দিকে কুদৃষ্টিতে তো তাকায়ইনি, মনকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয়ও দিইনি। অথচ সুযোগ কি কম এসেছিল! আমরা দুজন একা একা কক্সবাজার-কলকাতা-দার্জিলিং বেড়াতে চলে গিয়েছি যখন তখন। ভাইয়ের সঙ্গে বোন যাচ্ছে, ব্যাপারটাকে সবাই সুন্দর দৃষ্টিতেই দেখেছে। আমরা নিজেরাও সবার সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছি। লরার মুখে দিকে তাকালেই আমার সব লোভ মোহ উঠে যেত মন থেকে। এমন পবিত্র শুচিতাকে গোলাপের মতো গাছে রাখলেই মানায়। হাত বাড়ালেই যে পাপড়ি খসে যাবে! খচখচে কাটার মতো মনে পড়তে লাগলো দার্জিলিং-এর কথা। দার্জিলিংয়ে আমরা এক বেডে ঘুমিয়েছি। লরা আমার বুকে মাথা রেখে জানালা দিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা কাঞ্চনজংঘার দিকে তাকিয়ে থেকেছে! আমার কি তখন সামান্যও ওকে ভোগের জন্য শরীরটা জাগ দিয়ে উঠেনি? যদি বলি উঠেনি, নিজের সঙ্গে নিজের চরম মিথ্যা বলা হবে! টয়লেটে ঢুকে নিজের রিপু দমন করে এসেছি! আমার সেইসব ত্যাগ আদর্শগিরির জন্য নিজেকে এখন বোকচোদ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি একটা আবাল! কার জন্য আমি আমার যৌবনকে বঞ্চিত রেখেছিলাম! যে এক লম্পটের সঙ্গে নিঃসংকোচে হাত ধরে চলে আসতে পারে আট বছরের সংসার আর ছয় বছরের বাচ্চা ফেলে! আমি তাকে এক বেডে পেয়েও কুপাই নি? ইরফানের দিকে তাকিয়ে ওকে সান্ত¦না দেব কী, উলটো এই এতদিনে লরাকে পাওয়ার একটা উদগ্র বাসনায় দংশিত হতে লাগলাম। মনে মনে স্থির প্রতিজ্ঞা করলাম, যদি ওকে উঠতি শিল্পপতির কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারি, আমিও আমার অতীতের যত ভালোমানুষির ভন্ডামি দেখানো হয়েছে, তা চড়ায় গ-ায় উশুল করে নেব! ওদিকে ইরফানের ব্যাকুলতা আর হা হতোস্মি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে! ওর মুখের দিকে ভালো করে তাকানোই যায় না। এ-যুগেও যে কারোর জন্য কারোর মনে এতটা ছায়া পড়ে, এতটা প্রভাত হয়, রোদ ওঠে, দিন যায় বৃষ্টি আসে, জল পড়ে পাতা নড়েÑ ওকে না দেখলে ঠিক বিশ্বাস করা কঠিন হতো। লরাকে ফিরে না পেলে বেচারা বোধহয় মারাই যাবে। সারাদিন চুপচাপ ঘরে শুয়ে থাকে। কিছু খেতেটেতে চায় না। লন্ডনে বাচ্চাটার কী অবস্থা সেদিকেও খেয়াল নেই। এভাবে দিন গেলে যে ইরফান আর ওর বাচ্চার অবস্থা দিন দিন আরো সঙ্গীণ হয়ে যাবে আর উলটো, লরা পরিণত হবে বাজারের সেরা রা-িতে- এসব ভেবে ভেবে আমি, লরা আর সেই উঠতি শিল্পপতি দারাউস মীর্জাকে খুঁজতে সিরিয়াস হয়ে উঠলাম। নানামুখে শুনলামই শুধু, ওরা গুলশানের দিকে কোন একটা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকে। কিন্তু কোনভাবেই সেই ঠিকানাটা ট্রেস করতে পারলাম না। তবে মীর্জার অফিসের খোঁজটা সহজেই মিলল। মিলল না শুধু মীর্জার সঙ্গে দেখা করার কোনো সুযোগ অথবা সোর্স। বোধহয় নিজের যে অনেক শত্রু আছে, সে সম্পর্কে মীর্জা ভালোই ওয়াকিবহাল, তাই সহজে ও অপরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা করে না। দেখা করতে হলে পিএস-এর কাছে দেখা করার কারণ উদ্দেশ্য সব ব্যাখ্যা করতে হয়। বলার অপেক্ষা রাখে যে, আমরা সে পরীক্ষায় হেরে গিয়েছি! বিশেষ করে ইরফানের কারণে, ও মুখে কিছু বলেনি বটে, তবে ওর হাবভাব ব্যাকুলতা দেখে কেসটা যে কী, সম্ভবত পিএস ব্যাটার বুঝতে দেরি হয়নি। আরো পরে বুঝেছি, সিসি ক্যামেরা দিয়ে কে বা কারা মীর্জার সঙ্গে দেখা করতে এলো না এলো, তা দেখার ব্যবস্থা ও করে রেখেছে! কিন্তু আমিও সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নই। একদিন সব দ্বিধা ঝেড়ে আমাদের অফিসের পিআরও হারুন রশিদ ভাইয়ের কাছে সব কথা খুলে বললাম। ও আচ্ছা, আমার পরিচয়টা এখনো বিশদ দেওয়া হয়নি। আমি একটি অ্যাড ফার্মে একজন সিনিয়র ভিজুয়ালাইজার হিসেবে কাজ করি! শুধু তবলা বাজিয়ে এদেশে কি চলবার উপায় আছে! মাঝে মধ্যে বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে খ্যাপ মারার সুযোগ পাই। সেটা আমার বাড়তি রোজগার। যাহোক, পিআরও হারুন রশিদ ভাই সবকিছু মন দিয়ে শুনেটুনে একেবারে নিরাশ করলেন না। বললেন যে, ভেরি টাফ। মীর্জার ওখান থেকে লরাকে বের করে আনা সো টাফ বস। তবু আমি দেখছি আপনার জন্য কী করা যায়!
আমি পিআরও হারুন রশিদের ওইটুকু কথাতেই আশ্বস্ত বোধ করি। কারণ, ওর শিকড়ও অনেক গভিরে। ঢাকা ক্লাব, গলফ ক্লাব, গুলশান ক্লাবসহ ঢাকা এবং চিটাগাংয়ের এমন কোনো বার নেই, যেখানে ও যায় না। অবশেষে দিন তিনেক পর, পিআরও হারুন রশিদ আমাকে একটা গ্রিন সিগন্যাল দেয়। বলে যে, আজ সন্ধ্যার পর কুরিয়ানায় থাকবা। বিশ ত্রিশ হাজার টাকার মতো বিল উঠতে পারে। রেডি হয়ে যেয়ো। বান্টি ভাইয়ের সঙ্গে বসবো আমরা।
বান্টি ভাই! আমি অবাক হয়ে তার সম্পর্কে জানতে চাইলাম! বান্টি ভাইটা আবার কে? দারাউস মীর্জার মাগি সাপ্লায়ার। আরেকটা ভদ্র পরিচয় আছে। সেটা তোমার জানার দরকার নাই। দারাউস মীর্জার রুমে ঢুকতে ওর কোনো পারমিশন লাগে না। এতগুলো টাকা একসঙ্গে মদের জলে ভেসে যাবে! আমি ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। পরমুহূর্তেই, ইরফানের কথা মনে করে সব উদ্বিগ্নতা কেটে গেলে আমার। ও এসেছে ওর বউকে উদ্ধার করতে, টাকা তো ওইই দেবে! আমার এতো টেনশন কিসের! আমি শুধু একবার লরাকে মুখোমুখি পেলেই হলো, ওর চোখে চোখ রেখে শুধু জিগ্যেস করবো, আমাকে তুই ঠকিয়েছিস কেনো? হ্যা?

৩.

কুরিয়ানায় বান্টি ভাইকে দেখে আমি শুধু অবাকই হলাম না, সন্দিহানও হলাম, এই লিকলিকে শরীরের চিকনা মানুষটার পক্ষে কীভাবে সম্ভব হবে লরাকে উদ্ধার করা! ওর তো দারাউস মীর্জার রুমে যাওয়ার এন্ট্রিই মিলার কথা না। কিন্তু সময় যত পেরুতে লাগলো, আমার অবাক হওয়া শুধু বাড়তেই থাকে। নিজের চোখের সামনেই দেখলাম কুরিয়ানাতে যত হোমরা চোমরা আসছে, সবাই বান্টি ভাইকে যেন কর দিয়ে চলে। কেউ হাত মিলিয়ে যায়, কেউ সালাম দিচ্ছে। পিআরও হারুন রশিদ ওর সামনেই গর্ব করে বললো, ওর কাছে অনেক আমলা, শিল্পপতি, কোটিপতিই ধরা আছে, বুঝতে পারছো মামা! কতো যে ক্ষমতাধর মানুষ, অরে দেখলে টের পাইবা না। মীর্জার কাছে যেতে ওর পাসপোর্ট লাগে না, ফোন করাও লাগে না। তাই না মামা?
ততক্ষণে বেশ কয়েক পেগ হয়ে গেছে বান্টির। ওর গলাও জড়িয়ে এসেছে, একটা মুরগির পিস মুখের ভেতর ঠেলে দিতে দিতে জানতে চাইল, মীর্জার কাছে কী ব্যাপার! হোয়াটস ইয়োর প্রব্লেম! ওতো ভালো ছেলে! তর তর করে উঠছে! আরেকটা স্পিনিং মিলের কাজ শুরু করেছে!
আমিও অনেকদিন পর বেশ ক’ পেগ মেরে দিয়েছি। তাই কথাটা বলতে বাঁধলো না। ইরফানকে দেখিয়ে বললাম, ওর বউ লরা। লন্ডন থেকে দারাউস মীর্জার হাত ধরে চলে এসেছে!
ওহ্্ লরা! লরার নাম শুনেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো বান্টি। আরে যা জিনিস! ফাটাফাটি মাল! আপনি তো লাকি ম্যান, হ্যা। এমন একটা মালরে বিয়া করছেন!
আলো আবছায়ায় ইরফানের চেহারাটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। জানি না বান্টির কথা শুনে ওর কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, আমি নিজের মধ্যে শুধু অনুভব করলাম, লরাকে পাওয়ার জন্য আমার ভেতরের যে সুপ্ত বন্য ইচ্ছেটা তা বান্টির কথা শুনে একটু একটু করে চাউর দিয়ে উঠছে। কিন্তু আমরা এখন এসেছি লরাকে উদ্ধারে। আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হই, আমার কন্ঠে আর্তি ঝরে পড়ে, ‘ইরফান ওকে লন্ডনে ফিরিয়ে নিতে চায়! ওর একটা মেয়ে আছে! মেয়েটা মাকে খুব মিস করছে। আপনি যদি একটু ব্যবস্থা করে দেন!
ইমপসিবল! ইমপসিবল! আমার কথা শুনেই বান্টি এই মদের ঘোরেও সোজা হয়ে বসলো, এমন হট জিনিস মীর্জা ফেরত দিবে না। ডোন্ট মাইন্ড মিস্টার ইরফান, লরা আপনার বউ হতে পারে, কিন্তু আপনি বোধহয় ওকে ঠিকমতো সার্ভিস দিতে পারেননি, নইলে ঘরের মেয়ে কেনো পরের হাত ধরে চলে আসবে! হ্যা?
যেন সব দোষ আর দায়িত্ব ইরফানের। ও সেই দায় নিয়েই যেন মদের গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে ধরে পাথরমূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে রইল।
পিআরও হারুন রশিদ এবার সিরিয়াস গলায় বললেন, বান্টি! আপনি একবার চেষ্টা করে দেখেন না! আমার মনে হয় কাজ হবে!
মনে হয় না কাজ হবে! লরাকে তো আমি দেখেছি। কী যে হট! আগুন আগুন। এমন জিনিস কেউ ছাড়ে!
মদের নেশার ঘোরেই কিনা, হঠাৎ ইরফান একটা কান্ড করে বসলো। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে বান্টির পাশে বসে ওর দু’ পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কেঁদে ফেললো, আমার লরাকে ফিরিয়ে দিন। প্লিজ! প্লিজ বান্টি ভাই! প্লিজ!
শুধু আমি কেনো, বান্টি নিজে পর্যন্ত আকস্মিক এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেল। একটু বুঝি মায়াও জন্মালো ওর মনের ভেতর। ইরফানের চুল ধরে আদরের টান টানতে টানতে বললো, ‘আচ্ছা ভাই উঠো। কালকে দিনের বেলা আমারে একটা কল দিয়ো। দেখি, তোমার জন্য কী করা যায়!’

৪.
বান্টি যে সত্যিই কাজের, পরদিনই প্রমাণ হয়ে গেল। আফটার লাঞ্চ ও আমাদেরকে যেতে বলেছিল বারিধারায়, দারাউস মীর্জার অন্য এক অফিসে। তিনটের মধ্যেই আমি অধীর হয়ে পৌঁছে গিয়েছি। আমার মনের মধ্যে তীব্র এক উত্তেজনা- কতদিন পর দেখবো লরাকে! এই লরা সেই ছিপছিপে আমার সেই পবিত্র মুখের শুচিস্মিতা লরা নয়, এ হলো বান্টির ভাষায় ফাটাফাটি জিনিস, সত্যিকার অর্থেই সেই বান্টির লরাকে দেখতেই আমার মন উন্মনা হয়ে উঠলো। বেচারা ইরফান-এর ভেতরেও প্রবল উত্তেজনা টের পাচ্ছি। কিন্তু লরার সঙ্গে আমাদের আর দেখা হয় না। আমাদেরকে নিজের অফিস কক্ষে স্বাগত জানান দারাউস মীর্জা।
আক্ষরিক অর্থেই দারাউস মীর্জা ধীরস্থির-শান্ত এবং অবশ্যই স্মার্ট। সে জানে মানুষকে কীভাবে মোহমুগ্ধ করে রাখতে হয়। কীভাবে নিয়ে যেতে হয় ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ দিয়ে নিজের অভীষ্ঠ লক্ষ্য সাধনে। পারস্পারিক কুশল বিনিময় এবং কথাবার্তা সারার পর বান্টি আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, মীর্জা। শান্তিরঞ্জন আমার খুব ক্লোজ! তোর সঙ্গে কী একটা প্রাইভেট কথা বলবে। আমি বাইরের রুমে অপেক্ষা করছি।’
‘সিওর!’ বলে সহজেই মেনে নিল মীর্জা। বান্টি রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আমার দিকে কৌতূহল ভরা চোখে তাকাল। ও ইরফানকেও দেখে নিল একবার। আমি ইচ্ছে করেই ইরফানের আসল পরিচয়টা এখনো ওকে জানাইনি। প্রয়োজন হলে জানাবো। কিন্ত, হঠাৎ কথাটা আমি কীভাবে পাড়বÑখুব অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যাই। এমন একটা বিষয়Ñ যার অবতারণা যথাযথ না হলে বিপর্যয়েরও সম্ভাবনা থাকে। অথচ না বললেও নয়। তিন তিনটা জীবনÑ ইরফান, লরা আর ওদের মেয়ে সিমকির ভবিষ্যৎ যেন নির্ভর করছে আমারই ওপর। আমি মরীয়া হয়েই হঠাৎ আমার আসল পরিচয়টা ওকে জানিয়ে দেই, ‘আমি লরার ভাই।’ দারাউস মীর্জার কৌতূহল আর প্রশ্নভরা ঠোঁটের চিলতে হাসি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে।
এক মুহূর্তর জন্য চমকে ওঠলো দারাউস মীর্জা। তারপর তাড়াতাড়িই সামলে নিল নিজেকে। ‘ও আচ্ছা। আচ্ছা।’ আমি ওর বিব্রত ভাবটা সহজেই মিলিয়ে যেতে দেখি। নিজেও স্বতস্ফূর্ত হয়ে উঠি, ‘আপন ভাই না হলেও কোনভাবেই পর নই। ওর জীবনের সব বড় বড় ডিসিশনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছি। লন্ডনে ওর অভাবে ওর মেয়েটা মরতে বসেছে। মার জন্য শুধু কান্না করছে। আমি লরাকে ফেরত চাই।’  
     চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল দারাউস মীর্জা। উঠতে উঠতে ইরফানের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, উনি! আমি ওকে আশ্বস্ত করি, অসুবিধা নাই। আমারই ক্লোজ এক ফ্রেন্ড!
    মির্জা একটা সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করতে করতে ফিরে এলো আবার নিজের চেয়ারে। শান্তভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘দেখুন। আমি লরাকে ফেরত দেবার কে? লরা যদি যেতে চায়, যাবে। আই হ্যাভ নো প্রব্লে¬ম। আমারতো কোন অসুবিধা নেই। দিস ইজ আপ টু লরা।’
    ‘প্লীজ! আপনি ওকে একটু বোঝান।’
    ‘দেখুন! ব্যাপারটা সম্পূর্ণ লরার নিজের। আমি যেমন ওকে জোর করে আনিনি। আটকেও রাখতে পারি না। ও উইলিংলি এসেছে। উইলিংলি যাবে! আমি কে? দ্যাটস অল!’
    আমার কেন যেন মনে হয় এসব ছলেরই কথা। আমি খপ করে মীর্জার হাতটা ধরে ফেলি। ‘দেখুন আপনাকেই উদ্যোগী হতে হবে। আপনি ওকে ইনফ্লুয়েন্স করবেন। অন্তত ওর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে। লরার কাছ থেকে আপনার যতটুকু পাওয়ার আপনি পেয়ে গেছেন। ওকে তো আর বিয়ে করছেন না! করলে না হয় একটা কথা ছিল।’
    ‘থাক এসব কথা। আমিতো বলেই দিয়েছি ওকে আটকাবো না। আপনি আসুন আমার বাসায়। ওর সঙ্গে কথা বলুন। ব্যস! প্লে¬ইন এন্ড সিম্পল।’     
    সুযোগটা আমিও কাজে লাগালাম, ‘আমি কি আজই দেখা করতে পারি?’ কী ভাবল মীর্জা, তারপর পারমিশন নেয়ার ভঙ্গিতেই বলল, ‘আমি কি একটু লরার সঙ্গে কথা বলে নিতে পারি?’
আমি ওর হাতটা আবার ধরলাম, ‘লরা কোনভাবেই দেখা করতে রাজি হবে না। আপনি আমাকে সরাসরি ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিন। প্লি¬জ!’
থম মেরে এক মুহূর্তের জন্য কী ভাবলেন দারাউস মীর্জা। তারপর চোখ বন্ধ করে জানালেন, ‘ঠিক আছে। কাল বাসায় আসুন। কখন আসবেন। সন্ধ্যায় আসুন। সারাদিন আমার খুব রাশ যাবে। সন্ধ্যায় একটু ফ্রি থাকব।’  

৫.

পরদিন সন্ধ্যায় আমি ইরফানকেও সঙ্গে নেই। ওকে দেখে যদি লরার মনটা নরম হয়। বাচ্চাটার জন্য মৃত অনুভূতি জেগে ওঠে। আমি কোনভাবেই ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে চাই না। অন্তত লরাকে ঘিরে এ-আত্মবিশ্বাসটুকু আমার আছে। মীর্জার ফ্ল্যাটটা বড়ই মনোরম। সুন্দর। যেমন প্রাকৃতিক তেমনই সাজানো। দুটোর এমন চমৎকার সমন্বয় হতে পারে- ভাবাই যায় না। অর্কিড, গোলাপ-এ বারান্দা যেমন ভর্তি, তেমনি সিলিংয়ে ঝাড়বাতিসহ নানা রকমের দামি তৈজস মিলেমিশে আছে। আলোর ফোয়ারা। দেয়ালে দেশবিদেশের পেইন্টিং। সম্ভবত অরিজিনাল নয়। প্রিন্ট। মোগল মিনিয়েচারও আছে। লরা বেশ অসংকোচেই সামনে এসে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার গলায় খোঁজ-খবর নিল। আমি অবাক হয়ে দেখি। এ লরা সত্যিই অন্য লরা। আমার সেই লতানো কচিপাতার লরা নেই। শরীরটা বেশ ভরাট হয়েছে, যৌবনও যেন পূর্ণতা পেয়েছে ওর শরীরে এসে! চোখেমুখে কামুকী ভাব চুইয়ে পড়ছে। নাকি এ শুধুই আমার মনের প্রতিফলন! আমাকে দেখে ওর মধ্যে কোন ভাবান্তর ঘটলো বলে মনে হলো না। চুপ করে সোফায় বসে একটা কুশন কোলের ওপর নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। আমি চুপচাপ বসেছিলাম ইরফানের দিকে তাকিয়ে। মনে মনে চাইছিলাম ও-ই-ই কথা বলা শুরু করুক। ও-ই-ই বোঝাক। মন গলাক বাচ্চাটার সংবাদ জানিয়ে। ও বুঝি উল্টো আমার উপরই নির্ভর করছে। সে-কারণেই সম্ভবত বড়ই অস্বস্তিকর একটা নীরবতা বেশ কিছুক্ষণ মাথা ঠুকরে গুমরাতে লাগল রুমের চারদেয়ালে। শেষে আমিই মুখ খুললাম, ‘লরা! তোদের মধ্যে কি হয়েছে না হয়েছে, আমি সব জানি না, জানতেও চাই না। ব্যাপারটাকে আর বাড়তে দিস না। ইরফান তোকে নেয়ার জন্য এতদূর থেকে ছুটে এসেছে। আমি চাই পারলে তুই আজকেই ওর সাথে প্লেনে ওঠ। তোর বাচ্চাটা তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে মারা যেতে বসেছে।’
আমি লরার মধ্যে কোন রকম ভাবান্তর লক্ষ্য করি না। ও আগের মতোই চুপচাপ। মেঝেতে পায়ের বুড়ো আঙুল ঠুকছে। কোলের ওপর কুশন নাচাচ্ছে। আমি এবার খানিকটা অসহিষ্ণু হয়ে ধমকে উঠি, ‘কিরে কথা বলছিস না কেনো? কি এমন হয়েছে তোদের মধ্যে যে লন্ডন ছেড়ে চলে আসতে হলো? নিজের বাচ্চাটার চেয়ে অন্য মানুষ তোর কাছে বড় হয়ে গেল? আমি তোকে অর্ডার করছি, তুই আজই লন্ডন ফিরে যাবি। পারলে এখনই। প্লে¬নের টিকেট কীভাবে ম্যানেজ করতে হয়, সেটা আমি দেখব!’ লরা ফস করে উঠল, ‘ইমপসিবল!’ ওর কন্ঠে এমনই দৃঢ়তা ছিল যে, আমি চুপ  মেরে যাই। আমার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বেরোয় না। আশংকায় থাকি অস্বস্তিকর আরো কথা শুনব যা আমি জানি না। না, তেমন কিছু শুনি না। লরা গজ গজ করতে থাকে, ‘আমি কখনোই ও বাড়িতে ফিরবো না। এরচেয়ে জেলখানায় থাকাও অনেক ভালো। কোন ফ্রিডম নেই। শখ আললাদ নেই। আজকে আমি বাংলাদেশে থেকে গেলে আমার ক্যারিয়রটা কোথায় যেত বলো ভাইয়া? আমি এতদিনে টপ মডেলদের একজন হতে পারতাম!’
আমার মনে পড়ে যায়, সত্য বটে, লরা দু’ চারটে পণ্যের মডেলিং করেছিল। এবং এক্ষেত্রে ভালোই একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ওর। আর সে-মডেলিংয়ের সূত্র ধরেই তো ইরফান ওকে দেখেছিল প্রথম। মডেলিং করায় ওর বেশ ডিম্যান্ড হতে শুরু করেছিল। নাচের জন্য এখানে ওখানে আমন্ত্রণ পেতে লাগল। ঢাকার কোন একটা কালচারাল গ্রুপ লরাকে নিয়ে গিয়েছিল লন্ডনে কালচারাল প্রোগ্রামে অংশ নিতে। সেখানেই ওর নাচ দেখে ইরফান ওর প্রেমে এমনই মদমত্ত হয়েছিল যে, লন্ডন থেকে সোজা বাংলাদেশে চলে এসে লরাকে ধুমধাম করে বিয়ে করেছিল। তারপর ওকেসহ চলে গেল আবার সেই লন্ডনেই। পরে শুনেছি, ইরফানের বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই লন্ডনেই থাকে, একসঙ্গে এবং বেশ রক্ষণশীল। লন্ডনের মুক্ত-জীবনের কারণে এই রক্ষণশীলতা আরো শক্তভেদীর ওপর দাঁড়ানো।
লরার কথা শেষ হতেই ইরফান ওঠে দাঁড়াল। ওর পাশে গিয়ে ওর হাতটা ভয়েডরে নিজের হাতে লুফে নিয়ে ওর গভীর আকুতি, ‘তোমাকে আর ও-বাসায় ওঠতে হবে না লরা। আমরা আলাদা বাসায় থাকব। তুমি যেমন চাও যেভাবে চাও আমরা নিজের মতো ফ্ল্যাট নিয়ে থাকব। আমি তোমার কোনো ফ্রিডমেই নাক গলাবো না। তুমি তোমার মতো চলবে! আমাকে শুধু তোমার পাশে একটু থাকতে দিয়ো। সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট! তুমি জানো না, তোমাকে একদিন না দেখলে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে!’
লরাকে এখন যেন একটু নরম নরম মনে হচ্ছে। একটু নুয়ে পড়া। আমার বুঝি এখন এখান থেকে সরে যাওয়াই উচিত। আমি বুঝতে পারছি, ইরফান ওর রুদ্ধ-আবেগকে কিছুতেই পোষ মানাতে পারছে না। উচিত তো বোঝলাম। কিন্তু যাব কোথায়? এ-ড্রয়িং রুমটার পাশে যদি এক চিলতে বারান্দা থাকতো অথবা সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা! ঠাঁই নিতে পারতাম। তবু উঠে দাঁড়াই। পায়চারি করতে করতে ঘরের এক কোণে চলে আসি। যতটুকু দূরত্বে চলে যাওয়া সম্ভবÑ দেয়ালে প্রায় সেঁটে থাকি! সামনের পেইন্টিংটাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি। মানুষের হৃদয়ের ক্ষত যেন পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে আছে। ধুসর নীলাভ। মোহাম্মদ কিবরিয়ার শিরোনামহীন।
ওরা দুজন গলা নামিয়ে কথা বলছিল। তবু মাঝে মাঝে কিছু কথা হাল্কা হাল্কা ভেসে আসছে। আমি টের পাই বরফ গলছে। নদী ছুটছে। পাথরে রচিত হচ্ছে সম্পর্কের নতুন ভাস্কর্য! ‘তুই এইভাবে আমাকে ছেড়ে চলে আসতে পারলি? কেমনে পারলি?’ ‘চুপ কর চুপ কর!’ ইরফান গাধাটা হাউমাউ করে কাঁদছে। দূর থেকেও লরার গাল শুনতে পাই। ‘লজ্জা করে না। পুরুষ মানুষ কাঁদছিস?’ আমি আমার চোখ কান বন্ধ করে যতটুকু সম্ভব নিজেকে ওদের কাছ থেকে আরো দূরে অনেক দূরে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। কিবরিয়ার নীল-ধুসরতার ভেতরে নিমজ্জিত হই। হারিয়ে যেতে থাকি গভীর থেকে আরো গহন মনান্তরে। অনেকক্ষণ পর ইরফানের ডাকে ফিরে আসি বাস্তবতায়। ও আমাকে আবেগে জড়িয়ে ধরে বলল, থ্যাংক ইউ ভাইয়া! তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেবো! তোমার জন্যই সবকিছু ভালোয় ভালোয় ম্যানেজ হয়েছে। তুমি আমাকে নিউ লাইফ দিলা ভাইয়া। আমি এখন ওকে নিয়ে নতুনভাবে জীবনটা আবার শুরু করতে পারব। আশাকরি আর মিসটেক হবে না।’ ‘ও কি তোমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছে?’ আমি জানতে চাই। ‘হ্যা। রাজি মানে। এখনই যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে।’ আমি ইরফানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, ছেলেটা ভালোবাসার এতোটা ক্ষমতা কোথা থেকে পেল? কোন গ্রহ থেকে? আমাদের পৃথিবীতে কি এখনো এই ক্ষমা এই উদারতা জমা করা আছে? দুজন আবার সোফাসেটে গিয়ে বসি। আমি দূর থেকেই কিবরিয়ার পোড়াক্ষতে চোখ বোলাতে থাকে। লরা কখন আসবে? ও সাজতে যা সময় নেয়। জানি তো! ওর এই সাজুনিপনার জন্য দার্জিলিংয়ে আমাদের টয়ট্রেনের শিডিউলটা মিস হয়ে গিয়েছিল। আবার ওকে নিয়ে দার্জিলিং যাওয়ার একটা বন্য তাড়না আমি আমার ভেতরে জেগে উঠছে টের পাই।
প্রায় বিশ মিনিট কী আধাঘণ্টা পর ফিরে এলো লরা। সেই বেশে সেই ড্রেসেই। আমাকে ইরফানের একেবারে পাশাপাশি দেখে কী বলতে গিয়েও থেমে গেল। আমি সেটা বুঝে আবারও দূরে চলে যাওয়ার চেষ্টায় দেয়ালের সেই পেইন্টিংটার দিকে এগোই। একেবারে ওটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ভেতরে চলে যেতে চাই ছবিটার অন্তর্মূলে। ধুসরতা ছাড়িয়ে হাল্কা নীলের ব্যবচ্ছেদ। মানুষের হৃদয়ের পোড়া ক্ষত? সত্যিই? আমি তার ভেতরে নিজেকে আরো আত্মাহুতি দেই। তারপরও নিজের কানকে এড়াতে পারি না। শুনি, স্পষ্ট শুনি, লরা বলছে, ‘ইরফান! ও আমাকে আরেকটা রাত চাচ্ছে। বুঝতেই পারছ!’ ইরফান কী বলছে আমি বুঝতে পারছি না। ওর কথাগুলো কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে। ধুসর থেকে নীল- হাল্কা। ক্রমশই দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে!