করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





আঁধার-ছায়ার বাইরে
প্যাত্রিক মোদিয়ানো, অনুবাদ : রুবাইয়াৎ সিমিন
সে ছিল একজন মধ্যমাকৃতির নারী; জেরার্ড ভ্যান বেভার তার অপেক্ষা কিঞ্চিত খাটো। আমাদের প্রথম সাক্ষাতের রাতটি ছিল শীতার্ত একটি রাত; তা প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা, আমি জাহাজঘাটের কাছে তুরনেল হোটেলে নিজেকে তাদের মাঝে আবিষ্কার করি।
দুটি বিছানার একটি দরজার পাশেই, অন্যটি জানালার সম্মুখভাগে। জানালাটা ছিল হোটেলের পিছন দিকে, যেখান থেকে ঘাট দেখা যাচ্ছিলো না এবং আমার যতটুকু মনে পড়ছে জানালাটা অনর্থক একটানা একঘেয়ে একটা শব্দ করে যাচ্ছিলো।
রুমের মধ্যে সব কিছু জায়গামতই ছিল। বিছানা ছিল প্রস্তুত। সুটকেস কিম্বা কোন ধরনের কোন কাপড় ছিল না। শুধুমাত্র একটা এলার্ম ঘড়ি কোন একটা স্ট্যান্ড-এর উপর বসানো ছিল। এই এলার্ম ঘড়িটা ছাড়া মনে হচ্ছিলো তারা যে এখানে আছে সেটা যেন লুকোতে চাইছে সঙ্গোপনে, তাদের উপস্থিতির কোনরূপ চিহ্ন তারা রাখতে চাইছিলো না। সেই প্রথম রাতে আমরা খুব কম সময়ের জন্য রুমে অবস্থান করেছিলাম। শুধু কিছু আর্টের বই রাখি আমি; যেগুলো বহন করছিলাম সেন্ট-মাইকেল-এর এক পুরনো বইয়ের দোকানে বিক্রির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে।
অপরাহ্ণের কোন এক সময়ে সেন্ট মাইকেল-এ তাদের সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিলো। আমাদের চারপাশের কোলাহল জনস্রোতের মত মেট্রোর দিকে, নয়তো বিপরীত দিকের মূল রাস্তা ধরে পাশ কাটিয়ে চলে যাছিলো। নিকটবর্তী পোস্টঅফিস সম্পর্কে তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি ভীত ছিলাম কারণ আমার দেখানো পথনির্দেশনা তাদের জন্য স্পষ্টতর যদি না হয়। দুটি দূরত্বের মধ্যকার সংক্ষিপ্ততম পথ বাতলে দেবার কাজে আমি বরাবরই অপটু। আমার মনে হচ্ছিলো অডেন পোস্ট অফিসের পথটা দেখিয়ে দেয়া আমার জন্য উত্তম হবে। সেখানে পথে থেমে ক্যাফে-ট্যাবাক থেকে তিনটি স্ট্যাম্প কিনতে পারবে। যতক্ষণ খামে স্ট্যাম্পগুলি লাগানো হচ্ছিল সেই ফাঁকে আমি সময় পেয়ে গেলাম ঠিকানা পড়বার; জায়গাটা হলো মাজরকা।
কোন প্রকার দেখা-জোখা ছাড়াই চিঠিটাকে মেইলবক্সে ছেড়ে দিল সে। আমরা সেইন্ট মাইকেল এবং ঘাটের দিকে ফিরে এলাম। যে ভারি বইয়ের বোঝা আমি বয়ে বেড়াচ্ছিলাম সে বিষয়ে সে সচেতন হয়ে তীক্ষèভাবে ভ্যান বেভারকে বলল,
‘তুমি তাকে সাহায্য করতে পারো।’
সে আমার দিকে স্মিত হাসি দিয়ে আমার হাত থেকে সব চাইতে বড় বইটা তার বাহুতে নিয়ে নিল।


ঘাটের কাছে তুর্নেল হোটেলের ঘরে আমি নৈশদণ্ডের পাদদেশে বইগুলোকে সাজিয়ে রাখছিলাম, একটিকে এলার্ম ঘড়ির পাশে। চলমান ঘড়িটার কোন প্রকার আওয়াজ পাচ্ছিলাম না। বালিশগুলি রাখার জায়গাটাতে একটা দাগ। নিচু হয়ে বইগুলি ঠিক করে রাখবার সময় আমি কিছু একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম যা বালিশ এবং বিছানা থেকে আসছিলো। চিত্রকরের তুলির মত তার বাহু আমার সামনে দিয়ে উঠে গেলো এবং সে বেডসাইড ল্যাম্পটার সুইচটি টিপলো।
আমরা আমাদের দিনের প্রধান ভোজ সারলাম সংক্ষিপ্ততম জায়গার মধ্যে, তাদের হোটেলের খুব কাছাকাছি। আমরা শুধুমাত্র ঐ রাতের বিশেষ ডিশটাকেই বেছে নিয়েছিলাম। ভ্যান বেভার বিল মিটিয়েছিল। আমার সাথে সেই রাতে কোন প্রকার টাকা-পয়সা ছিল না এবং ভ্যান বেভার দেখলো যে তার ৫ ফ্রাঙ্ক কম পড়ছে, সে আতিপাতি করে তার জামার জ্যাকেটের সবগুলি পকেট খুঁজে দেখল এবং অবশেষে ৫ ফ্রাঙ্ক পেয়ে গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা চুপ থেকে সিগার ফুকতে ফুকতে অন্যমনস্কভাবে তাকে দেখছিল। সে তার খাবারের অংশভাগ আমাদেরকে দিয়ে একেবারেই কম খেয়েছিল ভ্যান বেভার-এর প্লেট থেকে। সে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
‘পরবর্তী সময়ে আমরা একটা ভাল রেস্তোরাঁয় যাব।’
মূল প্রবেশ পথে আমরা উভয়ে অপেক্ষা করছিলাম ভ্যান বেভারের জন্য। সে আমার বইগুলির জন্য রুমে গিয়েছিল। নীরাবতা ভেঙে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তারা এখানে দীর্ঘদিন বাস করবে কিনা। আরো শুধোলাম তারা কোন প্রভিন্স থেকে এসেছে। না ,তারা প্রায় প্যারিসের কাছাকাছি থেকেই এসেছিল শুধুমাত্র দু’মাসের জন্য থাকতে। তার ডাক নাম ‘জ্যাকলিন’। এটুকুই মাত্র কথা যা তার সাথে আমার সেই রাতের জন্য হয়েছিল।
ভ্যান বেভার নিচে নেমে এসেছিল এবং আমাকে আমার বইগুলি ফেরত দিল। সে আমাকে বলেছিল আগামী দিন আমি আমার বইগুলি বিক্রির চেষ্টা করলে এভাবে কিছু অর্থ যোগাড় করতে পারব। পুনরায় দেখা হওয়ার প্রত্যাশা জানালো দু’জন। তাদের মূল্যবান সময় থেকে সাক্ষাতের সুযোগ বের করা তাদের জন্য কঠিন ছিল, তবে তাদেরকে কদাচিত ক্যাফে ‘রু দান্তে’-তে দেখা যেতে পারে, জানাতে ভুলল না।

আমি স্বপ্নে বা কল্পনায় মাঝে মাঝে সেখানে যেতে থাকলাম। এক রাতে, ফেব্রুয়ারীর সূর্যাস্তের মত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ‘রু দান্তে’ তে গিয়েছিলাম। এতগুলো বছরের পরও ওটির এতটুকু পরিবর্তন হয়নি।
আমি গ্লাসের মাঝ দিয়ে দেখা চত্বরের ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে বারের দিকে দৃষ্টি দিলাম। পিনবল যন্ত্রটি এবং সুসজ্জিত টেবিলগুলি নাচের জায়গার উপযোগী করে ছিল সাজানো।
রাস্তাটা পার হবার সময় সেন্ট মার্টিন রোডের বিপরীত পাশের সুউচ্চ দালানগুলির ছায়া আমার উপর পড়ছিল। কিন্তু আমার পিছনের ফুটপাথে তখনো সূর্যালোক ছিল।
যখন আমি জেগে উঠলাম, আমি সচেতন হলাম যে জ্যাকলিন আমার কাছে আলো এবং ছায়ার পৃথক সত্তার মত আসছে। যেমনটা হয় ফ্যাকাশে শীতকালের রাস্তায় ভিনিশিয় জানালার খড়খড়ি দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়লে।


গার্ড ভ্যান বেভার এতবড় একটা ওভারকোট পরেছিল যে তার মধ্যে তাকে একটা সামুদ্রিক মাছসদৃশই দেখাচ্ছিল। আমি তাকে ক্যাফে রু দান্তের পিনবল যন্ত্রের সামনে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখতে পেলাম। কিন্তু জ্যাকলিন খেলছিল। তার বাহু ও কাঁধ ওই মুহূর্তে এমনভাবে নড়ছিল যেন বিদ্যুচ্চমকের মত ঝিলিক দিয়ে উঠছিল। ভ্যান বেভারের বিপুলায়তন কোটটি তার হাঁটু অব্দি নেমে এসেছিল। সে সটান দাঁড়িয়ে, উল্টানো কলার; আর হাতগুলি ছিল পকেটে। জ্যাকলিন পরেছিল ধূসর তারের মত দেখতে নরম চামড়ায় তৈরি জ্যাকেট।
প্রথম যেদিন আমি তাদের ক্যাফে রু দান্তে-তে দেখলাম, জ্যাকলিন আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে হেসে তার পিনবল খেলায় ফিরে গেল। আমি একটা টেবিলে বসলাম। বিশাল যন্ত্রটার সামনে তার বাহু এবং তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশকে ক্ষুদ্রকায় দেখাচ্ছিল। যন্ত্রটার ঝাঁকুনি তার অনগ্রসর কাঁধ আর শিরদাঁড়া সঞ্চালনার জন্য ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সে সোজা থাকার জন্য প্রায় সংগ্রামরত ছিল, যেন বা কেউ জলের আগ্রাসনে সংগ্রামরত। সে আমার সাথে টেবিলে এসে যোগ দিল এবং ভ্যান বেভার যন্ত্রটির দিকে গেল।
প্রথমত আমি বিস্মিত ছিলাম এত সময় ধরে তাদের খেলার বিষয়টা নিয়ে। মাঝে মাঝে তাদের খেলা বিঘিœত করতাম; যদি আমার না আসা হতো তবে এটা বেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য চলত।
বিকালে ক্যাফে প্রায় খালি থাকতো, যদিও ছ’টা বাজার সাথে সাথে খরিদ্দাররা বার এবং টেবিলময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রায় ভরিয়ে তুলতো। আমি খুব তাড়াতাড়ি কথোপকথনের গর্জন থেকে ভ্যান বেভার এবং জ্যাকলিনকে বের করে নিয়ে আসতে পারতাম না। সেখানে সপ্রতিভ পিনবল যন্ত্র এবং গ্রাহকরা একসঙ্গে গাদাগাদি হয়ে থাকতো। আমি প্রথমে ভ্যান বেভারকে, তারপর রিংবোনওয়ালা ওভারকোটসহ জ্যাকলিনকে দেখতে পেয়েছিলাম। এখানে ইতোমধ্যে কয়েকদিন এসেছি কিন্তু তাদেরকে পাইনি, এবং প্রতিবার আমি একটা টেবিলে বসে শুধু প্রতীক্ষাই করে গেছি। ভাবতাম তাদেরকে আর দেখতে পাব না, তারা কোলাহল আর শব্দের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এবং তখন একদিন প্রথম বিকেলের দিকে দুরতম প্রান্তের নির্জন ক্যাফেতে তাদেরকে পাশাপাশি পিনবল যন্ত্রের কাছে দেখতে পেয়েছিলাম।


আমি আমার সেই সময়ের জীবন যাপনের যে কোনো বিবরণ দিতে পারি। আমার মা-বাবার মুখ প্রায় ভুলে গেছি। তাদের এপার্টমেন্টে দীর্ঘদিন বাস করেছিলাম, এবং তারপর পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে পুরোন বই বিক্রি করতে শুরু করি রোজগারের জন্য।
জ্যাকলিন ও ভ্যান বেভার-এর সাথে সাক্ষাতের কিছুদিনের মধ্যেই আমি তাদের নিকটবর্তী হোটেল দে লিমাতে একটি কক্ষ ভাড়া নিই। পাসপোর্টে আমার বয়স এক বছর পরিবর্তন করেছিলাম, এরকম আরো কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন আনা লাগে আমার।
হোটেল দে লিমাতে আসার আগের সপ্তাহে আমার কোন ঘুমানোর জায়গা ছিল না। তাই তারা তাদের রুমের চাবি আমাকে দিয়ে যেত যখন তারা শহরের বাইরে একটা ক্যাসিনোতে যেত। এটা প্রায়ই ঘটতো।
বহুপূর্বে তারা এই অভ্যাসে পতিত হয়েছিল, অওউ ক্যাসিনো ছাড়াও নরমান্ডি উপকূলে ছোট শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দু তিনটি ক্যাসিনোতে তাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তারপর তারা ‘দিয়েপ’ এ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। শনিবার চলে গিয়ে সোমবারে ফিরে আসতো দুজন জুয়োয় জেতা অর্থ নিয়ে, যা কখনই এক হাজার ফ্রাঙ্কের বেশি ছিল না। ভ্যান বেভার ফিরে আসতো পেটি বেঁধে; ভাবখানা এমন যে সে পুরোপুরি পাঁচ নিয়ে ফিরেছে, কিন্তু এটা শুধুমাত্র তখনই সম্ভব হত যখন সে নিজেকে ছোট কয়েকটা বাজিতে সীমাবদ্ধ রাখতে পারতো।
আমি তাদের সাথে কখনো ক্যাসিনোতে যাইনি। সোমবার পর্যন্ত ওদের অপেক্ষা করতাম, কিম্বা আশেপাশে কোথাও যেতাম না। একটা সময় পর ভ্যান বেভার শুধুমাত্র ফোর্জ-এ যাওয়া শুরু করলো। এর কারণ হিসেবে সে ব্যাখা করেছিল যে এটি বানোল-দো-লোওর্ন অপেক্ষা নিকটতর। তখন জ্যাকলিন প্যারিসে অবস্থান করছিল।


রাত্রে একাকী তাদের রুমে থাকতাম, ইথারের গন্ধ সব সময় তাদের রুমময় ছড়িয়ে থাকত। সিঙ্কের উপরের তাকে নীল বোতলগুলি সাজানো ছিল। টয়লেটে কিছু কাপড়-জামা ঝুলানো ছিল; পুরুষ মানুষের জ্যাকেট, এক জোড়া ট্রাউজার, মেয়েদের একখানা অন্তর্বাস এবং ধূসর রঙের নরম চামড়ার সোয়েটার যা জ্যাকলিন পরে থাকত।
এইসব রাত আমি বাজেভাবে যাপন করছিলাম। ঘুম ভেঙে বুঝে উঠতে পারতাম না কোথায় আছি। ঘরটাকে স্মরণে আনতে আমার অনেক সময় লাগত। যদি কেউ আমাকে জ্যাকলিন কিম্বা ভ্যান বেভার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত, তার উত্তর দিতে কিংবা আমার এখানে অবস্থানের কারণ ব্যাখা করতে কষ্টবোধ হতো। তারা কি কখনও ফিরে আসবে? আমি এটা সন্দেহ করা শুরু করেছিলাম। যে লোকটা হোটেলের প্রবেশদ্বারে অন্ধকারের পিছনে কাউন্টারে বসে থাকত, কখনো সে সচেতন ছিল না উপরতলার সিঁড়ি বেয়ে তাদের রুমে যেতে কিম্বা বাইরে যাবার সময় চাবিটা আমার সাথে নিয়ে যাওয়া নিয়ে। সে আমাকে বেশ ভাল রকম অভিবাদন জানাতো।
শেষদিন রাতে, আমি পাঁচটার দিকে জেগে উঠি এবং কোনভাবেই আর ঘুম আসে না।
সম্ভবত জ্যাকলিনের বিছানায় ছিলাম, এবং ঘড়িটা এত তীক্ষèভাবে বাজছিলো যে আমার ইচ্ছা হচ্ছিল ঘড়িটাকে ছুড়ে ফেলতে অথবা বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রাখতে। কিন্তু আমার নীরবতা-ভীতি ছিল। আমি উঠে পড়ে হোটেল ত্যাগ করেছিলাম। জাহাজঘাট ধরে একাকী হাঁটছিলাম উদ্যানের গেটের দিকে এবং সেখান থেকে প্রবেশ করলাম রেল স্টেশন সংলগ্ন একমাত্র খোলা ক্যাফেতে ।
সপ্তাহ খানেক পূর্বে জুয়া খেলে তারা সর্বস্বান্ত হয়েছিল দিয়েপ ক্যাসিনোতে এবং খুব সকালে ফিরে এসেছিল। এটা বোধহয় আজকের সেই দিন, এক ঘন্টা কিম্বা দু ঘন্টার অপেক্ষা...
প্রতিদিনের যাত্রীর উঠতি চাপে গার-দ-অস্ত্রেলিজ ভরে ওঠে সংখ্যাতীতভাবে। এক কাপ কফি খেয়ে সবাই মাথা নোয়ায় মেট্রোর প্রবেশ পথে। আমি একাকী উদ্যানের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে গেলাম।
শেষ মুহূর্তের জন্য আমি তাদের সিলুয়েট করলাম দূর থেকে। ভ্যান বেভার তার রিংবোন ওভারকোট নিয়ে দূর থেকে অন্ধকারেই লক্ষণীয়। জাহাজঘাটের বিপরীত দিকের একটি বেঞ্চে তারা বসেছিল, সম্মুখে অল্পদূরত্বে রাস্তার পাশের বই বিক্রেতাদের পুস্তক প্রদর্শনের কেস। তারা তখন মাত্র দিয়েপ থেকে ফিরেছিল। দুজন রুমের দরজার কড়া নেড়েছিল কিন্তু সেখানে উত্তর দেবার মত কেউ ছিল না। এবং আমি পূর্বে কখনও এত দীর্ঘ সময়ের জন্য পকেটে চাবি নিয়ে কোথাও যাইনি।



হোটেল দে লিমা’র আমার জানালা দিয়ে প্রধান সড়ক সেন্ট জার্মিন এবং রু দে বার-নার্ডিন এর শেষ প্রান্তভাগ দেখা যাচ্ছিল। শুয়ে থাকা অবস্থায় আমি চার্চের বুরূজ দেখতে পেতাম যেটা জানালাবেষ্টিত এবং যার নাম আমি ভুলে গেছি। ট্রাফিকের কোলাহল থেমে যাবার পর সারা রাত্রি প্রতিপদে ভারী হয়ে উঠত। জ্যাকলিন এবং ভ্যান বেভার মাঝেমাঝে হেঁটে আমার হোটেলে আসত। আমরা রাত্রিকালীন আহারের জন্য কোন চাইনিজ রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম। একটি মুভি দেখতেও গিয়েছিলাম আমরা।
সেই সমস্ত রাতগুলোতে আমাদের সাথে প্রধান সড়ক সেন্ট-মাইকেল-এর ছাত্রদের কোনরূপ পার্থক্য ছিল না। ভ্যান বেভারের কোট এবং জ্যাকলিনের চামড়ার জ্যাকেটে রহস্যময়ী নারীর মিশ্র পরিপ্রেক্ষিত ফিরে আসতো। আমি নোংরা বেইজ রঙের একটা পুরাতন জ্যাকেট পরিধান করে বইগুলিকে আমার বাহুর মধ্যে বহন করছিলাম। না, দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত আমাদের কিছু ছিল না।



হোটেল দে লিমায় নিবন্ধন ফর্মে আমি নিজেকে একজন ইউনিভার্সিটির ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা ছিল শুধুমাত্র একটা আনুষ্ঠানিকতা, তারপর কোনদিনই ডেস্কের পিছনে বসে থাকা লোকটি আমাকে আর কোন অতিরিক্ত প্রশ্ন করেনি। একদিন একগাদা বই সমেত বের হচ্ছিলাম আমার চেনা একজন দোকানির কাছে বিক্রির অভিপ্রায়ে, সে আমাকে জিজ্ঞেস করল:
‘তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?’
প্রথমে তার কথা কেমন যেন ব্যঙ্গাত্মক শোনালো। যদিও সে ছিল সিরিয়াস।
হোটেল দে লা তুরনেল লিমার মতই নিরিবিলি শান্ত ছিল। জ্যাকলিন আর ভ্যান বেভার ছিল একমাত্র বাসিন্দা। তারা আমাকে ব্যাখ্যা করল যে এই হোটেল এত ক্লোজ যে এটাকে একটা এপার্টমেন্টে রূপান্তরিত করা সম্ভব। সেই দিনগুলোতে রুমের চারপাশে হাতুড়ির শব্দ শোনা যেত।
তারা কি তাদের নিবন্ধন ফর্ম করেছিল, এবং সেখানে তাদের পেশা কি লিখেছিল? ভ্যান বেভার উত্তর দিয়েছিল তার কাগজে সে লিখেছিল যে সে একজন ফেরিওয়ালা, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল সে ইয়ার্কি মারছে। জ্যাকলিনের অসহায়তা ছিল তার পেশাহীনতা নিয়ে। একই দাবি আমিও করতে পারি, সেই সময় আমি বইগুলি বহন করে একজন সেকেন্ডহ্যান্ড বিক্রেতা থেকে অপর জনের কাছে দৌড়ে বেড়াচ্ছিলাম।
এটা ছিল শীতের সময়। জাহাজঘাট এবং ফুটপাতের তুষার গলে যাচ্ছিল, শীতের কালো এবং ধূসরতা আমার স্মৃতিতে আসছিল। এবং জ্যাকলিন সবসময় সে সময়ের জন্য খুব হালকা তার চামড়ার তৈরী জ্যাকেট পরে বেরিয়ে যেত।


এটা ছিল কদর্য শীতগুলোর মধ্যে একটি। জ্যাকলিন এবং আমি ভ্যান বেভারের সাথে সিন নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম পোন্ট-মারি মেট্রো স্টপে, সম্ভবত ট্রেনটি গার সেন্ট-লায থেকে ছেড়ে আসত। সে আমাদেরকে বলত তার দিয়েপ ক্যাসিনোতে যাওয়া উচিত, এবং তার কিছু টাকা উপার্জন করা প্রয়োজন। সে তার সেই ওভারকোট নিয়ে মেট্রোর প্রবেশদ্বার দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত এবং জ্যাকলিন আর আমি সেই মুহূর্তগুলো একত্রে কাটাতাম।
আমি তাকে সব সময় ভ্যান বেভারের সাথে দেখতাম এবং তার সাথে সত্যিকারের আলাপচারিতার কোনরূপ সময় পাচ্ছিলাম না। উপরন্তু সে মাঝে মাঝে কোন কিছু না বলেই চলে যেত। অথবা সে অতিসংক্ষিপ্তভাবে ভ্যান বেভারকে বলত তার জন্য কিছু সিগারেট নিয়ে আসতে, যেন সে সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এবং আমার কাছ থেকেও। কিন্তু অল্প অল্প করে আমি তার নীরবতা এবং তীক্ষèতার স্বরূপ বুঝে উঠতে পারছিলাম।
ঐ দিন যখন ভ্যান বেভার মেট্রোতে নেমে গেল, আমরা পার হয়ে বাম পাশের দিকে যাওয়ার পরিবর্তে জাহাজ ঘাটের দিকের হোটেল দে-ভিয়ে তে হেঁটে গেলাম । সে ছিল শান্ত। আমি আশা করছিলাম যে কোন মুহূর্তে সে আমাকে বিদায় বলে দেবে। কিন্তু না, সে আমার পাশে হাঁটা অব্যাহত রাখলো।
জাহাজঘাট এবং সীন নদীর ওপর দিয়ে কুয়াশা ভাসছিলো। জ্যাকলিনের এই পাতলা চামড়ার জ্যাকেট জমে যাবার উপক্রম হওয়ার কথা। আমরা হাঁটছিলাম দে-লা-আরর্কেভিয়ে দিয়ে, শহরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত, এবং সে কাশতে শুরু করল নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে। শেষ পর্যন্ত শ্বাস নিতে সমর্থ হলো। আমি তাকে উষ্ণ কিছু পান করার জন্য বললাম। সে ক্যাফে রু দান্তেতে প্রবেশ করল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম।


[জর্ডান স্টাম্প-এর ইংরেজী অনুবাদ থেকে প্যাত্রিক মোদিয়ানোর ‘আঁধার-ছায়ার বাইরে’ (‘আউট অব দ্য ডার্ক’-- ইংরেজি সংস্করণের প্রকাশকাল: ১৯৯৮) উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায়ের বাংলা অনুবাদ বাংলামাটিতে পোস্ট করা হলো।

এই ম্যাগাজিনের কোনো লেখা কোনো অনলাইন বা প্রিন্ট পত্রিকায় প্রকাশ করতে হলে অবশ্যই সম্পাদকের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন হবে [email protected]]