গত কয়েক বছর যাবত আমাদের ‘একুশের সংকলন’-য়ে একুশের বইমেলাকে সামনে রেখে প্রকাশিত হাজার হাজার নতুন বই থেকে বাছাই করে আমরা ৫০টি বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সমৃদ্ধ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছি। তাতে কয়েকটি কবিতাগ্রন্থও থাকে অনিবার্যভাবেই। এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করা সহজ নয়, তবে কাজটি যে করা দরকার সেটি আমরা অনুভব করি বলেই সব সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারি। আমি নিজে প্রধানত কবিতাই লিখি বলে নির্মোহ বা নৈর্ব্যক্তিকভাবে শত শত নতুন কবিতার বই থেকে ৫০ নির্বাচিত ক্রোড়পত্রের জন্য কাব্যগ্রন্থ বেছে নিতে গিয়ে বারবার থমকে যাই। বইতো নিচ্ছি মোটে ক’খানা, কড়াকড়িভাবে ৫০ সংখ্যক বইয়ের হিসাব থেকে বেরুবো না এমনটাই প্রতিজ্ঞা। তাই বেশির ভাগ গ্রন্থই ক্রোড়পত্রের বাইরে থেকে যায়। জানি এতে আমার বহু বন্ধু-স্বজন বিরক্ত ও বিরূপ হন। তবু আমি অবিচল থাকি। বহু বছর ধরে সাহিত্য সম্পাদনা করে এসেছি। কবিতার পাঠক হিসেবেও আমি মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। সম্পাদক হিসেবে সীমিত বলয়ে গুটিয়ে আনার সাবলীলতা এবং পাঠক হিসেবে হাতের সামনে যা পাই, এবং অনুসন্ধানী মন যা খুঁজে বের করে সেসব পড়ে ফেলার প্রাঞ্জলতা- দুয়ের ভেতর সমন্বয়ের কোনো চেষ্টায় যাই না। আমি জানি, এতে দু-চারটে বেশ ভালো কবিতাগ্রন্থ হয়তো আমার তালিকার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সেটা আমি স্মরণে রাখি। পরবর্তীকালে সেই কবির নতুন কবিতার বইটির ওপর আমার বিশেষ নজর থাকে। তাই বলতেই পারি আমার এই কাজে কোনো সংকীর্ণতার স্থান থাকে না। কথাগুলো স্বীকারোক্তির মতো হয়তো শোনাচ্ছে। নিজে কবিতাঙ্গনের কেউ না হলে হয়তো এত কথা না বললেও চলত। এত কথা বলার কারণ এবার খোলাসা করি। ২০১৪ সালের ক্রোড়পত্রে নূরুল হক নামে এক কবির কবিতাকে শুরুতেই স্থান দিই। অস্বীকার করব না এই কবির মাত্র একটি গ্রন্থ এর আগে আমার সংগ্রহে ছিল। ভালো লেগেছিল। কিন্তু ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া’ বইটি হাতে নিয়ে তার কয়েকটি কবিতা দ্রুত পড়ে ফেলে আমি প্রাথমিকভাবে বইটির পক্ষে ভোট দিয়ে রাখি। পরে চূড়ান্ত নির্বাচনের সময় এটিই আমার কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। ক্রোড়পত্রে বইটি নিয়ে ছোট্ট করে যা লিখেছি তা নিচে উদ্ধৃত করছি।
‘স্বকাল-স্বভূমির দীর্ঘশ্বাস ও দীর্ঘবাদন, অর্জন ও বিসর্জন এবং আর্তি ও আকাক্সক্ষার সঙ্গে নিজের আত্মাকে সংযুক্ত করে নূরুল হকের মতো সত্যিকারের কবিতা লিখতে পারেন ক’জন? সত্তরোর্ধ নিভৃতচারী সহজিয়া এই কবি এখনও অপঠিত ও না-গৃহীত রয়ে গেছেন কবিতারাজনীতিতে বিশ্বখেতাব পাওয়ার যোগ্য এই অবাক বাংলায়।’
আমাদের কবিতাঙ্গনে হেভিওয়েট কিছু কবির নাম বারবার উচ্চারিত/ আলোচিত হয়। তাঁদের নাম নিশ্চয়ই স্মরণযোগ্য। কিন্তু কবিতার কারণে নয়, মঞ্চশোভা বর্ধনের জন্য তাঁদের নাম আলোচনায় আসে। তাঁদের সাম্প্রতিক কবিতা পাঠ করলে, কিংবা কম করে গোটা একটি দশকে বাংলাদেশের কবিতায় তাঁদের ‘অবদান’ বিবেচনা করলে কিছুতেই তাঁরা আর বিশিষ্ট থাকেন বলে আমি মনে করি না। তবু তাঁদের দিকে তাক করা থাকে প্রচারের আলো। তা থাকুক, আমার কেনো সমস্যা নেই। কিন্তু এর সমান্তরালে যদি নূরুল হকের মতো কবিরাও সাহিত্য সমালোচক/ সাহিত্য সম্পাদকদের সম্মান পেতÑ আমার কোনো খেদ থাকত না। দ্বিতীয়ত খুব সচেতনভাবে গোষ্ঠিবদ্ধ ক’জন কবি লেখায়-আলোচনায়-প্রচারণায় এমন একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসী যে মাতৃভূমি ও সমকাল নিয়ে রচিত কবিতা কোনো কবিতাই নয়। নতুন পাঠক নিশ্চয়ই এতে বিভ্রান্ত হন। কবিতায় রাজনীতির বিষয়আশয় উঠে এলে তাকে এক কথায় স্লোগান বলে খারিজ করার প্রবণতাও দেখা যায়। নবীন পাঠক এতে প্রভাবিত হন। জীবনানন্দ দাশকে বুঝলে আমার অবশ্যই মানবো যে কবিতা অনেক রকম। বিষয় বা প্রকাশভঙ্গি যেমনই হোক না কেন, একটি লেখা কবিতা হলো কিনা সেটাই আসল।
কবির কি কোনো নির্দিষ্ট দেশ থাকে? যে-ভাষায় তিনি লেখেন সে-ভাষাভাষি মানুষের প্রতি আলাদাভাবে তাঁর কি কোনো দায়িত্ব থাকে? মাতৃভূমির জন্যে তাঁর কী কর্তব্য থাকে? এখানে উৎকীর্ণ তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের বহুমুখী জবাব মনে আসে, নতুন জিজ্ঞাসাও তৈরি হয়। সেই পর্যায়ক্রমিক প্রশ্নের আগমন, আর ক্রমাগত জবাব অন্বেষণের জটিলতা আমরা এড়াতে পারি না। কবির নিজস্ব দেশ অবশ্যই থাকে, যদিও তিনি হতে পারেন বিশ্বনাগরিক, সেটাই কাম্য। একজন বড় মাপের কবি নিশ্চিতভাবেই হন সকল দেশের, অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের কণ্ঠস্বর। যদিও একান্ত স্বদেশের আকাশমাটির স্বাদ ও অভিজ্ঞতা প্রচ্ছন্ন থাকে তাঁর রচনায়; দেশকে পাওয়া যায় তাঁর উপমা, চিত্রকল্পের প্রয়োগ-সংকেতে, আবেগের আঙ্গিকে, উচ্চারণ-ভঙ্গিতে। শুধু দৈশিক পরিচয় নয়, একজন প্রধান কবির লেখায় স্পন্দমান থাকে নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্যও। স্বদেশের সীমানার বাইরের কোনো ক্রিয়ায় শৈল্পিক সাড়া দিতে গিয়ে তিনি যখন সেই অঞ্চলের মানুষের অনুভূতির অংশীদার হয়ে ওঠেন তখনও শব্দে-ছবিতে তিনি ইশারা রেখে চলেন আপন বংশের, আপন ভূমির। কবি তুলে ধরেন সত্যের স্বরূপ, শেকড়ের বিবৃতি, নীলিমার বেদনা। অনুভূতির বৈচিত্র্যে ভরিয়ে তোলেন পঙক্তির পর পঙক্তি। সত্য অন্বেষণ এবং অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার শিল্পিত প্রকাশÑ প্রধানতঃ এ দুটি তাঁর আরাধ্য। প্রকৃত প্রতিভা তাই পরিণত হন দ্রষ্টায়, কল্যাণময় স্বাপ্নিকে এবং দ্রোহীর প্রতীকে। অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপিত করেন স্বগোত্রের মানুষকে। আর সজ্ঞানে বা অসচেতনভাবে সমৃদ্ধ করে চলেন মাতৃভাষাকে। সমাজ প্রায়শই কবির মর্ম বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়, উপেক্ষা করে তাঁর অনিবার্য প্রয়োজন। যদিও কবি নিবেদিত থাকেন স্বকাল ও সমাজেরই কাজে। বাংলার কবির রচনায় যদি বাংলাদেশই না থাকে, বাঙালির স্বপ্ন ও সংকট না বিম্বিত হয়, তাহলে বাংলায় লেখা বলেই কি ওই কবিতাকে বাংলা কবিতা বলে মেনে নেয়া যায়? কবিকে বুকে টেনে বলা যেতে পারে আমাদের কবি, বাঙালি কবি!
মাতৃভূমির জন্যে কবির নিশ্চয়ই কর্তব্য থাকে। মাতৃভূমি বিপর্যস্ত নিষ্পিষ্ট বিদীর্ণ হতে থাকলে, এবসার্ড নাটকের উপাদানে উপহাসিত হতে থাকলে কবি নীরবতা পালন করতে পারেন না। কবি নিজে সংবেদনশীল শিল্পী, সংবেদনশীলতা জাগানোও তাঁর একটি প্রধান কর্তব্য। নূরুল হকের কবিতার বইটি পড়ে আমি এতে অনেকগুলো কবিতার সন্ধান পাই যা সর্ববিচারে উৎকৃষ্ট কবিতা। ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া’Ñ এই নামটির মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে দুটি এলাকার নাম করা হয়েছে। শাহবাগের গণজাগরণ প্রত্যক্ষ করেছিল বাংলাদেশ এবং শাহবাগকে বিতর্কিত করে তোলার বা শাহবাগ বিতর্কিত হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত এমন একটি স্বপ্ন-প্রতিজ্ঞায় আন্দোলিত হয়েছিল দেশের সব শ্রেণির সব পেশার মানুষ যা স্বাধীনতার পর আর দেখা যায়নি। একাত্তরের বাংলাদেশের হৃদয়ের আলোকশিখার সঙ্গে কিছুটা তুলনা দেয়া যায় ২০১৩ সালের শাহবাগের নবজাগরণকে। গজদন্তমিনারবাসী কবিও আন্দোলিত হয়েছিলেন শাহবাগ-শিহরণে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে জরুরি হলো যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায্য শাস্তি দেয়া। সেখানে সামান্যতম আপোষ কাম্য হতে পারে না। শাহবাগ, স্পষ্ট করে বললে বাংলাদেশ জ্বলে উঠেছিল রাজাকারদের ছাড় দেয়ার আশঙ্কায়। তাই নূরুল হকের কবিতা প্রথমত স্পর্শ করেছে শাহবাগের আবেগ। দ্বিতীয়ত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার যশোরের মালোপাড়া গ্রামের গল্প আলাদা কিছু নয়; সেখানেও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির নৃশংসতা। নূরুল হকের এই কবিতার বইয়ের নামে স্পষ্টত সমকালে স্বাধীনতার শত্র“দের বিরুদ্ধে মানুষের জাগরণের বিষয়টি প্রধান হয়ে উঠলেও এতে রয়েছে বাংলার হৃদয়েরই নানা ক্ষত ও ক্ষমতার শৈল্পিক সুষমা ও সংকেত। শাহবাগের শহীদ রাজীবকে তিনি যে মহিমায় চিত্রিত করেছেন তা অভিনব। এমনটা আমি আর কারো কবিতায় পাইনি। রাজীবকে নিয়ে একাধিক কবিতার (শাহবাগের উচ্চারণ) একটি থেকে কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি:
... দেখা যাচ্ছে মৃত্যুতেও তাকে পরাস্ত করা যাচ্ছে না
তাই তার কৃমিকীট নাড়িভুঁড়ি খেতে শুরু করেছে
শবভুকেরা
রাজীব এখন আমাদের চেতনায় ধ্র“বতারা
রাজীব তুমি চলো
আমরাও ছুরিতে চুমু খেতে খেতে
তোমার দেখানো পথ ধরে
চলতে থাকব।
২০১৩ সাল বাংলাদেশকেই প্রতিক্রিয়াশীলেরা পাঠাতে চেয়েছিল বার্ন ইউনিটে। মুক্তিযোদ্ধা কবির চোখ কত সইবে? ‘হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ছটফট করা অভিশপ্ত আগুন, অঙ্গার হয়ে যাওয়া গরুর শরীর দেখতে কবির ভাল্লাগে না’। তাই তিনি চোখ ঢাকার কথা বলছেন এভাবে Ñ ‘ঢাকো আমার চোখ, কালো কালো মেঘের পালক দিয়ে।’ এটাই তো কবিতা। ৫ মে ছড়িয়ে পড়েছিল হেফাজতি অন্ধকার। এ নিয়েও রয়েছে একাধিক কবিতা। খুব ছোট্ট একটি কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সূক্ষ্ম অপমানবোধের অনুরণন কী দারুণভাবেই না উঠে এসেছে। ছোট্ট কবিতার (৪২ বছর পর) পুরোটাই তুলে দিচ্ছি:
সোনার গাছে ফুল ধরবে
ফল ধরবে বলে
পুঁতেছিলাম বীচি
আজকে দেখি মান বাঁচানোই দায়
জল ঢেলেছি
হৃদয় থেকে
এতটা কাল
শুধুই মিছামিছি?
হরতাল-অবরোধে দেশ যখন সন্ত্রস্ত বিপর্যস্ত, এক পাহাড়সম অস্বস্তি আমাদের ঘিরে ধরেছে তখন নূরুল হকের ‘হালুয়া’ কবিতাটা চোখের সামনে মেলে ধরি। তিনি লিখেছন : হরতাল এবং অবরোধ এক ধরনের হালুয়া/ যা রাস্তায় ছিটিয়ে দিলে / কতই না জীবজন্তু ছুটে আসে। টিভির টক-শো নিয়ে নূরুল হক যে কবিতা লিখেছেন (টক- শো’র ঠোঁটগুলোকে জিন্দাবাদ) তাও প্রকৃতার্থে কবিতাই হয়ে উঠেছে। সহজ উচ্চারণ কিন্তু সত্যের আন্তর চেহারা উঠে আসে যখন তিনি বলেন, ‘ নোংরা কোমলতার ফাঁক দিয়ে . দানবের হিংস্র নিঃশ্বাসের মতো/ বেরিয়ে আসছে বিষাক্ত মিথ্যা...
২০১৩ সালÑ এই একটি বছর বাংলাদেশ দেখেছে যুগপৎ নতুন নক্ষত্র ও পুরনো অমাবস্যা; লক্ষ রজনীগন্ধার মতো ফুটেছে আশা, ফের আশাভঙ্গের আর্তনাদে খানখান হয়ে গেছে আকাশ। চারপাশ হয়ে উঠেছে ‘পরাবাস্তবের লাঠিসোটা’। আগামী প্রজন্ম যদি এই একটি বছরের বাংলাদেশকে কবিতায় পড়ে উঠতে চায় এবং একইসঙ্গে একজন প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধার ক্রোধ ও দীর্ঘশ্বাসের ধরনকে শনাক্ত করে নিতে চায় তবে নূরুল হকের এই একটি গ্রন্থই যথেষ্ট। সমকাল-চিরকালের নাকাড়া হয়ে বেজে ওঠা কবিকণ্ঠ কবিতারই রূপময় উপার্জন। সালাম কবি।
[email protected]