নতুন বছর, হোক তা বৈশাখী বছর বা অন্য কোন, বরাবরই প্রত্যাশার, ভালো সময় কাটানোর। তাই নতুনকে নিয়ে ভাবতে গেলে পুরনোকে বাদ দেয়া যায় না। বিচার বিশ্লেষণ ব্যাখ্যা, হিসাব-নিকাশের বিষয়টি সামনে চলে আসে। প্রথম ভাবনা, কেমন গেল বছরটা, বছরের দিনগুলো। আমরা বরাবরই বলে থাকি, যে দিন গেছে তা ভালোমন্দে মেশা। কিন্তু ইদানীং তেমন কথা বলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ করে গত বছর দুই তিন যেন অদ্ভুত এক দুঃসময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা নিয়ে চলেছে। সময় যেন রাজনীতির পাগলা হাতির পিঠে সওয়ার। সব কিছু তছনছ করে না দিলে তার চলছে না। পক্ষ-প্রতিপক্ষ কঠিন সময়ের সম্মুখীনÑ যেন ভালো না থাকা, স্বস্তিতে শান্তিতে না থাকার এক অবিশ্বাস্য চ্যালেঞ্জ।
কেউ যদি দিনপঞ্জির পাতা খুলে ঘটনাবলীর দিকে ফিরে তাকাতে চান তাহলে মন খারাপ না হয়ে যায় কোথায়। এর আগের বছরে মানুষ দেখেছে জামায়াতের ডাকা হরতালে মৃত্যুর উৎসব, চোরাগোপ্তা হামলা, বাদ যায়নি পুলিশ বাহিনীর সদস্যও। প্রচ- আতঙ্কে মানুষের দিন কেটেছে, দিন যাপন না মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা-এটাই জীবন যাপন। উপলক্ষ যুদ্ধাপরাধের বিচার।
এরপর কিছুদিন যদি বা উপদ্রবহীন গেল, তো শুরু হয়ে গেল রাজনীতির নতুন খেলা, যার নাম কবিতা বা গানের পঙ্ক্তি উদ্ধার করে বলা চলে ‘আমার সোনার হরিণ চাই।’ এবং তা যে কোন মূল্যে হোক। ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা নিয়ে সময়ের ওপর যেন হঠাৎ কালবৈশাখীর হামলা, ভাংচুরের অদ্ভুত নেশায়, বিচার বিবেচনাহীন সে রাজনীতির সূচনা অবরোধে।
অবরোধ কার বিরুদ্ধে? সরকারকে তথা ক্ষমতাসীন দলকে নিজের শর্তে ও স্বার্থে টেনে আনতে জনমনের নামে যে অবরোধ তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ, মেহনতি মানুষ তথা জনগণ। সরকারদলীয় নেতাদের গায়ে তার কোন আঁচড় লাগেনি। রাজনীতির যে নির্মমতায় যুক্ত হলো দিনের পর দিন টানা হরতাল। সপ্তাহের দুই ছুটির দিন বাদে। এমন ঘটনা এ যাবত কখনো ঘটেনি।
শুরুতে মানুষ গৃহবন্দী। হাটবাজার ছাড়া অন্য কোন কাজ হিসেবের বাইরে। শিক্ষার্থীর শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ। পরীক্ষার্থীর জন্য তা ভিন্ন এক চরম পরীক্ষার সময় হয়ে দাঁড়ায়। কোন আহ্বানে কাজ হয় না। তার চেয়ে বড় দুঃসংবাদ পরিবহন ব্যবস্থা অচল-কী দূরপাল্লার, কী রাজধানী মহানগরের। দুটো শব্দÑ পেট্রোলবোমা ও ককটেল বিস্ফোরণের বাইরে কারও মুখে কোন আলোচনা নেই।
হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে অগ্নিদগ্ধ মানুষের আর্তনাদ, না, বেঁচে থাকা নয় বরং মৃত্যু এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়, সে জন্য দগ্ধদের প্রার্থনা। তবু সে করুণ দৃশ্যে রাজনীতির মন গলে না। কেউ তার হিসেব থেকে সামান্যতম ছাড় দিতে নারাজ। মানুষ মরুক, হাঁস-মুরগি-গরু-বাছুর পুড়ুক তাতে কার কী আসে যায়। রাজনীতির শর্তপূরণের বাইরে কোন কথা নেই।
মানুষের প্রত্যাশা ছিল, দু’চারদিন, দু’এক সপ্তাহ গেলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু না, বাংলাদেশের রাজনীতি তেমন কিছুর ধার ধারে না। তার হিসাব না মেলা পর্যন্ত সে থামবে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল, এ সবের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠবে, রুখে দাঁড়াব। কিন্তু না, সেটাও হয়ে দাঁড়ায় এক দুরাশা। মানুষ ক্ষুব্ধ ঠিকই। কে চায় গৃহবন্দী অবস্থা। কে চায় তার উৎপাদিত ফসল মাঠে পড়ে থাক, পচুক পরিবহনের অভাবে? হোক তার অর্থনৈতিক ক্ষতি।
তবু সপ্তাহের পর সপ্তাহ তেমনটাই ঘটেছে। বোধোদয় হয়নি রাজনীতিবিদদের। তবে শেষ পর্যন্ত রুখে দাঁড়ানো না হোক, মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গেছে। মানুষ অবরোধ না মেনে, হরতালকে উপেক্ষা করে তার নিত্যদিনের প্রয়োজনের টানে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, অনেকটা প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই। শুরুটা রাজধানী ঢাকায়। এই প্রথম দেখা গেল হরতালের প্রতি চরম উপেক্ষা। ঢাকার রাজপথে পরিবহন সচল, যথারীতি যানজট।
এ বাস্তবতাও বিরোধী দলের অনড় অবস্থানে পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। ব্যর্থ হোক হরতাল, তবু হরতাল চলছে চলবে। অনেকটা একাত্তরে মদ্যপ ইয়াহিয়ার ঘোষণার মতোই যেন ‘জঙ্গ জারি রহেগা’। ইতোমধ্যে জঙ্গ শেষ। তবু তা জারি রাখার ঘোষণা তার। তেমনই হরতাল চলছে, মানুষ মরছে, তবু মানুষ ঘরের বাইরে। কত আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়।
এর প্রভাব পড়ে দেশের সর্বত্র। মানুষ সাহস করে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছে। অনেকটা গেছেও। অবশ্য তা ভয়ভীতি আতঙ্ক নিয়ে। তবু নেত্রীর বোধোদয় ঘটেনি। শেষ পর্যন্ত সুবাতাস বইতে শুরু, তিন পৌরসভার নির্বাচন ঘোষণা উপলক্ষে। সব দলেই সাজ সাজ রব। রাঙ্গামুলোর আহ্বানে কেউ কি সাড়া না দিয়ে পারে? বিশেষত রাজনীতিকগণ, যারা মৎস্য শিকারে বরাবর উৎসাহী, হোক তা ঘোলা জলে বা পরিষ্কার পানিতে।
সবারই মনে হচ্ছে এ উপলক্ষে অবস্থা হয়ত স্বাভাবিক হয়ে আসবে, অবশ্য যদি নির্বাচন সুষ্ঠু অবাধ ও যথারীতি সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাস্তবিকই কি তা হবে? এমন সুবুদ্ধি রাজনীতিকদের হবে? এদিকে বাংলা বছর তার চৈত্র শেষ করতে চলেছে। এগিয়ে আসছে বৈশাখ বর্ষ বরণের মাস। রাজনৈতিক মতভেদ, হিংসা, বৈরিতা ভুলে রাজধানীর রাজনীতিমনস্ক মানুষও রাজপথে নামবে পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে।
নতুন পরিচ্ছদে, নবীন উৎসাহে যোগ দেবে বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায়, গানে মাতোয়ারা হবে। গরমে ঘামে ভিজে। এই একটা দিনই বাঙালীর জীবনে রাজনীতি-নিরপেক্ষ, সম্প্রদায়-নির্বিশেষ জাতীয় উৎসবের। তাই দিনটির সদ্ব্যবহার চলে যথারীতি। কারও কারও মনে এমন ভাবনাও জাগে : বছরের প্রতিটি দিন এমন স্বচ্ছন্দ হয় না কেন? নির্মেঘ, ভারমুক্ত, শঙ্কামুক্ত দিন আনন্দময় দিন।
কেমন করে হবে? আমাদের রাজনীতি তো তেমন পথে চলে না। তার নিজস্ব স্বার্থের পথ ধরে তার চলা। পয়লা বৈশাখ বা একুশে ফেব্রুয়ারির মতো বছরের কয়েকটা বিশেষ দিন সুবাতাস বইয়ে দিলেই চলবে। এর বিপরীতে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবও তো কম নয়। তারা কি সংঘবদ্ধভাবে বলতে পেরেছে : আমরা চাই বছরের প্রতিটি দিন বর্ষশুরুর দিনটির মতো হোক।
না, তারা তা পারেনি, অন্তত বলতে হয়, এখন পর্যন্ত পারছে না। তাই সময় তার আপন নিয়মে চলছে। সমাজ চলছে স্বেচ্ছাচারের ছন্দে, অনেকটা তার ইচ্ছাপূরণের নিয়মে। তবুও বৈশাখ আসে, নতুন পাতার কচিমুখে মসৃণ পেলবতা ফুটিয়ে। প্রকৃতি মানুষের অনিয়ম মানে না। সে তার কাজ যথারীতি করে চলে, যদিও মাঝে মধ্যে চলে কালবৈশাখীর দুরন্তপনা।