‘ভাষা মতিন’ এ নামেই সকলে চেনে আবদুল মতিনকে। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৮ সালে আন্দোলনের সূচনা হয় সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের পূর্ববাংলাতে। আর সে আন্দোলন সিরাজগঞ্জের ‘ছাত্র মতিন’কে সারা পূর্ববাংলার মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলে ‘ভাষা মতিন’ নামে। সেই থেকে ভাষা মতিন নামের সমার্থক হয়ে ওঠে আমাদের দেশ-কাল-সমাজ-রাজনীতির উত্থানকাল, জাগরণকাল। ৮৮ বছর বয়সে গত ৭ অক্টোবর তার দৃশ্যত মৃত্যু ঘটেছে; দু চোখের কর্নিয়া দিয়ে নতুন করে এ পৃথিবীকে দেখতে শুরু করেছেন ইকবাল কবীর ও রেশমা নাসরিন। সারা জীবন ভাষা মতিন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন, মৃতদের জগতে যেতে যেতেও তিনি তার সে সংগ্রামকে অব্যাহত রেখেছেন কর্নিয়া দিয়ে, মরণোত্তর দেহদান করে।
জন্মভূমি সিরাজগঞ্জের প্রবীণ মানুষদের অনেকে এখনো আবদুল মতিনকে ডাকেন ছাত্র মতিন নামে তার ওই নাম সাক্ষ্য দেয় আমাদের সমাজ ইতিহাসের একটি বিশেষ কালপর্বের। তখনো মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হয়নি পূর্ববাংলাতে। তখনো পূর্ববাংলার সমাজ কৃষিসমাজ। কৃষক সন্তানদের কেউ কেউ শিক্ষিত হচ্ছেন, চাকরি নিচ্ছেন এবং কেবল জমাট বাঁধতে শুরু করেছে শুরু করেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিমানস। কৃষকদের ছাত্র ও চাকরিজীবী সন্তানদের তখন হাতে গোনা যেতÑনদীভাঙনের শিকার সিরাজগঞ্জ-পাবনার মানুষরা আবদুল মতিনকে অন্যান্য আবদুল মতিন থেকে আলাদা করেছিলেন ‘ছাত্র মতিন’ নামে। মা আমেনা খাতুন আর বাবা আবদুল জলিল অবশ্য তাকে ছোটবেলায় ডাকতেন গেদু নামে। তিনি ছিলেন তাদের স্বপ্নময়তার প্রথম ফসল। ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর তার জন্ম হয় চৌহালীর ধুবালিয়াতে। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর পর ১৯৩০ সালে এই মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারটি তাদের বসতভিটা, চাষের জমি হারিয়ে ফেলে নদীভাঙনে। তখন আবদুল জলিল কাজের খোঁজে চলে যান দূরের দার্জিলিংয়ে। কাজ নেন জালাপাহাড়ের ক্যান্টনমেন্টে সুপারভাইস স্টাফের। পরের বছর ১৯৩২ সালে বাংলা মাধ্যমের স্কুল মহারাণী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হন আবদুল মতিন। আর ১৯৩৩ সালে মাত্র আট বছর বয়সেই হন মাতৃহারা। চতুর্থ শ্রেণি পর্বের পড়াশোনা শেষ করার পর ১৯৩৬ সালে তিনি দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশোনা করেন। এনট্রান্স পাস করেন ১৯৪৩ সালে। তারপর রাজশাহীতে এসে ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি মহাবিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৪৫ সালে এইচএসসি পাস করার পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকে ব্রিটিশ আর্মির কমিশন র্যাঙ্কে ভর্তি পরীক্ষা দেন ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়ে। কমিশন পেতে তার কোনো সমস্যা হয়নি, কেননা তিনি ছিলেন একহারা দীর্ঘদেহী, তার আত্মবিশ্বাস আর সাহস ছিল এক নজরেই চোখে পড়ার মতো। তবে কমিশন পেয়ে কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে যেতে না যেতেই শেষ হয়ে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। ফলে যুদ্ধে তার আর যেতে হয় না, প্রশিক্ষণ সার্টিফিকেট নিয়ে তিনি ফিরে আসেন পূর্ববাংলাতে। ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর অব আর্টস-এ। তখন তিনি থাকতেন ফজলুল হক হলে। ১৯৪৭ সালে এখান থেকেই গ্র্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করেন তিনি, তারপর মাস্টার্স করার লক্ষ্যে ভর্তি হন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে।
আবদুল মতিনের এই সাধারণ জীবন বৃত্তান্তকে অসাধারণ করে তুলেছে তার রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা ও প্রতিবাদী সত্তা। রাজনৈতিক কারণে তার পড়াশোনা অসমাপ্ত থেকেই যায়। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় তিনি যুক্ত হন জনগণকে সংগঠিত করে তোলার কার্যক্রমে, প্রকাশ পায় তার সাংগঠনিক দক্ষতা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একজন তরুণের কাছে আদর্শ হিসেবে যা ছিল অনুুকরণীয়, সেই সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাকেও উদ্বুদ্ধ করে। তিনি যুক্ত হন রাজনৈতিক কার্যক্রমে, কৃষক-শ্রমিকের মুক্তির কার্যক্রমে। ১৯৪৮ সালে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদÑযার সদস্য ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলন আপাত স্থবিরতায় নিমজ্জিত হলে ১৯৫০ সালে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদÑযার আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কারাগারেই ছিলেন ১০ বছরের মতো। ১৯৫২ সালে কারাগারে যাওয়ার পর তিনি সেখানে মার্কসবাদে দীক্ষিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সংস্পর্শে আসেন, উদ্বুদ্ধ হন সাম্যবাদী আদর্শে। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি যুক্ত হন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালে। কৃষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা থাকলেও কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব নেন। এক বছর সে দায়িত্ব পালন করার পর কৃষক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালের নভেম্বরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীসভ্য এবং ১৯৫৪ সালের মার্চে পার্টির সদস্য হন। এ বছর পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হিসেবেও নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৬৬ সালে উত্তীর্ণ হন সংগঠক পর্যায়ে। ১৯৬৩ সালে ঢাকার রায়পুরায় অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সম্মেলন। এ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক নিযুক্ত হন যথাক্রমে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হাতেম আলী খান এবং আবদুল মতিন। তিন বছরের মাথায় ১৯৬৬ সালে সংগঠনটির পরবর্তী সম্মেলন হয় সিলেটের কুলাউড়াতে। এ সম্মেলনে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন যথাক্রমে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবদুল হক এবং আবদুল মতিন।
এর মধ্যে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলন মস্কো ও পিকিং ধারায় বিভক্ত হওয়ার সুবাদে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতেও ভাঙন আসে। মণি সিংহ ও খোকা রায়ের নেতৃত্বে মস্কোপন্থী ধারা এবং সুখেন দস্তিদার, আবদুল হক ও মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে পিকিংপন্থী ধারা তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে। আবদুল মতিন যুক্ত হন পিকিংপন্থী ধারার রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)-এর সঙ্গে। ১৯৬৮ সালে এ দলটিতে আবার ভাঙন ধরে। আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমেদ, দেবেন শিকদার ও আবুল বাশাররা ওই বছরের অক্টোবরে গঠন করেন নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৬৯ সালে এ দলের সাধারণ সম্পাদক দেবেন শিকদার গ্রেফতার হওয়ার পর সে দায়িত্ব পান আবদুল মতিন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে এ দলের সংগঠকরা সারা দেশে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৬৯ সালের ৫ অক্টোবর পাবনার শাহপুরে অনুষ্ঠিত হয় লাল টুপি সম্মেলন। এতে সমবেত হয় বিভিন্ন এলাকার লক্ষাধিক কৃষক ও দিনমজুর। আবদুল মতিনের সাংগঠনিক দক্ষতা এ সম্মেলন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত আবদুল মতিন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় চারু মজুমদারের রাজনৈতিক পন্থা নিয়ে দলটিতে বিতর্ক দেখা দেয়। পাবনার শাহপুরে পার্টি প্লেনামে একাত্তরের ১৬ জুলাইয়ে চারু মজুমদারের রাজনৈতিক পদ্ধতি অনুমোদন পেলে আবদুল মতিন ভিন্নমত পোষণ করে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এ সময় দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন আমজাদ হোসেন। অন্যদিকে আবদুল মতিন ও আলাউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের ৪ জুন আত্রাইয়ের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত ঘটনায় গুলিতে আহত হয়ে গ্রেফতার হন আবদুল মতিন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন তিনি। মুক্তি পাওয়ার পর আবারো তিনি যুক্ত হন দলের সাংগঠনিক তৎপরতায়। ১৯৭৮ সালে এ সাংগঠনিক তৎপরতার ফসল হিসেবে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) ও বাংলাদেশের মার্কসবাদী লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করে নতুন সংগঠন কমিউনিস্ট লীগ (এম-এল)। এভাবে দশকের পর দশক ধরে পিকিংপন্থাতেই পাকিস্তানিরা হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে নিহত হন তার আরেক ভাই সিরাজগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল গফফার ঘটু।
১৯৭২ সালে কারাবন্দি হওয়ার পর ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন ভাষা মতিন। মুক্তি পাওয়ার পর জিয়াউর রহমান তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক ২০০০-এর সঙ্গে মাহবুব রেজার গৃহীত এক সাক্ষাৎকারে ভাষা মতিন বলেন, ‘অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার সঙ্গে গেলাম দেখা করতে। অফিস ঘরে তার সামনে বসে আছি। একপাশে টিভি চলছিল। জিয়াউর রহমান খুব চালাক ছিলেন, যাকে বলে চিকন বুদ্ধির মানুষ। কথা বলছিলেন নিচু স্বরে। ব্যস্ত মানুষ। সবকিছুতে তার অর্ডার দেয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করলাম। আর্মির মানুষ তো! টেলিফোনে আরেকজনের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। আমি তার সামনে। হঠাৎ তিনি করলেন কী, আমাকে ইশারায় টেলিভিশনের সাউন্ড কমানোর ইঙ্গিত করলেন। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল মুহূর্তে। আমার বাসায় তখন পর্যন্ত টেলিভিশন তো দূরের কথা, সামান্য দুই ব্যান্ডের রেডিও নেই। সঙ্গত কারণে থাকার কথাও নয়। আমি মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রেখে জিয়াউর রহমানকে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি জানি না কীভাবে টেলিভিশনের সাউন্ড কমাতে হয়। কারণ আমার ঘরে টেলিভিশন নেই এবং যন্ত্রপাতির সঙ্গে আমি পরিচিত নই।
‘জিয়াউর রহমান ঠা-া প্রকৃতির মানুষ বিধায় তিনি তার সম্ভাব্য অনুগতদের এভাবে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা নিতেন। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি শিকার ধরতেন। যারা তার কথামতো চলতেন তাদের তিনি দলে নিতেন। আমি তার সে রকম মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম এবং তৃপ্ত বোধ করেছিলাম। উনি আর কথা না বাড়িয়ে চেয়ার থেকে উঠে এসে সাউন্ড কমিয়েছিলেন। অবশ্য সে সময় জিয়াউর রহমান বাম-ডানদের নিয়ে সার্কাস খেলেছিলেন।’
আবদুল মতিনের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও পথ নিয়ে অনেকের দ্বিমত রয়েছে, কিন্তু বাংলার মানুষ ও বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তিনি আজীবন যে আপষহীন ছিলেন, তা লেখাই বাহুল্য। দাফন চাননি তিনি, মরণোত্তর দেহদান করেছেন। জীবনের বিভিন্ন পর্বে বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন তিনি। যার মধ্যে আত্মজীবনীমূলক বই ‘জীবন পথের বাঁকে বাঁকে’ ‘ভাষা আন্দোলন কি এবং তাতে কি ছিল’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার বাংলাবাজার চাঁদগাজী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ইকবাল কবীর এবং ঢাকার ধামরাই উপজেলার শিয়ালপুর গ্রামের রেশমা নাসরিনের চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তার দুটি কর্নিয়া। যে স্বপ্ন ছিল ভাষা মতিনের চোখে, সে স্বপ্ন এখনো জেগে আছে, আগামীতেও জেগে থাকবে এ দেশের মানুষের চোখে।
(সাপ্তাহিক ২০০০-এর সৌজন্যে)